• ক্যাম্পাসের খবরে জেন্ডার


    0    113

    November 3, 2017

     

    বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের অবস্থান বিক্ষোভ

    বিএইচইউ, পিঞ্জরা তোড়, #MeToo এর প্রচার এবং GSCASH-এর দাবিতে ঘেরাও—কোনদিকে এগোচ্ছে লিঙ্গসাম্যের লক্ষ্যে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন 

    গত মাসে দুর্গাপুজার ঠিক আগে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটা একটি শ্লীলতাহানির ঘটনা খবরের শিরোনামে উঠে আসে। ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের মধ্যে কয়েকজন বাইক আরোহীর দ্বারা নিগৃহীত হওয়ার পর কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলেও হেনস্থা ও অসহযোগিতার মুখে পড়তে হয় অভিযোগকারী ও তার বন্ধুদের। তারপর গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ব্যাপক আকারে আন্দোলন শুরু হয় তা বেনারস শেষ কবে দেখেছে জানা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলন নিরসনের জন্য সহজতর পন্থাটি বেছে নেওয়া হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর পুলিশের লাঠিচার্জে বহু ছাত্রী গুরুতরভাবে আহত হন। পাশাপাশি ১২০০-এরও বেশি অচিহ্নিত আন্দোলনরত ছাত্রীর নামে এফআইআর দায়ের করা হয়। গোটা দেশে শিক্ষামহলে এই ঘটনার প্রতিবাদ ও নিন্দা করা হয়। রাজ্য সরকার, পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একাধিক বিবৃতির মাধ্যমে ক্যাম্পাসের মধ্যে লাঠিচার্জের ঘটনা বারংবার অস্বীকার করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু এর মধ্যেই প্রতিমা গোন্দের অভিযোগ উঠে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএমভি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ডেন এবং মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা প্রতিমা গোন্দ ২৩ সেপ্টেম্বর রাত্রে হোস্টেল অবধি পুলিশের তাড়া খেয়ে ছুটে আসা এক ছাত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হন। পুলিশের লাঠির আঘাতে তাঁর আঙুল ভাঙে। এরপরেই মুখরক্ষার খাতিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবার মহিলা চিফ প্রোক্টর হিসাবে রোয়ানা সিংকে নিয়োগ করা হয়।

    বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মাস আগেকার ঘটনা চুম্বকে এটুকুই। এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও ২১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার জন্য কাউকে গ্রেপ্তার ক্রয়া সম্ভব হয়নি। বরং গোটা অক্টোবর মাসে থানায় দায়ের হয়েছে একাধিক অভিযোগ, যার মধ্যে আছে—শ্লীলতাহানি, হেনস্থা, মারধোর, অপহরণের মত ঘটনা। এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে GSCASH (জেন্ডার সেনসিটাইজেশান কমিটি এগেন্সট সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট) গঠিত হয়নি। নবনিযুক্ত প্রোক্টর GSCASH তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা বললেও ছাত্রীদের দাবি, কর্তৃপক্ষ শুধু ICC (ইন্টারনাল কমপ্লেইন কমিটি) তৈরি করেই ক্ষান্ত হতে চায়। কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের দাবিমত যথেষ্ট সংখ্যায় আলো ও সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

    বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা কেন স্ফুলিঙ্গের আকার নিল তা বুঝতে হলে কিছুটা পিছনে যেতে হবে। আজ যেখানে দেশজুড়ে মেয়েদের সমানাধিকারের দাবি প্রধান রাজনৈতিক দাবি হিসাবে সামনের সারিতে উঠে এসেছে, এবং দেশব্যাপী সেই নারী আন্দোলনে যারা মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন, সেই ছাত্রীদের প্রতি কর্তৃপক্ষের জারি করা নিয়মকানুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়েই আটকে আছে, যা নিঃসন্দেহে তখনও ততটাই সংকীর্ণ ছিল। আবাসিক ছাত্রীদের সন্ধ্যার মধ্যে হোস্টেলে ঢুকতে হবে, সারারাত্রি চালু থাকা লাইব্রেরীতে যাওয়া যাবে না ইত্যাদি, এছাড়া পোশাকের উপর বিধিনিষেধ তো আছেই। প্রায় এক বছর ধরেই ছাত্রীরা এই জাতীয় বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন, ২১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা এবং তারপর কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা তাতেই ঘৃতাহুতির কাজ করে। স্পষ্টতই, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত, এবং শুধুমাত্র সিসিটিভি বা রাস্তার আলোর সংখ্যা বা ঔজ্জ্বল্য কর্তৃপক্ষের ভাবনার আঁধার ঘোচাতে পারবে বলে মনে হয় না।

     

    বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন এই আন্দোলন চলছে, ঠিক সেই সময়েই ‘পিঞ্জরা তোড়’-এর পক্ষ থেকে দিল্লীতে জমায়েত ও প্রতিবাদসভার আয়োজন করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘পিঞ্জরা তোড়’ দিল্লীর রাস্তায় রাত্রে মহিলাদের, বিশেষত ছাত্রীদের, নির্ভয়ে চলাচলের উপর সরকার, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং সর্বোপরি পরিবার থেকে যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করার মঞ্চ হিসাবে শুরু হয়েছিল, যা আজ দিল্লীর বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলিতে ছাত্রীদের প্রতি বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ এবং যৌন হেনস্থার অভিযোগের দ্রুত তদন্তের দাবিতে লড়াই করছে। ২৮ সেপ্টেম্বরের রাতে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের সমর্থনে এবং সক্রিয় GSCASH-এর দাবিতে পথে নামে।

    এই আন্দোলন আরও একবার সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে GSCASH গঠন করার প্রয়োজনীয়তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিরন্তর আন্দোলন সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (UGC) উদাসীনতা ক্রমশ আরও প্রকট হয়ে উঠছে। ICC বা আভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি, যার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে, তা জেন্ডার সচেতনতার প্রচার ও যেকোনো অভিযোগের তদন্ত করার ক্ষেত্রে কতটা সদর্থক ভূমিকা নিতে সক্ষম, তা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ থেকে বোঝা গেছে। তার বিপ্রতীপে GSCASH-এ ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মচারীদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপস্থিতি জেন্ডার সচেতনতার প্রক্রিয়াকে আরও গণতান্ত্রিক করবে। সম্প্রতি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত GSCASH ভেঙে দেওয়ার প্রতিবাদে এবং সমস্ত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় GSCASH –এর দাবিতে গত ২৭ অক্টোবর ইউজিসি অভিযানের ডাক দেওয়া হয় ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকে।

    #MeToo হ্যাশট্যাগের সাথে গত মাস থেকে যেভাবে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন বয়স, জীবিকা ও নাগরিকত্বের মেয়েরা নিজেদের নিগ্রহের দিনলিপি সামনে এনেছেন, আনছেন তা সত্যিই খুব গুরুতর। গত মাসের শেষে দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষাজগতের পঞ্চাশেরও বেশি প্রতিষ্ঠিত, সুপরিচিত, স্বল্পপরিচিত মানুষের নাম নিগ্রহকারীর ‘তালিকায়’ প্রকাশ পেয়েছে। এই তালিকার পক্ষে বা বিপক্ষে বিভিন্ন মানুষ তাঁদের মতামত রাখছেন, রাখবেন, কিন্তু সক্রিয় GSCASH তৈরির যে দাবি ছাত্রীদের, সেই আন্দোলন আগামীদিনে নিঃসন্দেহে আরও জোরদার হবে। কারণ এই ‘নাম ও বদনামের’ তর্কের আড়ালে যাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজের দায় এড়িয়ে যেতে সক্ষম না হয়, সেবিষয়ে সচেতন থাকা ও করার দায়িত্ব আন্দোলনকারী এবং তাদের পাশা থাকা সকলের কাঁধেই সমানভাবে বর্তায়।

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics