শেষযাত্রা
0 120১
তিনি একমনে ছবি আঁকছিলেন। ক্যানভাস জুড়ে শুধু নীল আর নীল। আকাশ আর সমুদ্র মিশে গেছে। তার মধ্যে দিয়ে একটা নৌকো চলছে। নৌকো না বলে কলার ভেলা বলাই ভালো। এই বিরাট সমুদ্রে তার কখন তলিয়ে যাবার কথা। তবু চলছে। তিনি নৌকোটার গায়ে বাদামী রঙের পোঁচ দিতে লাগলেন জোরে জোরে। না, না, নৌকোটাকে কিছুতেই ডুবতে দেওয়া যাবে না।
ক্যানভাসে যেমন, জানলার বাইরেও তেমন সমুদ্র, ঢেউয়ের পরে ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে। দূরে দূরে নৌকো, জাহাজও দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের ধারে মেলার মতো ভিড়। বড়াপাও-পাপড়িচাট-কুলপি-র পসরা। ঘোড়া নিয়ে দর কষাকষি। বেলুন কিনে দেবার জন্য মা’র হাত ধরে বাচ্চাদের ঝুলোঝুলি। জানলা দিয়ে দৃশ্যটা দেখে তাঁর হাত ক্যানভাসের ওপর থমকে গেল। ছোটবেলায়, খুব ছোটবেলায়, মা তাঁর হাত ধরে জুহু বিচে নিয়ে আসত। কিন্তু সেটা বিকেলে বা সন্ধে বেলা নয়, ভোররাতে। কার কাছ থেকে শুনেছিল নামী দামী ফিল্মস্টার আর প্রোডিউসাররা একটু নির্জনতার জন্য নাকি এই সময়টা হাঁটতে আসে বিচে। মা আসত তাদের এক ঝলক দেখার জন্য নয়, ফিল্মে একটা ব্রেক পাওয়ার জন্য। মা তখনও ভাবত মা আগের মতই সুন্দরী আছে। একটা, জাস্ট একটা ব্রেক পেলেই মাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। তখন জুহুতেই তাদের বিরাট বাংলো, বিদেশি গাড়ি, সুব্বু বিদেশে পড়াশোনা করবে। মা তাকে সুব্বু বলে ডাকত, বাবা’ই সুব্বু ডাকতে শুরু করেছিল প্রথম থেকে, বাবার দেখাদেখি মা। শুভলক্ষ্মী থেকে সুব্বু। শুভলক্ষ্মী নামটা অবশ্য সিনেমায় চলেনি। মেহেরা সা’বের কথাটা এখনও কানে বাজে - “ম্যায় কেয়া মিথোলজিকাল ফিল্ম বানাউঙ্গা যাঁহা হিরোইন কি নাম শুভলক্ষ্মী হোগি? আরে মেরে ফিল্মমে তো তুমকো বিকিনি ভি পেহননা হোগা। বিকিনি অউর শুভলক্ষ্মী – কভি নহি চলেগা। তুমহারি নাম হোনা চাহিয়ে কায়রা - ভেরি সেক্সি নেম, বিলকুল তুমহারি তরা...।”
এইভাবে শুভলক্ষ্মী নামটা হারিয়ে গেলেও সুব্বু রয়ে গেল সারাজীবন। বাবার ওই একটাই জিনিস মা ফেলে দেয়নি কক্ষনো। শুধু সুব্বু নামটা নয়, সুব্বুও তো বাবারই দান। বাবা ব’লে যে লোকটাকে জানেন তিনি, ফরম ভরার সময় কতবার লিখতে হয়েছে, শিবদাস আয়েঙ্গার। সেই শিবদাস, ললিতাকে একটা নয়, দু’-দু’টো সন্তান দিয়েছিল, জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে চলে গিয়েছিল প্রথম সন্তান, সুব্বুর দাদা। তার নাম রাখা হয়েছিল শিবললিত, শিবদাসের শিব আর ললিতার ললিত মিশিয়ে তৈরি সে নাম। শিবললিতকে সুব্বু দেখেনি, সে আসার আগেই চলে গিয়েছিল সেই ছেলে, আর সুব্বু হবার বছর খানেকের মধ্যে বাবা চলে গেল। মারা যায়নি, অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে ভেগে গেল। মা বলত মরে গেলেই ভাল হত এর চেয়ে। বাবা কিন্তু মরেনি। সেই শীলা বলে মেয়েটাকে ছেড়ে একটা কোংকনী মেয়ের সঙ্গে থিতু হয়েছিল শেষমেষ। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে আসত সুব্বুর সঙ্গে স্টুডিওয়। টাকা চাইত না, কিচ্ছু না। শুধু সুব্বু বলে ডেকে মাথায় হাত রাখত আর বলত নিজের টাকা পয়সার খেয়াল রাখতে, ললিতার ওপর সব ছেড়ে না দিতে।
সমুদ্রে আরও একটু নীল রং দিতে দিতে তাঁর আজ হঠাৎ মনে হল, বাবার বদলে মা যদি তাকে ছেড়ে চলে যেত, তাঁর জীবনটা একদম অন্যরকম হত। পালিয়ে যাবার মতো আশিক তো কম ছিল না মা’র জীবনে। কিন্তু মা তাদের কাউকে চাইত কি আদৌ? ফিল্ম ছাড়া মা’র মাথায় কোনওদিন কিছু ছিলনা। তাই অন্ধকার বিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত একটা ব্রেকের আশায়। সুব্বুকে একা রেখে যেতে হবে বলে সঙ্গে নিত। আর তাই অত ছোটবেলাতেও সুব্বু বুঝে গেছিল, সাধারণ চোখে যা সুন্দর লাগে, ফিল্ম লাইনে তার কোনও দাম নেই। শরীরের ধকটাই আসল এখানে, আর কচ্চি কলি হলে তো কথাই নেই। সুন্দরী হলেও তখন মা’র শরীরে এসব কোনওটাই ছিল না। দু’-দু’টো বাচ্চার জন্ম, অভাব, নিত্য অশান্তি মা’র সব গ্ল্যামার কখন যে শুষে নিয়েছিল, মা বুঝতেই পারেনি। অথচ সুব্বু , তখন মাত্র তিন-চার বছরের মেয়ে হলেও বুঝতে পেরেছিল মা কোনওদিন সিনেমায় চান্স পাবে না, বুঝে গিয়েছিল মা’র মুখের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া লোকজনের উপেক্ষার দৃষ্টি দেখে। ওইসময় কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে যেত বলে এমনিই তার ভাল লাগত না। আরও খারাপ লাগত তখন কোন বেলুনওলা থাকত না বলে। সে মনে মনে চাইত মা তাকে বিকেলে বা সন্ধের সময় বেড়াতে নিয়ে যাক, আর পাঁচটা বাচ্চার মতো সে যখন বেলুনের জন্য বায়না করতে পারে। বেলুন পায়নি সত্যি, কিন্তু সিনেমায় রোল পেয়েছিল। মা’র কোলে থাকা তার গাল টিপে একজন প্রোডিউসার বলেছিল তার পরের ফিল্মে এইরকম একটা বাচ্চার রোল আছে, ললিতা কি দেবে তার বাচ্চাকে?
তুলি থামিয়ে তিনি বাইরের দিকে তাকালেন। মুম্বইতে আটটা’র আগে সন্ধে নামে না। আকাশে এখনও অনেক আলো, সমুদ্র কী তীব্র নীল... হাওয়ায় একগোছা বেলুন উড়ছে। সব, সব আগের মতো আছে। শুধু তাঁর জীবনটাই এমন ঘেঁটে গেল কেন?
২
ফোনটা বাজছে। ঠিক বাজছে না, কাঁপছে। ভাইব্রেশনে দেওয়া আছে। আওয়াজটা শুনবেন না বলে ভাইব্রেশনে দিয়ে রেখেছেন। খুব মৃদু সরোদ বাজছে সাউন্ড সিস্টেমে। এ রাগটা তিনি চেনেন, মারুবেহাগ। ভালবাসার রাগ। আগে চিনতেন না কোনটা মারুবেহাগ, কোনটা দেশ, কোনটা কেদার। অবিনাশ চিনিয়েছে। ভালবাসার রাগ থেকে ভালবাসা – সব। ওই শিখিয়েছে কাজের সময় ক্লাসিকাল ইন্সট্রুমেন্টাল চালিয়ে রাখতে, এতে নার্ভ ঠান্ডা থাকে, কাজে মন বসে, স্ট্রেস কমে। স্ট্রেসের কারণগুলো জীবন থেকে ছেঁটে ফেলবেন বলেই তো এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে এসে উঠেছেন, রং-তুলি-গান আর খুব দরকারি জিনিসগুলো নিয়ে। এখন অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে বুঝতে পারছেন, জীবনে কোন কোন জিনিসগুলো সত্যি দরকারি। সারাজীবন তো মা চালিয়েছে, মা ঠিক করে দিয়েছে সব। নিজের সত্যি কী দরকার, কাকে দরকার, বুঝতেই পারেননি। মা যখন আর পারল না, প্যারালিসিসে শরীরের ডান দিকটা, এমনকি কথা বলার ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে গেল, ততদিনে তো ভিকি মালহোত্রা তাঁর জীবনে এসে গেছে। মা’র বদলে ভিকি ঠিক করত সব তাঁর জন্য। ছবি সাইন করা থেকে পার্টির পোশাক, ডায়েট চার্ট থেকে জিম রেজিউম সব। ওর ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছিলেন তিনি, কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, ভিকির জীবনটাই তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হতে শুরু করেছিল, এতটাই যে ও নিজের ১৪ বছরের বিবাহিত বউ, ফুটফুটে দুই ছেলেমেয়ে সবাইকে ছেড়ে তাঁর সাথে লিভ ইন করতে শুরু করল। মা তখন উঠতে পারে না, কথা বলতে পারে না, কিন্তু বুঝতে তো পারে সব কিছু। নিজের মেয়ে এভাবে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, সেটা একেবারেই মেনে নিতে পারছিল না। ওষুধ না খেয়ে, খাবার না খেয়ে, নানাভাবে জেদ অশান্তি করে প্রতিবাদ জারি রেখেছিল। বাধ্য হয়ে মা’কে ছেড়ে অন্য একটা ফ্ল্যাটে, মা’র চোখের আড়ালে থাকতে শুরু করলেন ভিকির সঙ্গে। সমাজ, তারকাদেরও সমাজ থাকে একটা, সেখান থেকে চাপ আসছিল। সবাই ভাবছিল কায়রা-র মাথা খারাপ হয়ে গেছে, নইলে কেউ ভিকি মালহোত্রার মতো ফ্লপ প্রোডিউসারের সঙ্গে জড়ায়। ভিকি তো স্রেফ চেনে টাকা, আগের বউটাও তো রাইজিং স্টার ছিল, সনিয়া কাপুর। ওর টাকা, শরীর, কেরিয়ার, সব ছিবড়ে করে এখন ভিকি কায়রা-র দিকে ঝুঁকেছে। এটাই ওর আসল ব্যবসা, সুন্দরী নায়িকাদের সিঁড়ির মতো ব্যবহার করা। এমনিতে তো একটা সিনেমাও চলে না...।
এসব বিষে মুম্বাইয়ের বাতাস ভারী হচ্ছিল যখন, ঠিক তখনই তিনি ভিকিকে বিয়ে করলেন। আর বিয়ের দিন রাতে, মা চলে গেল। সেটাও নিঃশব্দে নয়, মেয়ের উপেক্ষার প্রতিশোধ মা নিল সুইসাইড করে। একজন প্যারালাইজড মহিলা কীভাবে এত স্লিপিং পিল জোগাড় করতে পারে- সেটা নিয়ে গুজগুজ ফুসফুস চলতে চলতে পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছল। বলা হল পথের কাঁটা সরিয়ে দেওয়ার জন্যে মা’কে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে কায়রা আর ভিকি। খুন করার হলে মা’কে তো অনেক আগেই খুন করা উচিত ছিল তাঁর। করতে পারলে জীবনটা অনেক সুন্দর করে বাঁচা যেত। তাঁর জীবনের প্রথম, হয়ত একমাত্র প্রেমকে ওভাবে গলা টিপে মারতে হত না। শাওন কুমার, আসল নাম শ্রাবণ মুখার্জি, বাংলার ছেলে, তীব্রভাবে চেয়েছিল তাঁকে। পুণের এক মন্দিরে গোপনে বিয়েও হয়ে গিয়েছিল তাঁদের মালা বদল করে, মা ঠিক জেনে গেল। গুন্ডা বাহিনী নিয়ে হাজির হল মন্দিরে, শাওনকে খুনই করত, কায়রা মা’র হাতে পায়ে ধরে, বিয়ে ভাঙার প্রমিস করে শাওনকে বাঁচান। শাওন সেই নবলব্ধ জীবন নিয়ে আর তাঁর দিকে ফিরেও তাকায়নি, তিনি নানাভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। শাওন ফোন ধরেনি, দেখা হলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এক, সব পুরুষ এক। মেয়েদের মন ওরা বোঝে না। ওরা জানে শুধু মেয়ে শরীর আর নিজেদের ইগো। মা’র মৃত্যু নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছিল। নিচ থেকে ওপর সবার মুখ বন্ধ করতে অনেক টাকা খসল, অনেক টেনশন ছুটোছুটি। বিয়ের প্রথম বছরটা এইভাবেই কেটে গেল। যেই ভাবতে শুরু করলেন এবার একটু থিতু হয়েছেন, ভিকির ভালবাসায় বাকি জীবনটা শান্তিতে কেটে যাবে, তখনি ভিকি স্বমূর্তি ধরল। মদ, উঠতি নায়িকাদের কাজের টোপ দিয়ে ফস্টি নষ্টি, সবই তাঁর টাকায়। বাধা দিলে অকথ্য গালাগাল, এমনকি মারধোর। কিন্তু এত ঝড়ঝাপ্টার কোনও প্রভাব কায়রার কাজে পড়েনি। মা তার চারপাশে কেমন একটা বায়ুনিরোধক বর্ম তৈরি করে গেছিল, সেটা খুব কাজে লেগেছে সারাজীবন। এই যে এখন কোলাবা-র বাড়ি থেকে বেরিয়ে একা রয়েছেন, এখান থেকেই শুটিং এ যাচ্ছেন। এখন তো বেছে বেছে ছবি করা। খুব পাওয়ারফুল চরিত্র পেলে তবেই করেন। সেসব নিজেই সামলে নিচ্ছেন। কিন্তু ভিকির সঙ্গে আর নয়। এনাফ ইজ এনাফ। শুধু মেয়েটার জন্য বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা। এই মেয়েকে আঁকড়েই তো ভিকির সঙ্গে কাটালেন এতগুলো বছর। কিন্তু আর নয়।
ফোনটা আবার কাঁপছে, চিংকি, তাঁর মেয়ে ফোন করছে। ওর ভালো নাম তিনি রেখেছেন শুভলক্ষ্মী, তাঁর সেই হারিয়ে যাওয়া নামটা। নামটা যেন তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কোন দামী গয়নার মতো, যা কেবল একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে চলে যাবে, কিন্তু ব্যবহার হবে না। কারণ তিনি জানেন এই নামটাও বদলে যাবে, চিংকিও সিনেমায় নামছে যে। ওর বাবারই বিশেষ আগ্রহ। এতদিন কায়রার পয়সায় খেয়েছে, এবার কায়রার মেয়ের পয়সায় খাবে। চিংকিকে অনেক বুঝিয়েছেন তিনি, বলেছেন তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে আসতে। মেয়ে আসেনি। এখন কেন ফোন করছে? মা’কে কিসের দরকার?
৩
অবিনাশ বলেছিল আসবে দেখা করতে। তিনি বারণ করেছেন। অবিনাশকে দেখলে তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারবেন না। আর এই বয়সে সে ধাক্কা সামলাতে পারবেন? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অবিনাশকে ডেকে পাঠাবেন। ফোনটা তাঁকে খুব অস্থির করে দিয়েছে। অবিনাশকে সব বলা দরকার।
চিংকির ডেবিউ এ বছর শেষের দিকে, ওর অপোজিটে আছে শাওনকুমারের ছেলে অঙ্কিত। তাঁর আদৌ ইচ্ছে ছিল না চিংকি সিনেমায় নামুক। তিনি চেয়েছিলেন ও আগে পড়াশোনাটা শেষ করুক, ওর তো এখনও আঠারো’ই হয়নি। সেই চার বছর বয়স থেকে তিনি লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন শুনে আসছেন, এই ইন্ডাস্ট্রির হাড়হদ্দ জানেন। তাঁর কাছে খিদে একটা মোটিভেশন ছিল, কাজ না পেলে না খেয়ে মরতে হবে, চিংকির সামনে তো তা নেই, ওর মতো নরম আদুরে মেয়ে এই লাইনের ওঠাপড়া নিতে পারবে না। এই নিয়েই ভিকির সঙ্গে খিটিমিটি শুরু তাঁর। তাও হয়ত মেনে নিতেন, যদি না অঙ্কিতের অপোজিটে কাস্ট করা হত চিংকিকে। নিউকামার জুটিদের নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি নানা গসিপ বাজারে ছাড়ে ছবি হিট করাবার জন্য, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা সত্যি হয়ে যায়। রোমান্টিক সিন করতে করতে সত্যিকারের রোমান্সে জড়িয়ে পড়ে নতুন হিরো হিরোইন। হায় ভগবান! সেরকম যদি হয়! ওরা যে ভাইবোন! মন্দিরে বিয়ের আগেই শাওনের সন্তান এসেছিল তাঁর গর্ভে। মা যখন সব শেষ করে দিল, তখন জেদ করে শাওনের সন্তানকে অ্যাবর্ট করেননি কায়রা, আর সেই খবরটা শাওনের নিঃসন্তান স্ত্রী রীতার কানে পৌঁছয়। এক দুপুরে রীতা এসে তাঁর কাছে প্রায় ভিক্ষে চায় অনাগত সন্তানকে। তাঁকে বোঝায় একে বড় করে তুলতে গেলে সমাজ তাঁর বিরুদ্ধে থাকবে চিরকাল, তার থেকে শাওন আর রীতার বৈধ সন্তান হিসেবে বড় হোক সে। তিনি রাজি হয়ে জান, এর থেকে ভালো লালন তিনি কি দিতে পারতেন? সমস্ত পৃথিবী জানে অঙ্কিত শাওন আর রীতার ছেলে। শুধু তাঁরা তিনজন ছাড়া। আর মা জানত। ভিকিও না। জানলে হয়ত ওকে বোঝানো যেত।
চিংকি ফোন করে বলল,
-- মা আজ পার্টিতে কি পরে যাব?
সেই আদুরে গলা। এমনভাবে বলছে যেন কিছুই ঘটেনি, তিনি চলে আসেননি বাড়ি ছেড়ে। শুনে গলে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ মনটা কু গাইল,
-- কীসের পার্টি রে সপ্তার মাঝে?
-- অঙ্কিত থ্রো করছে মা, প্রাইভেট পার্টি
-- না
-- কী না?
-- ওখানে যেও না সোনা, আগে ছবি রিলিজ করুক, প্লিজ মা’র কথা শোন, প্লিজ চিংকি
-- কিন্তু মা
-- কোন কিন্তু না মা
-- আচ্ছা মা তুমি বারণ করলে যাব না, কিন্তু একটা ফোন বারবার আসছে দুবাই থেকে, একটা ওয়েডিং রিসেপশনে ওয়ান নাইট অ্যাপিয়ারেন্স। হিউজ পে করবে।
থরথর করে কেঁপে উঠল শরীর। দুবাই, ওয়েডিং রিসেপশন, ওয়ান নাইট অ্যাপিয়ারেন্স- এই শব্দগুলো ভীষণ চেনা। সারাজীবন কতভাবে মোকাবিলা করতে হয়েছে এগুলোকে। ভীষণ মা’র অভাব বোধ করলেন এই মুহূর্তে। মা বাঘিনীর মতো আগলে রাখত তাঁকে। আর তিনি এই সময় কেন যে চলে এলেন মেয়েটার পাশ থেকে? আসলে ভিকিকে আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। ও মেয়েটাকে শেষ করে দেবে। কে জানে ওই হয়তো ডিল করছে। পিম্প!
তিনি শক্ত গলায় বললেন,
-- ‘সোনা, যা বলছি মাথা ঠান্ডা করে শোন। এখন কোন পার্টিতে যেও না, যেই ডাকুক। আর ওই নম্বরটা দাও। লিখে নিচ্ছি।’
নম্বরটা লিখে অবিনাশকে ফোন করলেন কায়রা।
৪
সাদা ফুলে ঢাকা গাড়িটা জনসমুদ্রের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। পেছনের গাড়িতে কালো চশমায় চোখ ঢাকা চিংকি ভাবছিল মা’কে এত লোক ভালবাসত? মা তো সে হওয়ার পর দীর্ঘদিন কোনও ছবি সাইন করেনি, কিন্তু বারো বছর পরে যখন করল, সে ছবি সুপার ডুপার হিট। কী একটা যেন ছিল মার মধ্যে। যেমন অভিনয়, তেমনি সৌন্দর্য্য। সেই মা মাত্র পঞ্চান্ন বছরে চলে গেল! মেনে নিতে পারেনি ফ্যানেরা। একজন নাকি সুইসাইড করেছে। আচ্ছা, মা কি কিছু দেখতে পাচ্ছে? তাকে ঘিরে এই উন্মাদনা? এত লোকের ভালবাসা? যাকে এত লোক ভালবাসত, সে ভালবাসত তাকে, শুধু তাকে? কেমন অবিশ্বাস্য লাগে, অথচ কথাটা সত্যি। তাকে বাঁচাতেই তো চলে গেল মা। ওই অদৃশ্য হাতের বিরুদ্ধে আঙ্গুল যেই তুলবে, তাকেই সরিয়ে দেওয়া হবে। অবিনাশ আঙ্কল বলেছে সব তাকে। বাথটবে পড়ে থাকা নিস্পন্দ শরীর কাটাছেঁড়া করে কী পাওয়া গেছে, সেই তথ্য আর কক্ষনো সামনে আসতে দেওয়া হবে না, চিংকি জানে। আর শুধু দুবাই কানেকশন নয়, তার বাবা লোকটা, মানে ভিকি মালহোত্রা এর মধ্যে আছে। নইলে এত তাড়াতাড়ি ওরা মা’কে মেরে ফেলতে পারত না। অবিনাশ আঙ্কল তাকে বলেছে ‘তোমার মার শেষ ইচ্ছে শুধু সাদা ফুল নয়। তুমি জান কায়রা চায়নি তুমি সিনেমায় নামো। কিন্তু সে জানত একবার ঢুকলে এখান থেকে বেরোনো অসম্ভব, অনেকটা বাঘের পিঠে চড়ার মতো। তাই সে বারবার বলেছে চিংকি যেন নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়, কারো হাতের পুতুল হয়ে না থাকে।’
চিংকি চোখের জল মুছে মোবাইলে একটা ফোন করে। যাকে ফোন করছে, সে ঠিক তার পেছনের গাড়িতে সাদা পাঞ্জাবি পাজামায় আপাদমস্তক শোকের প্রতিমূর্তি হয়ে বসে আছে। সমস্ত মিডিয়ায় বিবৃতি দিয়ে চলেছে সে কতটা শোকার্ত কায়রাকে হারিয়ে। চিংকি ওর শোকের বুদবুদ এক লহমায় ফুটো করে দেয় একটা কথা বলে।
‘আপ মম কি ফিউনেরাল মে না যায়ে তো আপকে লিয়ে আচ্ছা হোগা। সবাই জেনে গেছে মম কীভাবে মারা গেছে। পাবলিক খুব ফিউরিয়াস হয়ে আছে। তোমাকে ওরা ছাড়বে না।’
সেদিন চ্যানেলে চ্যানেলে চর্চার বিষয় ছিল কায়রার শেষযাত্রায় ভিকির অনুপস্থিতি। মুখাগ্নির সময় চিংকির সঙ্গে অঙ্কিতও কেন এগিয়ে এসেছিল, সেটা নিয়েও জল্পনা কল্পনা চলছে। এটাও কি নতুন ছবির প্রমোশানের মধ্যে পড়ে? খানিকটা দূরে বসে থাকা অবিনাশের মনে হচ্ছিল, কায়রাকে কি এতদিনে একটু শান্তি দিতে পারল? আর ওই জনসমুদ্র, কলরব থেকে অনেক অনেক দূরে সমুদ্রের ধারে এক বৃদ্ধ, একা একা, একটার পর একটা রঙিন বেলুন আকাশে উড়িয়ে চলেছিলেন, আর বিড়বিড় করে কীসব বলছিলেন। কেউ যদি কান পাতত, তবে শুনতে পেত ‘সুব্বু, শুভলক্ষ্মী, মা আমার, তুই ছোটবেলায় যে বেলুনগুলো ওড়াতে চেয়েছিলি- নীল লাল, হলুদ, ববি প্রিন্ট- সমস্ত বেলুন তোর সঙ্গে দিয়ে দিলাম। এদের সঙ্গে তুই মনের আনন্দে উড়ে যা।’
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply