• রিফিউজি কলোনি-র কমিউনিস্ট মেয়েরা


    11    1363

    May 9, 2017

     

    ১৯৪০-এর দশকে কলকাতায় একটি রাজনৈতিক শিক্ষা শিবিরে বিভিন্ন জেলার কমিউনিস্ট মেয়েরা

    আমাদের ছেলেবেলার বিজয়গড়, নেতাজীনগর, শ্রী কলোনি, আজাদগড়, সংহতি কলোনি, সমাজগড়, নিঃস্ব কলোনি, গান্ধী কলোনি – এইসব উদ্বাস্তু এলাকার চেহারা এখনকার সঙ্গে একদমই মিলবে না। শ্রী কলোনি-র মোড় থেকে যাদবপুর এইট বি বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তাটা পিচের। কিন্তু বাহন বলতে রিকশা। নাহলে সাইকেলে বা হেঁটে যেতে হবে। পাকা বাড়ি হাতে গোনা। বেড়ার বাড়ি বেশির ভাগ। টালি বা টিনের চাল। জমির সীমানাগুলো হয়তো রাংচিতের বেড়া দিয়ে ঘেরা বা বাঁশের। সব বাড়িতেই প্রায় ফল এবং ফুলের গাছ। উঠোনগুলো মাটির। বৃষ্টি হলেই পিছল, কাদাময়। তখন গেট থেকে ঘরের দাওয়া পর্যন্ত জোড়া জোড়া করে ইঁট পেতে রাখা হত। তুলসীতলা ছিল প্রায় সব বাড়িতে। সন্ধে দেওয়ার সময় অল্প আগে পরে শাঁখ বেজে উঠত বাড়িতে বাড়িতে। আমাদের বাড়িতে বাজত না। আমার মা বাবা দুজনেই ‘পার্টির’ লোক।

    মা রান্না-টান্না করে স্কুলে পড়াতে চলে যেত। এক পা গোদে ফোলা রাজেনদা ছিল মা-র বাঁধা রিকশা। মা-কে কখনও শাদা শাড়ি ছাড়া কিছু পরতে দেখিনি। পাড়ের কারুকার্যই একমাত্র বিলাসিতা। শাঁখা বারবার ভেঙে যায় বলে মা একহাতে কেবল একটা লোহা পরত আর অন্য হাতে একটা কি দুটো খুব সরু সোনার চুড়ি। নেল পালিশ, লিপস্টিক, কাজল নিজে তো ব্যবহার করতই না, আমার নিতান্ত দুই বালিকা দিদিদেরও বারণ ছিল ওসব ব্যবহার করায়। উদ্বাস্তু কলোনির প্রসাধনের শেষ কথা বসন্ত মালতী। সন্ধেবেলা ফুলের গন্ধের সঙ্গে টক্কর দিত বসন্ত মালতী। কিন্তু সেই স্বর্গোদ্যানের বস্তু আমাদের বাড়িতে ঢুকত না। এখন বুঝতে পারি মা তখনও মধ্য তিরিশ।

    মা-র বন্ধুরাও সব পঁচিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে বয়স। সবাই পাড় দেওয়া শাদা খোলের শাড়ি পরত। কেউ কেউ দু’-একবার শাদার উপরে ডুরে। কেউ লিপস্টিক লাগায় না, নেল পালিশ লাগায় না, কাজল কদাচিৎ, নিতান্ত সাধাসিধে। কেউ সন্ধে দেয় না, শিবরাত্রির উপোস করে না, হরির লুট দেয় না। সবাই আমার মাসি। কেবল পুলিশের অত্যাচারে নিম্নাঙ্গ অবশ হয়ে ছ’-মাস বিছানায় পড়ে একটু একটু করে আবার হাঁটতে শিখল যে সে অপর্ণা পিসি। কেননা সে বাবাকে দাদা মেনেছে। পিসিও শাদা শাড়ি পরে, সাজগোজ করে না, ইস্কুলে পড়ায়।

    এখানে আমরা যে স্কুলে পড়েছি ছেলেবেলায় সেই ‘শিশুর দেশ’-এর কথা একটু বলতে হবে। এই স্কুল ছিল বিজয়গড়ের ক্রেমলিন বিজয়গড় কলেজের অধ্যক্ষ অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর বাড়িতে। এখানে যে দিদিমণিরা পড়াতেন তাঁরা যে সব পার্টির লোক ছিলেন এমন নয়। তবে তাঁরাও মূলত শাদা শাড়ি পরতেন, সাজগোজ করতেন না। বড় দিদিমণি ছিলেন সুষমা চক্রবর্তী যাকে আমি জেঠিমা বলে ডাকতাম। জেঠিমা মায়েদের চেয়ে একটু বয়েসে বড়। মা-দের মত করে শাড়ি পরতেন না। উনি পড়তেন ঘরোয়া স্টাইলে।আঁচলে একগোছা চাবি বাঁধা থাকত।

    পড়াশোনা নিয়ে বাচ্চাদের ভয় দেখানো ছিল একদম বারণ। অনেক কবিতা-গল্প পড়া, মজার মজার নানা খেলায় স্কুলের অনেকটা সময় দেওয়া হত। এই কর্মকান্ডের অধিনায়িকা ছিলেন জেঠিমা। তিনি ঠিক পার্টি কর্মী ছিলেন না। কিন্তু মনে প্রাণে কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি চির অনুগত। জ্যাঠামশাই মা-দের ‘মাস্টারমশাই’। জীবনযাত্রা কতটা সাধাসিধে হবে এ ব্যাপারে মা-রা দেখেছি জেঠিমার নির্দেশ – উক্ত বা অনুক্ত – মেনে চলত। রবীন্দ্রজয়ন্তী ইত্যাদির নির্দেশক ছিলেন জ্যাঠামশাই – এইট বি বাসস্ট্যান্ড থেকে শ্রী কলোনি মোড় পর্যন্ত সংস্কৃতির সবচেয়ে স্বীকৃত, সবচেয়ে প্রতাপশালী কমিসার।

    বিশ্বমাসি এলে পাশের বাড়ির লোকও জানত কেউ এসেছে। অত প্রাণখোলা অট্টহাস্য খুব কম শুনেছি। বিশ্বমাসিও ইস্কুলে পড়াত। আর সে যে কি অপূর্ব মেটের ঝোল রাঁধত সে আর কি বলব। পরে শুনেছি খুব অল্পবয়েসেই নাকি মহিলা আত্মরক্ষা সমিতিতে যোগ দিয়েছিল বিশ্বমাসি। এই মাসিরা মাঝে মাঝে রবীন্দ্রজয়ন্তী করত। গান হত, নাটক হত, এমনকি নৃত্যনাট্যও হত। আবার মিছিলও করত। বিজয়গড় বাজারের সামনে পথসভায় বক্তৃতাও দিত।

    মা-র থেকে একটু ছোট কণিকা মাসি ছিল সবচেয়ে তুখোড় বক্তা। ছিপছিপে, ঘন কালো একজোড়া চোখ তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে, জেদীভাবে একটু ঠেলে বেরোনো চোয়াল, রিনরিনে গলায় বক্তৃতা করত। প্রত্যেকটা কথা স্পষ্ট উচ্চারণে কেটে কেটে ঝরঝরে বাংলায় বলা। সহজেই ভিড় জমে যেত।

    মা-দের একটা বড় আড্ডা ছিল বিজয়গড় আর শক্তিগড় এর সীমানায় ছায়া মাসির বাড়ি। মা-দের ছায়াদি আরেকজন যাকে সবসময়েই দেখেছি ঘরোয়া স্টাইলে শাড়ি পরতে। পান খেতেন খুব। স্থূলকায়া। পরিষ্কার বলতেন লেখাপড়া বেশি করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু প্রবল বিক্রমে ছোট ছোট মেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পার্টির কাজ করতেন। ওঁর স্বামী ছিলেন অত্যন্ত মৃদুভাষী। এখন মনে হয় সাংসারিকভাবে নিশ্চয় অসফল ছিলেন না। কেননা ওঁদের ছিল পাকা দোতলা বাড়ি। মা-দের বৃত্তে প্রায় কারুরই ছিল না। কিন্তু ছায়া মাসির প্রবল ব্যক্তিত্বের কাছে সম্পূর্ণ আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। সবাই বলত ছায়াদির বাড়ি।

    ছায়া মাসি অত পোষাকি ভদ্দরলোকির তোয়াক্কা করত না। কিন্তু সকলের আশ্রয়। ছায়া মাসি এলেই মাকে নিয়ে কোনো কাজে বেরিয়ে যাবে এই নিয়ে খুব ছোটবেলায় আমি হয়ত একবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলাম। আমাকে তাই নিত্য ক্ষ্যাপাত। এসেই বলত – খোকন, তর মা রে কিন্তু লইয়া যামু। কিন্তু ততদিনে আমার ছায়া মাসির সঙ্গে ভাব হয়ে গেছে। হাসতাম কেবল।

    এই স্বচ্ছ ঋজু চেহারার মেয়েদের দেখলেই চেনা যেত। অনেকটা মেঘে ঢাকা তারার নীতার মত ছাঁচ। কেবল দাঁড়ানোটা আরেকটু আত্মবিশ্বাসী। বিশ্বমাসির হাসির মধ্যেও যেটা ছিল। একটা বাড়তি কোন আত্মপ্রত্যয়। 

    শাদা শাড়ি আর সাজগোজের সম্পর্কে তাচ্ছিল্য নিশ্চয়ই খানিকটা ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এসেছিল। ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধেই ধেই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে মেয়েরা তাদের চেহারায় হয়ত একটা শুচিতার ঘোষণা থাকা অনেক অনর্থক ইঙ্গিতকে আগেই রুখে দিত। আর নানা গরিব এলাকায় চটকদার সাজ করে কাজ করতে যাওয়ার মত অশ্লীলতা করার তো মানেই হয় না। কিন্তু এছাড়াও কোনো একটা ভাবে মেয়ে হয়ে ওঠার একটা অন্য গল্প এঁরা পেশ করছিলেন যাকে উপেক্ষা করা যায় না।  

     
     



    Tags
     



    Comments (11)
    • আরেকটু বিস্তারিত করা গেলে উপকৃত হব। প্লিজ করুন।

    • আমার জীবনের প্রথম ৭ বছর কেটেছে গান্ধী কলোনিতে ১৯৭০-৭৭। আপনার বিবরণের সাথে আমার স্মৃতি মিলে যাচ্ছে বেশ।
      শিশুর দেশ নিয়ে আমার স্মৃতি ভিন্ন। আমার দাদা আর দিদি ভাল ছাত্রছাত্রী ওরা ওখানকার উজ্জ্বল সদস্য, আমি কিছুই পারতাম না (আজ বুঝি আমার লার্নিং ডিসএবিলিটি ছিল), ভীষণ কাঁদতাম, স্কুলে যেতে ভীষণ ভয় করতো। হাল্কা দুটো স্মৃতি আছে শুধু , কোন একটা অনুষ্ঠানে আরও কয়েক জন বাচ্চার সাথে দর্জি সেজে পিচবোর্ডের কাঁচি হাতে একটা প্রকাণ্ড শামুককে কিছু বলছি ছড়ায়। আর স্পোর্টসে রসগোল্লা দৌড়ে সবার শেষে পৌঁছানোর পরেও দিদিমণি রসগোল্লাটা খাইয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু ক্লাস ওয়ানের পরে আর ঐ স্কুলে আমাকে পাঠানো যায়নি, আমার প্রবল কান্না আর বমির প্রতিবাদে। তারপর আমি পড়েছি গান্ধী কলোনির শিশু মেলায়। তার পর আমাদের পারিবারিক ঠিকানা বদল এবং স্কুল বদল, সেটা ১৯৭৭ এর মাঝা মাঝি। তবে আমি প্রথম স্কুলের মজা পাই আমার পঞ্চম স্কুলে – হরিনাভি ডি ভি এ এস হাইস্কুল, সে আমার বড় মধুর স্মৃতি।

      মহিলাদের পোশাকের বিষয়টা শুধু মাত্র কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব নয়, তখনকার রাজনৈতিক ঘরানাটাই কিছু ছবি তৈরি করতো। কংগ্রেসি পুরুষ রাজনৈতিকদেরও আটপৌরে ধুতি পাঞ্জাবী পায়ে কেডস আমি ছোটবেলায় দেখেছি।

      আমার মা ১৪ বছর বয়সে নবদ্বীপে গিয়ে পিতলের গোপাল মূর্তি কিনে এনে ১৬ বছর বয়সে কমিউনিস্ট গৃহশিক্ষকের অনুপ্রেরণায় নাস্তিক। যৌবন থেকে আজও মার প্রায় সব শাড়িই সাদা বা তার কাছাকাছি। মা’র সাদাসিধে প্রলোভন মুক্ত জীবন আমাকে পথ দেখায়। আমার দাদা মারা যায় মাত্র ৩৫ বছর বয়সে, মা শ্রাদ্ধ করেনি, ১৫ দিনের মাথায় ঘরোয়া স্মৃতি চারণায় অঝোর অশ্রুধারায় গেয়ে ছিলেন – নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা…

    • যে সময়টা এখানে backdrop,তাতে মেঘে ঢাকা তারার নীতাদেরই যেন দেখলাম অন্য নামে।তখনও সমাজে নারী যখন বাতাসে অবশ্য-প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের মতো,চোখে দেখা যায়না, দেখার দরকারও নেই,এমন ভাবেই exist করতেন,সেই সময়ে এঁরা নিজেদের পেশ করেছেন এই dress code এ,শক্ত চোয়ালে কিন্তু দৃপ্ত গরিমায়,কিছুটা strategically বলেই মনে হয়।আসলে এখানে পাশাপাশি দুটো লড়াই চলছিল ওঁদের।কমিউনিস্ট পার্টির লড়াই আর মেয়েদের ব্যক্তি-মানুষ হিসেবে স্বীকৃতির লড়াই।দুটোই সমান রাজনৈতিক।

    • ধুস সুনন্দন-দা, জমে ওঠার মুখেই শেষ করে দিলে – আরো অন্তত ৩-কিস্তি চাই প্লীজ। খুব ভাল লাগলো।

    • খুব ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানতে পারলাম।সুনন্দন এর থেকে এই বিষয়ে আরো কিছু আশা করবো আর জানতে পারবো। ধন্যবাদ।

    • সুনন্দন কাকু বড় ভালো লাগলো লেখাটা। ছায়া পিসিও নেই। মনে পড়ছে আমার ছোটবেলা। তোমার মায়ের কথা অনেক শুনেছি কিন্তু আমার সঙ্গে তেমন আলাপ ছিল না। শিশুর দেশের পুরনো আদর্শই এখনো বহাল রেখেছেন আমার মা।

    • বেশ লাগল। নতুনভাবের লেখা। নারীশক্তির জয়গান।

    • Darun lekha. Monojog akorshon kore raakhe sampurno. Aro ektu jante icche korchhe Mashi der jibon ebong tader kanya ra arthat didi der katha. Sunandan aro likhun, ei bishoy niye.
      Salute

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics