• ‘মঞ্চ’ থেকে ‘মৈত্রী’ : নারী দিবসের সূত্রে


    0    171

    March 7, 2018

     

    কলকাতা শহরে আমি এসেছি ১৯৭৫ সালে, এমারজেন্সির সময়। তার আগে আমার ছাত্রাবস্থা কেটেছে বর্ধমান টাউনে। ১৯৮৩ সালে কলকাতায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চ গড়ে ওঠে। শুরু থেকেই আমি এই মঞ্চের সাথে যুক্ত আছি। কলকাতা শহরে আমার আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চ গড়ে তোলার পরে, ১৯৮৫/৮৬ সাল থেকে।

    ১৯৮৬ নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের পক্ষ থেকে প্রকাশিত প্রচারপত্র

    নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চ বিভিন্ন সংগঠন নিয়ে তৈরি মঞ্চ, তার যাঁরা সদস্য ছিলেন এই উদযাপনে সবাই যুক্ত হতেন। সেই সময়ে মঞ্চে ছিল সচেতনা, মহিলা পাঠচক্র, মহিলা পাঠাগার, অহল্যা, প্রগতিশীল মহিলা সমিতি প্রভৃতি সংগঠন। আমরা সাধারণত এই সভাগুলো করতাম শিয়ালদহ স্টেশনে। আজকের শিয়ালদহ স্টেশনের যা চেহারা, সেই চেহারাটা কিন্তু তখন ছিল না। অনেকটা খোলা জায়গা ছিল। সেখানে এইধরনের সভা অনেক হত। আমরা শিয়ালদহে করতাম কারণ ওইখানে সভা করলে বিরাট একটা জনতাকে আমরা শ্রোতা হিসাবে পেতাম। শিয়ালদহ থেকে সবাই ট্রেনে ওঠার আগে অনেকেই বক্তব্য শুনতেন দাঁড়িয়ে। যাঁরা শুনতেন তারা মূলত দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগণার নিত্যযাত্রী।

    ১৯৯০ সালে ছটি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে পালিত আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রচারপত্র

    সভায় মঞ্চের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখা হত, গান হত, ছোট নাটক হত। এইভাবে প্রতি বছর আমরা নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করতাম। একেক বছরে একেকটি বিষয় নিয়ে আমরা করেছি। একবার যেমন বিষয় ছিল, ‘পশ্চিমবঙ্গের মেয়েরা কি সত্যিই নিরাপদ?’ এই প্রশ্ন নিয়ে আমরা একটা পুস্তিকা প্রকাশ করেছি। তারপর ১৯৯৩ সালে ‘সাম্প্রদায়িকতা ও নারী’ বিষয়ে একটা পুস্তিকা বার করেছি। তারপর ‘নারী ও জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতি, বৈষম্য ও অধিকারহরণ’ এই বিষয়ে একবার পুস্তিকা প্রকাশ করেছি। একেক বছরে যে বিষয়টি সবথেকে জ্বলন্ত মনে হয়েছে, সেই ইস্যুকে সামনে রেখে আমরা প্রচার করেছি, পুস্তিকা বার করেছি, তথ্যসংগ্রহ করেছি, প্রচারের চেষ্টা করেছি, এবং তাকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বিষয় হিসাবে দেখেছি। যে বছর গীতা হরিহরনের রায় বেরোল, ১৯৯৯ সালে, সেই সময়ে আমরা একটা পুস্তিকা প্রকাশ করে, মায়ের অধিকারের বিষয়কে সামনে এনে, সেই বিষয়কে নিয়েই আমরা ৮ই মার্চ পালন করেছি।

    ১৯৯২, ১৯৯৩, ১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্রকাশিত পুস্তিকার প্রচ্ছদ
    ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত প্রচারপত্র

     

    ১৯৯৫ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবস কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এই বছরই রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে বেজিং সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সরকারী প্রতিনিধি ছাড়াও বহু বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হাজির ছিল। সেখানে সরকারী প্রতিনিধিরা গোপন করার নিরন্তর চেষ্টা করে তাদের দেশে কি জিনিস ঘটছে মহিলাদের উপরে, এবং আন্দোলনকারী সংগঠনরা সেখানে সেই ঘটনাগুলিকে তুলে ধরার চেষ্টা করে। এবং সেটা একটা হাতিয়ার হিসাবে কাজ হয়। সেই সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গ থেকেও অনেকে যান। অনেক সংগঠনের প্রতিনিধিরাই গিয়েছিলেন। তাঁরা ফিরে এসে প্রস্তাব দিলেন যে আমরা অনেকগুলি সংগঠন এখানে আছি, আমরা কেন ৮ই মার্চ পালন করি না? তখন আন্তর্জাতিক নারী দিবস মঞ্চ তৈরি হয়, ১৯৯৫ সালে। সে বছর মঞ্চের পক্ষ থেকে নারী দিবস পালন করা হয়, এবং সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই মঞ্চের পক্ষ থেকে চার্টার অফ ডিমান্ড তৈরি করা হয়। সেই চার্টার অফ ডিমান্ডে আমরা অনেকগুলি দাবি রাখি। দাবিগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঐতিহাসিক দিক থেকে এই মঞ্চের খুব গুরুত্ব রয়েছে। এবং পরে এই মঞ্চই ‘মৈত্রী’ হিসাবে গড়ে ওঠে। এবং ‘মৈত্রী’ কিন্তু তারপরে ধারাবাহিকভাবে ৮ই মার্চ পালন করে আসছে।

    ১৯৯৫ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস মঞ্চের পক্ষ থেকে প্রকাশিত পুস্তিকা
    ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস মঞ্চের পক্ষ থেকে প্রকাশিত 'চার্টার অফ ডিমান্ডস'।

    একবার মনে আছে, আমাদের নারী দিবস পালনের বিষয় ছিল যুদ্ধের বিরোধিতা। সেটা সম্ভবত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের পক্ষ থেকে নয়, যতদূর মনে পড়ছে। গ্লোবাল মার্চের সময় ‘যুদ্ধ নয়, কাজ চাই’ এই দাবিতে, ২০০০ সালে খুব বড় একটা মিছিল হয়েছিল কলেজ স্ট্রিটে। অনেকে এসেছিলেন গ্রাম থেকে, শ্রমজীবী মহিলা সমিতি কর্মসূচীতে যোগ দিয়েছিল। স্লোগান উঠেছিল, ‘যুদ্ধ নয়, খাদ্য চাই’। সেই সময়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা, এখনো বেশ মনে আছে।

    সেই বছরের একটা খুব উল্লেখযোগ্য ঘটনা মনে আছে। যে গ্লোবাল মার্চ হয়েছিল, সে বছর হিলিতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে আমাদের দুই দেশের মহিলা সংগঠনগুলি একসাথে সমাবেশ করেছেন, শান্তির দাবিতে এবং প্রধানত নারী পাচারের বিরুদ্ধে। এই উপমহাদেশে অসহিষ্ণুতা এবং মৌলবাদের চোখরাঙানি যেভাবে বাড়ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সেই সমাবেশ আরোই গুরুত্বপূর্ণ। গ্লোবাল মার্চের অংশ হিসাবে এই সমাবেশ হয়েছিল।  

    অনুলিখন : সুদীপ চক্রবর্তী 

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics