আগুন দিনের সঙ্গী
1 243তরুণ সান্যাল
সেই ১৯৪৯-৫০ সালের কথা৷ আমার বয়স তখন ষোলো সতেরো৷ বীণা সেন চৌধুরী ছিলেন আমার চেয়ে বছর দু-একের ছোট৷ আমি পড়তাম কলেজে আই এস-সি ক্লাসে৷ বীণা হরিসভা স্কুলের ক্লাস এইট-এ৷ সেই সময় থেকে তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব৷ বন্ধুত্বের সূত্রটি ছিল বিপ্লবী রোমান্টিকতা৷ দেশ বিভাজন ও তার সঙ্গী আমাদের নেতাদের শেখানো ‘ভুয়া’ স্বাধীনতা ছিল আমাদের বন্ধুত্বের ভিত্তি৷ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আসমুদ্র হিমাচল জুড়ে সেই যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণরোষ সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে সন্ত্রস্ত হয়ে ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা নাকি ভারতীয় হিন্দু-মুসলিম ‘সাচ্চা’ স্বাধীনতার বিরোধী নেতাদের হাতে বিভক্ত ভারতের ‘ভুয়া’ স্বাধীনতার চুষিকাঠিটি তুলে দিল৷ পর্দার আড়াল থেকে ভারতবর্ষ শাসন ও লুণ্ঠন চালিয়ে যাচ্ছে তারাই, এই ছিল আমাদের ধারণা৷ তখনকার দিনের কমিউনিস্ট পার্টি এমনই কথা আমাদের শিখিয়েছিলেন৷ বীণা সেই কথা বিশ্বাস করে সাচ্চা স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য লড়াইয়ে জীবন ও প্রাণ বাজি ধরেছিলেন৷ এইরকম ছিলেন তাঁর তরুণ কমরেডরাও৷ সৈয়দ আলী ইমাম, নীলকৃষ্ণ সেন, সুজিত ঘোষ, নারায়ণ রায়, দেবাশীষ দাশগুপ্ত, মহাতাবউদ্দীন, রফিক, বীণা ও আমি বর্ধমানে তরুণ কমিউনিস্ট ছাত্রদের ‘সেল’ সদস্য ছিলাম৷ আমাদের রাজনৈতিক কাজকর্ম দেখবার দায়িত্বে ছিলেন কমরেড সুশীল ভট্টাচার্য৷ নানা উপদেশ পাওয়া যেত কমরেড সাহেদুল্লাহ, কৃষ্ণ হালদার ও উপেন ভট্টাচার্যের কাছে৷ সে ছিল খুব গা-গরম-করা ঢাল তলোয়ারহীন লড়াই-খ্যাপা জনযোদ্ধাদের যুগ৷ ‘জেল মাঠ কারখানা একাকার/এক সাথে বন্ধন টুটবে’-র যুগ৷
বীণা এ আন্দোলনে কীভাবে এসেছিলেন? বীণার দিদি লীনা সেন চৌধুরী ছিলেন বর্ধমান মেডিকেল স্কুলের ছাত্রী৷ মমতা সেনের মত ডাক্তারি শাস্ত্র পড়া ছাত্রীদের সঙ্গিনী৷ এমনি ছিলেন ডা. রেবা গুপ্তাও৷ বীণা সম্ভবত লীনাদির ‘ছাত্রী সংঘ’-এর কাজকর্ম নজর করে দেখেছেন তখন৷ বীণা একটু আধটু ফরোয়ার্ড ব্লকের ছাত্র সংগঠনের দিকে প্রথম দিকে ঝুঁকেছিলেনও৷ বীণার ভেতরে ছিল এক শিল্পী ঘুমিয়ে৷ ইতিমধ্যে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণা থেকে সত্য ঘোষাল বর্ধমানে অন্তরীণ হয়ে এলেন৷ সত্য ঘোষাল ছিলেন সংস্কৃতিমনা কবিস্বভাবের কমিউনিস্ট৷ তাঁর সঙ্গে বীণার পরিচয় ঘটে৷ তারপর আর বীণা পিছনে তাকাননি৷ কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্য জীবন দেবার জন্যে তৈরি হয়ে গেলেন৷
সে ছিল এক আশ্চর্য সময়৷ বাস্তুহারা আন্দোলন, কৃষক-ছাত্র-শ্রমিক আন্দোলনের এক রক্তক্ষয়ী যুগ৷ সে সময় তরুণ-তরুণীরাও অতি কাছাকাছি এসেও প্রেম বাতিকের থেকে ছিল অনেক দূরে৷ কয়েকজন তরুণ ছাত্রছাত্রী বর্ধমান শহরে কমিউনিস্ট পার্টিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল৷ শাহ আহমেদ-এর পর আমাকে বর্ধমান জেলা ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক করা হল৷ বর্ধমানের শ্যামসায়রের দক্ষিণ দিকে, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ঘরটির উল্টোদিকে ছিল ছোট্ট গলিতে ছাত্র ফেডারেশনের অফিস৷ শুরু হল পুলিসি হামলা৷ ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে ছাত্র ফেডারেশন বেআইনি ঘোষিত হবার পর, শুরু হল উল্টোদিকে নানা গরম কর্মসূচি আমাদেরও৷ রাস্তার মোড়ে মোড়ে সভা, কখনও টাউন হলে সভা৷ সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মদিন পালন করাও ছিল বেআইনি৷ বীণার সঙ্গে ঐ সভার উদ্যোগ নেওয়াতে আমিও গ্রেপ্তার হয়ে যাই৷ ১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসে আমার প্রথম কারাবাস৷ তারপর কয়েকবার জেল যাতায়াত করে ১৯৫০ সালের জুন মাসে একেবারে চোদ্দো জন গ্রেপ্তার হয়ে যাই৷ বীণাও ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতমা৷ বীণা ছিলেন অগ্নিবর্ষি বক্তা, ছাত্রী সংগঠক, ভাল পোস্টার লিখিয়ে, অকুতোভয় এবং যে-কোন সন্ত্রাসের মোকাবিলা করার জন্য তৈরি৷ দীর্ঘ অনশন ধর্মঘটের পর জেলের বাইরে এলে আন্ত্রিক ক্ষতের অসুখে যমে-মানুষে টানাটানির পর বীণা সেবার বেঁচে যান৷
বীণার সঙ্গে ছিল আমার খুবই নিকট যোগাযোগ৷ একেবারে সহোদর-সহোদরার মত ছিলাম আমরা৷ আমার তখন একটি দু’টি কবিতা ‘পরিচয়’, ‘অগ্রণী’ প্রভৃতি পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে৷ বীণা সে-সব পত্রিকা দশজনকে ডেকে ডেকে পড়াতেন৷ বর্ধমান কুণ্ডুপুকুরের পাড়ে বীণার বাবা বঙ্কিম সেন চৌধুরীর বাড়িটি ছিল তখন আমাদের নানা বৈঠকের আস্তানা৷ এমনি মনে পড়ে ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা৷ বর্ধমান শহরের সব ছাপাখানাই দাঙ্গাবিরোধী হ্যান্ডবিল ছাপতে ইতস্তত করছে তখন৷ শেষে সৈয়দ সাহেদুল্লাহর মুসাবেদা করা হ্যান্ডবিলটি বীণাসহ আমাদের স্বাক্ষরিত হয়ে ছাপতে রাজি হল একটি ছাপাখানা৷ বর্ধমান শহরে তরুণ ছাত্রছাত্রীদের সেই দাঙ্গাবিরোধী অভিব্যক্তি এখনও মনে পড়ে৷ জেলখানা থেকে ছাড়া পাবার পর, রবীন্দ্র জন্ম উৎসব, নজরুল জন্ম উৎসব প্রভৃতি অনুষ্ঠানের প্রাণ ছিলেন বীণা৷ তাছাড়া বীণা নানা ধরনের বইপত্র পড়তে ভালবাসতেন৷ কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙারের স্ত্রী বিভা কোঙারও তখন নারী আন্দোলন গড়ে তুলছেন৷ বিভাদির সঙ্গে বীণা সহযোগিতা করতে থাকেন৷ বহু মহিলাকে তাঁরা সংগঠিত করতে সমর্থ হন৷ ১৯৫২ সালে আমি কলকাতা পড়তে আসি৷ সে বছর সাধারণ নির্বাচনে বর্ধমানের রাজাকে হারিয়ে বিনয় চৌধুরীকে জেতানোর কাজে বীণা ছিলেন প্রথম সারির কর্মী৷
বর্ধমানে গেলে বীণার সঙ্গে প্রায়শই সাক্ষাৎ হত৷ বীণা গোপনে কবিতা-গল্প-কথিকা ইত্যাদি লিখতেন৷ পরে সেই গুণ রাঙাবেলিয়ায় থাকবার সময় মূর্ত হবার সুযোগ পায়৷ আসলে বীণা রাজনীতিতে এসেছিলেন সাহিত্য-সংস্কৃতির হাত ধরে মানুষকে কিছু দেবার জন্য৷ তার আর্ত অবস্থা দূর করবার জন্য৷ বীণা কখনও সুখ চাননি৷ বরং তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল সম্ভবত আনন্দ৷ নানা জিনিসপত্তর, তৈজস-বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদিতে মানুষের নাকি সুখের বিস্তার হয়৷ এসব বাইরের দিক, বহিরঙ্গের বিষয়৷ কিন্তু মানুষের অন্তরে এমন সুষমা থাকে, এমন আন্তর উৎস থাকে যা আনন্দের শিকড়৷ সে আনন্দ রূপ পায় গান-কবিতা-নানা শিল্পকর্মে৷ এমনকী বিপ্লব সাধনায়৷ বীণা সে আনন্দের স্বাদ পেয়েছিলেন৷
১৯৫৭ সালে যখন আমি রাইপুর-কাশিয়ারা বিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করি, বীণা ঐ স্কুলের রাস্তাতেই বাসে করে বেগুট স্কুলে পড়াতে যেতেন৷ ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবর্ষে ঐ স্কুলে বক্তৃতা দিতে যাই৷ রবীন্দ্রবিষয়ক৷ চমৎকার একটি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা বীণা করেছিলেন এবং তা সফল হয়েছিল৷ আমার প্রথম কবিতার বই ‘মাটির বেহালা’৷ বীণা ঐ বইটি প্রকাশের পর কী যে খুশি হয়েছিলেন, তা মনে করে এখনও স্মৃতিময় হয়ে উঠি৷ বীণা ও তুষার, এঁরা হয়ে উঠেছিলেন সমব্রতে ব্রতচারী, ‘মেড ফর ইচ আদার’। তুষারও আমার বাল্যবন্ধু৷ তাঁদের বিবাহের সংবাদে অত্যন্ত আনন্দ বোধ করেছিলাম৷
বীণার সঙ্গে আমরা অনেকেই ঘর ছেড়েছিলাম৷ কারো ঘরে ফেরা হল৷ কেউ ফেরেনি৷ বীণা দশজনের ঘর গড়েছেন৷ আমি তা পারিনি৷ বীণা ও তুষার, আমার ‘অলটার ইগো’? আমি তাঁদের জনব্রতী কর্মমহিমায় যখন আপ্লুত হয়ে উঠি, একটা কাঁটা বুকের মধ্যে খচ খচ করে৷ বোধ হয় ঈর্ষায়৷ কেন আমি বীণার এত আপনজন হয়েও, তুষারের নিকট বন্ধু হয়েও, তাঁদের নামের সঙ্গে আমার নামও যোগ হল না কেন? আসলে আমার মত মানুষেরা রোমান্টিক কাগজের ফুল, বীণা ও তুষার আসলে সত্যিই জীবনফলটি ধরে রাখার টাটকা তাজা ফুল৷ একজন চলে গেলেন৷ আরেকজনের শতায়ু কামনা করি৷ আসলে তাদের মধ্যেই তো আমাদের মত বহু অকৃতার্থ মানুষের স্বপ্ন রূপ পেয়েছিল৷
১৯৯৩ সালে আমার একটি কবিতার বই বেরোয়৷ ‘নাস্তিকের দেবী বন্দনা’৷ উৎসর্গ করেছিলাম ‘বীণা কাঞ্জিলাল, তুষার কাঞ্জিলাল’কে৷ মুখবন্ধে লিখেছিলাম ‘সুন্দরবনে বাঘের সাপের সঙ্গে বসত করে যাঁরা নতুন ভুবন ও দেবদেবী গড়ার কারিগর, সেই আমার বাল্য সখাসখী তুষার ও বীণা কাঞ্জিলালের হাতে বইটি দিলাম৷’
কে বলে বীণা নেই৷ মানবিক গুণে সমৃদ্ধ মানুষ তো তার অভিজ্ঞতার অমৃতভাণ্ড অন্য মানুষের উন্মোচনের উপায় করে রেখে যায়৷ বীণা আমাদের অনেকের মধ্যেই তাঁর জীবনের মৃত্যুঞ্জয় অভিজ্ঞতা সঞ্চার করে গেছেন৷ বীণার সেখানেই অমরত্ব৷
আরও অনেক কথা মনে পড়ছে৷ লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে৷ তবু, একটি কথা না বললেই নয়৷ বীণা ও তুষার দুজনেই মার্কসবাদে বিশ্বাসী হলেও, দুজনের দুপার্টির চোখে বিশ্ব ও ভারতের রাজনৈতিক মূল্যায়ন ছিল ভিন্ন ভিন্ন—ফলে রাজনীতি ও রণকৌশলও ছিল ভিন্ন৷ এতে বীণা ও তুষারের সংসারযাত্রা কখনও মলিন হয়নি৷ উপরন্তু, যে রাজনীতিক দলের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত বীণার সংযোগ ছিল, তার মতাদর্শের সঙ্গে আমারও সহমত্য ছিল না৷ এজন্য বীণার সঙ্গে আমার কখনও মনান্তর হয়নি৷ অবশ্য প্রথম পরিচয় থেকে আমরা পরস্পরকে আপনি করেই বলতাম৷ কিন্তু তুষারের সঙ্গে তুই তোকারি৷
বীণা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাবার আগে, আমি ও আমার স্ত্রী কেয়া তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই৷ শরীরের রোগযন্ত্রণা চেপে রেখে তিনি হাসিমুখে আলাপচারী হলেন৷ তাঁর সংগৃহীত কিছু প্রত্নমূর্তি দেখলাম৷ খুশি মনে তিনি তাঁর বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখালেন৷ বলছিলেন, হাসপাতাল থেকে অস্ত্রোপচার শেষে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবার ইচ্ছার কথা৷ তাঁর অনেকগুলি কাজ নাকি বাকি ছিল৷ নিজ পরিবারের ভেতরে এবং তাঁর বহু মানুষ নিয়ে বৃহৎ পরিবারে৷ আশা করব, তাঁর সে সব ইচ্ছা যেন যথাশীঘ্র পূর্ণ হয়৷
সবাই তো চিরটাকাল বেঁচে থাকে না সশরীরে৷ তবু বলব বীণা একটু আগেই চলে গেলেন৷ সেখানেই আক্ষেপ৷ বীণার কথা মনে করে একটি সনেট কল্প-কবিতা লিখেছি৷ এছাড়া আমি কীই-বা করতে পারি৷ মনে হয়, বীণা বেঁচে থাকলে কবিতাটি পড়ে খুশিই হতেন৷ বীণা তো নিজেও কবি ছিলেন!
১৯৯৭ সালের মে মাসে বীণা কাঞ্জিলালের স্মরণসভায় প্রকাশিত ‘স্মরণে’ পুস্তিকায় তরুণ সান্যালের লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Mon-ta bhore gelo…