• একদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনলাম আমার বিয়ে


    0    235

    November 17, 2017

     

    শকুন্তলা মিদ্দে৷ মৈপীঠের বাসিন্দা এই গৃহবধুর জীবন নাটকের কাহিনীকেও হার মানায়৷ সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যে লড়াকু মানসিকতা থাকে তার বাস্তব উদাহরণ তিনি৷ আজও সেই লড়াই চলছে৷ আমরা তাঁর মেয়েবেলার কথা জানতে চাওয়াতে তিনি লিখে পাঠালেন সেই সুখ দুঃখ মেশা দিনগুলির কথা৷

     আমার কাছে কেউ ছোটবেলার কথা জানতে চাইবে কখনো ভাবিনি৷ জানি না যেসব কথার কোনও গুরুত্ব আছে কিনা৷ তবু যখন জানতে চেয়েছেন তখন জানাচ্ছি৷

    আমরা থাকতাম মৌপীঠের নগেনাবাদ গ্রামে৷ আমরা চার বোন, দুই ভাই৷ ছোট থেকে জেনে এসেছি আমাদের বড় দাদা কলকাতায় থাকে, দাদু দিদিমার সাথে, এখনো দাদা থাকে কলকাতাতেই আমাদের সে বাড়িতে ঢোকার উপায় নেই৷

    আমার বাবা বালীগঞ্জে একটি লোহার কারখানায় কাজ করতেন৷ আমার ছোটবেলায় একদিন শুনলাম বাবার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে৷ বাবার হাতে খুব আঘাত লাগল৷ তারপর থেকে বাবার কাজ চলে গেল৷ সেই থেকে শুরু হল আমাদের কষ্টের দিন৷ দশ কাঠা মত জমি ছিল আমাদের৷ সেই জমিতে চাষ হত একবারই বছরে৷ যে বছর বর্ষার সময় বাঁধ ভাঙত সে বছর তাও হত না৷ একবার জল ঢুকলে কোনও কোনও সময় পরপর দু’-তিন বছর ধান হত না৷ নদীর কোলের জমি৷ বাঁধ ভাঙলে কিছু করার থাকত না৷ কোনো কোনো কোটালে বাঁধ উপচেও জল ঢুকত৷

    আমার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল নগেনাবাদ বাদা প্রাইমারী স্কুলে৷ ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা করতে আমার খুব ভালো লাগত৷ বাড়িতে খুব অভাব ছিল৷ দেখিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না৷ তবু আমি একা একাই পড়তাম৷ স্কুলে মাস্টারমশাইদের কাছে জেনে নিতাম৷ পড়তে আমার খুব ভালো লাগত৷ প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারমশাইরা আমাকে খুব ভালোবাসতেন৷ ভালোভাবেই পাশ করতাম৷ প্রাইমারী স্কুল থেকে পাশ করার পর আমি আরও পড়ব বললাম৷

    তখন আমাদের গ্রামে কোনও হাইস্কুল ছিল না৷ পাঁচ-ছয় মাইল দূরে ভুবনেশ্বরী জয়কৃষ্ণ হাইস্কুলে সবাই পড়তে যেত৷ বাড়ি থেকে বলল আর পড়তে হবে না৷ প্রতিদিন অতদূর যেতে হবে, তার ওপর খরচও আছে অনেক৷ আমার খুব মন খারাপ হত৷ খুব জেদ করতাম৷ কান্নাকাটি করতাম৷ সেই সময় প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারমশাই চিত্তরঞ্জন দাস বাড়িতে এসে বাবাকে বললেন মেয়েটি যেন পড়া না বন্ধ করে৷ ওর পড়াশোনায় আগ্রহ আছে৷ অনেক কথাবার্তার পর আমি হাইস্কুলে ভর্তি হলাম, ক্লাস ফাইভে৷

    সে যে আমার কি আনন্দ হল বলে বোঝাতে পারব না৷ বড় স্কুলের বড় বড় ঘর, অনেক ছেলে মেয়ে, অনেক মাস্টারমশাই—আমার খুব ভালো লাগত৷ আমি মন দিয়ে পড়া করতাম৷ এই স্কুলেও মাস্টারমশাইরা আমাকে খুব ভালোবাসতে লাগলেন৷ ক্লাসের পরীক্ষায় আমার রোল দুই তিনের মধ্যে থাকত৷

    ছবি - শুধু সুন্দরবন চর্চা

    স্কুলের খরচ দিতে বাবার খুব অসুবিধা হত৷ আমি রবিবার করে লঙ্কা তুলতে যেতাম৷ এক কেজি লঙ্কা তুললে এক টাকা পাওয়া যেত৷ পঞ্চাশ কেজি মত লঙ্কা তুললে পঞ্চাশ টাকা পেতাম৷ ওই টাকা, পেন-পেন্সিল কিনতাম স্কুলের মাইনে দিতাম৷ পড়াশোনা দেখিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না৷ নিজে নিজেই পড়তাম৷ সবাই টিউশনি পড়তে যেত৷ আমার কোনও টিউশনি ছিল না৷ প্রাণপণ চেষ্টা করতাম নিজে নিজে পড়ে বোঝার৷ হাইস্কুলের মাস্টারমশাইরাও দেখিয়ে দিতেন৷ সাহায্য করতেন৷ বড় ইস্কুলে আমি ভালোই রেজাল্ট করতাম৷ শীতকালের দিনে বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে যেত৷ বাবা বকত, দাদা মারত। মাঝে মাঝে বলত, কাদের সাথে গল্প করে বাড়ি ফিরছিস এতক্ষণে? আমি ছুটির পরই ফিরে আসতাম, অতটা পথ হেঁটে ফিরতে হত৷ তাই দেরি হয়ে যেত, কেউ বুঝতে চাইত না৷ সবাই চাইত আমি পড়াশোনা বন্ধ করে দিই৷ পড়াশোনা করা দরকার সে কথা কেউ বুঝত না৷ গ্রামের লোকেরাও ভালো চোখে দেখত না৷ অনেকে সন্দেহ করত আমি সত্যিই ইস্কুলে ভালো রেজাল্ট করি কিনা৷ আমার যে সত্যিই দুই/চার রোল হচ্ছে সে কথাটা ঠিক কিনা দেখতে অনেকে স্কুলে খোঁজ নিত৷

    আমি যখন সেভেনে পড়তাম তখন আমার মা মারা গেল৷ সংসার আরও ছন্নছাড়া হয়ে গেল৷ দাদার বিয়ে হয়ে গেছে তখন৷ বৌদি খুব খারাপ ব্যবহার করত৷ আমি স্কুলে পড়তে যাই বলে হিংসা করত৷ নানা খারাপ কথা বলত৷ কোনও কোনও দিন ভাতের হাঁড়িতে জল ঢেলে দিত—যাতে আমি খেতে না পাই৷

     

    আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন একদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনলাম আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে৷ শুনে খুব রাগ হল৷ খুব কান্নাকাটি করলাম৷ মন খারাপ হয়ে গেল৷ পাশে এক বন্ধুর বাড়িতে চলে গেলাম৷ বাবা সেখানে গিয়ে আমাকে বোঝাল৷ এই সংসারে খুব অভাব৷ বাবার পক্ষে সব কিছু চালানো সম্ভব হচ্ছে না৷ বাবাও খুব কাঁদছিল৷ বলেছিল এখানে থাকলে খেতে পাবি না৷ বৌদিও অত্যাচার করবে৷ বলেছিল আমি ছেলের বাড়িতে কথা দিয়ে এসেছি৷ শুনলাম ছেলেকে আশীর্বাদ করাও হয়ে গেছে৷

    এইট থেকে নাইনে ওঠার বছরেই আমার বিয়ে হয়ে গেল৷ কি যে দুঃখ হয়েছিল বলে বোঝাতে পারব না৷ পরের বছরই মা হয়ে গেলাম৷ যে অভাবের জন্য বাবা বিয়ে দিল সে অভাব যে মিটে গেল তা কিন্তু নয়৷ কষ্টের দিন চলল, চলতেই থাকল৷

    ছেলে মেয়ে বড় হওয়ার বহুদিন বাদে আবার পড়ার সুযোগ পেলাম৷ মুক্ত বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছি৷

    এখন একটা শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে সামান্য চাকরী করি৷ সংসারে অভাব আজও আছে৷ ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছি৷ অবসর সময়ে কবিতা, নাটক, গল্প লিখি৷ এখানে যে ছোট পত্রিকা আছে সেখানে মাঝে মাঝে ছাপা হয়৷ অনেক বই পড়তে ইচ্ছে করে৷ সব সময় পাই না৷ ইচ্ছে থাকলেও সব সময় সাধ যে পূরণ হয় না সে কথা আমার থেকে ভালো আর কে জানে৷

    [শুধু সুন্দরবন চর্চা, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত। বানান ও ভাষা অপরিবর্তিত রেখে পত্রিকার সম্পাদকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।]

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics