অহো কি দুঃসহ স্পর্ধা
1 1143আজ ২২শে শ্রাবণ। রবীন্দ্রসংগীতের গায়ক, গায়িকা ও গায়কী নিয়ে আমাদের ব্লগে এবার দু-তিনটি বিশেষ লেখা। আমরা যখন রবীন্দ্রসংগীত শুনি, এবং কোনো কোনো গান আমাদের বিশেষ কারোর গলায় শুনতে ভাল লাগে, তখন সেই পছন্দ-অপছন্দের মধ্যে কি কোথাও নারীত্ব ও পৌরুষ সম্মন্ধে আমাদের ধারণাও একধরনের নির্ণায়কের ভূমিকা নেয়? এই নিয়েই কিছু অনুভব। পড়ুন, ভালো লাগলে শেয়ার করুন, এবং কোনো মতামত থাকলে নীচে কমেন্টে লিখে জানান।'যে ছায়ারে ধরব বলে'কিছুদিন আগে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কথাপ্রসঙ্গে একজন বললেন, “মেয়েদের এই দাঁত চেপে ন্যাকামো করে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়াটা অসহ্য লাগে”। অনেকে সমর্থন করলেন, প্রতিবাদ করলেন কেউ কেউ। প্রতিবাদকারীদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি বললেন যে এই ‘দোষ’ গায়কদের মধ্যেও যথেষ্ট পরিমানে লক্ষ করা যায়। এই আলোচনা অবশ্য একেবারেই নতুন নয়, কণিকা বনাম সুচিত্রা, দেবব্রত বনাম হেমন্ত-র সময় থেকে চলে আসছে। সুচিত্রা মিত্রের গায়কী বলিষ্ঠ, তাই “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি” অনেক পুরুষকন্ঠের থেকে তাঁর গলায় বেশি মানায়, এ তো আমরা যুগ-যুগ ধরে শুনে আসছি। তাঁর মানে কি দাঁড়ালো? রবীন্দ্রসংগীতের প্রচলিত গায়কী ‘মেয়েলি’, মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে, তাই পৌরুষময় গায়কীর জন্যে আমাদের যেতে হয় দেবব্রত বিশ্বাস, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, পীযুষকান্তি সরকারদের কাছে।রবীন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্রসংগীত খায় না মাথায় দেয়, তা বুঝতে শেখার আগেই রবীন্দ্র সদনে ‘চিত্রাঙ্গদা’ দেখতে গিয়ে অর্জুনের প্রবেশ-দৃশ্যে “অহো কি দুঃসহ স্পর্ধা”-র গর্জন শুনে চমকে-চমকে উঠেছি। সেই “অহো”-তে এমন প্রাণপণ শক্তি ও ক্রোধের প্রদর্শন, যে বাকি গানের লাইন ভুলভাল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। একবার তো এক অর্জুনকন্ঠ পরের গানটি “গান্ডব আমি অর্জুন, পান্ডীবধন্বা” গেয়ে ফেলে এক কেলেংকারি কান্ড বাঁধালেন। মা এবং পিসিদের কাছে শোনা “চিত্রাঙ্গদা” মঞ্চায়নের আগে খোঁজ পড়ত ব্যারিটোন গলার। একই নৃত্যনাট্যে আর একটি প্রশ্নও ভাবায়। কুরূপার গান কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় গাইছেন, আর সুরূপার গান গাইছেন সুচিত্রা মিত্র, এরকম আমরা ভাবতে পারি না কেন?কাব্যিক দিকটা সরিয়ে রাখলে রবীন্দ্রসংগীতকে আর-পাঁচটা বাংলা গানের থেকে যদি আলাদা করা যায়, তার কারণ রবীন্দ্রসংগীতের গায়কী একেবারে ভিন্ন, স্বতন্ত্র। কিন্তু আমাদের বলা হয়েছে যে এই গায়কী মেয়েলি। তা হলে একবার দেখে নেওয়া যাক ‘মেয়েলি’ গায়কীর ‘বৈশিষ্ট্য’ কী। গাওয়ার সময় মুখ যথাসম্ভব কম ফাঁক করা, ‘চ’ বর্গের বর্ণ উচ্চারণের সময় হালকা একটা ‘s’-এর অনুষঙ্গ যোগ করা, তারসপ্তকের স্বরে গলা সরু করে ফেলা, এবং মীড় ও গমকের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা – এই হল কয়েকটি। প্রশ্ন হল, গাওয়ার এই ধরণটি আমাদের মনে ‘মেয়েলি’ হিসেবে গেঁথে গেল কি ভাবে?রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে, বা তার পরবর্তী কয়েক দশকের রেকর্ডিং শুনলে কিন্তু দেখা যাবে যে তার সঙ্গে আজকাল আমরা যেটাকে রাবীন্দ্রিক গায়কী – বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে – বলে চিহ্নিত করি, তার অনেকটাই ফারাক। অমিয়া ঠাকুর, কনক দাশদের গায়কী বাহুল্যবর্জিত, ঝরঝরে। ঢালা গানের ক্ষেত্রেও তাঁদের মধ্যে অযথা প্রলম্বনের প্রবণতা কম। এঁদের পরে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, ঋতু গুহ, রাজেশ্বরী দত্তদের গানেও মেদ কম এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ছাপই বেশি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রবীন্দ্রগান পরিবেশনের ধরণে যুক্ত হয়েছে নানারকমের বহিরাগত কারুকার্য, নিম্নগামী লয়, এবং অদ্ভুত এক উচ্চারণশৈলী, যার সঙ্গে কথ্য ভাষার লক্ষনীয় ফারাক। আরো একটা জিনিষ হয়েছে – প্রাণের আনন্দে গান গাওয়ার ব্যাপারটা ক্রমে হারিয়ে গেছে।একটি অলিখিত ফরমুলা বা টেম্পলেট কি করে যেন তৈরি হয়ে গেছে রবি ঠাকুরের গানের। অবশ্য ‘কি করে যেন’-ই বা বলছি কেন? কি করে হয়েছে তা কি সত্যি আমাদের অজানা? অধিকাংশ বাঙ্গালির কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত (আসলে রবীন্দ্রগন্ধী যে-কোনো জিনিষ) ধর্মের থেকে কোনো অংশে কম নয়, তাই যুগে-যুগে এ-ধর্মেও মোড়ল এসেছে। তাঁরা বলে দিয়েছেন কি ভাবে গাওয়া হবে এই গান। ব্যক্তিগত ইন্টারপ্রিটেশনের জায়গা ছোটো হতে হতে প্রায় মুছেই গেছে। এ-কথা সত্যি যে রবীন্দ্রনাথ নিজে চান নি যে তাঁর গান নিয়ে যথেচ্ছাচার হোক। তবে সেটা রুখবার ব্যবস্থাও তো তিনি নিজেই করে গেছেন – গান তৈরির সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরাদেবী বা দিনু ঠাকুরকে ডেকে করিয়ে নিয়েছেন স্বরলিপি। সেই স্বরলিপিরক্ষার দায়িত্ব যখনই অন্যের ওপর বর্তেছে, তখন তারা খানিক খোদার ওপর খোদকারি করার লোভ সামলাতে পারেন নি। তাদের ধার্য করা বিধান মানতে অস্বীকার করায় ব্রাত্য হয়েছেন দেবব্রত বিশ্বাস, বিফল মনোরথ হয়ে ফিরেছেন বহু প্রতিভাবান শিল্পী। কপিরাইট-উত্তর যুগে রবীন্দ্রসংগীত কি ভাবে গাওয়া হবে, তা কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠী আর ঠিক করেন না বটে, কিনতু ক্ষতি যা হওয়ার ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী বেড়েছে বই কমে নি, কিন্তু সবাই কেমন একই ছাঁচে ঢালা, আলাদা করে চিনে নিতে কষ্ট হয়।পুরুষতন্ত্রের চিরকালীন নিয়মে শাসনবিধির চাপ মহিলাদের ওপরেই বর্তায়। রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রেও অন্যথা হয় নি। তাই বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের অযৌক্তিক দাবির বিরুদ্ধে সরব হওয়ার জন্যে একজন দেবব্রত বিশ্বাসকে পাওয়া গেলেও গায়িকারা বহু দশক ধরে কোনো প্রশ্ন না করে নিয়মমাফিক গেয়ে গেছেন। আর তার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি নিষ্প্রাণ, গতানুগতিক অনেক শিল্পী এবং সীমিত পরিধির মধ্যে তাদের বিচরণের নমুনা। শেখা এবং শোনার এই জগতে রবীন্দ্রগানের সত্ত্বার মধ্যে প্রবেশ করার থেকে অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে নিয়মনিষ্ঠতাকে, বা পূর্বতন গাইয়েদের অনুকরণ করাকে। তাই ছায়াকে ধরতে গিয়ে মাধুরী অধরাই থেকে যায়, আজও।- শ্রেয়সী দস্তিদার‘তোমারি ঝর্ণাতলার নির্জনে’
মেঘমন্দ্র, কিংবা মেঘমেদুর। রবীন্দ্রসংগীত শোনার স্মৃতিতে প্রথম যাঁর কণ্ঠ, তাঁর সম্বন্ধে এই দুটো শব্দ ফিরে ফিরে আসে আমার মনে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আমার কেনা প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেটটি হেমন্তর। প্রথমবার দেবব্রত বিশ্বাসের গান শুনে নাক সিঁটকে বলেছিলাম এ কী, কান্নাকাটি করছেন কেন! বলা বাহুল্য, সে গানটা ছিল ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’। কিন্তু একদিন দেখলাম ঘরের তাকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ক্যাসেট ছাপিয়ে ঝলমল করছেন দেবব্রত বিশ্বাস। যে স্বল্পসংখ্যক গান স্টুডিয়ো-রেকর্ডিং করেছেন সেগুলোর তো কথাই নেই, কিন্তু কী মায়া যে আছে ওই ঘরোয়া রেকর্ডিংগুলোতেও! ভয়ানক খারাপ ট্র্যাকে বসিয়ে তাকে বাজারে চালানোর চেষ্টাও তার মাধুর্য নষ্ট করতে পারেনি। একাকী নির্জনের গান বলেই হয়ত। যখন ‘হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু গুরুগুরু’ শুনি, কান থেকে বুকে সে স্বর ধাক্কা দেয়, নীচের দিকে নামতে থাকে একধরণের উৎকন্ঠা। এ কাণ্ড হেমন্ত পারেননি কখনও।
আশ্চর্যজনকভাবে, আমার গানের স্মৃতির প্রথম যুগে কোনো মহিলা গায়িকা নেই। অথচ, যাকে বলে ‘ইনিশিয়েশন’--আমার হয়েছে খুব ছোটো বয়সেই। কলামন্দিরের প্রথম সারির আসনে, একসন্ধ্যে-ভরা সুচিত্রা মিত্রর সতেজ কণ্ঠের রবীন্দ্রসংগীত। কিন্তু গায়কের গাওয়া গান তো কোথাও একটা আমারই না-গাওয়া গান হয়ে ওঠে,আমারই অশ্রুত কণ্ঠ। কোনো একটা কারণে সে গানের কণ্ঠ সুচিত্রার সঙ্গে মেলে না আমার। মেলেনা কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। অসামান্য শিল্পী এঁরা, কিন্তু আমার একান্তের না। বহুদিন পর্যন্ত তাই আমার প্রিয় শিল্পী ছিলেন পুরুষরাই। রবীন্দ্রগান বললেই মন্দ্র, উদাত্ত, উদাসী বা মেদুর। এই ভুখ মিটে যেত হেমন্ত, দেবব্রত, বা চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে। হয়তো এই কারণেই সুবিনয় রায়ও আমার দূরের। বুদ্ধি তাঁকে মানে, কিন্তু হৃদয় নয়।
প্রথম প্রিয় নারীকণ্ঠ বলতে মনে পড়ে সুমিত্রা সেন। অপ্রয়াসেই সুললিত, ঘরানা বা গায়কী নিয়ে মাথাব্যথা নেই — মিষ্টি অথচ গভীর। ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’-র বিষণ্ণ মেদুরতা, কিংবা সেই ‘শুন বরনারী’ ছবিতে ‘ঘরেতে ভ্রমর এলো’-র সলজ্জ উচ্ছাস, আমার ভারি ভালো লাগল। ভালো লাগল ঋতু গুহর কণ্ঠও। সতেজ, অথচ লাবণ্যময়। যে লাবণ্য কিছুটা দেবব্রত বিশ্বাসে, যে সতেজতা কিছু সুচিত্রা মিত্রে।
বিদ্দজ্জনেরা আমায় জাতে মারবেন, কিন্তু আশা ভোঁসলের গলায় একটি-দুটি গান আমার প্রিয়। সুর বাঁধন না মেনে উপচে ওঠে যাঁর কন্ঠে, তাঁকেই তো মানায় ‘ঝর্ণাতলার নির্জনে’। কিংবা ‘স্বপ্নে আমার মনে হল’-র ওই অবর্ণণীয় ‘হায়’-টি?
আমার ধারণা ছিল বিশেষ একটি ধারার গায়কী আমার সয় না। কিন্তু সে ধারণা দুরমুশ করে যে আমাকে জয় করলেন, তিনি গীতা ঘটক। যে অপূর্ব বস্তুটি তিনি রবীন্দ্রগানে নিয়ে এসেছিলেন তাকে লোকে বলে ‘এক্সপ্রেশন’, আমি বলি ‘লচক’। উদাত্ত, উদাসী, বা উতলা—গীতা এসব সংজ্ঞার বাইরে। এই ‘লচক’ কিছুটা যেন বিক্রম সিং খাঙ্গুরার গানেও ছিল।
আর্কাইভে কাজ করবার সুবাদে শুনেছি প্রৌঢ়া রাজেশ্বরী দত্তের গান। উদাসী, মেদুর -- উদাত্ত, কিন্তু বড়ো একলা। মালতী ঘোষাল--অনায়াস, লাবণ্যময়। চিত্রলেখা চৌধুরী, আবারও, অনায়াস।
মন্দ্র, মেদুর, উদাত্ত, উদাসী, অনায়াস, লাবণ্যময় — বিশেষণগুলো বিবেচনা করলে, মন্দ্র যেন কেবলই পুরুষের। ব্যারিটোনের বালাই তো মেয়েদের নেই! অন্য সমস্ত বিশেষণের রূপ হয়তো নারী বা পুরুষ সাপেক্ষে একটু আলাদা, কিন্তু প্রয়োগ করেছি দুইক্ষেত্রেই। আমার কাছে গান গায়কনির্ভর, গায়কের লিঙ্গপরিচিতিনির্ভর নয়। যে লাবণ্য বিক্রমের গানে, সে লাবণ্য তারই স্বকীয়। আর শব্দের প্রয়োগ তো খানিকটা সমাজ দিয়েও বাঁধা। নাহলে প্রমিতা মল্লিকের কণ্ঠকে যদি মগ্ন এবং মন্দ্রও বলি, তাহাতে আসে যাবে কী বা কার?যে গান যাঁর কণ্ঠে আশ্চর্য করেছে, তিনি স্থান করে নিয়েছেন মনের মধ্যে। জ্ঞানত বাছবিচার করিনি। কিন্তু একটা ছবি কী ফুটে উঠল না এই লেখার মধ্য দিয়ে? এখন ভাবছি।-স্পন্দনা ভৌমিক
‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’
কয়েক সপ্তাহ আগে প্রতিদিন কাগজের রোববার পত্রিকায় কিশোর কুমারকে নিয়ে একটা বিশেষ সংখ্যা হয়। সেখানে সন্দীপ রায়-এর সঙ্গে সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে একটা লেখায় জানতে পারি ঘরে বাইরে ছবির চিত্রনাট্য তৈরি হওয়ার সময় সত্যজিৎ রায় স্থির করেন কিশোর কুমার-ই গাইবেন ছবিতে ব্যবহৃত গোটা দুই-তিন স্বদেশী গান। তারপর বিজয়া রায় গানগুলো নিজের গলায় রেকর্ড করে কিশোর কুমারকে পাঠান গান তোলার জন্য। এই একই পদ্ধতিতে নাকি চারুলতা-র গানগুলোও কিশোর তুলে নিয়েছিলেন। ঘরে বাইরে-তে কিশোরের গলায় সৌমিত্র-র লিপ-এ আমরা পাই ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’ এবং ‘চল রে চল সবে ভারতসন্তান’ – এই দুটি রবীন্দ্র-জ্যোতিরিন্দ্র সংগীত।
সন্দীপ-এর চরিত্রে কিশোরের অনবদ্য গায়কীতে গান দুটি আমার বিশেষ প্রিয়। কিন্তু আমি ভাবতে চেষ্টা করছি বিজয়া রায়ের গলায় যদি ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’-র একটা রেকর্ড থাকত, কেমন লাগতো শুনতে? সুচিত্রা মিত্র ছাড়া আর কোনো নারীকন্ঠে গানটা আমার শোনা হয় নি। এমনকী রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের অনেক গান-ই আমি সুচিত্রা ছাড়া আর কোনো নারীকন্ঠে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। সাম্প্রতিককালে পূবালী দেবনাথের গলায় যদিও এই পর্যায়ের অনেকগুলো গানই শোনা। তবে আমার স্মৃতিতে বেশিটা ধরা আছে জীবনের প্রথম পঁচিশ-তিরিশ বছরে রেকর্ড ও রেডিও-এ শোনা গান। আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সবিতাব্রত দত্ত-এর গমগমে গলায় অন্যান্য স্বদেশী গান।
যে সময় স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলি লেখা সেই যুগে দেশসেবায় নিবেদিত-প্রাণ ভারতসন্তান বলতে অবশ্যই ভারতের পুরুষসন্তানকেই (পড়ুন হিন্দু উচ্চবর্ণ) বোঝানো হতো। তার বহূ পরে স্বাধীনতাত্তোর ভারতের ৫০-৬০-৭০-৮০-এর দশকেও স্বদেশ পর্যায়ের বেশিরভাগ গান কেন আমরা পুরুষকন্ঠেই মূলত শুনেছি? গানগুলির নির্ভিকতা-বলিষ্ঠতা-ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা সাধারণত নারীকন্ঠের মানানসই নয়—এমন একটা ধারণা কাজ করেছে কি আমাদের মধ্যে? ঠিক যেমন করুণরস সিঞ্জিত ‘বাজে করুণ সুরে’ আমরা শুনতে অভ্যস্ত হয়েছি কণিকা বা রাজেশ্বরীর কন্ঠে? অথবা ‘এ পরবাসে রবে কে’-এর বিষণ্ণতা জড়িয়ে গেছে অমিয়া ঠাকুর, মালতী ঘোষাল, কণিকা বা রাজেশ্বরীর সঙ্গে? ইদানীং অবশ্য বিক্রম সিং খাঙ্গুরা বা সাশা ঘোষালের কন্ঠে পাওয়া গেছে ‘এ পরবাসে’ ও ‘বাজে করুণ সুরে’র মতো গান।
স্বদেশ পর্যায়ের ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’ বলতেই কিন্তু আমার মনে পড়ে দেবব্রত বিশ্বাস বা সুশীল মল্লিক। ‘সর্ব খর্ব তারে দহে’ বলতেও সর্বাগ্রে দেবব্রত। কোনো একটি ক্যাসেটে হেমন্ত ও উৎপলা সেন-এর দ্বৈত কন্ঠে একবার ‘সর্ব খর্ব’ শুনেছিলাম। অনেকটা সহকারী কন্ঠে উৎপলা সেন যেন ছিলেন এই গানে। গানের বেশিরভাগটাই হেমন্তের গাওয়া। ‘প্রস্তরশৃঙ্খলোন্মুমক্ত ত্যাগের প্রবাহ’ সুচিত্রা ছাড়া আর কোনো নারীকন্ঠে মন্দ্রিত হতে আমি শুনি নি। তবে শান্তিদেব ঘোষের গাওয়া ‘সর্ব খর্ব’ শুনে মনে হয়েছে ‘নারীত্ব’ ও ‘পৌরুষ’-এর ধারণাগুলো একরকম চ্যালেঞ্জ করে এই রেকর্ডিংটি।
নারীকন্ঠে সব চেয়ে বেশি যে স্বদেশ পর্যায়ের গানটি শোনা যায় সেটি বোধহয় ‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’। এক সময় রেডিওর ‘মহিলা মহল’ অনুষ্ঠানে এটাই ছিল সিগনেচার ট্যুন। এখনও আছে কি না বলতে পারব না। বিপ্লবী লীলা রায়ের সম্পাদনায় ঢাকা থেকে ১৯৩১ সাল নাগাদ ‘জয়শ্রী’ পত্রিকা বেরোনোর পর গানটি রবীন্দ্রনাথ আশির্বাদ স্বরূপ পাঠিয়েছিলেন যত দূর মনে পড়ছে। ‘সংকোচের বিহ্বলতা’ বহূ মহিলাকণ্ঠে আমরা আগে এবং এখন একক বা সম্মিলিতভাবে শুনতে পাই। আমার সবচেয়ে প্রিয় অবশ্য কনক দাশ ও দেবব্রত বিশ্বাসের প্রকৃত অর্থেই দ্বৈত কন্ঠে গাওয়া এই গানের রেকর্ডটি। কনক-দেবব্রত দুজনেরই কন্ঠমাধুর্য ও গানের মধ্যে একাত্মতা সম্ভবত আমাকে স্পর্শ করে গভীরে। ওই দ্বৈত কন্ঠের মাধুর্যমণ্ডিত রেকর্ডিং-এ ‘বলিষ্ঠতা’ বা ‘সলজ্জতা’ মনকে অধিকার না করে একটা sense of harmony, একটা প্রশান্তি এনে দেয় বোধহয়।- শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত
'যদি পার্শ্বে রাখো মোরে'
ভাষারও যে একটি অন্তর্নিহিত লিঙ্গপরিচয় থাকতে পারে, তা জার্মানি আসার আগে সেভাবে বুঝিনি। জার্মান ভাষায় প্রায় প্রতিটি শব্দের আগে একটি করে লিঙ্গনির্ধারক ‘আর্টিকেল’ বসে। মজার বিষয়, বাচ্চা মেয়ে বা স্কার্টজাতীয় চরম মেয়েলী শব্দ এই ভাষার চোখে পুংলিঙ্গসূচক আর্টিকেলবাহী। এই ভাষায় লিঙ্গনির্ধারণ করে বিশেষ্য, বিশেষণ নয়। আমি এতে অবাক হই কারণ আমি বেড়ে উঠেছি এমন এক পরিবেশে যেখানে বিশেষণ ও তার লিঙ্গপরিচয়ের ভারে ন্যুব্জ হওয়া দৈনন্দিনতা বইকি।
‘মিষ্টি’, ‘সুশ্রী’, ‘নমনীয়’- এই বিশেষণগুলি আমরা চিরাচরিতভাবে মেয়েদের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হতে দেখি। তুলনায় ‘বলিষ্ঠ’, ‘সুদৃঢ়’ এসব উপমা যেন পুরুষের সাথেই বেশি খাপ খায়। এ কারনেই বোধহয় যখন সুচিত্রা মিত্র গেয়ে ওঠেন, ‘পূজা করি মোরে রাখিবে উর্ধ্বে, সেনহিনহি, হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে, সেনহিনহি’, তাঁর গায়কী কি পর্যাপ্ত পরিমাণে মেয়েলী হয়? নাকি সময়ের সংজ্ঞায় সুচিত্রা মিত্র রবীন্দ্রগানের জগতে একটি দুষ্প্রাপ্য, বলিষ্ঠ নারীকন্ঠের অধিকারী হয়ে ওঠেন? একই যুক্তি মানলে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গায়কী শিখিয়েছে এক আশ্চর্য স্থির, মাদকীয় প্রেমের নিবেদন। কিন্ত আসল সত্য মোটেও তা নয়। রবীন্দ্রগানের, গায়কের এবং গায়কীর প্রত্যেকের নিজস্ব একটি স্বকীয় লিঙ্গ পরিচয় আছে বলে আমি মনে করি।
একটি গানের, বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীতের লিঙ্গপরিচয় আমরা সচরাচর কাটা-ছেড়া করি ‘কন্টেন্ট’-এর ওপর ভিত্তি করে। গানের বাণী, সুর এবং লেখকের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই আমরা শান্ত হই। অথচ একই গানের ভিন্ন পরিবেশনায় যে সেই পরিচয় মূহুর্তে নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে, তা গ্রাহ্য করি না মোটেও। ভুলে গেলেও মনে রাখতে হবে, যে গানের ক্ষেত্রে তার কনটেন্ট হচ্ছে বিশেষ্য পদ, যা বিশেষভাবে দৃশ্যমান, এবং গায়কী তার বিশেষণপদ, অর্থাৎ সেই বিশেষ্যপদের বর্ণনা, তার নিবেদন। শেষ বয়সে এসে দেবব্রত বিশ্বাস যখন গান, ‘না গো, এই যে ধূলা, আমার না এ’, সেই গায়কী কোন পুরুষের উদ্ধত পৌরুষ মনে করায় না।
গায়কীর লিঙ্গ নির্ধারণ গায়কের লিঙ্গপরিচয় দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়।এবং একইভাবে একটি গানের, বিশেষত রবীন্দ্রসংগীতের লিঙ্গপথনির্ধারণএকমুখী বিশ্লেষণ দ্বারা সম্ভব নয়। আমাদের ফিরে যেতে হবে গানের অনেকান্তিক সত্যের কাছে, যা তাত্ত্বিক বাখতিনের ভাষায় heteroglossaic truth। একসাথে একাধিক অর্থবাহী, রূপকাশ্রয়ে চলা রবীন্দ্রগান কখনো তাই পরিষ্কারভাবে একটি লিঙ্গরূপ নিয়ে চলে না। অতি চেনা কোন গায়কের কন্ঠে শোনা খুব পরিচিত কোন গানও তাই চমকে দেবার ক্ষমতা রাখে শ্রোতাদের। ঠিক যেভাবে দেবব্রত বিশ্বাস চমকে দিয়েছিলেন লেনিনের জন্মদিনে ‘গায়ে আমার পুলক লাগে চোখে ঘনায় ঘোর/ হৃদয়ে মোর কে বেঁধেছে রাঙা রাখির ডোর’ গেয়ে উঠে।
সেদিনের সেই উচ্চারণ ছিল রবীন্দ্রসংগীতের মধ্যে অনেকান্তিক সত্যের প্রবণতার প্রমাণ, যা সাধারণত আমাদের চোখে-কানে ধরা পড়ে না। এবং ধরা পড়ে না বলেই, আমরা মেতে থাকি সুচিত্রা-কণিকাকে গায়কীর মাপকাঠিতে একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করাতে, পাশাপাশি নয়। এটাই বেশিরভাগ রবীন্দ্রসংগীত শ্রোতার অত্যন্ত দুঃখজনক চরিত্র।
- শবনম সুরিতা
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
চারটে লেখাই সুন্দর, তবে স্পন্দনা ভৌমিক এর লেখাটি প্রাণ কাড়ল। একটি কথা তবু বলি সবার আলোচনায় লেজেন্ডদের গান শুনলাম। ইদানীংকার কারো গানই কি সাড়া দেয় নি?