• আইনি লড়াই না 'নেমিং-শেমিং'? (২)


    0    344

    November 4, 2017

     

    দু-একটি সম্পাদকীয় বক্তব্য

    দিন দশ-পনেরো ধরে উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে একাধিক যৌন হেনস্থার অভিযোগ ও অভিযুক্তদের নামের তালিকা প্রকাশকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় চাপানউতোর চলছে। তবে আলোচনাই বলুন আর তরজাই বলুন প্রায় সবটাই চলছে ইংরেজিতে। ‘এবং আলাপ’-এর ব্লগে আমরা জ্ঞানের বণ্টন ও বিভিন্ন ভাষার মধ্যেকার এই হায়ারার্কি কিছুটা ভেঙে যৌন হেনস্থা নিয়ে জরুরি আলোচনার পরিসর বাড়াতে চাইছি বাংলা ভাষায়। আমরা সংগঠনগতভাবে ২০০৩ সালে থেকেই চেষ্টা করে আসছি বিভিন্ন ‘সচেতন নাগরিক’ কর্মশালার মাধ্যমে বাংলা মাধ্যমের স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ তৈরি করতে। গত ছ-মাস ধরে আমাদের নতুন ব্লগ ‘এখন আলাপ’-এ বাংলা ভাষায় জেণ্ডারকেন্দ্রিক লেখা প্রাধান্য পাচ্ছে। আমরা মনে করি আজকের বিশেষ ব্লগের বাংলা লেখাগুলো আরো অনেকের সাথে যৌন হেনস্থা বিষয়ে মত বিনিময় সম্ভব করবে।

    এটাও আমরা লক্ষ করেছি যে যৌন হেনস্থাকারীদের এই ক্রাউডসোর্সড তালিকাকে ঘিরে পক্ষে-বিপক্ষে মত বিভাজন মূল সমস্যার জায়গাগুলো থেকে আমাদের সরিয়ে দিচ্ছে অনেকটাই এবং এর ফলে কতগুলো খোপ তৈরি হচ্ছে—যেমন, ‘নবীন-প্রবীণ’, ‘সুপরিচিত-স্বল্পপরিচিত’, ‘দলিত-উচ্চবর্ণ’ ইত্যাদি। আলোচনাগুলো এতটা কোটরবন্দি হয়ে পড়লে সমস্যার অতিসরলীকরণ আর কে কত পয়েন্টে কার থেকে এগিয়ে সেই তরজা চলতেই থাকবে। আমাদের এই উদ্যোগ ‘আমরা-ওরা’ ছকে বিতর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নয়, বরং এই তরজার ঊর্ধ্বে উঠে যৌন হেনস্থার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিভিন্ন পন্থা ও মতামতকে এক জায়গায় নিয়ে আসা।

    এই ব্লগের লেখকদের বয়স, সামাজিক অবস্থান, পেশা, মতামতে বৈচিত্র আছে, আবার মিলও পাওয়া যেতে পারে কিছু। শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা সম্পর্কে এঁদের কারোর মতামতই ‘এবং আলাপ’-এর সাংগঠনিক মত নয়। দশজন লেখকের মধ্যে তিনজন ‘এবং আলাপ’-এর সদস্য হলেও তাঁদের মতামত সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত।  

    পাঠক চাইলে যে কোনো লেখা অনুবাদ করে প্রচার করতে পারেন, অবশ্যই লেখক ও ‘এবং আলাপ’-এর স্বীকৃতিসহ। প্রথম পর্বে প্রকাশিত হয়েছে সাতটি লেখা। দ্বিতীয় পর্বে প্রকাশিত হলো বাকি তিনটি।

     

    নারী আন্দোলনে বারবার জোর দেওয়া হয়েছে টেস্টিনিয়ালের উপর

    রুচিরা গোস্বামী, অধ্যাপক ও আন্দোলনকর্মী 

    গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে ‘তালিকা’র প্রকাশ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে, এবং এখনও চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, আমি সেখানে একদিক থেকে আউটসাইডার যেহেতু আমি ফেসবুক করি না। ফলত এই বিতর্ক যে সময় ধরে ক্রমশ দানা বেঁধেছে, আমি জানতে পেরেছি তার বেশ কিছুদিন পরে। বিতর্কে অংশ নেওয়া বিভিন্ন মানুষের নানান মতামত পড়ে। কিন্তু আবার একইসাথে আমি ইনসাইডারও বটে, কারণ একজন নারীবাদী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে আমার কাছে গোটা ঘটনাটা খুবই ইন্টারেস্টিং লেগেছে।

    ফেসবুক বা অন্য কোনও সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ক্যাম্পেন চালালে আদতে তা কত মানুষের কাছে পৌঁছয়, বা সংখ্যায় বেশি হলেও সেই মানুষগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একই পরিসরে ঘোরাফেরা করে থাকেন—যে কোনো অনলাইন প্রচারাভিযান নিয়ে আমার ব্যক্তিগত এই জাতীয় সমালোচনা থাকলেও এই ‘তালিকা’র প্রকাশ ও তারপরের বিতর্ক পড়ে আমার মনে হয়েছে, এটা কোথাও প্রবীণ ও নবীন প্রজন্মের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব-বিরোধের আকার নিয়েছে। তালিকার পক্ষে একজন যেমন লিখেছেন, আমরা আরও অনেক বড় ঝুঁকি নিচ্ছি। এবং একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই, এঁরা সত্যিই ঝুঁকি নিয়েছেন। যে কারণে ‘কাফিলা’য় প্রকাশিত বিবৃতি অনেকেরই পৃষ্ঠপোষকসুলভ মুরুব্বিয়ানা মনে হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার তেমনটা মনে না হলেও আমি ‘তালিকা’ নামিয়ে নেওয়ার আবেদনের ঘোর বিরোধী।

    আইন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো এবং বিভিন্ন নারীবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে একথাও জানি যে আইনব্যবস্থা সত্যিই ব্যর্থ। তরুণ প্রজন্মের মেয়েরা আইনব্যবস্থার উপর আর ভরসা রাখতে পারছেন না। কারণ আমরা বহু ক্ষেত্রেই দেখেছি, নিগৃহীত মেয়েরা সুবিচার পায় না। আমার মনে হয় আমাদের দেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাস মাথায় রেখে আমাদের এই দুই প্রজন্মের বিরোধকে বুঝতে হবে। কারণ আমাদের আগে বা আমাদের সময়ে নারী আন্দোলনের প্রধান একটি অ্যাজেণ্ডা ছিল, আইন ও আইনি ব্যবস্থার মধ্যে বদল আনতে হবে। এখনকার প্রজন্ম আর আইনি প্রক্রিয়ার উপর ভরসা রাখতে পারছেন না, কারণ দেশের আইনি কাঠামো তাঁদের সামনে এইধরনের অভিযোগের বিচারপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কোনও উদাহরণ তৈরি করতে পারেনি। ফলত তাঁরা #MeToo  পোস্ট দিয়ে নিজেদের নিগ্রহের কথা লিখছেন, এবং সেভাবেই একধরনের সিস্টারহুড তৈরি হচ্ছে, যা নারী আন্দোলনের শুরুর দিকেও হয়েছিল। একদল মেয়ের দীর্ঘদিনের চেপে রাখা ক্ষোভ, অপমান, ‘সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া’র প্রহসনে পরিণত হওয়ার প্রতি রাগ—সব মিলিয়ে এই অনুভূতিগুলোই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এসেছে। 

    কিন্তু এর ফলে যে পুরুষদের বিরুদ্ধে আগেই অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে/তদন্ত চলছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাদের নামের পাশে এমন অনেকের নাম দেখা যাচ্ছে যাদের নামে আগে কখনও কোনো অভিযোগ আসে নি। তাই আমাদের ভাবতে হবে এ ব্যাপারে একটু সতর্ক কী ভাবে হওয়া যায়!

    আমরা জানি এই ধরনের যৌন হেনস্থার ঘটনায় প্রমাণ বা সাক্ষী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে না। নারী আন্দোলনে এ কথাটা বারবার উঠে এসেছে এবং জোর দেওয়া হয়েছে টেস্টিমনিয়ালের উপর। আমার মতে মেয়েদের নিজেদের টেস্টিমনিয়াল প্রকাশ করা দরকার। নামের তালিকায় যা প্রকাশ পায় না, টেস্টিমনিয়ালে সেই কষ্ট-রাগ-ক্ষোভ অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিলে আরও বেশি মেয়েরা এই আলোচনায় অংশ নিতে পারবে, নিজেদের উপর হওয়া নিগ্রহকে চিহ্নিত করতে পারবে।   

    আমার মনে একটা আশঙ্কার সম্ভাবনাও প্রবল হয়ে উঠছে। ‘এরপর কী?’ প্রশ্নের উত্তরে আমি নতুনদের কাউকেই কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা বলতে শুনিনি। তাই আমার চিন্তা হচ্ছে, অন্যান্য স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মত এটাও পথ হারাবে না তো? যাঁরা ‘তালিকা’ প্রকাশ করেছেন বা তাতে নাম পাঠিয়েছেন, এমনটা হতেই পারে যে তাঁরা এরপর কি করবেন ভাবেননি, কিন্তু ভবিষ্যতের পরিকল্পনা না থাকলে এই গোটা বিষয়টাই লঘু হয়ে যাবে না তো? নাহলে ‘হোক কলরব’-এর মত সমাজে প্রভূত আলোড়ন তৈরি করার পরও লিঙ্গন্যায়ের ক্ষেত্রে আশাভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।      

     

    সবটাই প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার শিক্ষা কি আমরা নারীবাদী ধারাগুলোয় পেয়েছি?  

    শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত, লেখক-গবেষক ও আন্দোলনকর্মী 

    রায়া সরকারের ক্রাউডসোর্সড লিস্টকে কেন্দ্র করে যখন সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম, তার কিছু দিন আগে থেকেই দেখছি রায়ার প্রজম্নেরই একটি মেয়ে তার বাবাকে নিয়ে, তাদের বাড়ির মধ্যে প্রতিদিনের গার্হস্থ্য হিংসা নিয়ে খোলাখুলি লিখছে। আমি এখানে রাতুলা সাহার বাবার-হাতে-মার-খাওয়া ছবিসহ পোস্টটির কথা বলছি না কিন্তু যেটা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইদানিং মাঝেমাঝেই দেখি ২০-২৫ বছরের মেয়েরা তাদের পরিবারের মধ্যেকার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখছে। নিজের নাম ও পারিবারিক পরিচয় গোপন না রেখে, অত্যাচারি বাবা/কাকা সম্পর্কে একদম অকপটে তারা লেখে। লেখে মুখ-বুজে-মেনে-নেওয়া মা ও পরিবারের অন্যান্য মেয়েদের কথা। যে মেয়েরা লিখছে তারা সম্ভবত এখনও ছাত্রী অথবা সদ্য পাশ করেছে, এবং তারা হয়তো আর্থিক বা অন্যান্য কারণে এখনও পারিবারিক চৌহদ্দির মধ্যেই বাস করে। নিজেদের আলাদা বাসস্থান, ভালো চাকরি, পায়ের তলায় শক্ত জমি পেতে এখনও বাকি এদের। তবু যে ছাদের তলায় থাকছে, সেখানকার ‘ঘরোয়া’ কথা এই সাহসী মেয়েরা নিজেরা লিখছে প্রকাশ্যে। এটা করতে কত বড় বুকের পাটা লাগে তাই ভাবছি। এধরনের পোস্টগুলো আমাকে ব্যক্তিগতভাবে নাড়া দিয়ে যায় অনেক বেশি কারণ স্বনামে নিজের পরিবারের মধ্যেকার হিংসা নিয়ে লেখাটা বোধ করি সবচেয়ে কঠিন। এই পোস্টগুলো নিয়ে হই চই হয় না কারণ যে লিখেছে সেই মেয়েটি ও তার বাড়ির লোকেদের ছাড়া আর কারো বিশেষ কিছু যায় আসে না।

    ফেসবুকে পোস্ট করা ওই ক্রাউডসোর্সড লিস্টকে ঘিরে বাদানুবাদ চলবেই কারণ অনেক পাবলিক ফিগার-এর নাম তালিকায় আছে এবং যাঁরা নামগুলো পাঠিয়েছেন তাঁরা এখনও সুজেট জরডান বা ক্রিস্টিন ফেয়ারের মতো সাহস সঞ্চয় করে নিজমুখে নিজ পরিচয় দেন নি। নিশ্চয়ই তাঁদের বেশিরভাগের মধ্যে তীব্র বিপন্নতার বোধ কাজ করছে, তাঁরা সেফ স্পেস পাচ্ছেন না, সেইজন্যেই দেন নি।

    এখন কথা হলো যে ৮০-৯০ জন মহিলার অভিযোগের ভিত্তিতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ওই লিস্ট তৈরি হয়, যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনার ক্ষেত্রে তাদের চাইতে শতগুণ বেশি বিপন্ন বোধ করেন আমাদের দেশের অধিকাংশ উচ্চশিক্ষার্থী মেয়েরা যাঁরা শ্রেণিগত, জাতপাত ও সম্প্রদায়গত বহূ বাধা অতিক্রম করে কলেজে পৌঁছোন এবং যাঁরা ইংরেজি মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা করতে অভ্যস্ত নন। এই কথাটা নানা বিতর্কের মধ্যে একেবারেই তলিয়ে যাচ্ছে দেখছি।

    এক পক্ষ বলেছেন যৌন হয়রানির সব অভিযোগ সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে জানানো উচিত। কথাটার সঙ্গে নীতিগতভাবে আমি একমত। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনের মধ্যে যে অসংখ্য মেয়েরা নানা মাত্রার যৌন হেনস্থার শিকার হয়, তাদের অনেকের কলেজেই একটা sexual harassment complaints committee  পর্যন্ত নেই! হ্যাঁ, UGC mandate থাকা সত্ত্বেও কমিটি নেই।

    একটু আগেই আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হচ্ছিল হুগলির একটি কলেজের এক অধ্যাপকের। তিনি বলছিলেন তাঁদের কলেজ প্রিন্সিপালকে এ নিয়ে কয়েকবার বলা সত্ত্বেও ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এ কলেজগুলো দিল্লি বা অন্যান্য বড় শহরের নামকরা কলেজ নয় বলে কি আমাদের ধর্তব্যের মধ্যেই নয়? অথচ এ সব জায়গাতেই কিন্তু পড়তে আসে নানাভাবে প্রান্তিক মেয়েরা –যে মেয়েদের কাছে ক্রাউডসোর্সড লিস্টে অভিযোগ পাঠানোর রাস্তাটুকু বহূ দূরের।

    যেখানে কমিটিই নেই, সেখানে পড়ুয়ারা অভিযোগ জানাবে কোথায়? থানায় গিয়ে? আর যেখানে যেখানে কমিটি আছে সেসব কমিটির বেশিরভাগ সদস্যেরই জেণ্ডার বা সামাজিক লিঙ্গ নির্মাণ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। তাহলে কাজটা হবে কীভাবে? আর যে ভুরি ভুরি কলেজ ঝপ করে একটা কমিটি ও একটা-দুটো জেণ্ডার সেমিনার করে নেয় NAAC আসার ঠিক আগে আর NAAC –এর রিপোর্ট কার্ডে স্টার পাওয়ার পর বেমালুম ভুলে যায় জেণ্ডার বলে আদৌ কিছু আছে, ছাত্রীছাত্র/শিক্ষাকর্মী/শিক্ষিকারা সেখানে কতটা ন্যায়বিচার পেতে পারে?

    UGC mandate সত্ত্বেও সারা দেশে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কমিটি তৈরি করে নি এবং সেই কমিটির কাজ সম্পর্কে প্রচার করে নি, তাদের পাল্টা লিস্ট তৈরি করে কীভাবে চাপ দেওয়া যায় সেটা নিয়ে দেশের সেরা কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত আমাদের নারীবাদী বন্ধুরা একটু ভাববেন কি?

    সব নিয়মকানুন মেনে যেসব কমিটি তৈরি হয়, সেখানে কয়েকজন অধ্যাপক, শিক্ষাকর্মী, ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়াও একজন NGO  প্রতিনিধি থাকার কথা যিনি এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। সেরকম দু-একটি কমিটিতে থাকার সুবাদে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো বিধি মেনে NGO  প্রতিনিধিকে রাখা হলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের internal ও external অ্যাকাডেমিক সদস্যদের ক্ষমতা ও নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ এত বেশি যে তাঁদের মতামতের কাছে NGO  প্রতিনিধির মত তেমন গুরুত্বই পায় না! গুরুত্ব পাওয়াতে গেলে note of dissent দিতে হয়! কোন অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তিনি কত বড় পণ্ডিত এবং কত ভালো পড়ান সেটা বারবার নানাভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়! আমার মতো একজন জাঁদরেল মধ্যবয়সিরও যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের sexual harassment complaints committee –তে বসে এরকম অস্বস্তি হয়ে থাকে, তাহলে কমিটিগুলোর ছাত্র প্রতিনিধিদের অভিজ্ঞতা সাধারণত কীরকম সেটা জানার কোনো চেষ্টা আমরা করতে পারি কি?

    কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরগুলোতে যদি নারীবাদী ছাত্রীছাত্ররা ইনফরমাল সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি করে সারা বছর সক্রিয় থাকে, কথা বলবার/ আদানপ্রদানের একটা সেফ স্পেস সৃষ্টি করে, তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক কমিটিগুলোর বাইরেও যৌন হেনস্তা মোকাবিলার আরো অনেক রাস্তা বেরোতে পারে। সবটাই প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার শিক্ষা কি আমরা নারীবাদী তত্ত্ব ও ইতিহাসগুলোয় পেয়েছি? 

    ফেমিনিজম আমাকে বিপদে ফেলেছে আজ!!!

    সুমিতা, কুইয়ার নারীবাদী কর্মী 

    আমি অ্যাকাডেমিয়ার অংশ নই কোনোভাবেই। তবু রায়া সরকারের হল অফ শেমের লিস্ট নিয়ে কিছু কথা বলতে চাইছি। প্রথম যখন লিস্টটা দেখেছিলাম, যে অনুভূতি ভিতরে এসে ধাক্কা দিয়েছিল, তা ভয়। ভয় হয়েছিল যে চারপাশের কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা বুঝি ভেঙ্গে পড়তে চাইছে। আমি কিছুটা পুরনো ধাঁচের মানুষ যারা ‘শিক্ষা’ তারপর ‘শিক্ষক’ এইসব শব্দগুলোকে কিঞ্চিৎ মর্যাদা দিয়ে থাকে। এই লিস্টে এমন কিছু মানুষের নাম দেখলাম যারা আমার কাছ থেকে সরাসরি সেই মর্যাদার প্রাপক।

    এই যুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তি দেওয়া খুবই সহজ। কারণ আমার অস্বস্তির কোনো যুক্তিই নেই আসলে। এটা একধরনের আবেগমাত্র। চারপাশের নানা ভঙ্গুর অস্থায়ী অপস্রিয়মাণ অধরা অবস্থানের মধ্যে ভাসতে ভাসতে একটা খুঁটি ধরার চেষ্টা কেবল। নিজেই নিজের এই নেই-আঁকড়েপনা দেখে হেসেছিলাম।

    তারপর তো কতই জল গড়াল। দুনিয়ার ফেমিনিস্ট এক হও-এর বদলে নানাবিধ ভাঙচুর হল। প্রমাণ ও পদ্ধতিগত নানা প্রশ্ন উঠল। উইচ-হান্টিং ও কোল্যাটেরাল ড্যামেজ নামক নানা শব্দ জল ঘোলা করল। আজ ২ নভেম্বর ২০১৭ আরেকটি লিস্ট বেরিয়েছে দেখলাম। আরও কিছু নাম, কিছু ঘৃণা, কিছু অসহায়তা, রাগ...

    এক বন্ধু বলছিলেন আমরা কি অনৈতিক সম্পর্ক, অনিচ্ছুক সম্পর্ক, জোর খাটানো ইত্যাদিকে একইভাবে বুঝছি? ‘কনসেন্ট’কে কীভাবে দেখছি আমরা, যেখানে ক্ষমতার তারতম্য একটা খুব বড় ভূমিকা পালন করছে? 

    ১৯৯৩ থেকে ’৯৪ পর্যন্ত আমাকে কর্মক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে একজন পুরুষের যৌন আগ্রাসনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। কখনই স্পষ্ট করে ‘না’ বলিনি, বলতে পারিনি। সম্ভবত চাইওনি। এর বিনিময়ে আমি কাজের সুরক্ষা পাচ্ছিলাম। যেটা সেদিন আমার জন্যে খুবই জরুরি ছিল। আমি জানতাম ওই বিপুল ক্ষমতাবান পুরুষটি আমার শরীর ব্যবহার করছে। এবং আমিও আমার শরীর ব্যবহার করতে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত করছি। কনসেন্ট আছে বলেই মনে হয়েছিল সে সময়ে তবে বছরখানেকের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা এমন পর্যায়ে যায় যে কাজ এমনিতেই বন্ধ হয়ে যায়। এই ঘটনার কোনও প্রমাণ আমার হাতে নেই। এই মানুষটির নামসহ ঘটনার বিবরণ, সালতারিখ জানিয়ে হল অফ শেমে পাঠিয়েছি। আমি কোনও আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবিনি। কেবল নামটা হল অফ শেমে দেখতে চাই।

    এটা হল ব্যক্তিগত চাওয়া। কিন্তু অ্যাক্টিভিস্ট হিসাবে আরেকটু জটিল ভাবনার মধ্যে রয়েছি এই মুহূর্তে। এই নামগুলো নিয়ে আমি/আমরা কী করব? এদের কারো কারো সঙ্গে কাজের সম্পর্ক রয়েছে, ব্যক্তিগত সম্পর্ক তো রয়েছেই, সেসব সম্পর্ক নিয়ে কী করব? যেমন ছিল তেমন থাকবে? নাকি এদের সরিয়ে দেব জীবন থেকে? কথা বলব? আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেব? যেখানে কোনো প্রমাণ নেই, সেখানে কি কোনো কিছু অপ্রমাণ করা যায়? 

    ফেমিনিজম আমাকে বিপদে ফেলেছে আজ!!!

     

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics