• আমার শাশুড়িমা উষারাণী


    7    576

    April 14, 2018

     

    উষারাণী বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মেছিলেন ১৯১০ সালে বীরভূম জেলার ন্যাকরাকোন্দা নামের একটি বর্ধিষ্ণু গ্রামে। ন্যাকরাকোন্দাকে সে যুগের পক্ষে খানিকটা অগ্রসর গ্রামই বলা যেতে পারত।গ্রামের মধ্যবিত্ত মানুষজন ভদ্র পোষাক পরিচ্ছদ পরত, ছোট ছেলেমেয়েদের পোশাকেও সভ্যতা বজায় রাখা হত। সেখানে ছেলেদের স্কুলের পাশাপাশি মেয়েদেরও স্কুল ছিল। উষারাণী সেই স্কুলে কয়েক বছর পড়েছিলেন, বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়াতে সে পড়া বেশিদূর এগোয়নি। তবু ওই কয়েক বছরের স্কুলে পড়া তাঁর পড়াশুনার আগ্রহটা জাগিয়ে দিয়েছিল, পরবর্তীকালে তিনি প্রচুর বাংলা বই, খবরের কাগজ, পত্র-পত্রিকা পড়তেন। অসম্ভব বুদ্ধিমতী ছিলেন তো, লোকের কথাবার্তা শুনে, রেডিও শুনে, পরে টেলিভিশন দেখে আর শুনে বেশ কিছুটা ইংরেজিও শিখেছিলেন। ইংরেজি শেখার একটা দারুণ পদ্ধতি নিজে আবিষ্কার করেছিলেন। টেলিভিশনের সেই প্রথম যুগে কলকাতা চ্যানেলে বাংলা, হিন্দী ও উর্দুর সঙ্গে ইংরেজি খবরও পড়া হত। বিশ্বনাথন, কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়, আরও কয়েকজন শিক্ষিত মানুষ সুন্দর উচ্চারণ এবং শীলিত বাচনভঙ্গীতে ইংরেজি খবর পড়তেন—মা দেখতাম মন দিয়ে শুনছেন। বিশ্বনাথনের নকলে ফাইম মিনিস্টার বলে মজা পেতেন। ইংরেজি খবরের পরেই যে বাংলা খবরটা পড়া হত, সেটাও মন দিয়ে শুনে দুটো মিলিয়ে বেশ বুঝে নিতেন কোন ইংরেজি কথার কী মানে।

    মায়ের হাতের বাংলা লেখা খুব সুন্দর আর পরিষ্কার ছিল, ছেলেমেয়েরা তাদের মায়ের কাছেই প্রথম পড়া আর লেখা শিখেছিল।

    উষারাণীর ডাকনাম ছিল খাঁদু, কিন্তু তাঁর নাকটি তত লম্বা না হলেও সুন্দর ছিল। মুখখানি লাবণ্যে ভরা, গায়ের রং শ্যামলা। ছোটো থেকেই বেশ ব্যক্তিত্ব আর সুচিন্তিত মতামতের বিকাশ দেখা গিয়েছিল মেয়েটির মধ্যে। তখন থেকেই ন্যাকরাকোন্দার লোকজনের কাছে মেয়েটি যেমন আদরের, তেমনই সম্মানের জায়গাটি দখল করে নিয়েছিল। আমরাও মায়ের সেই অবস্থানটি অটুট থাকতে দেখেছি।

    একদিকে জাতপাত আর শ্রেণীবিভাগের, সেই সঙ্গে মেয়েদের মানুয হিসেবে না দেখার গল্প তো আমাদের সমাজে চিরদিনের। উষারাণীর কিন্তু এই সব বৈষম্যের নিষ্ঠুরতা গা-সওয়া হয়ে যায়নি কোনোদিন। আমাকে একবার একটা গল্প বলেছিলেন, যেটা আমি ভুলতে পারিনি।

    উষারাণীর বাপের বাড়ির দেশে বেশ কিছু জমিজমা ছিল। সেসবের দেখাশুনা করতেন উষারাণির বিধবা ঠাকুমা। তিনিই রায়তদের কাছ থেকে খাজনা ইত্যাদি বুঝে নিতেন। একদিন বিকেলে ঠাকুমা বারান্দায় চেয়ারে বসে আছেন, নিচে উঠোনে প্রজারা একে একে এসে তাদের হিসেব জানাচ্ছে, ঠাকুমার নির্দেশে একজন কর্মচারী টাকাকড়ি আদায় করছে। সাত/আট বছরের উষারাণী ঠাকুমার পাশে বসে চুপ করে সব দেখছে, শুনছে। একজন প্রজা এলো—বোধ হয় বেশ দূর থেকে এসেছে, ক্লান্ত চেহারা। উঠোনে বসে পড়ে গামছার খুঁটে ঘাড় মুখ মুছে নিজের হিসেব সবিনয়ে নিবেদন করল। তার কাছ থেকে পাওনা-গণ্ডা আদায়ের পর লোকটি যখন উঠে বাইরের দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে, ঠাকুমা চেঁচিয়ে একজন কাজের লোককে বললেন লোকটি উঠোনের যেখানে বসেছিল, তার পুরো জায়গাটা গোবর দিয়ে মুছে দিতে। লোকটি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মা, আমি একজন মানুষ, আমি বসেছি বলে জায়গাটা আপনি জানোয়ারের গু দিয়ে মুছে দিতে বললেন?’ উষারাণী এটা শুনে দৌড়ে ভেতরে চলে গিয়েছিল।

    গল্পটা বলে মা আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা যে কীভাবে মানুষকে ঘৃণা করি, তাদের বোধবুদ্ধিসম্পন্ন জীব বলেও মনে করি না–তাই লোকটি শুনতে পাবে জেনেও তার সম্বন্ধে অপমানজনক কথা বলতে দ্বিধা করি না, সেটা সেদিন ওই লোকটি আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল’।মা নিজে ছোট বয়স থেকে দেখে শেখা পূজোপাঠ, আচার-বিচার, ব্রতপার্বণ সবই পালন করতেন, কিন্তু তার জন্য অন্য কারও যাতে আঘাত না লাগে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন। আমার শ্বশুরমশাই বিমলানন্দ মাত্র বাষট্টি বছর বয়সে মারা যান। মা হিন্দু ব্রাহ্মণের বিধবার নিয়ম একটু আলগাভাবে হলেও পালন করতেন। খাবার সময় বড় খাবার টেবিলে অন্যদের সঙ্গে না বসে আলাদা একটা ছোট টেবিলে বসতেন। একদিন দুপুরে খাচ্ছেন, এমন সময় ছেলেদের ক্লিনিকের কর্মচারী রহিম কোনো কারণে দেখা করতে এলো। মা অনেকের মতো রহিমেরও প্রিয় মানুষ। রহিম এগিয়ে এসে মায়ের খাবার টেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে জমিয়ে গল্প শুরু করে দিল। আমরা ভাবছি, গেল মায়ের খাওয়া! কোথায় কী? মা দিব্যি রহিমের গল্পের সঙ্গে তাল দিচ্ছেন আর একটু একটু খাচ্ছেন। পরে প্রশ্ন করাতে বললেন, ‘আমার খুব ভয় ছিল, পাছে রহিম আমার সংকোচটা টের পায়, আর কষ্ট পায়।’

    ছোটবেলা থেকেই মা জানতেন, তাঁর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে খুব বড়লোকের বাড়িতে,  বাঁকুড়া জেলার ভাড়া গ্রামে দামোদর নদীর ধারে সেই পরিবারের বিরাট বাড়ি, বাড়ির সাথে প্রতিষ্ঠা করা কালীমার মস্ত মন্দির। সবাই বলল, ‘তুই কালো হলেও তোর বর টুকটুকে ফরসা।’ বারো বছর বয়সে সেই গল্পে শোনা বাড়ির ছোট ছেলে—পনেরো বছরের  সত্যিই অত্যন্ত ফরসা কিশোর বিমলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল উষারাণীর। ভাড়া গ্রামে শ্বশুরবাড়ি এসে দেখলেন, বাড়িটা বিরাট ঠিকই, কিন্তু এদের বড়লোক বলে তো মনে হচ্ছে না! শাশুড়ী, পিসশাশুড়ী, বড় জায়েরা সবাই শুধু একখানা করে মোটা শাড়ি পরে আছে, না আছে ব্লাউজ, না কোনো সায়া। সভ্য গ্রামের ভদ্র মেয়ের খারাপ লাগল। সঙ্গে বাপের বাড়ি থেকে যে দাসী এসেছিল, সে  মুখ বেঁকিয়ে বলল ‘তোমার শাশুড়ী, জায়েদের গায়ে কোনো গয়না নেই কেন? হাতেও তো শুধু নোয়া আর মোটা লাল শাঁখা! এ কেমন ধারার বড়মানুষ?’ সে অবশ্য জানত না বাঁকুড়া জেলার শাঁখা চিরদিন লাল রঙেরই হয়।         

    আর একটা ব্যাপার মায়ের খুব খারাপ লেগেছিল—বাড়ির পাশেই বিরাট গোশালা, তাতে ত্রিশ পঁয়ত্রিশটা দুধেল গরু, বেশ কয়েকটা বিদেশি মণ্টোগোমারি, গ্রামের লোক সহজ করে মণ্টুকুমারী বলে। বালতি বালতি দুধ হয়, তা থেকে দুধের চা হয়, ছোটরা গেলাস গেলাস দুধ ঢক ঢক করে খায়। বড় বড় কড়াইয়ে দুধ জ্বাল দিয়ে রাখা হয়, তাতে মোটা সর পড়ে আর সকলে সেটা গুড় বা চিনি দিয়ে খায়। এরা তাহলে দুধ থেকে ছানা, সন্দেশ, পায়েস, মালপোয়া, ক্ষীরের মিষ্টি কিছুই করতে জানে না!

    দ্বিরাগমনের কিছুদিন পরে নববধূর আড়ষ্টতা খানিকটা কেটে গেলে মা শ্বশুরবাড়ির অন্দরমহলে খানিকটা সভ্যতা আনবার কাজে লাগলেন। বাপের বাড়ি থেকে আনা সেলাইয়ের মেশিনটি কাজে লাগিয়ে মহিলাদের প্রত্যেকের জন্যে সেমিজ বানালেন, এবং বড়দের অনুরোধ উপরোধ করে আর ছোটোদের সঙ্গে রঙ্গতামাসা করে তাদের সেগুলি পরা অভ্যাস করালেন। কোনো বৈরিভাব সৃষ্টি না করে এই বিপ্লব আনার কাজটা বড় সহজ ছিল না। এর পরে মেয়েরা, বিশেষতঃ কমবয়সীরা মায়ের সাহায্যে একটু একটু করে সাজগোজ করতে শিখল। এর একটা ফল হয়েছিল মায়ের কাছাকাছি বয়সের ভাসুরঝিদের সঙ্গে মায়ের খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, যেটা পরে আমি নিজে দেখেছি। এই সুসম্পর্ক অনেক দুঃখ, শোক, মনোস্তাপে মাকে সান্ত্বনা যুগিয়েছে, এগিয়ে যেতে মনোবল দিয়েছে।

    রান্নাঘরেও পরিবর্তন আনলেন ছোটবউ। মেয়েরা মিষ্টি, নোনতা নানা রকমের খাবার বানাতে শিখল। ফল, তরকারি কাটায়, সাজানোয় নতুন শৌখিনতা এল।

    আমার শাশুড়ী অনেকগুলি সন্তানের মা হয়েছিলেন। বড় হয়ে বেঁচেছিল ছ’টি ছেলে এবং তিনটি মেয়ে। আরো তিনটি সন্তান আঁতুড়েই মারা যায়। বড় ছেলে জন্মায় মায়ের পনেরো বছর বয়সে, পূর্ণ গর্ভের পর, বাপের বাড়িতে, বিশেষ অসুবিধা হয়নি। তার আড়াই বছর পরে এল দ্বিতীয় প্রসবের পালা। গর্ভের মাত্র অষ্টম মাস, মা শ্বশুরবাড়ির গ্রামে আছেন, প্রসবের জন্য বাড়ির কেউই প্রস্তুত নয়। বাড়ির বাকিরা গ্রামেই কোথাও যাত্রাপালা দেখতে গেছে, মায়ের কোলের ছেলেটিকে এবং বাড়ির অন্য ছোটদেরও নিয়ে গেছে। শুধু একজন দাসী বাড়িতে আছে। হঠাৎ মা অনুভব করলেন তাঁর প্রসব ব্যথা উঠছে! কোনোমতে কিছু কাপড়চোপড় আর এক প্যাকেট তুলো হাতে করে বিশাল উঁচু উঁচু পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন। ভালো করে কিছু বোঝার আগেই প্রসব হয়ে গেল। মা দেখলেন একটি জলভরা থলির মধ্যে দুটি ছোট্ট ছোট্ট ছেলে কিলবিল করছে!কী করবেন? আশ্চর্য মনের জোর আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখালেন সতেরো/আঠারো বছরের মেয়েটি। হাত দিয়ে থলিটা সাবধানে ছিঁড়ে ফেললেন। একটি সদ্যোজাতকে তুলো আর নরম কাপড় দিয়ে মুড়ে ফেলে বুকের উষ্ণতায় জড়িয়ে নিলেন।  তারপর অন্য শিশুটিকে কোনো মতে একহাতে তুলে কোলে রাখলেন। ততক্ষণে দাসী দৌড়ে গিয়ে গ্রামের ধাইমাকে ডেকে এনেছে। কিন্ত তারপরে অনেক চেষ্টা করেও অন্য ছেলেটিকে বাঁচানো যায় নি। বেঁচে যাওয়া প্রহ্লাদমার্কা শিশুটিই পরবর্তীকালে হলেন আমার স্বামী!

    সেই সময়কার মেয়েরা অনেকেই বহু সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। বিশেষতঃ গ্রামাঞ্চলের পরিবারের এইসব মহিলাদের শারীরিক আর মানসিক ক্ষমতার কথা ভাবলে অবাক লাগে। নানা কুসংস্কারের আর ক্ষতিকর নিয়মকানুনের জালে বাঁধা এই দুর্ভাগিনী মেয়েদের গর্ভধারণের পুরো সময়টা, প্রসবের বিভিন্ন ধাপগুলি এবং পরের একুশটি দিন কতটা কষ্টের মধ্যে দিয়ে যে কাটাতে হত, তা কল্পনা করলেও শিউরে উঠতে হয়।

    উষারাণীর নিজের মুখে শুনেছি সে সময় প্রসব হত বাড়ির সবথেকে নিকৃষ্ট ঘরটিতে—অনেক বাড়িতে গোয়ালেও হত। বোঝাই যাচ্ছে স্বাস্থ্যরক্ষার ন্যূনতম ধারণা ছিল না, ব্যবস্থাও ছিল না। তার ফলে নানা সংক্রমণ ঘটত আর বহু শিশু ও প্রসূতির কঠিন রোগ, অনেক সময় মৃত্যুও ঘটত। প্রসূতিকে জল বা অন্য তরল খাবার খুব কম খেতে দেওয়া হত। ধারণা ছিল জলীয় জিনিস খেলে ‘নাড়ি’ শুকোবে না। অথচ সকলেই জানি, ওই সময় শরীরের জল প্রচুর বার হয়ে যায় বলে বেশী করে তরল খাওয়া দরকার, তেষ্টাও পায় সাংঘাতিক। একবার তেষ্টা সহ্য করতে না পেরে মা হামাগুড়ি দিয়ে আঁতুর ঘর থেকে বার হয়ে দরজার পাশে মাঙ্গলিক আমপাতার ঘটের পচা জল খেয়েছিলেন!

    তখনকার দিনে পরিবার পরিকল্পনার একমাত্র পদ্ধতি ছিল পুরুষের কন্ডোম। কিন্তু বেশিরভাগ পুরুষের মত শ্বশুরমশাই সেসব ভাবেনই নি। মা বোধহয় অভিমানবশতই এতগুলি সন্তানের জন্ম দিতে হয়েছে বলে বাবার কাছে কোনো অনুযোগ করেন নি। একবার শুধু বিদ্রুপের সুরে বলেছিলেন, ‘রাশিয়ায় জন্মালে আমি নিশ্চয় পুরস্কার পেতাম!’ আর একবারমাত্র দেখেছি এই ব্যাপারে মায়ের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে। বাবার বেশ প্রৌঢ় বয়সে চিকেন পক্স হল। ডাক্তার বাবাকে তিন সপ্তাহ ঘরে থাকতে বললেন। এদিকে বাবার অভ্যাস সারাদিন ঘুরে বেড়ানো। তাই একটু সুস্থ হতেই বলতে লাগলেন, আমি বেরোব, কোনো মানুষ এইরকমভাবে দিনের পর দিন ঘরে বন্ধ থাকতে পারে? মা খুব রাগের সুরে বলে উঠলেন, ‘তাহলে এবার বোঝো, তুমি যতবার বাবা হয়ে ফূর্তিতে ডগমগ হয়েছ, ততবারই আমাকে একুশ দিনের জন্যে ঘরে বন্ধ থাকতে হয়েছে।’

    উষারাণী মেয়েদের উপর অবিচার, অত্যাচারের ব্যাপারেও অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, প্রতিবাদ করতেও পিছপা হতেন না। যেহেতু আমার বিয়ের অনেক আগেই আমার  খুড়তুতো দিদির সঙ্গে মায়ের বড় ছেলের বিয়ে হয়েছিল, তাই ওই বাড়ির সবার সঙ্গে ছোট থেকেই আমার জানাশোনা। একদিন মা আমাকে বললেন তাঁদের আত্মীয়ার মেয়ে গীতাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে, মেয়েকে সাজাবার জন্যে আমি যেন মায়ের সঙ্গে তাঁদের বাড়ি যাই। আমি তো সেখানে গিয়ে গীতাকে সাজিয়ে দিলাম। পাত্রের বাবা আর কাকা এসেছিলেন। একটু কথাবার্তার পরেই সেই কাকা বললেন ‘মেয়ের চুলটা খুলে দিন, আর মেয়ে একটু শাড়ি উঁচু করে তুলে হাঁটুক, আমরা দেখতে চাই কোনো খুঁত আছে কিনা।’ কিছুক্ষণ আগে থেকেই আমি দেখছিলাম পাত্রপক্ষের হাবভাব দেখে মা মারাত্মক রেগে যাচ্ছেন, এবার বলে উঠলেন, ‘তার আগে আপনারা দু’ভাই একটু উঠে হেঁটে দেখান তো, দেখি বাত আছে কিনা, থাকলে তো আমাদের মেয়েকেই আবার শ্বশুরদের পা টিপতে হবে।’ বলা বাহুল্য, ওই বরের সঙ্গে গীতার আর বিয়ে হয়নি!

    আর একটা ব্যাপারে মহিলা-পুরুষের দ্বন্দ্বে মায়ের আশ্চর্য ন্যায়বিচার দেখেছিলাম। মায়েরই এক ছেলে যখন তার স্ত্রীর প্রতি অত্যন্ত অবিচার করেছিল, তখন মা অন্য আর পাঁচটা মায়ের মতো বউমার দোষ না খুঁজে নিজের ছেলেকে শাসন করেছিলেন; শুধু তাই নয়, বউমাকে একটা পড়ানোর ট্রেনিং নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করায় উৎসাহ দিয়েছিলেন, সাহায্যও করেছিলেন।

    আামার বিয়ের আগে থেকেই আমাকে খুব স্নেহ করতেন মা। হাতের কাছে পেলেই সামনে বসিয়ে টেনে টেনে চুল আঁচড়ে চুলের শ্রী ফিরিয়ে দিতেন। আমাকে নিয়ে অনেক জায়গায় বেড়াতে যেতেন। একদিন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটু হেসে আমায় বললেন, ‘তোমার গায়ের রঙ কালো বলে দুঃখ কোরো না। আমার মতো তোমারও ফর্সা বর হবে। আমি বুঝলাম ওঁর মেজ ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বুঝে গেছেন, সম্মতিও দিয়েছেন।

    নানা ব্যাপারে মায়ের এইধরনের খোলা এবং সে সময়ের পক্ষে খুবই অগ্রসর মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যেত। আমার শ্বশুর মারা যাওয়ার পরে কিছু নিয়ম পালন করে ছিলেন—নিরামিষ খেতেন, লাল ছাড়া অন্য রঙের পাড়ের সাদা শাড়ি পরতেন। কিন্তু কোনো বাড়াবাড়ি করেননি। কিছুদিন পর থেকে আমাদের সঙ্গে বেড়াতে, সিনেমা, নাটক দেখতে, আত্মীয় বন্ধুদের বাড়ি যেতে শুরু করলেন। প্রচণ্ড আথ্রাইটিসের ব্যথার চিকিৎসার জন্যে নিয়মিত আমার সঙ্গে ফিজিওথেরাপি করাতে গেছেন, ফেরার সময় পাঞ্জাবির দোকানের লস্যি খেতেন, আমাকেও খাওয়াতেন। সবসময় বলতেন, ‘যতদিন বাঁচবে, জীবনটা ভালো করে উপভোগ করবে।’

    বাবা মাকে কলকাতায়, গ্রামেগঞ্জে, বাংলার বাইরেও অনেক জায়গায় বেড়াতে নিয়ে গেছেন, কিন্তু মায়ের এত সবের মধ্যেও কোথায় একটা অতৃপ্তি থেকে গিয়েছিল। তাঁর মনে হয়েছিল এ তো শুধু স্বামীর পেছন পেছন ঘোরা। স্ত্রী নয়, একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে বাইরেটা দেখতে চেয়ছিলেন তিনি। শেষে নানা খোঁজখবর নিয়ে কুণ্ডু স্পেশালের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। জানতে পারলেন, সেবার পূজোর পর কুণ্ডু স্পেশালের ট্রেন যাবে মধ্যভারতের গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের নানা জায়গায়। ব্যাস, মনস্থির করে ফেললেন যাবার জন্যে। মায়ের জেদের সামনে বাবা বা অন্য কারো আপত্তি টিকল না। একা বাকি সব অচেনা মহিলা ও পুরুষের সঙ্গে প্রায় একমাস ঘুরবেন, বাবা বললেন একজন পুরুষ আত্মীয় সঙ্গে যাক। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মা বললেন, ‘কেন, আমি তো মেজ বেয়ানের সঙ্গে যাচ্ছি, আমাদের সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, দুজনের টিকিটও কাটা হয়েছে। কুণ্ডুদের লিস্ট আনিয়েছি, সব গুছিয়ে নিয়েছি। একেবারে হাওড়া স্টেশনে বেয়ানের সঙ্গে দেখা হবে।’ বাবার মতো আমরাও হতবাক—কখন, কী ভাবে এত সব হল?

    সেই এক মাসের বেড়ানোটা মা যে কতটা উপভোগ করেছিলেন, তা পরে তাঁর আনন্দ আর উচ্ছাসে ভরা বিবরণ থেকে আমরা বুঝতে পারতাম। এতগুলি মানুষের সঙ্গে চেনাশোনা হওয়া, তাদের প্রত্যেকের একেকরকম আচার ব্যবহার লক্ষ্য করা, একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া, নতুন নতুন জায়গা, নানা রকম দৃশ্য দেখা, কত অপ্রত্যাশিত ঘটনা—এত সুন্দরভাবে খুঁটিয়ে সব কিছুর বর্ণনা দিতেন, শ্রোতারা যেন সবকিছু চোখের সামনে দেখতে পেত। মা নিজের রোজনামচাও লিখেছিলেন, আমরা অপদার্থ, সেগুলি যত্ন করে রাখতে পারিনি।

    মায়ের বয়স যখন ঊনষাট, তখন বাবা হার্ট অ্যাটাক হয়ে মাত্র বাষট্টি বছর বয়সে মারা গেলেন। মা তীব্র শোক সামলে সংসারের যেসব কর্তব্য বাবা সেরে ষেতে পারেননি, সেগুলির দিকে মন দিলেন। সব থেকে ছোট ছেলের বয়স তখন একুশ, ছোটো মেয়ে অর্চনার তেইশ। বাবার মৃত্যুর এক বছরের মাথায় মায়ের নেতৃত্বে আমরা সকলে মিলে সে মেয়ের বিয়ে দিলাম সবিতেন্দ্র রায়ের সঙ্গে—আজ যে সকলের কাছে মিত্র ঘোষ পাবলিশার্সের ভানুবাবু বলে বিখ্যাত। মায়ের আগের দুই জামাইয়ের মতো ভানুর কাছেও মা খুব প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। আমরা বউয়েরাও তাদের শাশুড়ির কাছে কম আদর পাইনি। অদ্ভুত নজর ছিল মায়ের সব দিকে—এতগুলি ছেলে, মেয়ে, বউ, জামাই, নাতি, নাতনি, এমনকি নাতজামাইরা সকলে কে কী খেতে ভালোবাসে খেয়াল রাখতেন এবং সেইমতো ব্যবস্থা করতেও কখনো ভুল হত না।

    ছেলেমেয়েদের বন্ধুরাও মায়ের এই যত্নের থেকে বঞ্চিত হয়নি কখনো। তাই তাদের প্রিয় আড্ডার জায়গা, আর খাওয়াদাওয়ার জায়গা ছিল সর্দার শঙ্কর রোডের ওপর আমার শ্বশুরবাড়িটি।

    কে না এসেছে সে আড্ডায়? আমাদের বাড়ির দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ছিল একটি মাঝারি মাপের হলঘর। সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা একটি বড় চেয়ারে সাম্রাজ্ঞীর মত বসে থাকতেন মা। ধীরে ধীরে এসে পড়তেন রবি ঘোষ, চিন্ময় রায়, তপেন চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, জয়া ভাদুড়ি, তরুণকুমার, সমিত ভঞ্জ, অজিতেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতা, পরবর্তী কালের বিখ্যাত ব্যারিস্টার সমরাদিত্য পাল, বিচারক রুমা পাল, তখনকার খ্যাতনামা রাজনীতিক নন্দিনী সৎপথী ইত্যাদির মতো সব নামজাদা মানুষদের মধ্যে বেশ কয়েকজন। আত্মীয়স্বজনরা তো আসতেনই। রাস্তার উল্টোদিকের বিখ্যাত রাদুবাবুর দোকানের চা আর মায়ের পরিচর্যাকারিণী হরিদির তৈরি খাবারের সঙ্গে আড্ডা জমে উঠত। জয়া ভাদুড়ি যখনই কলকাতায় আসত, একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করত।

    এইসব বিভিন্ন ধরনের আর নানা বয়সের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মা কি সহজেই না মিশতেন! অনায়াসে তাদের নিজেদের কথা, পরিবারের খুঁটিনাটি নিয়ে গল্প করতেন। সেসব গল্প অনেকটা সমবয়সীদের মতো মজা করে করতেন। এইরকম গল্প করতে করতে মা চারপাশের আধুনিক জগতটা সম্পর্কে অনেককিছু জেনে নিতেন, পরে সেসব খবর দিয়ে আমাদের অবাক করে দিতেন। শেষের দিকে পায়ের ব্যথার জন্যে বাড়ি থেকে বেশি বেরোতে পারতেন না, কিন্তু শহরে বা বাইরে নতুন কী ঘটছে সব জানতেন আর খুব আগ্রহ ছিল বলে মনেও রাখতেন। জীবন সম্বন্ধে, মানুষ সম্পর্কে আগ্রহ আর উৎসাহ জীবনের শেষ দিনটি অবধি ছিল বলে অন্যদের—কমবয়সীদের কাছেও তিনি এতটা প্রিয় ছিলেন।      

     

    © এবং আলাপ ও সংশ্লিষ্ট ব্লগার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। লেখা পুনঃপ্রকাশের জন্য www.ebongalap@gmail.com –এ ইমেল করুন।  

     
     



    Tags
     



    Comments (7)
    • কী অপূর্ব রচনা! অতি সরল সাদাসিধে নির্মেদ লেখা। পড়লে মন ভরে ওঠে। ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠেন এক মা!

    • কাল পড়েছি, খুব ভাল লেগেছে।তখনকার দিনের অনেককিছু জানতে পারলাম।এরকম স্মৃতিচারণ তাই পড়তে ভাল লাগে। শুভ নববর্ষ ১৪২৫, রজতদা। পুরনো অমলিন স্মৃতিরা ঝরে যাক্‌। নতুন শুভারম্ভ হোক। খুব ভাল থাকবেন। মা-কে আমার প্রণাম জানাই।

    • অদ্ভুত ভালো লেখা। একটানে পড়ে ফেললাম। পুরো লেখাটায় একটা অদ্ভুত সারল্য আছে – আর আছে তুমুল উপস্থাপনা। প্রণাম।

    • খুব ভালো লাগলো পড়ে । অনেকদিন পরে মণ্টুকুমারী গরুর নাম শুনলাম । বাঁকড়ো জীবনযাত্রার বর্ণনা পড়ে, মনটা দেশে চলে গেলো । অনেক ধন্যবাদ ।

    • সর্দার শঙ্কর রোডের সেই আড্ডায় যাঁদের নাম উল্লেখ করা আছে, তাঁরা ছাড়াও নিয়ম করে আসতেন কলকাতার বহু ডাক্তার, পরে যাঁদের প্রায় সকলকেই কলকাতার মানুষ এক ডাকে চিনতেন।

    • খুব ভাল লাগল। দীর্ঘ লেখা, তবু অনায়াসে পড়ে ফেললুম।

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics