আবাহন ও বিসর্জন
0 135নারীবাদী হওয়া সতত মুশকিলের কাজ। লোকচক্ষুতে চিহ্নিত হওয়া, তা আবার এই সময়ে যখন যা কিছু ‘লিবারাল’ তাই সন্দেহজনক, মেনস্ট্রিম রাজনীতি থেকে শুরু করে সংখ্যাগরিষ্ঠের চোখে। এ অবস্থায় নড়ি চড়ি, আঘাত পাই, চুপ করে থাকি, মুখ খুলি না, আবার মুখ খুলিও... সুযোগ পেলে, অথবা সুযোগ করে নিয়ে। দুর্গাপূজার বৃহৎ ক্ষমতা আমাদের আরো বেশি করে নেড়েচেড়ে দিয়ে যাবার। তায় আবার দেবীটি নারীরূপিণী, সবাই মুহূর্মুহূ তাকে গড় করব, মা মা বলে কাৎরাবো, ভক্তি গদগদ হয়ে মাটন রোল আর মাংস লুচি খাব... তারপরো বাঙালির দুর্গাপুজো হিড়িকের মধ্যে মধ্যে ঢুকে থাকবে বাঙালি ঘরের মহিলাদের/মেয়েদের/বউদের/শিশুমেয়েদের লাঞ্ছনার গল্পগুলো, পণের জন্য মরবে সদ্যবিবাহিত মেয়ে, ছোট মেয়েশিশুর যৌনাঙ্গে ঢুকে যাবে কাচ, সারাশরীরে অসংখ্য সূচ নিয়ে মারা যাবে এক তিন বছরের বালিকা।
ইতিমধ্যে ঘটে যাবে আবার হাবিব কান্ড। হাবিবের দোকানের বিজ্ঞাপনের মিষ্টি কিউট মজার যে রূপ-গুলো দুর্গা-অসুর-কার্তিক-লক্ষ্মীদের, আমরা আশৈশব সেই কার্টুনায়িত ঘরের মেয়ে উমা ও তার ফ্যামিলিকে দেখে অভ্যস্ত, আজ কারা হাবিবের দোকানে গিয়ে কাচ ভাঙছে, হাবিব ক্ষমা চেয়ে বিজ্ঞাপন নামিয়ে নেওয়ার পরও, ভেবে এত আশ্চর্য হচ্ছি যে বলার নয়।
ক্রমাগত এমন চলেছে, গত কিছুদিনে ডায়েরিতে, লেখায়, নিজেদের সোশাল মিডিয়ার আলাপচারিতে কেবলই নানা ঘটনার প্রতিক্রিয়া লিখছি, উল্লেখ রাখছি বিশেষ বিশেষ মুহূর্তের। আর মনের ভাবনার। কখনো চমকাচ্ছি, কখনো আঁতকে উঠছি, রেগে উঠছি, হতবাক হচ্ছি।
এইসব ঘটমান ঘটনার মধ্যেই ঢুকে যাচ্ছে কলকাতা ও তার আশেপাশে দুর্গাপূজার মত এক ঘটমান চলমান কার্নিভালপ্রতিম সাংস্কৃতিক ঝড়। টাকার শ্রাদ্ধ, আলোর ঘুর্নি, ট্রাফিকের তছনছ।
এই কার্নিভালের ভাল-মন্দ দুইই বারবার উঠে আসে আমাদের মননে, কিন্তু কখনো অস্বীকার করা যায় না। বাঙালির অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক দুর্গাপূজা, তাইই এ অনস্বীকার্য। শুধু তাই না, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দিক থেকেও দুর্গাপূজার মান্যতা অন্য যে কোন পূজার চেয়ে অনেক বেশি। অন্যদিকে পুজোকে ঘিরে কত সাংস্কৃতিক কাজ। সাহিত্যের পূজাসংখ্যা বা শারদসংখ্যা, সারাবছরের এই সময়টার দিকে তাকিয়ে থাকার মরশুম। লেখক সারাবছরের শ্রেষ্ঠ লেখাটি তুলে দিচ্ছেন পাঠকের হাতে। এই সময়েই।
সেভাবেই গায়কের গান এক সময় ছিল এই সময়ের দিকে চেয়ে। এখন পুজোর আগে আগে রিলিজ হবার সিনেমাও নিতান্ত কম নয়।
এতসবের মধ্যে, পাড়ায় পাড়ায় অলিতে গলিতে ট্রাফিক বন্ধ করে ফেলে প্যান্ডেল খাটানোর অবাধ স্বাধীনতাসহ, পুজোর ক’দিন সারা কলকাতা অচল হতে দেখে রাগব আমি। পাশাপাশি অজস্র মফস্বলি মানুষের কলকাতায় পুজো দেখতে আসার হিড়িকে মুগ্ধ আর অবাক হব। আবার সেই সময়েই ফুচকার স্টল, চাউমিনের স্টল, খাবার বিক্রির আশায় থাকা গরিব বধূ বা মাসিমার ছোট ছোট উদ্যোগকে সেলাম দেব।
মানে, আগামী কিছুদিন আমি সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত থাকব। এই গালি দেব ব্যবসায়ীদের গড়ানো চব্বিশ কেজি সোনার শাড়িতে আবৃত প্রতিমা দেখতে যাওয়া মূর্খ মানুষকে, তো পরমুহূর্তে মুগ্ধ হব গ্রামের বন্যাপীড়িতের প্রতি হাত বাড়িয়ে দেওয়া ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলির ক্রিয়াকর্ম দেখে। বৃদ্ধাবাসে গাঁঠরি করে শাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসা মেয়েদের দিচ্ছি অজস্র শুভেচ্ছা। বাচ্চাদের জন্য জামা কিনে ছোট ইশকুলে দিয়ে আসছে যে গ্রুপ, তাদের দিচ্ছি আদর।
তার মধ্যে মধ্যে নস্টালজিয়ায় ভুগছি, ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে, প্রতি পুজোর সময় থেকে রোদ্দুরের রং ক্রমশ কমলাটে হয়ে আসার স্মৃতিতে ভারাতুর হচ্ছি। কাজে যেতে যেতে পথিপার্শ্বে দেখা কাশের বন দেখে আকুল হচ্ছি। জনমত সংগঠন করার চেষ্টা করছি শুধু বাঙালি না, ভারতের পূর্বীক্ষেত্রের সব
আমিষভক্ষণ-আসক্ত শক্তিপূজার প্রথায় দৃঢ় বিশ্বাসীদের। গোটা উত্তর ভারত নবরাত্রিতে নিরামিষ ভক্ষণ করবে বলে, বাঙালির নিরীহ এগরোলকেও ভিলেন বানাচ্ছে, হাসছে, দুয়ো দিচ্ছে, উশকে দিচ্ছে জঘন্য গালাগালিকে। সেটা জেনে স্তম্ভিত হয়ে বাঙালি বলছে, আমরা বাঙালি, আমরা সেকুলার, আমরা হিন্দু কিন্তু হিন্দুধর্মের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কারে বিশ্বাসী নই... আমাদের দর্শন আলাদা, সংস্কার আলাদা, আমরা পুজোতে সাঁটিয়ে বিরিয়ানি খাই... আমি সেদিকে তাকিয়ে ভাবছি, এত হইহই কেন, উড়িয়ারাও পুজো উপলক্ষ্যে মাংস খায়, চিঙড়ি আর পমফ্লেট মাছ চুটিয়ে রান্না হয় এই দশ বারো দিনের মধ্যেও... অসমিয়া হিন্দুরাই বা কোথায় আবার নিরামিশাষী হল। কামাখ্যায় ছাগবলি হয়, শক্তির পীঠে বলিপ্রথা তো আছে... এ কথা তুলতে না তুলতে কেউ কেউ বলছে সে তো নরবলি ও হত...বলিপ্রথা কি ভাল?
ভাল নয়, এত রক্ত কেন, এসব আমরা বলেছি, ধর্মের নামে পশুহত্যা ভাল নয় সে কথা বলার স্বাধীনতা আমার আছে, একইভাবে গোটা ভারতের বিভিন্ন অংশে হিন্দুদের প্রথাপালন পূজার পদ্ধতিতেও তফাত আছে, কত রকমের যে খাদ্যাভ্যাস, কত রকমের যে ধর্মানুষ্ঠান, এই বহুস্বরকে ত মান্যতা দিতেই হবে, সেটাও বলছি... বলেছি। বহুভাষার মত, ধর্মপালনের বহুত্বকে অস্বীকার করলে তার ফল হবে বিষময়, এ কথা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি মূলধারার কিছু সংখ্যাগুরু মত্তকে।
সবের পর, আবার ফিরে পড়েছি, স্বাধীনতা সংগ্রামের তুঙ্গমুহূর্তে অরবিন্দ ঘোষ নামক এক বহুভাষাবিদ, পন্ডিত, বিপ্লবী, মেধাবী ব্যক্তির আশ্চর্য দুর্গাস্তোত্র।
১৯০৯ সালে লেখা এ স্তোত্র পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী যুবকদের জপমন্ত্র। গীতা পকেটে নিয়ে মৃত্যুকে তুচ্ছ করা সশস্ত্র বিপ্লবী সেই যুবকেরা যারা আজকের আমাদের কাছে শুধু গল্পের বইয়ের চরিত্র। ১৯০৮-এ ঘটে গেছে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকির মিস-অ্যাডভেঞ্চার। কিংসফোর্ড হত্যার ষড়যন্ত্র করে ভুল করে অন্য গাড়িতে বোমা মারলেন। ব্যারিস্টার কেনেডির স্ত্রী ও মেয়ে মারা গেলেন। দীর্ঘ সেই আলিপুর বোমার মামলায় ধরা পড়লেন অরবিন্দ। অন্যতম ষড়যন্ত্রী হিসেবে। চিত্তরঞ্জন দাশকে পেলেন আইনজীবী হিসেবে। ১৯০৮ থেকে ১৯০৯ সলিটারি কনফাইনমেন্টে, একাকী জেলবাসে থাকতে হয়েছিল শ্রী অরবিন্দকে।
এই সময়ের লেখা দুর্গাস্তোত্রে, অরবিন্দ বলছেন, হে সিংহবাহিনী! তোমার শক্ত্যংশজাত আমরা বঙ্গদেশের যুবকগণ। আমরা প্রার্থনা করছি, ঊর বঙ্গদেশে, প্রকাশ হও। ঊর অর্থ এসো। কবি কল্পনায় শক্তিমূর্তি অনন্ত আশাপ্রদায়িনী। কিন্তু ভাষার ওজস্বিতা শ্রী অরবিন্দের এমনই, যে তিনি সে ভাষাকে কোথায় না নিয়ে যাচ্ছেন এ স্তোত্রে। সিংহবাহিনী মাকে বঙ্গদেশের যুবকেরা বলছে, জীবনসংগ্রামে ভারত সংগ্রামে তোমার প্রেরিত যোদ্ধা আমরা, তুমি আমাদের প্রাণে মনে অসুরের শক্তি দাও অসুরের উদ্যম দাও।
সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার যে মুহূর্তে এ লেখা লেখা হল, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, যতীন বাগচিদের আত্মদানের যে গৌরব তখন রচিত হচ্ছে, তখন, সাদাকালো, দৈবী শক্তি-আসুরিক শক্তির ভেদ মুছে দেওয়া এ লেখাকে কী বলব, কবির কল্পনা, নাকি আজকের ভাষায় সাবভার্শান। ধর্মকে ব্যবহার করার নানা ফন্দিফিকিরে আক্রান্ত আমরা আজকের পাঠক, এ লেখার একমুখী বিশ্বাসী আবেগী অভিঘাতের সামনে নতজানু হই তাই।
সেই ক্ষতবিক্ষত, নৈরাশ্যময় সময়ে, এই বাণী, এই আবাহন, বার বার দুর্গাকে বলছেন, এসো মা, এসো আমাদের মধ্যে, তোমার ছেলেদের শিখিয়ে দাও কীভাবে লড়াই করতে হয়। আর তারপর, বলছেন, একবার এস, তারপর আর চলে যেও না। “আর বিসর্জন করিব না” ... বারংবার দিচ্ছেন এই প্রতিশ্রুতি, আর সবশেষে, বলছেন, আমাদের সমস্ত জীবন অনবচ্ছিন্ন দুর্গাপূজা হউক।
এ শপথ, শক্তিকে ধরে রাখতে চাওয়ার এ স্বপ্ন, এ কি আমারও স্বপ্ন নয়?
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply