• আগুন দিনের সঙ্গী


    1    243

    October 24, 2017

     

    তরুণ সান্যাল

    সেই ১৯৪৯-৫০ সালের কথা৷ আমার বয়স তখন ষোলো সতেরো৷ বীণা সেন চৌধুরী ছিলেন আমার চেয়ে বছর দু-একের ছোট৷ আমি পড়তাম কলেজে আই এস-সি ক্লাসে৷ বীণা হরিসভা স্কুলের ক্লাস এইট-এ৷ সেই সময় থেকে তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব৷ বন্ধুত্বের সূত্রটি ছিল বিপ্লবী রোমান্টিকতা৷ দেশ বিভাজন ও তার সঙ্গী আমাদের নেতাদের শেখানো ‘ভুয়া’ স্বাধীনতা ছিল আমাদের বন্ধুত্বের ভিত্তি৷ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আসমুদ্র হিমাচল জুড়ে সেই যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণরোষ সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে সন্ত্রস্ত হয়ে ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা নাকি ভারতীয় হিন্দু-মুসলিম ‘সাচ্চা’ স্বাধীনতার বিরোধী নেতাদের হাতে বিভক্ত ভারতের ‘ভুয়া’ স্বাধীনতার চুষিকাঠিটি তুলে দিল৷ পর্দার আড়াল থেকে ভারতবর্ষ শাসন ও লুণ্ঠন চালিয়ে যাচ্ছে তারাই, এই ছিল আমাদের ধারণা৷ তখনকার দিনের কমিউনিস্ট পার্টি এমনই কথা আমাদের শিখিয়েছিলেন৷ বীণা সেই কথা বিশ্বাস করে সাচ্চা স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য লড়াইয়ে জীবন ও প্রাণ বাজি ধরেছিলেন৷ এইরকম ছিলেন তাঁর তরুণ কমরেডরাও৷ সৈয়দ আলী ইমাম, নীলকৃষ্ণ সেন, সুজিত ঘোষ, নারায়ণ রায়, দেবাশীষ দাশগুপ্ত, মহাতাবউদ্দীন, রফিক, বীণা ও আমি বর্ধমানে তরুণ কমিউনিস্ট ছাত্রদের ‘সেল’ সদস্য ছিলাম৷ আমাদের রাজনৈতিক কাজকর্ম দেখবার দায়িত্বে ছিলেন কমরেড সুশীল ভট্টাচার্য৷ নানা উপদেশ পাওয়া যেত কমরেড সাহেদুল্লাহ, কৃষ্ণ হালদার ও উপেন ভট্টাচার্যের কাছে৷ সে ছিল খুব গা-গরম-করা ঢাল তলোয়ারহীন লড়াই-খ্যাপা জনযোদ্ধাদের যুগ৷ ‘জেল মাঠ কারখানা একাকার/এক সাথে বন্ধন টুটবে’-র যুগ৷

    কৈশোরে বীণা কাঞ্জিলাল (ডানদিকে)

    বীণা এ আন্দোলনে কীভাবে এসেছিলেন? বীণার দিদি লীনা সেন চৌধুরী ছিলেন বর্ধমান মেডিকেল স্কুলের ছাত্রী৷ মমতা সেনের মত ডাক্তারি শাস্ত্র পড়া ছাত্রীদের সঙ্গিনী৷ এমনি ছিলেন ডা. রেবা গুপ্তাও৷ বীণা সম্ভবত লীনাদির ‘ছাত্রী সংঘ’-এর কাজকর্ম নজর করে দেখেছেন তখন৷ বীণা একটু আধটু ফরোয়ার্ড ব্লকের ছাত্র সংগঠনের দিকে প্রথম দিকে ঝুঁকেছিলেনও৷ বীণার ভেতরে ছিল এক শিল্পী ঘুমিয়ে৷ ইতিমধ্যে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণা থেকে সত্য ঘোষাল বর্ধমানে অন্তরীণ হয়ে এলেন৷ সত্য ঘোষাল ছিলেন সংস্কৃতিমনা কবিস্বভাবের কমিউনিস্ট৷ তাঁর সঙ্গে বীণার পরিচয় ঘটে৷ তারপর আর বীণা পিছনে তাকাননি৷ কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্য জীবন দেবার জন্যে তৈরি হয়ে গেলেন৷

    সে ছিল এক আশ্চর্য সময়৷ বাস্তুহারা আন্দোলন, কৃষক-ছাত্র-শ্রমিক আন্দোলনের এক রক্তক্ষয়ী যুগ৷ সে সময় তরুণ-তরুণীরাও অতি কাছাকাছি এসেও প্রেম বাতিকের থেকে ছিল অনেক দূরে৷ কয়েকজন তরুণ ছাত্রছাত্রী বর্ধমান শহরে কমিউনিস্ট পার্টিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল৷ শাহ আহমেদ-এর পর আমাকে বর্ধমান জেলা ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক করা হল৷ বর্ধমানের শ্যামসায়রের দক্ষিণ দিকে, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ঘরটির উল্টোদিকে ছিল ছোট্ট গলিতে ছাত্র ফেডারেশনের অফিস৷ শুরু হল পুলিসি হামলা৷ ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে ছাত্র ফেডারেশন বেআইনি ঘোষিত হবার পর, শুরু হল উল্টোদিকে নানা গরম কর্মসূচি আমাদেরও৷ রাস্তার মোড়ে মোড়ে সভা, কখনও টাউন হলে সভা৷ সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মদিন পালন করাও ছিল বেআইনি৷ বীণার সঙ্গে ঐ সভার উদ্যোগ নেওয়াতে আমিও গ্রেপ্তার হয়ে যাই৷ ১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসে আমার প্রথম কারাবাস৷ তারপর কয়েকবার জেল যাতায়াত করে ১৯৫০ সালের জুন মাসে একেবারে চোদ্দো জন গ্রেপ্তার হয়ে যাই৷ বীণাও ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতমা৷ বীণা ছিলেন অগ্নিবর্ষি বক্তা, ছাত্রী সংগঠক, ভাল পোস্টার লিখিয়ে, অকুতোভয় এবং যে-কোন সন্ত্রাসের মোকাবিলা করার জন্য তৈরি৷ দীর্ঘ অনশন ধর্মঘটের পর জেলের বাইরে এলে আন্ত্রিক ক্ষতের অসুখে যমে-মানুষে টানাটানির পর বীণা সেবার বেঁচে যান৷

    'পার্টি কর্মীদের বৈঠক' ছবি - সোমনাথ হোড়

    বীণার সঙ্গে ছিল আমার খুবই নিকট যোগাযোগ৷ একেবারে সহোদর-সহোদরার মত ছিলাম আমরা৷ আমার তখন একটি দু’টি কবিতা ‘পরিচয়’, ‘অগ্রণী’ প্রভৃতি পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে৷ বীণা সে-সব পত্রিকা দশজনকে ডেকে ডেকে পড়াতেন৷ বর্ধমান কুণ্ডুপুকুরের পাড়ে বীণার বাবা বঙ্কিম সেন চৌধুরীর বাড়িটি ছিল তখন আমাদের নানা বৈঠকের আস্তানা৷ এমনি মনে পড়ে ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা৷ বর্ধমান শহরের সব ছাপাখানাই দাঙ্গাবিরোধী হ্যান্ডবিল ছাপতে ইতস্তত করছে তখন৷ শেষে সৈয়দ সাহেদুল্লাহর মুসাবেদা করা হ্যান্ডবিলটি বীণাসহ আমাদের স্বাক্ষরিত হয়ে ছাপতে রাজি হল একটি ছাপাখানা৷ বর্ধমান শহরে তরুণ ছাত্রছাত্রীদের সেই দাঙ্গাবিরোধী অভিব্যক্তি এখনও মনে পড়ে৷ জেলখানা থেকে ছাড়া পাবার পর, রবীন্দ্র জন্ম উৎসব, নজরুল জন্ম উৎসব প্রভৃতি অনুষ্ঠানের প্রাণ ছিলেন বীণা৷ তাছাড়া বীণা নানা ধরনের বইপত্র পড়তে ভালবাসতেন৷ কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙারের স্ত্রী বিভা কোঙারও তখন নারী আন্দোলন গড়ে তুলছেন৷ বিভাদির সঙ্গে বীণা সহযোগিতা করতে থাকেন৷ বহু মহিলাকে তাঁরা সংগঠিত করতে সমর্থ হন৷ ১৯৫২ সালে আমি কলকাতা পড়তে আসি৷ সে বছর সাধারণ নির্বাচনে বর্ধমানের রাজাকে হারিয়ে বিনয় চৌধুরীকে জেতানোর কাজে বীণা ছিলেন প্রথম সারির কর্মী৷

    বর্ধমানে গেলে বীণার সঙ্গে প্রায়শই সাক্ষাৎ হত৷ বীণা গোপনে কবিতা-গল্প-কথিকা ইত্যাদি লিখতেন৷ পরে সেই গুণ রাঙাবেলিয়ায় থাকবার সময় মূর্ত হবার সুযোগ পায়৷ আসলে বীণা রাজনীতিতে এসেছিলেন সাহিত্য-সংস্কৃতির হাত ধরে মানুষকে কিছু দেবার জন্য৷ তার আর্ত অবস্থা দূর করবার জন্য৷ বীণা কখনও সুখ চাননি৷ বরং তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল সম্ভবত আনন্দ৷ নানা জিনিসপত্তর, তৈজস-বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদিতে মানুষের নাকি সুখের বিস্তার হয়৷ এসব বাইরের দিক, বহিরঙ্গের বিষয়৷ কিন্তু মানুষের অন্তরে এমন সুষমা থাকে, এমন আন্তর উৎস থাকে যা আনন্দের শিকড়৷ সে আনন্দ রূপ পায় গান-কবিতা-নানা শিল্পকর্মে৷ এমনকী বিপ্লব সাধনায়৷ বীণা সে আনন্দের স্বাদ পেয়েছিলেন৷

    ১৯৫৭ সালে যখন আমি রাইপুর-কাশিয়ারা বিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করি, বীণা ঐ স্কুলের রাস্তাতেই বাসে করে বেগুট স্কুলে পড়াতে যেতেন৷ ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবর্ষে ঐ স্কুলে বক্তৃতা দিতে যাই৷ রবীন্দ্রবিষয়ক৷ চমৎকার একটি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা বীণা করেছিলেন এবং তা সফল হয়েছিল৷ আমার প্রথম কবিতার বই ‘মাটির বেহালা’৷ বীণা ঐ বইটি প্রকাশের পর কী যে খুশি হয়েছিলেন, তা মনে করে এখনও স্মৃতিময় হয়ে উঠি৷ বীণা ও তুষার, এঁরা হয়ে উঠেছিলেন সমব্রতে ব্রতচারী, ‘মেড ফর ইচ আদার’। তুষারও আমার বাল্যবন্ধু৷ তাঁদের বিবাহের সংবাদে অত্যন্ত আনন্দ বোধ করেছিলাম৷

    ১৯৪০-এর দশকে বর্ধমান শহরে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির মিছিল

    বীণার সঙ্গে আমরা অনেকেই ঘর ছেড়েছিলাম৷ কারো ঘরে ফেরা হল৷ কেউ ফেরেনি৷ বীণা দশজনের ঘর গড়েছেন৷ আমি তা পারিনি৷ বীণা ও তুষার, আমার ‘অলটার ইগো’—? আমি তাঁদের জনব্রতী কর্মমহিমায় যখন আপ্লুত হয়ে উঠি, একটা কাঁটা বুকের মধ্যে খচ খচ করে৷ বোধ হয় ঈর্ষায়৷ কেন আমি বীণার এত আপনজন হয়েও, তুষারের নিকট বন্ধু হয়েও, তাঁদের নামের সঙ্গে আমার নামও যোগ হল না কেন? আসলে আমার মত মানুষেরা রোমান্টিক কাগজের ফুল, বীণা ও তুষার আসলে সত্যিই জীবনফলটি ধরে রাখার টাটকা তাজা ফুল৷ একজন চলে গেলেন৷ আরেকজনের শতায়ু কামনা করি৷ আসলে তাদের মধ্যেই তো আমাদের মত বহু অকৃতার্থ মানুষের স্বপ্ন রূপ পেয়েছিল৷

    ১৯৯৩ সালে আমার একটি কবিতার বই বেরোয়৷ ‘নাস্তিকের দেবী বন্দনা’৷ উৎসর্গ করেছিলাম ‘বীণা কাঞ্জিলাল, তুষার কাঞ্জিলাল’কে৷ মুখবন্ধে লিখেছিলাম ‘সুন্দরবনে বাঘের সাপের সঙ্গে বসত করে যাঁরা নতুন ভুবন ও দেবদেবী গড়ার কারিগর, সেই আমার বাল্য সখাসখী তুষার ও বীণা কাঞ্জিলালের হাতে বইটি দিলাম৷’

    কে বলে বীণা নেই৷ মানবিক গুণে সমৃদ্ধ মানুষ তো তার অভিজ্ঞতার অমৃতভাণ্ড অন্য মানুষের উন্মোচনের উপায় করে রেখে যায়৷ বীণা আমাদের অনেকের মধ্যেই তাঁর জীবনের মৃত্যুঞ্জয় অভিজ্ঞতা সঞ্চার করে গেছেন৷ বীণার সেখানেই অমরত্ব৷

    আরও অনেক কথা মনে পড়ছে৷ লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে৷ তবু, একটি কথা না বললেই নয়৷ বীণা ও তুষার দুজনেই মার্কসবাদে বিশ্বাসী হলেও, দুজনের দুপার্টির চোখে বিশ্ব ও ভারতের রাজনৈতিক মূল্যায়ন ছিল ভিন্ন ভিন্ন—ফলে রাজনীতি ও রণকৌশলও ছিল ভিন্ন৷ এতে বীণা ও তুষারের সংসারযাত্রা কখনও মলিন হয়নি৷ উপরন্তু, যে রাজনীতিক দলের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত বীণার সংযোগ ছিল, তার মতাদর্শের সঙ্গে আমারও সহমত্য ছিল না৷ এজন্য বীণার সঙ্গে আমার কখনও মনান্তর হয়নি৷ অবশ্য প্রথম পরিচয় থেকে আমরা পরস্পরকে আপনি করেই বলতাম৷ কিন্তু তুষারের সঙ্গে তুই তোকারি৷

    বীণা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাবার আগে, আমি ও আমার স্ত্রী কেয়া তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই৷ শরীরের রোগযন্ত্রণা চেপে রেখে তিনি হাসিমুখে আলাপচারী হলেন৷ তাঁর সংগৃহীত কিছু প্রত্নমূর্তি দেখলাম৷ খুশি মনে তিনি তাঁর বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখালেন৷ বলছিলেন, হাসপাতাল থেকে অস্ত্রোপচার শেষে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবার ইচ্ছার কথা৷ তাঁর অনেকগুলি কাজ নাকি বাকি ছিল৷ নিজ পরিবারের ভেতরে এবং তাঁর বহু মানুষ নিয়ে বৃহৎ পরিবারে৷ আশা করব, তাঁর সে সব ইচ্ছা যেন যথাশীঘ্র পূর্ণ হয়৷

    সবাই তো চিরটাকাল বেঁচে থাকে না সশরীরে৷ তবু বলব বীণা একটু আগেই চলে গেলেন৷ সেখানেই আক্ষেপ৷ বীণার কথা মনে করে একটি সনেট কল্প-কবিতা লিখেছি৷ এছাড়া আমি কীই-বা করতে পারি৷ মনে হয়, বীণা বেঁচে থাকলে কবিতাটি পড়ে খুশিই হতেন৷ বীণা তো নিজেও কবি ছিলেন!

    ১৯৯৭ সালের মে মাসে বীণা কাঞ্জিলালের স্মরণসভায় প্রকাশিত ‘স্মরণে’ পুস্তিকায় তরুণ সান্যালের লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

     
     



    Tags
     



    1 Comment

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics