• সুশীল মানে সুবোধ নয়


    0    239

    February 2, 2018

     

    যুবা হুঙ্কার র‍্যালি, দিল্লি

    ইংরেজি ‘সিভিল সোসাইটির’ বাংলা হিসেবে ‘সুশীল সমাজ’ কথাটা উঠে এসেছিল সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়। তারপর তখনকার বামফ্রন্ট সরকারের সমর্থকরা কথাটাকে মূলত ব্যাঙ্গার্থে ব্যবহার করতে শুরু করে। ‘সিভিল’কে ‘সুবোধ’ বলে ব্যঙ্গ করার পাশাপাশি নিজেদের মারমুখী চেহারাটাকে সরকারি বামেরা সেই সময় ‘হার্মাদ’ বলে অভিহিত করেছিল। তার অনুষঙ্গ ছিল এই যে ন্যাকা সুশীল সমাজ শোষিতের পক্ষে লড়া মারমুখী বামেদের ‘হার্মাদ’ বলছে, তাই বামেরাও ব্যঙ্গ করে নিজেদের সেই মিথ্যা পরিচয়টাকেই তুলে ধরছে। দু:খের বিষয় পরবর্তী দিনে সেই বামেদের প্রায় মুছে যাওয়া সম্ভবত বলে যে মানুষ সেই পরিচয়টাকে ছদ্ম বলে মনে করেনি, আক্ষরিক ভাবেই নিয়েছিল। কেবল বাংলায় নয়, পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়নেও কিন্তু সুশীল বনাম সরকারি বামেদের মধ্যে অনেক বড় এক লড়াই আমরা দেখেছিলাম ১৯৮৯ সাল নাগাদ। যখন পূর্ব ইউরোপের নানান দেশে সুশীল সমাজ বা সমাজের নানান ধরণের মানুষের অসংগঠিত প্রতিবাদ জোরালো আন্দোলন হয়ে উঠে স্তালিনবাদের পতনের কারণ হয়ে উঠেছিল।

    সুশীল কথাটা সিভিল কথাটার ঠিক বাঙলা কিনা এই নিয়ে আলোচনা চলতে পারে। কারণ ব্যবহারিক ভাবে সুশীল কথাটার সঙ্গে বাংলায় কী রকম একটা পোষমানা ভাবের যোগাযোগ আছে বলে মনে হয়। রাষ্ট্র আর পরিবারের মধ্যেকার যে পরিসরকে আমরা সিভিল সোসাইটির জায়গা বলে জানি, ইতিহাসে তার ভূমিকা কিন্তু সব সময় সুবোধ নয়। কিন্তু বরাবরই সংগঠিত দলগুলি এই নাগরিক সমাজের ভূমিকাকে সন্দেহের চোখে দেখেছে, সুযোগ মত ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে, আর দলীয় স্বার্থের বিপক্ষে গেলেই নানানভাবে নিন্দা আর বিরোধিতা করেছে। কিন্তু গণতন্ত্রে সচেতন নাগরিক সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, একেবারে মৌল। একটি সমাজে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে দলীয় পরিসরের বাইরে সাধারণ মানুষের আন্দোলন, বিতর্ক, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোতে যোগ দেওয়া যে কতটা জরুরি, সেটা আমাদের দেশেও আমরা বারবার দেখেছি।

    বারবার আমাদের প্রদেশে বা দেশে নাগরিক সমাজের ওপর আক্রমণ নেমে আসতে আমরা দেখেছি। ইমারজেন্সিকে একটা চূড়ান্ত মুহুর্ত বলে ধরে নেওয়া হলেও, তার আগে আর পরে সরকার বা নানান দল এই ধরণের আক্রমণ করেছে। গত কয়েক বছর ধরে তো এই আক্রমণ বেড়েই চলেছে। ধর্মের নামে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে সব রকমের সমালোচনার টুঁটি টিপে ধরে ভয়ের আবহাওয়া তৈরি করে চলা হচ্ছে। এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে যেখানে কোনও ভিন্ন স্বর শুনতে পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়ে দিতে হচ্ছে।  এই সময়ে হঠাৎ তিন জন যুবক উঠে এসেছেন, যাঁদের ঘিরে আবার কিছুটা অন্য হাওয়া বইছে। গত ১৮ জানুয়ারির দি হিন্দু-তে এঁদের নিয়ে নীরা চন্দোকের লেখাকে অবলম্বন করে আমরা একটা জরুরি আলোচনা করতে পারি। নীরা বলছেন, এই তিন জনকে ঘিরে বর্তমান সরকারের শক্তির কেন্দ্র গুজরাটেই কিছুটা হলেও ভিন্নমত দানা বেঁধে উঠেছে। এঁরা সমাজের নানান বর্গের মানুষদের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার প্রশ্ন, অধিকারের প্রশ্নকে বতর্মান জাতীয় রাজনীতির ধরনধারনের সঙ্গে যুক্ত করে নানান রকমের দাবি তুলছেন। এই তিন জন অর্থাৎ জিগনেশ মেভানি, হার্দিক প্যাটেল ও অল্পেশ ঠাকোর হয়ত আপাতত নাগরিক সমাজের মূক, ম্লান মুখে দিতে পারেন ভাষা, আর ভগ্ন শুষ্ক ইত্যাদি বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে পারেন আশা। এই তিন জনের মধ্যে শ্রী মেভানিকেই সবচেয়ে শক্তিশালী আর দৃঢ-প্রতিজ্ঞ বলে মনে হয়। ২০১৬ সালে উনা-তে দলিতদের বীভৎস ভাবে খুন হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে উনি উঠে এসেছিলেন, স্লোগান ছিল: ‘গরুর লেজ তুমি নাও, আমাদের জমি দাও’। এইভাবে উনি দলিত আন্দোলনকে বোঝার ব্যাপারে কেবল জাতপাত আর আত্মপরিচয়ের রাজনীতির থেকে আরও জরুরি আর্থ-সামাজিক দিকটা তুলে ধরেন। জাতপাত আর শ্রেণির প্রশ্নকে একসাথে মিলিয়ে উনি জোড়া স্লোগান তুললেন: ‘জয় ভীম’ আর ‘লাল সালাম’ -- আর এই ভাবে উন্নয়নের গুজরাট মডেলকে চ্যালেঞ্জ করলেন। যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণা শ্রমিক কৃষককে উন্নয়নের ফল ভোগের আওতা থেকে বাদ রাখে, তার যার্থাথ্য নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুললেন। জিগনেশ বিজেপি ছাড়াও গোটা নিও-লিবারেলিজমকেই প্রশ্ন করেন। আজকের ভারতে নাগরিক মানচিত্রের বাইরে পড়ে থাকা কোটি কোটি মানুযের হয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন। তিনি বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেন যে ঢাক ঢোল পিটিয়ে যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, সেটা আসলে শুধু বড়লোকদের জন্য, আর তার দাম দিচ্ছে গরিব মানুষ।

    এইভাবে তাঁর রাজনীতি জাতপাতের রাজনীতির ওপরে উঠে যায় যখন দেখি তিনি শুধু দলিতদের কথা বলছেন না, গরিব ব্রাহ্মণদের কথাও বলছেন, আক্রান্ত মুসলমানদের কথাও বলছেন, আর উপজাতি আর আদিবাসীদের কথাও বলছেন। জিগনেশ তাঁর বক্তব্যে কৃষকদের বিপুল সমস্যার কথা তুলে ধরছেন, তিনি বলছেন, বর্ণভেদের অসাম্য তখনই দূর হবে যখন দলিতরা জমি পাবে, চাকরি পাবে। যখন তারা উৎপাদনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে মূল্য উৎপাদন করতে পারার আত্মবিশ্বাস অর্জনের অধিকার পাবে তখন।  

    জিগনেশ মনে করেন দলিতদের কিছু টাকা ছুঁড়ে দিয়ে তাদের উন্নয়ন ঘটানো যাবে না। যদি জমি না থাকে, রোজগার না থাকে তবে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় না। জিগনেশ উনা-র ঘটনা নিয়ে আন্দোলনের মুখটাকে অনেক ছড়িয়ে দিয়েছেন। এ কেবল ওই দলিত শহিদদের নিয়ে নয়, এই আন্দোলন সব ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন। এই আন্দোলনে এগিয়ে এসে কিন্তু এই তিন নেতা তিনটি আলাদা জনগোষ্ঠীকে একটা যৌথ আন্দোলনের মধ্যে নিয়ে আসায় সফল হয়েছেন।

    আমরা দেখেছি, জাতীয় মঞ্চ তৈরি করার উদ্দেশ্যে জিগনেশ দিল্লিতে ছাত্র আন্দোলনের নেতা কানহাইয়া কুমার, শেহলা রশিদদের সঙ্গে ৯ই জানুয়ারি, ২০১৮ একটি যুব হুঙ্কার র‍্যালি সংগঠিত করেছিলেন। আমাদের মিডিয়া বড় আনন্দের সঙ্গে আমাদের জানিয়েছে যে সেই র‍্যালিতে মোটেও লোক হয়নি – যেন এই খবরে আমাদের আহ্লাদিত হওয়া উচিত! হিংস্র রাজনীতিবিদদের মিটিং-এ লোক ভেঙে পড়ে, জিগনেশদের মিটিং-এ লোক আসে না কেন, এই নিয়ে যে আমাদের গভীরভাবে চিন্তিত হওয়া দরকার, সেই বোধ খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। জিগনেশরা নিজেদের মত করে লড়ে যাবেন, কিন্তু আমাদের পশ্চিম বাংলায় নাগরিক সমাজের ভবিষ্যৎ কী ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রায় এককভাবে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মতামত রেখে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর দলীয় মঞ্চ থেকে পশ্চিম বাংলায় ক্ষমতায় থাকার রাজনীতির বেশি কিছু উঠে আসবে বলে মনে করা কঠিন। এমন কী দলের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা সত্যিকারের আদর্শ না কি কেবল ভোটের হিসেব, সেটাও বলা কঠিন। বিজেপি এখনও এখানে ঠিক জমি পায়নি, কিন্তু কোনোদিন পাবে না বলা ভুল হবে। হিংস্রভাবে লোভী ভারতীয় মধ্যবিত্ত নিজেকে বঞ্চিত ভাবতে ভালোবাসে, তাই কখনও মুসলমান, কখনও দলিত, কখনও মেয়েরা বেশি সুবিধা পাওয়াতে ‘আমাদের’ সর্বনাশ হল, এই বোধ তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া বেশি কঠিন নয়। মন্ডল আন্দোলন থেকে মহরমের মিছিল হবে কেন থেকে মেয়েদের ওপর বিদ্বেষে আমরা বারবার এই ছবি দেখে চলেছি। সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় যাঁরা সুশীল সমাজ হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ মন্ত্রী, কেউ সরকারি আমলা বা সরকারি মদতে সুবিধাভোগী হয়ে গিয়েছেন। অনেকে আবার এসব সুবিধা না নিয়ে নিজের কাজে ফিরে গিয়েছেন। মাঝে মাঝে ‘নট ইন মাই নেম’ জাতীয় আন্দোলনের আঙিনায় তাঁদের দেখা যায়, এঁদের অনেকেরই আবার বেশ বয়স হয়ে গিয়েছে। তবু এঁরা আসেন, অল্পবয়সিদের কম দেখি।

    মাঝে মাঝে মনে হয় জিগনেশ-এর মত বা শেহলা/কানহাইয়ার মত অল্পবয়সি নাগরিক নেতা আমাদের রাজ্যে হল না কেন? যাদবপুরে যে হোক কলরবকে কেন্দ্র করে ছোটরা বেশ কিছু কথা বলেছিল, সেগুলো হারিয়ে গেল কেন? ছড়ালো না কেন? উত্তর জানি না, তবে একটা কথা মনে হয় যে রাজনীতি মানেই দলীয় রাজনীতি এই ধারণাটা এই রাজ্যে বোধ ও অভ্যাসের এত দিন ধরে সব রকমের মানুষের ভেতরে ঢুকে গিয়েছে, যে সত্যি সত্যি একটা নাগরিক সমাজের রাজনীতিতে আমাদের অভ্যাস নেই, বিশ্বাসও আছে কিনা জানি না। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আন্দোলনও কিন্তু শেষ অবধি তৃণমূলের ভোট জেতাতেই আটকে গেল। জমি, শিল্প, রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাস নিয়ে নানা আলোচনা তখন উঠে এসেছিল, সব হারিয়ে গেল—জানি না, কী হবে, তবে দলের বাইরে একটা রাজনৈতিক ফোরাম দরকার, যার জোর আসবে তার মুক্ত, আপাত ঢিলেঢালা আর নানারকমের মত নিয়ে চলা কিন্তু কতগুলো মৌলিক ব্যাপারে লড়ে যাওয়ার মানসিকতা থেকে।

    (ঋণ স্বীকার: থ্রি চিয়ার্স ফর সিভিল সোসাইটি, নীরা চন্দোক, দি হিন্দু, জানুয়ারি ১৮, ২০১৮)

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics