• মা তৈরীর ইস্কুল


    2    528

    July 11, 2017

     

    আজ মায়ের জন্মদিন। মনে পড়ে ছোটবেলায় মায়ের জন্মদিনে আমার কাকা-পিসিরা মা-কে ফুল উপহার দিতেন। সেজকাকা আর ন’কাকা, যাঁরা কিনা মায়ের দেওরের থেকেও বন্ধু বেশী, মা-কে লাল গোলাপ উপহার দিতেন। সেই গোলাপ মায়ের ড্রেসিং টেবিলের কোণে রূপোলি ফুলদানিতে সাজানো থাকত। মা রোজ ফুলদানির জল পাল্টাতেন। বাবা মা-কে কিছু উপহার দিলেও সেটা চলতো গোপনে। আমি একবার আলমারি গোছাতে গিয়ে মায়ের জন্মদিনে বাবার হাতে লেখা একটা কার্ড খুঁজে পেয়েছিলাম। সে কার্ডে রবি ঠাকুরের কবিতা ছিল, “জন্মদিন আসে বারে বারে/মনে করাবারে/এ জীবন নিত্যই নূতন/প্রতি পাতে আলোকিত/পুলকিত/দিনের মতন”।

    সত্তরের দশকে আমাদের সেই উত্তর কলকাতার বাংলা মিডিয়াম কালচারে মা-কে হ্যাপি বার্থডে বলার চল ছিল না। ফলে ছোটবেলায় আ্মরা কখনো মা-কে হ্যাপি বার্থডে বলিনি। মা-র জন্মদিনে কোন পার্টিও হত না। দিদিমা মা-কে রোজই একবার ফোন করতেন, জন্মদিনের দিন সেই দৈনন্দিন ফোনে কোনও ‘উইশ’ করতেন কিনা জানি না। অন্তরে চরম শৌখিন আমার মা জন্মদিনের দিনও ভোর পাঁচটায় উঠে উনুনে আঁচ দিতেন। বৈশাখের তপ্ত বেলায় গলদঘর্ম হ’য়ে রান্নাঘরের ছাতে ব’সে তিরিশ জনের জন্য আঁশবটি নিয়ে কুচো মাছ কাটতেন। তড়িঘড়ি হাতে আমাদের স্কুলের টিফিন বানাতেন। কেউ মা-কে বলতো না, আজ তোমার জন্মদিন, আজ তোমার ছুটি। মায়ের আদরের দেওররা, যারা কিনা মা-কে লাল গোলাপ দিতেন, কিম্বা মায়ের সদাশিব স্বামী, কেউই বলতেন না, আজ তুমি আরাম করো, আজ আমরা মাছ কাটছি, আমরা বাচ্চাদের টিফিন তৈরী করছি।

    আসলে মায়েদের কোন ছুটি হয় না। কোনকালেই কোন দেশেই মায়েদের বিশ্রাম নেই। মায়েরা সেই রানারের মতো সংসারের জন্য, সন্তানের জন্য সারাক্ষণ ছুটে চলেন। আর মায়েদের এই দৌড় প্র্যাক্টিস শুরু হয় ছোটবেলা থেকে, তাদের কন্যাকাল থেকে। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের মা হিসেবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চালু হয়। লেখাপড়ার ইস্কুলে ভর্তি করার আগেই মেয়েদের মা বনার ইস্কুলে ভর্তি ক’রে দেওয়া হয়। জন্মলগ্ন থেকেই আদর ক’রে তাদের ডাকা হয় ‘মা’। কিছুকাল আগেও মেয়েদের জন্য চালু আশীর্বাণী ছিল, “শত পুত্রের জননী হও, মা”।

    শুধু ডাকাডাকিতেই ব্যাপারটা সীমিত থাকলেও না হয় চলতো। কিন্তু তুমি মেয়ে হ’য়ে জন্মালে ‘মা’ হ’য়ে ওঠার ইস্কুলে তোমাকে ভর্তি হতেই হবে। আর সেখানকার সিলেবাসও বেশ ভারী। সে ইস্কুলে প্রথম পাঠ দেওয়া হয় আত্মত্যাগের। আজ তুমি কচি মেয়ে, ঠিক আছে, কিন্তু কাল তো তুমি মা হবেই।(উহ্য কথাটি হল, তুমি চাও বা না চাও, মা তোমাকে হতেই হবে। নইলে গদি ছাড়তে হবে।) আর মা হওয়া মানে শুধু বাচ্চার জন্ম দিয়েই তুমি খালাস পাচ্ছো না মা-জননী, তারপর থেকে তোমার আসল পরীক্ষা শুরু। এই পরীক্ষার মক টেস্ট অবশ্য শুরু হয়ে যায় মা বনার ইস্কুলে, তুমি সত্যিকারের মা হওয়ার অনেক আগে। সে মক পরীক্ষায় তোমার বাচ্চার জায়গায় আসীন থাকে ছোট ভাই কিম্বা দাদা, কখনো কখনো তোমার বাবা, মামা, কাকাও। অর্থাৎ পরিবারের মধ্যে যেকোন বয়সের যেকোন সম্পর্কের পুরুষ তোমার প্রশ্নপত্র হতে পারেন। এদের প্রয়োজন এবং ইচ্ছানুসারে তোমাকে খাবারদাবার, লেখাপড়া, চাকরিবাকরি, পয়সাকড়ি, আনন্দ-ফূর্তি সব কাস্টোমাইস করতে হবে। এই মক পরীক্ষায় যদি তুমি ঠিকঠাক পাস কর, তাহলেই তুমি বাচ্চার মা হ’লে বাচ্চা না খাওয়া অবধি পেটে কিল মেরে ব’সে থাকতে পারবে আর ক্ষিদেতে পেট চুইচুই করলেও বলতে পারবে, সন্তান ইস্কুল কিম্বা কলেজ থেকে ফিরে না খাওয়া পর্যন্ত তোমার নাকি গলা দিয়ে ভাত নামবে না। বাচ্চা ছোট হওয়া সত্ত্বেও বাচ্চার বাবা যখন হিল্লি-দিল্লী ঘুরে নিজের পেশার উচ্চশিখরে পৌঁছুবেন, তখন তুমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে হাসিহাসি মুখ ক’রে বলতে পারবে, “ফুলটাইম মাদারিং-টা আমার চয়েস”।

     

    মা তৈরীর ইস্কুলের দ্বিতীয় পাঠ হল, তোমার নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে কিভাবে বলিদান করতে হয়। ধরা যাক, তুমি একটি ছোট্ট মেয়ে। তোমার ঐ রেলগাড়িটা নিয়ে খেলতে সাধ, কিন্তু ভাই যদি চায় তাহলে তোমাকে নিজের সাধ জলাঞ্জলি দিয়ে ওই রেলগাড়ি ভাইকে দিয়ে দিতে হবে। আবার তোমার বিরাট কোহলি    দেখার মুড এখন, কিন্তু দাদা চাইছে ব’লে তোমাকে হাসিমুখে চ্যানেল ঘুরিয়ে কার্টুন দেখতে হবে। এসব শিক্ষার ফলে তুমি পরে মা হ’য়ে অকাতরে নিজের ইচ্ছেকে টুঁটি টিপে মারতে পারবে।তোমার যখন বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে আর পপকর্ন খেতে মন চাইবে, তখন মাতৃত্বের দোহাই দিয়ে তুমি নিজেকে ঘরবন্দী করবে, ছেলেমেয়েকে হোমওয়ার্ক করাবে আর বস্তাপচা বাংলা সিরিয়াল গিলবে। কেউ তোমাকে বলবে না যে, “যাও, আজ তুমি ফূর্তি করো, বাচ্চাদের লেখাপড়া আমি দেখিয়ে দিচ্ছি”।

    মা তৈরীর ইস্কুলের তৃতীয় পাঠ হল, অষ্টপ্রহর সংসারের জোয়াল টানো। টোয়েন্টি ফোর হাওয়ার্স এ্যাট ইয়োর্স সারভিস। সন্তান এবং গুষ্টির সক্কলের সুখ সুবিধার দায়িত্ব মায়ের। পরীক্ষার আগে মাঝরাতে কফি কে করে দেবে? মা। রাতে পড়তে পড়তে যাতে ঘুমিয়ে না পড়ি, সেজন্য সারারাত জেগে ব’সে থাকবে কে? মা। ভরদুপুরে বলা নেই, কওয়া নেই, একদল বন্ধু নিয়ে বাড়ি এসে ভাত খেতে চাই। কে ঐ অসময়ে ম্যাজিক ক’রে মাছের ঝোল ভাতের যোগান দেবে? মা। মেয়েদের এইসব ম্যাজিক শিক্ষাও শুরু হয় ঐ মা তৈরীর ইস্কুলে। কোন ছোটবেলা থেকে মেয়েরা কচি হাতে বাসন মাজে, সবজি কাটে, কাপড় কাচে, বিছানা ঝাড়ে, ঘর পরিস্কার করে। মায়ের হাতে হাতে কাজ মেয়েদের সেই টেপজামা পরা কাল থেকেই করতে হয়। মা তৈরীর ইস্কুলে মায়ের হাতে হাতে কাজ করতে করতে মেয়েরা নিজের অজান্তেই কখন যেন মা হয়ে ওঠে।

    মা ইস্কুলের আরেকটি শিক্ষা হল, সারাক্ষণ নিজেকে অপরাধী ভাবো আর সেজন্য সংসারে ঘুষ দিয়ে যাও। তুমি যদি আমার মতো ‘টরেটক্কা’ মা হও, অর্থাৎ কিনা সারাক্ষণ বারমুখো, তবে কিন্তু তোমার হেব্বি অপরাধবোধ হওয়া উচিত। তুমি যদি চাকরি ক’রে টাকা কামাও, তাহলে সেই টাকার সিংহভাগ তোমাকে সন্তানের পেছনে খরচ করতে হবে। রোজ অফিসফেরত বাচ্চার জন্য খেলনা, খাবারদাবার নিয়ে ফিরতে হবে। নাহলেই ছেলেপুলের যত না মুখ ভার, তার চারপাশের লোকের তার থেকে বেশী মুখ ভার। আর আপিসের পর যদি তুমি বন্ধুদের সঙ্গে এক পাত্তর কফি খেয়ে বাড়ি ঢুকবে ভাবো, তাহলে তো তোমার মরমে ম’রে যাওয়ার কথা। আর এই অপরাধে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার পাঠও মা তৈরীর ইস্কুলে ছোটবেলা থেকেই দেওয়া হয়। ভাইয়ের জন্য যে মাছের মাথাটা রাখা আছে সে মাথা যদি লোভে প’ড়ে একদিন গলাধঃকরণ করেছো তো তুমি মেছো শাঁকচুন্নি। ভাইকে তুমি মোটে ভালবাসো না।

    মা ইস্কুলের ফাইনাল পরীক্ষাটি হল, তোমাকে নিজেকে ভুলে যেতে হবে। এমনভাবে নিজেকে ভুলতে হবে যে, তুমি নিজের নাম পরিচয় সব গঙ্গায় ভাসিয়ে অমুকের মা হ’য়ে উঠবে। পাড়ায় ডাকপিওন পর্যন্ত চিঠি বিলি করতে এসে অমুকের মা-কে খুঁজবে। তবেই না তুমি রত্নগর্ভা! আর বড় বয়সে হঠাৎ নাম পরিচয় জলাঞ্জলি দিতে যদি তোমার আত্মসম্মানে লাগে,তাই ছোট বয়স থেকেই তুমি কেয়ার অফ বাবা, দাদা, মামা ইত্যাদি। অর্থাৎ কখনোই তোমার নিজের পরিচয় যেন গড়ে না ওঠে, সে বিষয়ে এই ইস্কুলে কড়া নজরদারী।

    একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, মা তৈরীর ইস্কুল কতৃর্পক্ষ কিন্তু নিজেদের কাজে ভারী নিষ্ঠাবান। নিয়মিত তারা সিলেবাস আপডেট করেন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা পাঠক্রম বদলান। যেমন ধরা যাক আজকের মা আমার সে আমলের মায়ের মত আঁশবটি নিয়ে তিরিশ জনের মাছ কাটেন না, তিনি ছিমছাম ফ্ল্যাটে স্বামী সন্তান নিয়ে বিজ্ঞাপণী ঢঙে সংসার করেন। তিনি হয়তো দশটা-পাঁচটার বাঁধা সময়ের চাকরি করেন না, রাতবিরেতে কাজ থেকে ফেরেন, এই মায়ের জন্য কিন্তু ভিন্ন পাঠ। Y প্রজন্মের মায়েদের পড়ানো হয়, অফিসের তুমুল কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিভাবে তারা গুগল ঘেঁটে চটজলদি বাচ্চার স্কুলের প্রোজেক্ট বানাবেন, কি কি হেলথ ড্রিঙ্ক খাইয়ে বাচ্চাকে সবার সেরা ক’রে তুলবেন, কোন ক্রিকেট কোচিং-এ পাঠালে তার ছেলে সচিন কিম্বা সৌরভ হবে, কোন আবাকাসে পাঠালে মেয়ে লীলাবতী হবে, আকাশ বাতাস কোন টিউশনে দিলে সন্তান আই.আই.টি. অথবা বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিশ্চিত ঘাঁটি গাড়তে পারবে।

    আরও আছে। মাঝরাতে হাক্লান্ত অফিস থেকে ফিরেও ভোরে উঠে মধ্য-তিরিশের মা কীভাবে বাচ্চাকে ইস্কুলের জন্য তৈরী করবেন, ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে টিফিন বক্সে পাস্তা ভরবে্ন, অফিসের কম্পুটারে চোখ রেখে রেখে যখন তার চোখ টনটন করছে ব’লে তিনি একটূক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করবেন তখনই তার বাচ্চার আয়ার ফোন আসবে, “ বৌদি, তিতলি (কিম্বা টংলু) কিছুতেই ভাত খাচ্ছে না, ভীষণ দুষ্টুমি করছে”। তখন তিনি ফোন নিয়ে বাচ্চাকে ভোলাবেন, আয়া মাসীকে ঠান্ডা করবেন, তারপর আবার মেশিনে মনোনিবেশ।তাকে শেখানো হয়, ক্লায়েন্ট-এর সঙ্গে একটা হাই-প্রোফাইল মিটিং সেরে বাড়ি ফিরে জামাকাপড় না পাল্টেই তিনি কিভাবে ক্লাস ফোর-এর ইতিহাসের অলিতে গলিতে প্রবেশ করবেন।সারাদিনের শ্রান্তি যখন তাকে পেড়ে ফেলছে তখন হয়তো তার সন্তান পড়তে ব’সে আনমনা, টেবিলের তলায় হাত ঘুরিয়ে সে কাল্পনিক ক্রিকেট বল করছে, তবুও তিনি হাসিমুখে মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ বর্ণনা করবেন।হ্যাঁ, মা ইস্কুলে ধৈর্যের পরীক্ষাও দিতে হয় বৈকি। 

    আপডেটেড সিলেবাসে মায়েদের অপরাধবোধের শিক্ষায়ও কোন গাফিলতি নেই।একালের মায়েদেরও ঘুষ দিতে হয়। এদের ঘুষও যুগপোযোগী। অন লাইন অর্ডার দাও, মা বাড়ি পৌঁছানোর আগেই লেগো পৌঁছে যাবে বাড়িতে। আর মা যদি ট্যূ্রে থাকেন তাহলে মা কতদিনের ট্যূরে গেছেন তার ওপর নির্ধারিত হয় ঘুষের কলেবর। এতেই শেষ নয়। এর পর সপ্তাহান্তে বাচ্চার ইস্কুলের বন্ধুদের তাদের বাবা-মাসহ থিম পার্টিতে ডাকতে হবে, তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হৈহূল্লোড়ে মাততে হবে এবং সবার আগে সেইসব হূল্লোড়ের ক্যান্ডিড ছবি ফেসবুকে আপলোড করতে হবে।এসব যদি তুমি সুচারুভাবে করতে পারো তাহলে মা তৈরীর ইস্কুলে তোমার গোল্ড মেডেল পাক্কা।

    এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না।একেলে কিছু বাবা কিন্তু আমার বাবা কাকাদের থেকে বিস্তর বদলেছেন।বাবা তৈরীর ইস্কুলে যেহেতু আমি যাইনি, তাই সে ইস্কুলের কথা আমি বিশদে জানি না। কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে, সে ইস্কুলও পরিবর্তনের চেষ্টায় কিছু কম যায় না।বেশ কিছু বাবা দেখি আজকাল ঘরের কাজে মন দিয়েছেন। সাধু সাধু।কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল, একই কাজের জন্য বাবাদের কপালে যখন A+ জোটে তখন মায়েদের ক্ষেত্রে সেকাজ মায়ের কর্তব্য মাত্র।আরও একটা অবাক-করা ব্যাপার হল, একালে কিছু কিছু বাবা যেমন ঘরের কাজে মন দিয়েছেন, তেমনই অনেক মা-ই সংসারের ই.এম.আই.-এর বোঝা বহন করেন। কই সেই মায়েদের জন্য তো কোনো আলাদা ক’রে হাততালির চল দেখি না!

    যাক গে যাক, চিচিং ফাঁক!অত সাতপাঁচ কথায় আমাদের কাজ কি। আমরা বরং মা তৈরীর ইস্কুলের গপ্পে ফিরি। আমাদের এই মা তৈরীর ইস্কুলে কিন্তু বেশ কয়েকটা ভুতুড়ে ব্যাপার আছে। এই ইস্কুলের কোন বিল্ডিং তুমি দেখতে পাবে না, সীমানা অদৃশ্য। কিন্তু গোটা পৃথিবীই এই ইস্কুলের চত্ত্বর।এই ইস্কুলের দুনিয়া জোড়া বিস্তার। এ ইস্কুলের এতই প্রতাপ যে, কোনও মেয়েকে জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করা হয় না, তুমি এ ইস্কুলে ভর্তি হ’তে চাও কিনা।প্রাকৃ্তিকভাবে তুমি মেয়ে জন্ম নিয়েছ, অর্থাৎ তোমার একখানি যোনি আছে মানেই তুমি এ দুনিয়ায় মা হ’তেই জন্মেছ।তোমার কোন চয়েস নেই।মা হ’তে যদি তোমার বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকে, অথবা তুমি যদি আর পাঁচজনের কথা না শুনে তোমার সুবিধামতো সময়ে মা হ’তে চাও, তাহলে তুমি রমণীকুলের কলঙ্ক। মা ইস্কুলের ফেলু ছাত্রী।

    মা তৈরীর স্কুলের পঠনপাঠন নিয়ে দুকথা ব’লে আজকের মতো নটেগাছ মুড়োই। এই ইস্কুলে লেখাপড়া শেখানোর রকমসকম কিন্তু ভারী আজব।তোমাকে আলাদা ক’রে রোজ সন্ধ্যেবেলা বইপত্তর নিয়ে ক্লাসের পড়া করতে হবে না। কিন্তু কোথা দিয়ে যেন সেই ভুতুড়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা তোমাকে পাঠ মুখস্ত করাবেন।এমনভাবে তোমাকে পাঠ্যবিষয় গেলানো হবে যে তুমি সারাজীবন তোতাপাখির মত মাতৃত্বের জয়গান গাইবে।তুমি বিশ্বাস করতে শিখবে, এত যে সিলেবাসের চাপ তুমি সারাজীবন ব’য়ে বেড়াচ্ছো, তা শুধুমাত্র ভালবাসার তাগিদে।মা হওয়ার যে হাড়ভাঙা খাটুনি সে তুমি সম্পূর্ণ অস্বীকার করবে। কারণ এই ইস্কুলে সারাক্ষণ মাতৃ্ত্বকে মহিমান্বিত করতে শেখানো হয়, পুজো করতে শেখানো হয়।স্ত্রীলিঙ্গ-যুক্ত দেবতাকে মা ডাকা হয়, যে চারপেয়েকে হিন্দুর দেবী মানা হয় তাকে মাতা ডাকা হয়, মা-এর আত্মত্যাগকে মাথায় তুলে গান সাহিত্য রচনা হয়, এমনকি ফ্লাইওভারকেও মহান প্রমাণের জন্য মা নামকরণ করা হয়।আর এই মাহাত্ম্যগানে তুমি-আমি ফেঁসে যাই। আমার মায়ের মত, পিতামহীর মত, ছেলেপুলের জন্য, সংসারের জন্য, জান লড়িয়ে দিই।ভুলেই যাই, বহুযুগের ওপারে কোনোদিন আমার কন্যাকাল ছিল, কোনোকালে আমিও একটি মেয়ে ছিলাম। মা নয়, সংসারে চোখ বাঁধা বলদ নয়, শুধুই এক মেয়ে ছিলাম।

    বিষাদের কথা, সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে।

     
     



    Tags
     



    Comments (2)
    • না রে বিদিশা, মোটেই অমূলক নয়।রাষ্ট্র চিরকাল মেয়েদের কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে খালাস!

    • দুরন্ত চুমকিদি! এই লেখাটার খুব দরকার ছিল।সময় বদলেছে কিন্তু মা-পনা নিয়ে একটা বিকারগ্রস্ত আদিখ্যেতা এখনও সমাজ বাংলা সিরিয়ালের মতো জিইয়ে রাখায় সচেষ্ট।মোক্ষম জায়গায় খোঁচা মেরেছ।ফলে অনেক কথা উঠবে।উঠুক।
      আর একটা বিষয়ে একটু বলি? এই যে রাষ্ট্র খুব মানব-মুখি একটা আইন আনলো-সি.সি.এল,তাতে করে আদতে আবার ঘুরে পুরো দায় এবং দায়িত্বটা মা এর কোর্টে এসে গেল না? যে এবার রাষ্ট্র তোমায় তোমার এই মাধ্যমিকটার(ছেলে মেয়েকে বড় করতে জান লড়িয়ে দেওয়া) জন্য 730 দিন বেতন সহ ছুটি দিল-এরপরও যদি সন্তান ‘মানুষ’ না হয়,তাহলে তুমিই তোমার শাস্তি ঠিক কোরো।আমার এই ভাবনা কি খুব অমুলক?

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics