ওই লালে কোনো শহীদ নেই
2 164
ডেনমার্কে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে আসতে না আসতেই আবার ডেরা বাঁধলাম জার্মানির বন শহরে। ডেনমার্কের অরহুস শহরে থেকেছিপ্রায় একটা বছর। সেখানে একটি দোতলা বাড়ির নীচতলায় ভাগাভাগি করে থাকতাম সোনা আর আমি। হাসি-ঠাট্টায় মিলিয়ে মিশিয়ে ঘরকন্নার কাজ ভাগাভাগি করে নিতাম আমরা। সপ্তাহান্তে বাথরুম থেকে উঠোন সারা বাড়ি ঝকঝক করাতে লেগে পড়তাম দুজন কোমর বেঁধে। আর ঘর ঝাঁট, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, রান্না করা তো রোজের সঙ্গী। অবশ্য দশমাস যে সব কাজ সমান উদ্যমে করেছি আমরা, তা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব না। এত বড় মিথ্যে বলা শিখিনি।
প্রায়ই লোকঠকানো, চটজলদি রান্নায় ভরে উঠত আমাদের ফ্রিজ। না-কাচা জামা রাখবার বিনব্যাগ যখন চোখে ঠেকতে শুরু করত, প্রবল আলসেমি কাটিয়ে লন্ড্রীরুমের দিকে পা বাড়াতাম দু’জন। কিন্ত হাসি-ঠাট্টা, হইহই রইরই হারাত না। নিজেরাই নিজেদের আলসেমি নিয়ে হেসে কুটিপাটি হতাম। আবার পরমূহুর্তেই গৃহকর্মে নিপুণা হবার খেতাব চাপাতাম একে অন্যের ওপর।
এতকিছুর পর যখন দেশে ফিরে এলাম, স্বভাবতই অনেক রকম পরিকল্পনা ছিল মাথায়। কলকাতায় ফিরে কী কী রান্না করব তার তালিকা ডেনমার্ক ছাড়ার শেষ দিনগুলিতে শুধুই বেড়ে যেতে লাগছিল। কিন্ত তেমন কিছুই আর বাস্তবায়ন করা হল না। মেরেকেটে একটা কি দুটো পদ ছাড়া আমি গত দু'মাসে কিছুই রান্না করিনি। সত্যি কথা বলতে, ইচ্ছেই করেনি। যে আমি কিনা সকাল আটটার ক্লাসে যাবার আগে পর্যন্ত লাঞ্চ রান্না করে যাবার এনথু হারাতাম না, সেই আমিই হয়ে গেলাম রান্নাঘর-বিমুখ।
ভেবে দেখলাম, আংশিকভাবে এমন কোন জিনিসের প্রতি অধিকার ফলানোর অভ্যেস আমার একেবারেই হারিয়ে গেছে বিগত কয়েক বছরে। বুক ফুলিয়ে যে কষা মাংসের লাল টুকুটুকে ঝোলের ওপর কর্তৃত্ব ফলাব, সেই মাংস মোটেও আমি বাজার থেকে বেছে কিনে আনিনি। রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় বাসন আমি মাজিনি, পেঁয়াজ-আদা-রসুন কেউই আমায় পেস্টরূপ ধারণ করবার আগে দেখেনি। এই রান্নাঘরে এখন আমি অতিথি। না চাইতেই মাসি এসে হাত থেকে ছুরি কেড়ে নেয়। রান্নাঘরের গরমে আমি ঘামলে আমায় পাখার তলায় পাঠিয়ে নিজে দায়িত্ব নেয় মশলা কষানোর। কিন্ত পাতে পড়ার পরমূহুর্ত থেকে খাতির বাড়ে আমার। আমি চূড়ান্ত বাড় খেতে থাকি।
গত দু'বছরের অভ্যেসের ঠেলায় বাড়তি খাতিরে আমার অসম্ভব আপত্তি জন্মেছে। যে কাজে নিজের আলসেমি-বিরক্তি-মাথার ঘাম কোনকিছুরই অংশবিশেষ দেখতে পাই না, সেখানে নিজের খাতির দেখলে গা-পিত্তি জ্বলে ওঠে। এই কারণেই বোধহয় নিজে সামাল দিতে পারছি না, কিন্ত মাসমাইনে দিচ্ছি বলেই আমার সমস্ত কষ্টের দায়ভার আমারই মত আরেকজন অসহায়ের ওপর ঠেলে দেওয়াটা এজন্মের মত আমি আর পারলাম না। শুনতে সাহেবি মনে হলেও, স্বাবলম্বী হবার স্বপ্নটা আমাকে ভাবায়। পয়সার জোরে মাথা কিনে নেওয়া যায় যেসব মানুষদের, তাদের গায়ে-গতরে খেটে করে দেওয়া কাজে তাই আর নিজের হলমার্ক বসাতে পারিনা, চাই না। ওই যে বললাম, এখনও এতটা মিথ্যে বলা রপ্ত করতে পারিনি। তাই আগাগোড়া মাসির হস্তশিল্পে তৈরী মুরগির ওপর অধিকার ফলাবার কথা ভাবলে মনে হয় মুরগিই চূড়ান্ত বিরক্তিপ্রকাশ করে উঠবে।
মুরগির কথায় মনে পড়ল, আশেপাশের মানুষকে দেখি, প্রায়শই নামী দোকান থেকে বিরিয়ানীর প্যাকেট হাতে বাড়ি ফিরতে। নির্ঘাত জানি, এই প্যাকেটের পুরোটা বুড়িমাসির হাতধরা বাচ্চাটি খেতে পারবে না নিজে। তাকে খাইয়ে দিতে হবে। যে হাত খাইয়ে দেবে ‘মালিকের সন্তানকে’, সেই হাতের সামর্থ্য নেই ওই বিরিয়ানীর গ্রাসে ভাগ বসায়। বুড়িমাসির জন্য সারাদিনের বরাদ্দ পিঁড়ি, মোটা চালের ভাত, উচ্ছিষ্ট-অবশিষ্ট তরকারি আর রাতের বেলার ঠান্ডা মেঝে। কাজে ঝিম ধরে যায় পাছে, তাই সাউন্ডস্কেপে মালিক-মালিকানীর কথার চাবুক।
দেশ এখন স্বাধীন। সাদা চামড়ার জুতোর তলায় আমাদের রাখার ক্ষমতা আইনের নেই। স্বাধীন ভারতবর্ষে এখন ঘরে ঘরে কোম্পানি-রাজ বিরাজমান। জুতোর তলায় না হলেও, টেবিলের তলায় মানুষকে আটকে রাখা আমাদের আজীবনের অভ্যেস। আর আমার দেশে তো মানুষের জীবন কেবলমাত্র ছোট-বড়র সাধনাতেই আটকে। ছোটকে আরো ছোট করে দেওয়াটাই যেন একমাত্র লক্ষ্য। এতটা ক্ষুদ্র করে ফেলতে হবে যাতে দেখতে না পাওয়া যায়। বড়দের রাজত্ব থেকে এতটাই দূরে পাঠিয়ে দিতে হবে বুড়িমাসিদের, যাতে পিঁড়ি থেকে উঠতে চাইলেই কানে আছড়ে পড়ে উদ্ধত চাবুকের আস্ফালন। বড় মানুষের জীবনের অনেক দাম। সেখানে ছোট কাজের, ছোট মানুষের জন্য সময় নেই। থাকবেই বা কেন? বড় মানুষেরা সূর্য, ছোটরা চাঁদ। সূর্যের আলোতেই চাঁদের আলোর ভণিতা।
বড় মানুষের শুনি মনও অনেক বড় হয়। তাই বছরে একটা-দুটো পুরনো জামা-শাড়ি দিয়ে ক্ষুদ্রকে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করিয়ে দেওয়াটা বড়দের দায়িত্ব। বড় বলে, দেখো, আমি অনেক বড়, উৎকৃষ্ট। তুমি নীচু। অপ্রয়োজনীয়। সুতরাং আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া জামা-কাপড় দিয়ে তুমি এবার ভরিয়ে তুলতে পার তোমার ক্ষুদ্র জীবনের তার চেয়েও ক্ষুদ্র পরিসরটুকু। মনে রেখো, সেখানেই তোমার মুক্তি। ভুলোনা, আমিই তোমার অন্নদাতা। বড় মনের উদারতার রোশনাইয়ের সামনে টিমটিম করে জ্বলতে থাকে বাধ্য একটি পিদিম।
এমনই আলোয় মোড়া, ঝলমলে রাস্তার ওপর বড় বাড়ি। তাতে বড় বড় ঘর। ঘরে বিশাল খাট। খাটের ওপর পায়ে পা। ঠান্ডা ঘরের আবছা সত্যের সামনে এভাবেই মুক্তি আর চাবুক গুলিয়ে যেতে থাকে ক্রমশ। খাটের পাশেই আয়না। যেখানে সকাল-বিকেল মুখ দেখে নেওয়া চলতে থাকে। বড় কাজ করতে যাওয়া বড় মানুষেরা এই আয়নাতেই রোজ মিলিয়ে নেন আরো আরো বড় হতে চাওয়ার সব অঙ্ক। চুল আঁচড়ানোর মূহুর্তও বাদ পড়ে না। চিরুনী চুলের জট ছাড়াতে ব্যস্ত থাকে। আর মস্তিষ্কে ঘোরে পাশের মানুষকে ছোট করে আরেকটু বড় হতে পারার অদম্য জেদ।
আমি আর কলকাতায় বাড়ি ফিরে রান্না করিনি তাই। কোথায় একটা বাধত। খেতে বসলেই মনে হত আমার দিকে চেয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে লাল টুকুটুকে ঝোল। চোখের সমস্ত স্বপ্ন কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে আমায় শিখিয়ে দিচ্ছে এই লাল ঝোলে কার অধিকার আসলেই। রক্তপতাকার কথা, শহীদের রক্তে রাঙানো পথে নেমে লড়ার ডাক পাঠাতে এক মিনিটও বিলম্ব হয়না আমাদের।
ইতস্তত তখনই আসে যখন বুড়িমাসির কোলে-পিঠে বড় হওয়া বাচ্চাটি পরীক্ষার দিন মাসিকে প্রণাম করতে চায়। খানিক হাবার মত মুখ চাওয়াচাওয়ি বড় ঘরের আনাচে কানাচে তখনই ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, যখন পিঁড়ি হারিয়ে যায় আর খাবার টেবিলে যোগ হয় আরেকটা চেয়ার। বিরিয়ানীর প্যাকেটের সংখ্যাও বোধ হয় তখন বাড়তে দেখা যায়।
আমি ঠিক বলতে পারব না।
কারণ আমার চোখ এখনও আটকে আছে হাতা থেকে চলকে পড়া লাল ঝোলের দিকে।
আমার দৃষ্টি স্পষ্ট এখন। বুঝতে পারি, ওই লালে কোন শহীদ নেই।
আর টেবিল মুছতে এদেশে ন্যাকড়া লাগে, রক্তপতাকা নয়।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
অসমম্ভব সৎ একটি লেখা।অত্যন্ত জোরালো ভাবে মানবিক।