• পনেরোজন মেয়ের জীবনে 'স্বাধীনতা-র অর্থ


    2    443

    August 15, 2017

     

    বর্তমানে যে দেশটাতে বাস করছি সেখানে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটা কবে যে Illusion/মায়া/বিভ্রমে পরিণত হয়েছে সে খবর রাখা হয়নি। কেনই বা রাখব, আমাদের ব্যস্ত জীবন, নির্ঝঞ্ঝাট যাপনকে উপভোগ করে মরে যাওয়া উচিত, যে রাস্তা বাজার দেখিয়েছে সেই মোতাবেক। বাজারের লোভনীয় ‘মায়ার’ সাথে পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের তৈরি ‘বিভ্রমে’ আমরা বুঁদ হয়ে আছি। অযথা মন মাথাকে নানা খবরে বিভ্রান্ত করার প্রয়োজন আছে কি? এই স্বাধীন নির্মিত ভারতমাতার বুকে প্রতি বছরে অসংখ্য কৃষকসন্তানের মৃত্যু আমাদের কেন ভাবাবে? আচ্ছা ভারতমায়ের এই মাটিতে দলিত বা মুসলমান সন্তানের স্বীকৃতি আছে কি? এই সময়ে ভারতমায়ের আকার আমাদের কাছে শুধুই ভৌগোলিক, যার চারপাশের সীমান্ত রক্ষার্থে তার পুরুষ সন্তানেরা রাইফেল বুটের ‘শব্দে’ ‘অসংখ্য শব্দকে’ দাবিয়ে দিতে সক্ষম। আর আমরা একটি ভারতমাতা নির্মাণে তৎপর হয়ে উঠেছি। ‘মাতা’ হিসাবে ভারত দেশকে প্রতিস্থাপনের একটা অন্য অর্থ আছে, আমাদের চোখে ‘মা’ শব্দটা যতই আবেগবিগলিত মোড়কে উপস্থিত করা হোক না কেন, তাকে যে কেবলই উৎপাদন যন্ত্র হিসাবেই দেখা হয়ে থাকে। মেয়েরা মায়ের জাত বলে তাঁদের অসংখ্য অধিকারকে অস্বীকার করার রীতি বহুকাল যাবৎ চলে আসছে। তাই ভারতমাতা প্রশ্ন করে না! তার বুকে হাজারো অন্যায় হয়ে গেলেও সে মুখ বুজে মেনে নেয় সব কিছু; ঠিক যেমন বাড়ির মা মেনে নেয় সব কিছু। তো এই ভারতমায়ের স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে পুরুষরাষ্ট্রের ভাষায় যাদের ‘মায়ের জাত’ বলা হয় তাঁদের সাথে কথা বলে জানবার চেষ্টা করেছি তাঁদের কাছে স্বাধীনতা দিবস ঠিক কী অর্থ বহন করে। ১৫ আগস্ট সম্পর্কে ১৫ জন মেয়ের জবানে তাঁদের স্বাধীনতার রকমফের।

    প্রথম মেয়েটিকে আমি জন্ম থেকে দেখে আসছি, সে গাছে উঠতে ভালোবাসত, নির্দ্বিধায় খালি পায়ে শাড়ি উঁচিয়ে রাস্তায় দৌড়াতে পারত, একগাদা পুরুষমানুষের মধ্যে নিজের আওয়াজকে সোচ্চার করবার চেষ্টা করত। আমি ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি মেয়েমানুষের ফোপরদালালি ভালো কথা নয়, মেয়েমানুষ এত কথা বলবে কেন? তাই আমার বাড়ির সকাল-বিকেলের আসরে প্রধানত পুরুষমানুষদের আসরে কোন বক্তব্য/মন্তব্য ঘিরে এই মেয়েটি তার গলা চড়ালে, আমার নিজেরই কেমন লজ্জা লাগত; মনে হতো ছি ছি, এই মেয়েমানুষ একগাদা পুরুষমানুষের মধ্যে ঢুকে ঝগড়া করে। আমি মাঝে মাঝে তাকে টেনে আনতাম, রাস্তা থেকে, ঝগড়ার আসর থেকে, পাঁচিলে উঠলে, গাছের ফল পাড়তে উঠলে। মাঝে মাঝে তার এহেন দুরন্ত কার্যকলাপে লজ্জায় মাথা কাটা যেত যেন, কারণ তাকে নিয়ে যে পড়শিরা হাসাহাসি করত, ঠাট্টা করত। পারিবারিক সম্মান নামের ভণ্ডামোর দোহাই দিয়ে আমরা এই ‘দুরন্ত মেয়ে’-টাকে একটু একটু করে ‘মা’ বানিয়ে দিলাম। সেই মা দিনভোর রান্না করে, আর সংসার করাই প্রকৃত উদ্দেশ্য, মেনে নিয়ে একটা ধারাবাহিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।

    এই মেয়েটা আমার মা; তাকে আমরা অনেকদিন হল মেয়ে থেকে মায়ে পরিণত করেছি; তাকে প্রশ্ন করেছিলাম মা, স্বাধীনতা বলতে তুমি কি বোঝো? সে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে জানিয়েছিল, স্বাধীনতা বলতে আমি ‘তোমাকে’ বুঝি।

    - কেন?

    - ‘তুমি কলকাতা শহরে একা যাওয়াআসা কর, একা থাক; তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী তুমি নানা জায়গাতে যাচ্ছ। আমার জীবনে যা যা সম্ভব হয়নি, তোমার জীবনে সে সব সম্ভব হবে, আর তাই তোমার চোখ দিয়ে আমি দুনিয়া দেখি, মানুষ চিনি, নতুন জায়গা দেখি; তুমি যা কিছু দেখবে, শুনবে, উপভোগ করবে সেসবই আমার অনুভবে আসবে। তাই স্বাধীনতা মানে আমার কাছে তুমি’। এক মায়ের মৃত-স্বাধীনতাকে মেয়ে কি করে পুনরুজ্জীবিত করবে জানা নেই। তবে একজন অসম্ভব চঞ্চল-সোচ্চার মেয়ের, শান্ত-স্নিগ্ধ মা হয়ে ওঠার পিছনে আমার স্বার্থপরতা জড়িয়ে আছে ভেবে নিজের প্রতি আজকাল ঘেন্না হয়। তবুও এগোতে হবে, ঐ মেয়েটার অপূর্ণ স্বাধীনতাকে কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করতে হবে।

    এবং আলাপের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা দিবসের আগে কয়েকজন মেয়ের কাছ থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটা নিয়ে দু’-চার কথা শুনে লেখার প্রস্তাব আসার সাথে সাথে রাজী গেলাম। কখনো একটি সামান্য ‘শব্দ’ আমাদের সামাজিক কাঠামোয় ‘নির্মিত’ অসংখ্য অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন করে, আর দাবি জানায় নতুন উত্তর অন্বেষণের। তাই স্বাধীনতা শব্দটির সাথে পনেরোজন মেয়ের জীবনের সম্পর্ককে একটু আলগাভাবে হলেও তুলে আনার চেষ্টা করছি।

    অপর্ণা দিদির সাথে কথা হচ্ছিল ট্রেনে; চোখের ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছিলেন অপর্ণা বাউরি—বয়স ৪০ থেকে ৪৫-এর মধ্যে, নিজেই অনুমান করলেন। চার মেয়ে ও স্বামী নিয়ে সংসার, স্বামী মেলায় ঘুগনি বিক্রি করেন। অপর্ণাদি মনে করেন স্বাধীনতা শব্দটা তাঁর জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়; কারণ ওটা জরুরি নয়। অভাবের সংসার টিমটিম করে চলে, তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, ছোটটার বিয়ে দিতে পারলেই ছাড়া হাত-পা অপর্ণা দিদি—স্বাধীন। তাঁদের কোন ছেলে নেই তাই বুড়ো-বুড়ির শেষ জীবন কোনোমতে দিন গুজরানের খরচা জোগাড় হলেই কেটে যাবে। স্বাধীনতার মানে বইয়ে লেখা আছে, অপর্ণাদি জানালেন, বইয়ের স্বাধীনতা সম্পর্কে তিনি অত জানেন না, আর না জেনে স্বাধীনতা সম্পর্কে কোনোদিন ভাবেনও না। আমার প্রশ্ন তাই অপর্ণাদির কাছে বড্ড অদ্ভুত ছিল, স্বাধীনতা শব্দের অর্থ যা তাঁর জীবনে নেই। তাঁর সাথে আমার সম্পর্কের সূত্রপাত হয় তালের বড়া সম্পর্কিত বিষয়ে, পরিচিত একজনের সাথে তালের বড়া খাওয়ার প্রসঙ্গ আলোচনায় ঢুকে উনি উষ্ণতার সাথে আমাকে ওঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। সেখান থেকে আমাদের একটা নতুন সম্পর্ক তৈরি হলেও স্বাধীনতা শব্দটা নিয়ে বোঝাপড়া আমাদের মধ্যে অসংলগ্ন থেকে গেল।

    স্বাধীনতার অর্থ আমাদের কাছে এত অস্বচ্ছ কেন, অথবা স্বাধীনতা শব্দটা আমাদের জীবনে এত অপ্রয়োজনীয় কেন? আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ সঙ্গীতা জেঠিমার উপলব্ধিতে স্বাধীনতা বেশ কিছুটা আলাদা। ব্যাঙ্ক কর্মচারী, অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর জেঠিমা স্বাধীনতা ভোগ করেন বলে জানান। তবে তাঁর মনে হয় স্বনির্ভরতা কখনোই স্বাধীনতা নয়! ওনার কথায় ‘এখনও এই সমাজে মেয়েদের উপার্জন কত যেকোনো মানুষ কি নির্দ্বিধায় জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু ছেলেদের উপার্জন নিয়ে প্রশ্ন করা বারণ’। তাঁর অভিজ্ঞতাতে বারবার উঠে আসে সেই মানুষদের কথা যাঁরা ওনার বাড়িতে কাজ করবার সূত্রে পরিচিত। সঙ্গীতা জেঠিমা বলেন এই মেয়েগুলো সারাদিন পরিশ্রম করে অর্থোপার্জন করে। তারপর বাড়ি ফিরে স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে হয়। স্বনির্ভর হওয়া সত্ত্বেও এরা নিজের সামান্য ইচ্ছেগুলোও পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। দুপুরের খিদে কখনো শুকনো সাবু চিবিয়ে জল খেয়ে নিবারণ করে। তাই এইসব স্বনির্ভর মেয়েদের স্বাধীন হওয়ার নিশ্চয়তা কতদূর সে বিষয়ে প্রশ্ন রেখে দিলেন তিনি।

    মিমি কাকিমা গৃহবধু, অর্থনৈতিকভাবে মোটামুটি সচ্ছল মধ্যবিত্ত; তাঁর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হল যেকোনো মানুষকে ঝট্‌ করে আপন করে নিতে পারেন। বেশ কিছুদিন হল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ, জানতে পারি কাকিমা এক সময়ে অসাধারণ নাচতেন, মমতাশংকরের ট্রুপে। বিয়ের পর পারিবারিক কারণে ছেড়ে দেন। তিনিও মেয়ের মধ্যে দিয়ে অপূর্ণ কিছু স্বপ্ন নতুন করে দেখতে চেয়েছিলেন। তবে মেয়ে পড়াশুনোর চাপে নাচ ছেড়ে দিলে কাকিমা অসম্ভব হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তবে সেই হতাশা সামলানোর জন্য ছিল সংসারের খাটনি। কাকিমা সারাদিন কাজ করে যান। ওনার কাছে স্বাধীনতার অর্থে স্বনির্ভরতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো স্বাবলম্বী হলে অনেক আকাঙ্ক্ষা পরিপূরণ করা সম্ভব হত তাঁর পক্ষে, তাই নিজের মেয়েকে তিনি স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে চান। যদিও তাঁর কাছে সমাজ নির্মিত স্বাধীনতা বনাম স্বেচ্ছাচারিতার বিতর্কটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

    যেখানে আজকাল থাকি, সকাল আটটা থেকে খুটখাট-খুট নির্মাণ শ্রমিকের একটানা কাজ চলে। সেখানেই পরিচয় রেবা মাঙ্গার দিদির সাথে। অসম্ভব মিষ্টি এবং পরিশ্রমী একজন মানুষ। বছর পঞ্চাশের এই মানুষটার অকপট স্বীকারোক্তি—বছর কুড়ি আগে স্বামী বেঁচে থাকার সময় প্রেম আর বাঁধনে আটকা থাকতে ভালো লাগত। তখন জীবন সুন্দর ছিল, সব ওলটপালট করে এখন তিনি স্বনির্ভর কারণ সন্তানের উপর নির্ভরশীলতার বদলে নিজেই একটা ঢাল হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন রেবাদি। নানাধরনের কাজ করেছেন। তাঁর কাছে কাজের স্বাধীনতা আছে, পরিবারের শক্ত বাঁধন নেই, পুরুষদের সাথে একযোগে কাজ করেন, স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর কোন অনুযোগ নেই। তবে বয়সের সাথে কর্মক্ষমতা কমার বিষয়টা তাঁকে আজকাল বেশি ভাবাচ্ছে।

    দীপালিদি, আর তাঁর বৌমা দোলন , তাঁদের বাড়ি যাই স্বাধীনতার খোঁজ করতে। দীপালিদি এমনিতেই কম কথা বলেন, তাও ভালোবাসেন বলে অসম্ভব অপ্রস্তুতির সাথে বলেন ‘এ কেমন একটা প্রশ্ন! কি যে বলি স্বাধীনতা সম্পর্কে, আমি ঠিক মতো জানিই না স্বাধীনতাটা ঠিক কি বিষয়! তার জন্য তো পড়াশুনো করতে লাগে। বৌমা তুমি কি কিছু বলতে পারবে?’ দোলন উৎসাহের সাথে বলে ‘হ্যাঁ দিদি ক্লাস সেভেন পর্যন্ত আমি পড়েছি, তখন স্কুলে স্বাধীনতা দিবস পালন করে পতাকা তোলা হত। কিন্তু এখন ঐ দিন ঠিক কবে আসে কবে চলে যায় খবর নেই। মা তুমি কিছু বল।’ দীপালিদি বলেন ‘যেসব বাবুদের বাড়িতে কাজে যাই সেখানে স্বাধীনতা দিবসেও ছুটি মেলে না। সামনের স্বাধীনতা দিবসের দিনও হয়ত তোমার ঘর মুছতে যাব, আমাদের কাছে স্বাধীনতা কি আর নতুন কিছু আনে?’

    কৃষ্ণাদি, কৃষ্ণা নস্কর (৩৫), প্রথমে আমাকে যে কথাগুলো বলেন সেগুলোই উল্লেখ করতে চাইব। ‘আমাদের স্বাধীনতার খবর জেনে বাজারে বেচবা বলে জানতে এসচো, এমনি এমনি তো আর আসনি, নিজের মতলব ছাড়া। তুমাদের মতো দাদা দিদিমনিরা হরদম আমাদের এই সুন্দরবনে আসে খবর সংগ্রহে। তারপর আমারা একই থেকে যাই। কি হবে আমার স্বাধীনতা বুঝাপরা তুমাকে জানিয়ে? আমরা খুব ভালো আচি, আমাদের সরকার খুব ভালো রেখিচে। দু’ টাকার গন্ধওলা চাল, আর এলাকার মাছে বেঁচে থাকা যায়। আমরা তো আর আপনারা নই। তোমাদের স্বাধীনতার বুঝাপড়া নিয়ে তুমরা পাতা ভরিয়ে লিখো’।

    অনেকক্ষণ পরে কৃষ্ণাদি বলেছিলেন ‘আসলে খুব রাগ হয় এখন, সবার উপরে। তুমি যদি এগুলো লিখতে পারো লিখো। স্বাধীনতা মানেই যারা জানে না, তুমি ঠাট্টা করে এ নিয়ে কি সব শুনতে এসচ , বলিহারি’। 

    সাথী তাঁতি, ক্যানিং-এর এই গৃহবধু আমারই বয়সি। পড়াশুনোর সুযোগ পেলে আমার চাইতে আরও অনেক অনেক ভালো লিখত। কৃষ্ণাদি যখন খুব রেগে সব কিছু অস্বীকার করছেন তখন সাথী বলতে থাকে ‘আসলে আমাদের বলে যেতে হবে কৃষ্ণাদি। আজ চোরের উপর রাগ করে ভাত মাটিতে কেন খাব। উনি স্বাধীনতা সম্পর্কে জানতে এসছে যখন, তুমি বল তুমি কি স্বাধীন? একটা ছেলের সমান তোমার অধিকার না কি ওনার সমান তুমার অধিকার? নাই তো? তাহলে কেন প্রশ্ন করবা না তুমি? দেখ আমাদের স্বামীরা উনাদের মতো বাবু বাড়িতে সারাদিন ভুত-খাটনি খাটে, সেসব রাগ রাতে আমাদের উপর এসে দেখায়, এখন আমি উনাকে প্রশ্ন করি উনারা, আমাদের স্বামীরা, আর আমরা সবাই তো স্বাধীন, তবে সবার স্বাধীনতা কি এক হল? তাই স্বাধীনতা নিয়ে সব কিছু জেনেশুনেও দিদি প্রশ্ন করেন’।

    রেহেনাদি, রেহেনা সর্দার। ওনার স্বামী মেলায় মেহেন্দি পরিয়ে বেড়ায়। তাঁর কথায় ‘আসলে কাকে কি বলব এখন বুঝে উঠি না গো। ভয় লাগে তুমি যদি সরকারী লোক হও, আমাদের কথা তুলে নিয়ে গিয়ে আমাদের জেলে ভরে দাও। ভারতটা তো আমাদের দেশ, আমাদের দেশ খুব ভালো দেশ, স্বাধীনতা দিবস খুব ভালো মনে হয়। আমার ছেলে স্কুলে পতাকা তুলে স্বাধীনতা দিবস করে। সে খুব দেশকে ভালোবাসে। আমার স্বামীও স্বাধীনতাকে খুব সম্মান করে’।

    ‘তবে খুব অভাব আমাদের, মেহেন্দি বেচে পেট চালাতে খুব কষ্ট হয় গো। আমরা ওদেশের নই, অনেক পুরুষ থেকে এদেশের মাটি, আর খিদে আঁকড়ে পড়ে আছি। এখন কিছু লোক আমাদের শুধু মুসলমান হিসাবে দেখে। এই দেশ, স্বাধীনতা তো আমাদেরও, নাকি বল দিদি?’

    রেহেনাদির ক্রাইসিসের সাথে নাসিমার ক্রাইসিস মেলানো যাবে না। তবু কোথাও যেন একটা সূত্রতা আছে। রেহেনাদি যখন ভীত, নাসিমা তখন লড়াইয়ের সমস্তরকম পথের অনুসন্ধান করছে। সে একজন মেধাবী মুসলমান স্কলার, তার স্বাধীনতার ধারণায় অসম্ভব ক্ষুরধার কিছু আলোচনা উঠে আসে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা মেয়েটার লড়াই শুধুই এই দেশের স্বাধীন নাগরিকের যাবতীয় অধিকারসহ সম-সুযোগ আদায়ের লক্ষ্যে নয়। সে তার লড়াইয়ে যুক্ত করেছে যৌনতা বিষয়ক সামাজিক ট্যাবুকে সোচ্চার ভেঙে দেবার সাহস। একই সাথে সে লড়ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চবিত্ত ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে। কঠিন লড়াই এখানে, টিকে থাকার জন্য ছাদটুকু পেতেও একটানা সংগ্রাম করতে হয়, সেখানে আধিপত্যশালীদের এই একাডেমিয়াতে সামান্য জায়গা দখল করাও কঠিন, তবু লড়াই চলতে থাকে। দেশের এই প্রেক্ষিতে নাসিমাকে যে রেহেনাদিদের কণ্ঠ হয়ে উঠতে হবে। টিকে থাকা, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সাহস জোগাতে হবে।

    নাসিমার সাথে কাবেরীর সূত্রতা কোথাও যেন ইন্সটিটিউশন ঠিক করে দেয়। কাবেরী প্রশ্ন তোলে স্বাধীনতা নিয়ে, বরাবর আমরা যে চর্চাকেন্দ্রের মধ্যে আবদ্ধ সেই স্বল্প পরিসরেই বা কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা, সম-অধিকার ও যাবতীয় বিষয়গুলো অনুশীলন করা হয়, প্রশ্ন কাবেরীর। আমাদের চর্চা কখনো তত্ত্বের সীমানা পেরিয়ে কি বাস্তবের অনুশীলনে এসেছে? আমরা যখন শিক্ষিতের অবস্থান থেকে কোন বিষয়কে দেখছি তখন সেখানে কোনভাবে আমাদের হায়ারার্কিকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছি না তো? স্বাধীনতা আসলে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে আমাদের সাধারণ চর্চা ও অনুশীলনে আনা প্রয়োজন। আবার প্রশ্ন করতে হবে স্বাধীনতাই বা কেন চর্চার আলোতে আসছে? আরও কী কী এই চর্চা ও অনুশীলনে আসতে পারত। ‘শব্দ হোক, চর্চা বা অনুশীলন, এসবকে আমরা যখন একাডেমিয়ার অন্তর্গত করি তখন আমাদের দেখার চোখে যে হায়ারার্কি তৈরি হয়ে যায় সেখান থেকে স্বাধীন হওয়া জরুরি’।  

    শিরিনদি, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে যাবতীয় ধর্মীয় বিধিনিষেধ উলঙ্ঘন করতে সক্ষম হয়েছেন। নিজের মত করে জীবনের লড়াই দিয়ে একটু একটু করে গোঁড়ামির জাল কেটে চলেছেন। শিরিনদি অসম্ভব ভালো কবিতা বলেন ও নাটক করেন। সাথে সমান পরিমাণে রাজনৈতিক সচেতন ও সংবেদনশীল একজন মানুষ। ছোটবেলায় স্বাধীনতা দিবসে, আবেগে মোড়া পতাকার মাঝ দিয়ে যখন ফুল ঝরে পড়ত শিরিনদির মনে হত তাঁদের গায়ে যেন স্বাধীনতার দুয়া বর্ষিত হচ্ছে। তবে ধূলাগড়, বসিরহাটের অসুস্থ পরিবেশ ও আকলাখ, পেহেলু, জুনায়েদ-এর মৃতদেহগুলো তাঁকে নতুন করে প্রশ্ন করতে বলছে এদেশের স্বাধীনতাকে। কাদের স্বাধীনতা, কিভাবে, কারা ভোগ করছে? শিরিনদি স্বপ্ন দেখেন ‘আমরা একদিন সংঘবদ্ধভাবে এই মেকি স্বাধীনতার স্বরূপ উন্মোচন করে প্রকৃত স্বাধীনতার লক্ষ্যে এগিয়ে যাব’।

    পামেলা জানা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাথে সাথে বিয়ের পর সংসারে বেশ কিছু  নিয়ম ভাঙার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। পামেলার বাড়ি রায়দিঘির প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। তার কাছে পোশাকের স্বাধীনতা ও বিবাহিতা নারীর শাঁখা, সিঁদুর ও পোশাকের নানা প্রথা না মেনে চলার মধ্যে একটা বোঝাপড়া নিয়ে লড়াইটা চলছে। সে বলে শাখা-সিঁদুর পরতে অপমান লাগে তবু কখনো কখনো সমাজের অসংখ্য চোখ চাপ তৈরি করে, আগে সেসব চোখের সন্তুষ্টির জন্য শাঁখা সিঁদুর পরতাম, এখন আর এই অভিনয় করতে পারি না। সে মনে করে দেশের স্বাধীনতার তুলনায় এখন আমাদের নিজস্ব যে পরাধীনতাগুলো আছে সেগুলো কাটিয়ে, স্বাধীনতা দিবসের নতুন সংজ্ঞা আনা প্রয়োজন।

    -পুরো নাম?

    -কোনটা, আব্বার দেওয়া?

    -যেকোনো।

    -আব্বার দেওয়া নাম রাজিয়া খাতুন, আমি স্কুলে অনেকবার চেষ্টা করছিলাম খাতুন পাল্টে নিজের পদবী নিতে, হয়নি। তখন খুব দুঃখ হত। এখন আর হয় না বরং মনে হয় ভালই হয়েছে। তখন পদবী নিলে সেই তো আব্বার পদবীই নিতে হত। নতুন আর কি হত। বরং শুধু রাজিয়া নয়তো খাতুন যোগে রাজিয়াই ঠিক আছে।

    রাজিয়াদি স্কুল শিক্ষিকা, মিতভাষী মানুষ তবে যা বলেন, যেভাবে বলেন তাতে আমার সব পূর্ববর্তী ধারণা উলটপালট হয়ে যায়। বর্তমানে রাজিয়াদির ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অর্থ হল একটা নিজের বাড়ি তৈরি। তবে বাড়ি কোথায় করবে? ভাইদের সম্পত্তির অধিকার থাকলেও রাজিয়াদির নেই। কারণ বাবা, দাদা বেঁচে থাকাকালীন সেসব পারিবারিক সম্পত্তি ভাইদের নামেই মূলত রেজিস্ট্রি হয়। আমাদের কমবেশি সব পরিবারেই এই রীতি বহাল, বাবা বা দাদুরা দায়িত্ব নিয়ে পুরুষ উত্তরসূরিদের জন্য এই মহান কাজটি করে যান।

    তবুও রাজিয়াদি স্বনির্ভর অবিবাহিতা, একাই এই অধিকারের লড়াই আজও চালিয়ে যাচ্ছেন। একদিন রাজিয়াদির ব্যক্তিগত জীবনে স্বাধীন–স্বনির্ভর মানুষের অধিকার আদায় হবে। অনেক আগামীর রাজিয়াদের প্রভাবিত করতে এই লড়াই জরুরি।

    অনেকক্ষণ ধরে শব্দ হিসাবে ‘স্বাধীনতা’ বড্ড কানে লাগতে শুরু করে। এই কাজ করবার সময় আমার এক বন্ধু আমাকে বলে, আচ্ছা এই স্বাধীনতাটা মুক্তি নয় কেন? আমিও ভাবি, ঠিকই তো, স্বাধীনতা শব্দটার প্রভাব আমার মাথায় এত গভীর কেন ? আসলে আমাদের শব্দ-ভাষা এসবের মধ্যেও অদ্ভুতভাবে একটা আধিপত্য কাজ করে। নিজেদের অজান্তে কখন সেই ক্ষমতার পাতা আধিপত্যের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলি। বাজারে স্বাধীনতা দিবস নিয়ম করে আসে, পুঁজির বাজারে তার উদযাপনেও রমরমা। আচ্ছা স্বাধীনতা শব্দের প্রতিস্থাপন কি ‘মুক্তি’ শব্দ দিয়ে করা যায়? অথবা ‘আজাদ’। স্বাধীনতার মধ্যে পরিশীলিত একটা বিষয় আছে, উলটোদিকে মুক্তি ও আজাদ শব্দের মধ্যে আছে একটা চাপা আগুন। তাই মুক্তির স্লোগান, আজাদির স্লোগানে ক্ষমতা ভয় পায়। আর আমাদের ব্যর্থতা এখানে যে আমরা এই শব্দগুলোকে সার্বজনীন করে তুলতে পারিনি। যদি তেমন হত তবে আমার প্রশ্ন হত আপনি মুক্তি বলতে কি বোঝেন? কি থেকে আপনি আজাদ হতে চান? ’৪৭ এর ‘মুক্তি দিবস’ আপনার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আজকের প্রেক্ষাপটে সেই মুক্তির লড়াই কি থেমে গেছে? এমন আরও প্রশ্ন...। হয়ত অন্য কোথাও অন্য কোনভাবে চলবে এই ভাষা ভাঙার কাজ। এখানে আপাতত শুরু হল পনেরোজন মেয়ের নিজস্ব অভিজ্ঞতায় মেলানো মেশানো দু’-চারটি আটপৌরে কথা। বিপ্লবের আগুন-ফাগুন না থাক, কিছুটা জানাবোঝা তো তৈরি হোক। লেখাটির সীমাবদ্ধতা এই যে প্রতিটি বর্গের মেয়েদের কাছে পৌঁছতে পারিনি আমি। পৌঁছতে পারিনি পেয়ারাবাগানের লতাদির কাছে যিনি তাঁর সন্তানের সামনে খরিদ্দার ধরেন, অথবা ক্ষেতমজুর শাহিনদির কাছে যাঁর জন্মের পর নারী বা পুরুষ নির্ধারিত না হবার কারণে আমাদের গ্রামের সরল সমাজের পক্ষে তাঁকে মেনে ও মানিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে ওঠে; তবু তাঁর সংগ্রাম চলে। এই মানুষগুলোর কাছে স্বাধীনতা দিবস বা মুক্তির অর্থ কি? পৌঁছতে পারিনি সেই মেয়েটির কাছে যে ফ্যাব-ইন্ডিয়ার জামা পরে আজাদির স্লোগান দিয়ে ক্যাম্পাসের মিছিলে হাটে, যার ব্যাগে একটা হালকা ম্যাকবুক আর চোখে বিদেশের স্কলার হওয়ার স্বপ্ন, জানা হয়নি তার কাছে মুক্তি বা আজাদি শব্দের অর্থ। তাই লেখাটির শেষ অংশে একটা অতৃপ্তি নিয়ে শেষ করতে বাধ্য হচ্ছি।   

    তবে আমি আরও অনেকগুণ বেশি কৃতজ্ঞ নতুন ভাবনার আধার তৈরি করে দেওয়া এই মানুষগুলোর কাছে, তাঁদের মূল্যবান সময়ের অনেকটা দিয়ে তাঁরা আমাকে একটি শব্দকে ঘিরে অনেক নতুন জীবন-যাপন-লড়াইকে বুঝতে সাহায্য করেছেন। যদিও সময় ও শব্দসাকুল্যের পরাধীনতার কারণে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা-অভিজ্ঞতা-প্রশ্ন-অভিমান-লড়াই-হার-জিত এইখানে অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। হয়ত ভবিষ্যতে এগুলো অন্য কেউ আপন করে খুঁজবে আরও। আর রাষ্ট্রনির্মিত ‘স্বাধীনতা’ শব্দের কাঠিন্য পেরিয়ে শব্দরা আরও মুক্ত-আজাদ হয়ে উঠবে।  

     
     



    Tags
     



    Comments (2)
    • বেশ ভাল লাগল। মন দিয়ে কথা শোনা ও আমাদের শোনানো।
      পরের কোন লেখায় এই সব কিছু থেকে একটু তত্ত্বায়ন করতে পারলে, আজই আমি কি করব, সেটা ভাবতে সুবিধে হবে।

    • Je mohila train e sodyo alap haoya toruni ke obolilai barite taler bora khabar amontron janate paren tini kothao giye nischoi shadhin.

      ekti lekhar modhye sobbaike politically correct hoye dore flete hobe emon bhabar othoba na parle tai niye koifiyot deoyar kono proyojon nei Labani. Prothome maa ke diye shuru korar bhabna khub bhalo laaglo. baire toh jetei hobe… ghor thekei shuru na korle seta boddo meki hoye jaai somoy biseshe.
      laalbati elakar meyeti ba fab indiar punjabi pora meyetir kotha na hoi onyo kothao onyo kono bhabe shona jabe. eder nice je shobdho gulo khorcha holo ekhane, tar poriborte onyo jader kotha likhecho, simito shobdo sonkhyar modhye tader kotha arektu tule dhora jeto hoito.
      bisesh kore oi jara tomake sojore dhomke diyechen tader o amar kurnish. sotyii toh amra tader boro beshi ‘taken for granted’ kore feli… je somoy tuku tara den amader, oneksomoi tar binimoye samanyo parishromik othoba lekha berole ba tv te dekhano hole tader janano ba dekhanor kothai ba kotojon bhabi? ei rege othar shadhinota tuku tader achhe dekhe bhalo laglo.

      sob miliye khub bhalo laglo porte. aro lekho.

      poriseshe ektu byaktigoto bhabe boli…

      Amar barite sodyo jog deoya ekbelar rannar didi ke soptahe dudin chhuti deoya achhe. Sobe din dosh baro kaaj korechen, gotokal jokhon take swadhinota dibose chhuti boli…tini jante chan “chhuti kyano? thakbe na tomra?” ( ektu ashonka je tahole ki ranna pochondo hochhe na, kono bhul holo onar ba kaaj ta gyalo? ) take janai je thakbo. Jodi proyojon hoi ami ranna tutu kore nebo. ei je rannar didi ke aaste baron korlam kintu kauke kono jobab ba koifiyat dite holo na…otocho jani onyo onek poribarei ei din ektu beshi ranna hobe ebong rannar didi na ele barir grihinir swadhinota ba chhutir bodole otirikto kaaj ebong porishrom korte hobey. Sobar kache seta hoito soman bhabe kharap nao laagte pare. kintu kharap laagle setuku bolar shwadhinota tuku thake kojoner -setai proshno. amar kachhe ei chhuti dite parar swadhinotatuku o boro omulyo …thik tototai jotota hothat chuti peye prothome sondigdho hoye seshmesh sob sondeher obosan ghotanor pore amar kachhe omulyo hoye jai Rinku dir (rannar didi) mukher hashita…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics