• ফিরে দেখা: কলকাতায় শিখবিরোধী দাঙ্গা


    0    141

    December 5, 2017

     

    হিংসার কোনো ব্যাকরণ হয় না, হিংসাজনিত স্মৃতিরও। কথায় বলে, স্মৃতি সততই সুখের। কিন্তু সব সময় কি তা হয়? ‘সারা দেশে তখন আগুন জ্বলছিল। পাইকারি হারে চলছিল শিখ নিধন। আর আমার বাবা মাত্র দু-একটা চড়-থাপ্পড় খেয়েছিলেন, কিন্তু সেইটুকু দুঃখের স্মৃতি তাকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত কষ্ট দিয়েছিল।’ – এলগিন রোডের মুখের গুরুদোয়ারা-র লাগোয়া চায়ের দোকানের বিখ্যাত চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বললেন মনমোহন সিং। মনমোহনজীর জন্ম কলকাতাতেই। তাঁর নানাজি সুদূর পাঞ্জাবের ফতেগড় জেলার সরহিন্দ গ্রাম থেকে এসেছিলেন এই শহরে, জীবিকার সন্ধানে। যখনকার ঘটনা, ততদিনে এই শহরে তাঁর কুড়ি বছর বাস হয়ে গেছে। মনেপ্রাণে এই শহরেরই মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, এখানকার মানুষ উদার, ক্ষমাশীল, সহৃদয়। সেই বিশ্বাসেই চিড় ধরেছিল সেদিনকার ঘটনায়।

    ১৯৮৪-র নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা সেটা। ৩১ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করে তাঁর দুই শিখ দেহরক্ষী। শুরু হয়ে যায় সারা দেশে শিখ-বিরোধী দাঙ্গা। বেশ কয়েকদিন গোটা শহরে কারফিউ ছিল। ব্যবসা বন্ধ থাকায় ক্ষতি হচ্ছিল খুব। তাই কারফিউ উঠতেই বাড়ির সকলের নিষেধ অমান্য করে বেরিয়ে পড়েছিলেন। একটা মিনিবাস ধরে তিনি যাচ্ছিলেন উত্তর কলকাতায় কালীকৃষ্ণ টেগোর স্ট্রীটে। সেখানেই ছিল তাঁর ট্রান্সপোর্টের ব্যবসার অফিস। বাস প্রায় ফাঁকাই ছিল, রাস্তাঘাটও। আতঙ্ক এবং কারফিউয়ের রেশ তখনও কাটেনি। নির্দিষ্ট স্টপেজে নামবার জন্য দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। হঠাতই রাস্তার ধারে জটলা করতে থাকা একদল লোক ‘ওই দ্যাখ একটা শিখ। মার শালাকে...’ বলতে বলতে প্রায় থেমে পড়া বাসটার দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চোখের পলকে প্রবীণ সর্দারজীর পাগড়ির ওপর, গালে, মুখে বেশ কয়েকটা চড়-চাপড় এসে পড়ে। রক্ষে এই যে, বাসের ড্রাইভার ছিলেন বুদ্ধিমান। গোলমালের আভাস পেয়েই তিনি বাসের স্পিড বাড়িয়ে দেন এবং থামান একেবারে পরের স্টপেজে গিয়ে। সেদিন আর কর্মক্ষেত্রে যাননি সিংজী। ফিরতি বাস ধরে সোজা বাড়ি ফিরে আসেন।

    যে শহরকে সেই বৃদ্ধ ভালোবেসেছিলেন, সেই শহরের মানুষদের কাছ থেকে পাওয়া ওই রকমের ব্যবহার, ওই অনাদরের ঘা তাঁর মন থেকে আর কোনোদিনই মুছে যায়নি। একথা ঠিক যে, রাজধানী দিল্লি বা হরিয়ানার মত কোনো পরিকল্পিত গণহত্যা দেখেনি সেদিনকার কলকাতা। কিন্তু ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু দাঙ্গা-হাঙ্গামা তো ঘটেই ছিল। ঠিক যেমন মনমোহন সিংজীর মনে পড়ে তার চোখের সামনে একটা দোকান জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা। তখন তিনি উনিশ বছরের সদ্য যুবক। ঝুঁকি নিতে ভালবাসতেন। ঝুঁকি নিয়েই বাপ-পিতেমোর সাবেক ট্রান্সপোর্টের নিরাপদ ব্যবসা ছেড়ে রেডিমেড পোশাকের ব্যবসায় নেমেছিলেন। ভবানীপুরে নিজেদের ভাড়া বাড়ির লাগোয়া একটা ছোট্ট দোকানঘর ভাড়া নিয়ে শো-রুম বানিয়েছেন। ইন্দিরা-হত্যা এবং তৎপরবর্তী দাঙ্গা-হাঙ্গামার খবর ছড়িয়ে পড়েছে তখন। এলাকার সমস্ত শিখ তখন সপরিবারে গৃহবন্দী। কিন্তু বেঁচে থাকতে গেলে আর কিছু না হোক, খাবার তো চাই। তাই তিনি বেরিয়েছিলেন কিছু রসদ জোগাড়ের আশায়। আশুতোষ মুখার্জী রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে আচমকাই যেন পা-দুটো মাটিতে গেঁথে যায় তার। কোনোক্রমে নিজেকে টেনে নিয়ে একটা বন্ধ পান-গুমটির আড়ালে নিয়ে যান তিনি। সেখান থেকেই দেখেন—জনা পঁচিশেক উন্মত্ত মানুষের একটা দল হইহই করে একটা রেডিও-টিভির শো-রুমে চড়াও হয়ে ভাঙচুর শুরু করল। ওই শো-রুমের মালিক ছিলেন ধর্ম-পরিচয়ে শিখ। লোকগুলোর হাতে লোহার রড, মোটা বাঁশ, সাইকেলের চেন। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল শো-রুমের কাঁচের দরজা। একের পর এক টিভি তুলে আছাড় মেরে ভাঙা হচ্ছিল রাস্তার পিচের ওপর। কেউ বাধা দেয়নি ওদের, দেওয়ার মত কেউ ছিলও না সেখানে। মনের সুখে বেশ খানিকক্ষণ ভাঙচুর চালাবার পর বিস্মিত আতঙ্কিত অমরজিৎজীর চোখের সামনেই দোকানটায় আগুন ধরিয়ে দেয় ওরা।

    ‘কংগ্রেস পার্টির লোক ছিল ওরা? হাতে কোনো পতাকা ছিল?’

    সাংবাদিক-সুলভ এই অর্বাচীন প্রশ্নের উত্তরে মনমোহনজী হাসেন, হাতের চায়ের কাপটা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে দিয়ে শান্ত নির্লিপ্ত গলায় বলেন, ‘দাঙ্গাবাজও কা, ফাসাদীওকা কোই জাত, কোই ধর্ম, কোই পার্টি নেহী হোতা হ্যায়। উসদিন ভি নেহী থা, আজ ভী নেহী হ্যায়।’

    এবং ভাল মানুষেরাও চিরকালই জাত-ধর্ম-পার্টির উর্ধ্বেই থেকে এসেছেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসুর কিছু বলিষ্ঠ প্রশাসনিক পদক্ষেপ যেমন সেই সময় কলকাতাবাসী বহু শিখের জীবন সম্পত্তি রক্ষা করতে সহায়ক হয়েছিল, ঠিক তেমনই বহু মানবিক মুখও দেখেছিল সেদিনকার কলকাতা। ভবানীপুর অঞ্চলে এখনও এমন অনেক গলি আছে, যার বিভিন্ন বাড়িতে পাশাপাশি এবং এমন অনেক ফ্ল্যাট আছে, যার বিভিন্ন তলে বাঙালি এবং শিখ পরিবার একত্রে বসবাস করে। এমনই একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা অশীতিপর বৃদ্ধ সমীর দাশগুপ্ত শোনাচ্ছিলেন তাঁর সেদিনকার অভিজ্ঞতা। ইন্দিরার মৃত্যু-সংবাদ তখন ঝড়ের মত ছড়িয়ে পড়েছে শহরের আনাচে-কানাচে। সুদূর বর্ধমানের অফিস থেকে ট্রেনে হাওড়া পৌঁছে শুনশান শহরের রাস্তা ধরে হেঁটে প্রায় মাঝরাতে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। ফিরে দেখেছিলেন, একতলায় শিখ পরিবারের সকলে তাঁর আগমন প্রতীক্ষায় উৎকণ্ঠিত হয়ে বসে আছে। সেই পরিবারের দুটি শিশুর ‘আঙ্কল আ গয়া, আঙ্কল আ গয়া’ বলে খুশীর নাচ এখনও তাঁর চোখে ভাসে। ‘আমার জন্য দুশ্চিন্তায় ওরা সেদিন নিজেদের বিপদের কথাও বেমালুম ভুলে গিয়েছিল’ বলছিলেন সমীরবাবু, ‘পরবর্তী কয়েকদিন অবশ্য আমরাই ওদের নিজেদের ফ্ল্যাটে এনে রেখেছিলাম। তার মধ্যে একদিন একদল হাঙ্গামাকারীরা লাঠিসোটা নিয়ে হাজিরও হয়েছিল ওদের খোঁজে। আমরা, বাঙলি পরিবারগুলো ফ্ল্যাটের ওপর থেকে সমবেতভাবে হুমকি দিয়ে ওদের ভাগিয়ে দিয়েছিলাম।’

    কলকাতা থেকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার উত্তরে ছোট শহরতলী ব্যারাকপুরেও শিখদের একটা ছোটখাটো বসতি আছে। তাঁরাও প্রায় সকলেই পরিবহন ব্যবসার সঙ্গেই যুক্ত। গোলমালের আঁচ সেখানে গিয়েও পড়েছিল। কলকাতার হাজরা এলাকার বাসিন্দা সোহনলাল চৌধুরী সেই ব্যবসার কাজেই সেদিন ব্যারাকপুরে গিয়ে আটকে পড়েছিলেন। প্রাণের ভয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন টিটাগড় থানা-চত্বরে। থানা থেকেই ফোন করে পাড়ার বন্ধু ‘মিত্র’-দাকে নিজের অবস্থার কথা জানিয়েছিলেন। তাঁর ভালবাসার মিত্রদা পরদিন খুব ভোরে নিজে ড্রাইভ করে টিটাগড় গিয়ে ‘বন্ধু’-কে নিরাপদে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। গোটা রাস্তাটাই গাড়ির পিছনের সিটে চাদরমুড়ি দিয়ে তিনি শুয়ে আত্মগোপন করে ছিলেন চৌধুরী-সাহেব। সেই ‘মিত্রদার’ কন্যা ষোড়শী মনীষা সেই পুরো ঘটনার সাক্ষী ছিল। আজ, এই মধ্যবয়সে পৌঁছে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এক অনির্বচনীয় তৃপ্তিতে ভরে যায় তাঁর চোখমুখ। ‘আর কিছু থাক বা না থাক, কলকাতা শহরের এই প্রাণটুকু আছে। জেনে রাখুন, শুধুমাত্র একটা ছেচল্লিশের দাঙ্গা দিয়ে এই শহরের পুরো ইতিহাস লেখা যাবে না। তার সঙ্গে পাল্লা দেবার মত হাজার হাজার মানবিকতার উদাহরণ এই শহরের ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে।’ হাসতে হাসতে বলেন মনীষা দেবী, ‘এই শহরের সম্প্রীতির মানচিত্রকে অত সহজে রক্তাক্ত করা যায়নি অতীতে, ভবিষ্যতেও যাবে না।’

    ‘দাঙ্গামুখো হতচ্ছাড়া’-রা শুনছেন?

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics