প্রযুক্তির কর্মজগতে মেয়েরা এত কম কেন?
0 102নব্বই দশকের গোড়ার দিক। তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ফোরণ, বিশ্বায়ন ইত্যাদির ঢেউ এসে পৌঁছেছে এদেশে। বি.ই. (ব্যাচেলর অফ ইঞ্জিনিয়ারিং) –র ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রীটি ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিচ্ছে এক নামজাদা মুদ্রণ সংস্থায় ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি পদের জন্য। সেই সংস্থাটি তখনো কারিগরি পদে মেয়েদের দেখতে অভ্যস্ত নয়। মেয়েটিকে ইণ্টারভিউ বোর্ডে (প্রশ্নকর্তারা সবাই পুরুষ) প্রশ্ন করা হল,
‘মেয়ে হিসেবে শপফ্লোরে কাজ করতে কোনো অসুবিধে হবে না?’
মেয়েটি উত্তর দিল শপফ্লোরে কাজ করতে একটা ছেলের যদি কোন অসুবিধে না হয়, তবে তারও হবে না। কারণ কাগজের রিল টানা ইত্যাদি কায়িক শ্রমের কাজের জন্যে সে আসেনি। তার ভূমিকা হচ্ছে, মেশিনের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা আর সময়মত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এখানে ছেলে মেয়ের প্রশ্ন অবান্তর। নব্বইয়ের দশকে কিন্তু এই প্রশ্নগুলো উঠত, আর আজ, দু’ দশক পরেও ওঠে। তবে সংখ্যায় কম। হার্ডকোর ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে মেয়েদের কাজ করতে দিতে নিয়োগকর্তার অনীহা ছিল, তার সঙ্গে ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংকীর্ণ মানসিকতা। তাছাড়া হার্ডকোর ইঞ্জিনিয়ারিং, যেমন সিভিল বা মেকানিক্যালে মেয়ে চোখেই পড়ত না প্রায়। মেয়েদের বেশি দেখা যেত আর্কিটেকচার বা কেমিক্যালে। সেই সময়ে মেকানিক্যালে নব্বই জন ছেলের মধ্যে একটি মেয়ে টিমটিম করত। এই গল্পটা যে সময়ের সে সময় একটি বিখ্যাত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ারের কয়েকটি মেয়ে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ের বিষয়ে জানতে গেলে প্লেসমেন্ট অফিসার তাদের বলেছিলেন, ‘মা জননীদের তো দেখতে-শুনতে ভালই, চাকরি না খুঁজে চটপট বিয়ে করে নাও!’
মনে হতে পারে এখন অবস্থাটা বদলেছে বুঝি। এখন পশ্চিমবঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সংখ্যা পঞ্চাশের ওপরে, আর এখানে পড়ুয়ারাও অনেকে মেয়ে। পরিসংখ্যান নিয়েই দেখা যাক। ২০১৭ জে.ই.ই.-তে ১১ লাখ পরীক্ষার্থী ছিল, যার মধ্যে ৭২% ছিল ছেলে। আর ভর্তির নিরিখে ছেলে মেয়ের তফাতটা প্রায় ৪০%। মিনিস্ট্রি অব হিউম্যান রিসোর্সের হিসেব তাই বলছে। আর অল ইন্ডিয়া সার্ভে অন হায়ার এডুকেশনের তথ্য বলছে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হওয়া মেয়েরা ৩০%-ও নয়।
বিজ্ঞান শাখায় মেয়েদের সংখ্যা কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি। ২০১৪-১৫ সালে বি.এসসি-তে পড়তে আসা মেয়েরা ছিল ৪৭.৬%। ২০১৫-১৬ সালে এটা দাঁড়াল ৪৮%। তার মানে বলা যায় বিজ্ঞানে মেয়েরা প্রায় অর্ধেক আকাশ দখল করতে পেরেছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং সেন্টার বা টিউটোরিয়ালের সুবিধা কম। মেয়েদের নিরাপত্তা একটা বড় সমস্যা। আর তার থেকেও বড় সমস্যা সমাজের জগদ্দল মনোভাব যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতটা শুধু ছেলেদেরই।
আর এই নিয়েই তো সেদিন গুগলে হয়ে গেল মস্ত কাণ্ড। জেমস ড্যামর, গুগলের এক সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার, এক মেমো ইস্যু করলেন, যার নাম ‘গুগলস আইডিওলজিকাল ইকো চেম্বার’, যার বক্তব্য নিয়ে দুনিয়া তোলপাড়, এমনকি অবস্থা এমন দাঁড়াল যে সামাল দিতে গুগলের সি.ই.ও. সুন্দর পিচাইকে ছুটি কাটছাঁট করে ফিরে আসতে হল। কী এমন ছিল সেই মেমোতে? জেমস লিখেছিলেন, মেয়েদের স্বাভাবিক কিছু জৈব প্রবৃত্তির জন্য তারা সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে পিছিয়ে পড়ছে। এটাকে জেমস বলেছেন ‘নিউরোটিসিজম’, যার ফলে মেয়েরা নাকি দীর্ঘমেয়াদী নেগেটিভ স্টেটে থাকে।
জেমস ড্যামর কিন্তু এ ব্যাপারে পথিকৃৎ নন আদৌ। তাঁর বহু যুগ আগে ডিলনে বলে এক ফরাসি সাহেব একখানা চটি বই লিখে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন মেয়েরা শারীরবৃত্তীয়ভাবেই উচ্চশিক্ষার অনুপযুক্ত। তাঁর বই থেকে একটু নমুনা দেওয়া যাক,
১। পুরুষদের নিশ্বাস টানিবার ক্ষমতা অধিক, এবং তাহারা অধিক মাত্রায় অক্সিজেন গ্রহণ করে। তাহাদের নাড়ি যদিও স্ত্রী নাড়ির ন্যায় বেগগামী নহে কিন্তু তাহাদের শরীরের তাপ স্ত্রীলোক অপেক্ষা অধিক।
২। পুরুষের শরীর ও অস্থি স্ত্রীলোক অপেক্ষা আয়তনে অধিক সুতরাং তাহারা শ্রেষ্ঠ।
৩। মেয়েদের পা বেশি মাটির সঙ্গে মেশানো, পুরুষদের খড়ম-পা, সুতরাং পুরুষগণ শ্রেষ্ঠ।
এই ডিলনে সাহেবের বাঙালি একলব্য শিষ্য উনিশ শতকে কিছু কম ছিল না। তেমনি একজন জনৈক নীলকণ্ঠ মজুমদার ‘বেদব্যাস’ পত্রিকার ‘নারীধর্ম’ নামক প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘... প্রকৃত শিক্ষাও নারীর পক্ষে অমঙ্গলের কারণ। কেননা, ইহা দ্বারা নারীর পুত্র প্রসবোপযোগিনী শক্তিগুলির হ্রাস হয়। বিদুষী নারীগণের বক্ষদেশ সমতল হইয়া যায়, এবং তাহাদের স্তনে প্রায়ই স্তন্যের সঞ্চার হয় না।’
শুধু কি তাই? অঙ্ক আর বিজ্ঞানপাঠের ফলে মেয়েদের সাংঘাতিক সব অসুখ বিসুখ হয়, কেননা ‘...স্তন থাকা বশতঃ স্ত্রীজাতি পুরুষজাতি অপেক্ষা অধিক ভাবপ্রবণ হয়, তাই তীক্ষ্ণ জ্ঞানালোচনা স্ত্রীজাতির পক্ষে খাটে না।’
নীলকণ্ঠ মজুমদাররা যে অজর, অমর, অক্ষয় তা বিজ্ঞান, বিশেষত প্রযুক্তিতে মেয়েদের ভর্তি হওয়ার হার দেখলেই বোঝা যায়। যারাও বা ভর্তি হয়, শেষ অবধি টিকে থাকে ক’জন?
সমস্যাটা কোথায়? বেশিরভাগ শিল্পক্ষেত্রে এমন একটা নারীবিরোধী পরিবেশ থাকে যে মেয়েরা কাজ করার স্বাচ্ছন্দ্য পায় না। নিয়োগকারী সংস্থা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেডিজ টয়লেট বা ক্রেশের কথা ভাবতেই পারেন না। এই বিষয়ে হেলথ কেয়ার সেক্টরের শীর্ষস্থানীয় চারু সেহগলের কথা প্রণিধানযোগ্য। ‘ইন্ডাস্ট্রিতে তখনি মেয়েরা তাদের কর্মক্ষমতার পূর্ণ প্রয়োগ করতে পারবে যখন ইন্ডাস্ট্রি বুঝতে পারবে মেয়েদের মাতৃত্বকালীন সুবিধা, ক্রেশ ইত্যাদি রাখা মেয়েদের প্রতি দয়াদাক্ষিণ্য করা নয়, এটা সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি তাদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। এই মাইন্ডসেটটা তৈরি হয়নি বলেই ফুডকোর্ট বা রিক্রিয়েশন সেন্টারে যে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়, অথচ তার সামান্য ভগ্নাংশও ক্রেশ বা বেবিসিটিং পরিষেবার জন্য ভাবা হয় না। ছোট্ট গ্যারেজে বায়োকন নামক মহীরূহের বীজ বপন করেছিলেন যিনি সেই কিরণ মজুমদার শ, তিনি আবার অন্য একটি কথা বলেছেন। তাঁর সংস্থায় নারী পুরুষের বিভাজন নেই। প্রত্যেকে সমান সুযোগসুবিধা পান। যে মেয়েরা কাজ করতে আসেন তাঁরাও যথেষ্ট সপ্রতিভ। মুশকিল হল, তাঁদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি। অনেক মেয়ে সিনিয়র পোস্টের জন্যে আবেদনই করেন না।
তাহলে সমস্যাটা কি আরও গভীরে? আমাদের সন্ধান জারি থাকবে।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply