• সমকামী হওয়াটা কি একজন শিক্ষকের অপরাধ?


    2    1726

    May 11, 2018

     

    [২০১৮ সালের মার্চ মাসে সংবাদপত্রের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছিল এমন দুটি ঘটনাযা আপাত পরিচয়ে প্রগতিশীল বাঙালির সমকামভীতির স্বরূপকে বেআব্রু করে দেয়। তার মধ্যে একটি ঘটনা ঘটে ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলেযেখানে গণিত ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক অভিজিৎ কুণ্ডুকে একদিনের নোটিশে চাকরী থেকে বিতাড়িত করা হয়। অভিজিৎ সংবাদমাধ্যমে ও নাগরিকমহলে অভিযোগ তোলেনতাঁর সমকামী হওয়া আত্মকথন বই আকারে প্রকাশের ফলেই এ কোপ নেমেছে তাঁর উপর। এরপর বিভিন্ন মহলে তর্কবিতর্কআলোচনা চলতে থাকেএখনো চলছে। 'এখন আলাপ'-এর পক্ষ থেকে আমরা জানতে উৎসুক ছিলামশিক্ষাক্ষেত্রে ক্যুইর সেনসিটাইজেশনের বাস্তব চিত্রটি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। শিক্ষক-শিক্ষিকা হোন বা ছাত্র-ছাত্রীকমলা গার্লস স্কুল ও ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে যতটুকু উঠে এসেছেতার চেয়ে গভীরে গিয়ে আমরা জানার চেষ্টা করেছিএকজন ক্যুইর মানুষকে কীভাবে নিরবিচ্ছিন্ন বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয় শিক্ষাক্ষেত্রের মধ্যে। অভিজিৎ কুণ্ডুর এই সাক্ষাৎকার সেই লক্ষ্যেই আলোকপাত করবেআমাদের বিশ্বাস। ]

    সুদীপ – তোমার আত্মকথন ‘নাচের ছেলে’ বইয়ের নির্মাণের সময়ের অভিজ্ঞতা দিয়ে আড্ডা শুরু করা যাক।

    অভিজিৎ - আসলে ভারত বা পশ্চিমবঙ্গের মত জায়গায় সমকামী মানুষদের জীবন মোটামুটি কমবেশি একইরকম স্রোতে চলে। যেমন ধরো, ভীষণ অ্যাবিউসিভ শৈশব, অপমান, এবং এক দীর্ঘ লড়াই। এবং এই লড়াই সমাজের মূল স্রোত থেকে ভিন্ন হওয়ার জন্যই, যে কারণে সমাজ বারংবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যে তুমি ভিন্ন! এই লড়াই চলতে চলতে আমার জীবনে এমন এক সময় আসে, যখন আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম। তবু আমি এমন কিছু বন্ধুর সাহচর্য পেয়েছিলাম, যারা সত্যিই আমার পাশে ছিলেন, তারাই আমাকে আমার নিজের কথা লিখতে উৎসাহ জুগিয়েছিল। আমার দুই খুব কাছের বন্ধু, অরণ্য ও বিতান, একজন গল্পকার ও একজন কবি, তাদের আমি নিজের মনের অনেক কথাই বলেছিলাম, বলতাম। তো ওরাই একদিন বলতে শুরু করল, অভিজিৎদা, তুমি এবার তোমার মনের কথাগুলো লিখতে শুরু করো।

    সেই সময়ে, ২০১১ সালে, আমি মানসিকভাবে খুব কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। লক্ষনৌতে একটি এলজিবিটিকিউ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাথে কাজ করতে গিয়ে আমি খুব খারাপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই, এবং তারপর ফিরে এসে আমি প্রায় তিন-চার মাস বাড়িতে বসেছিলাম, কোনও কাজ করতে পারিনি। তখনই আমি ডায়রিতে লেখা শুরু করলাম। এখন এই ইন্টারভিউ দিতে দিতে মনে হচ্ছে, সেই সময়ে সত্যিই ভাবিনি, লেখাটা এই জায়গায় যাবে। এবং এই লেখার সময়কার সবথেকে বড় প্রাপ্তি হলো, রিল্যাক্সেশন। মানে, আমি যাকে আমার সবথেকে কষ্টের জায়গা বলে ভেবে এসেছি, সেটাই লিখতে গিয়ে আমাকে আনন্দ দিয়েছে, শক্তি জুগিয়েছে।

    তো ২০১২ সাল অবধি লেখার পর আমি আরেকটা চাকরি পেয়ে চলে যাই, আর লেখার কাজটা অসমাপ্ত থেকে যায়। এরপর ২০১৬ সালে সৌমিক জানার সাথে আমার আলাপ হয়, যে তখন watstory নামে একটি ব্লগ চালাত। সৌমিকই আমাকে ওর ব্লগে আমার লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করার প্রস্তাব দেয়। সেই ব্লগ প্রকাশের পর আমি খুবই ভালো রেসপন্স পাই, চেনা-অচেনা পাঠকের থেকে। তারপর আমি বিভিন্ন বন্ধুদের পরামর্শে লেখাটি বই হিসাবে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিই। প্রথম সংস্করণ ‘দোসর’ প্রকাশনীর হাত ধরে বেরোয়। বইমেলাতে যথেষ্ট বড় করে বইপ্রকাশও হয়। কিন্তু সেই সংস্করণের মান নিয়ে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না। তাই আমি ‘হাওয়াকল’ প্রকাশনীর কাছে যাই। ওরাই এটার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে গতমাসে।

    সুদীপ – বইয়ের শিরোনাম তো প্রথমে অন্য ছিল।

    অভিজিৎ - হ্যাঁ। ব্লগে যখন এই লেখা প্রকাশ করি, তখন তার নাম ছিল, ‘ডায়রি নয়, আমার এজাহার’। তারপর বই আকারে প্রকাশের সময় মনে হয়েছিল, বইয়ের বিষয়বস্তু পাঠকের কাছে স্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্য আরও সহজ ভাষায় বলা দরকার। তাই বইয়ের নাম হয়, ‘নাচের ছেলে: আমার সমকামী এজাহার’।

    সুদীপ –  তো তোমার বই ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির চার তারিখে প্রকাশ হল,  আর ছ’ তারিখে তুমি যেখানে পড়াতে, সেই ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে টার্মিনেশন লেটার পেলে। এই বিষয়ে একটু বলো।

    অভিজিৎ - হ্যাঁ, ব্যাপারটা খুবই মজার। বিকল্প যৌন পরিচয়ের যে কোনো মানুষই, এইধরনের বৈষম্যের শিকার হন। এটা আমি কেন,  বহু লোকের হয়েছে। তাই এর সাথে লড়ার জন্য নিজের ডিফেন্স মেকানিজম তৈরি করতে হয়। কারণ কতটাই বা চিৎকার করব বলো। এর আগেও বহু স্কুলে এরকম হয়েছে। এর আগে যেসব জায়গায় পড়িয়েছি,  সব জায়গাতেই ভালো খারাপ মিশিয়ে ছিল। বরং বলব, খারাপের তুলনায় ভালোটাই পেয়েছি।

    আমাকে ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে যিনি রেফার করেছিলেন,  তিনি এমনটা ভেবেই করেছিলেন যে এখানে হয়ত আমার নিজস্বতার জায়গাটা স্বীকৃত হবে। তো আমি ওই স্কুলে ইনটারভিউ দিয়েছিলাম একজন ডান্স টিচার হিসাবে। আমি ছোটবেলায় নাচ শিখতে পারিনি। ২০০৬ থেকে নাচ শুরু করলেও সিরিয়াসলি আমি নাচ শুরু করি ২০১৩ সাল থেকে এবং এই সময়ের মধ্যে কিছুটা হলেও নিজেকে আমি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। তো, যাই হোক, আমাকে ইন্টারভিউতে বলা হয়,  যে ওই স্কুলে ক্লাসিক্যাল ডান্স শেখানোর সুযোগ সেভাবে না থাকলেও যেহেতু আমি দীর্ঘদিন ম্যাথামেটিকস পড়িয়েছি, তাই যেন আমি অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে কাজ শুরু করি। তার সাথে কালচারাল ফিল্ডটাও আমাকে দেখার জন্য বলা হয়। প্রথমে আমি ফুলটাইম টিচার হিসাবে কাজে যোগ দিলেও পরে আমার নাচ, লেখালিখি ইত্যাদি অন্যান্য কাজের জন্য আমি পার্টটাইমার হয়ে যাই।

    প্রথম দু’ মাস সব ঠিকঠাক চলেছিল। এর মধ্যে ইউটিউবে আমার নাচের ভিডিও নিয়ে টুকটাক কথা উঠলেও আমি তেমন গায়ে মাখিনি। প্রথম যে ঘটনাটা ঘটল, সেটা হল, আমাকে প্রিন্সিপালের ঘরে একদিন ডাকা হয়। ঘরে প্রিন্সিপাল এবং স্কুলের এইচ. আর ছিলেন। আমি যেতেই আমাকে প্রশ্ন করা হয়, আমার অভিনীত একটি শর্ট ফিল্ম ইউটিউবে আছে, সেটা আমি কোনও স্টুডেন্টকে দেখতে বলেছি কিনা। আমার প্রায় পাঁচ মিনিট লেগেছিল বিষয়টা হজম করতে। আমি বলি যে, ক্লাসে আমি পড়ানোর বাইরে অন্য কোনও বিষয়েই কোনও কথা বলি না। তাহলে আমাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছে কেন? তখন আমাকে বলা হয়, যে ওই শর্ট ফিল্মে কিছু ‘inappropriate scene’ আছে, এবং স্কুলে নাকি সেটা ভাইরাল হয়ে গেছে, তাই স্টুডেন্ট ও তাদের অভিভাবকরা বলেছেন, যে আমি নাকি সেটি সবাইকে দেখতে বলেছি। আমি তখন জানাই,  যে একজন সহশিক্ষক ছাড়া আর কাউকে আমি ফিল্মটি দেখতে বলিনি। এবং ২০০৯ সালে আপলোড করা একটি শর্ট ফিল্মের জন্য কেন আমাকে শোকজ করা হলো,  সেই কারণও জানতে চাই।

    এরপর বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। এরপরের ঘটনাটি ঘটে তার দেড় মাস পর, ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে, মিডটার্ম পরীক্ষার সময়। আমাকে ফের ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, আমি ইনভিজিলেশনের সময় কোনও ছাত্রের পিঠে হাত দিয়েছি কিনা। এমন অভিযোগ শুনে আমি সত্যিই অবাক হয়ে যাই। আমি জানাই, যে আমার কাছে বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক ছিল। আমি কল্পনাও করিনি, এর জন্য আমাকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে। আমার মনে হয়েছিল, আমি আমার ওরিয়েন্টেশন নিয়ে রাখঢাক করি না বলেই আজ আমাকে এই পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে। এই ঘটনার পর আমি খুবই ভয় পেয়ে যাই। আমাকে যিনি ওই স্কুলে রেফার করেছিলেন তাঁর সাথেও কথা বলি। তিনি বলেছিলেন, স্কুলে যেহেতু সিসিটিভি আছে, তাই আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ চ্যালেঞ্জ করা উচিত। কিন্তু যা হয়, চাকরির কথা ভেবে আমি সেইদিকে এগোইনি। এর দু’মাস পর, আমি কোনও ছাত্রকে নাকি মাড়োয়ারি বলেছি, এইধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগও করা হয়। তখন থেকেই আমি বুঝতে পারছিলাম, যে আমাকে আস্তে আস্তে কোণঠাসা করার চেষ্টা চলছে।

    এরপর বইপ্রকাশের আগে যখন আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় বই নিয়ে প্রচার শুরু করি, সেই বিষয়টি স্কুলেও পৌঁছয়। ক্লাস নাইনের ছাত্রছাত্রীরা আমাকে বইয়ের প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করে। আর এটা আমার দীর্ঘদিনের শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা, যে কোনও বিষয়ে যদি খোলাখুলি স্পষ্টভাবে কথা বলা যায়, তাহলে কিন্তু সমস্যা অনেক কম হয়। তো আমি আমার স্টুডেন্টদের বলেছিলাম, যে এটা একজন সমকামী মানুষের আত্মজীবনী। অদ্ভুতভাবে, সবাই কিন্তু বিষয়টাকে খুব ভালোভাবে নিয়েছিল এবং এরপর এক মাস আমি আগের চেয়ে অনেক ভালোভাবে ওদের ক্লাস নিতে পেরেছিলাম।

    যাই হোক, এরপর এবছর ২০১৮-এর ফেব্রুয়ারির চার তারিখ বই প্রকাশ হয়। তার পরদিন হঠাৎ আমার কাছে স্কুলের এইচ.আর-এর কাছ থেকে ফোন আসে। আমাকে বলা হয়, আমাকে টার্মিনেট করা হচ্ছে, কারণ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাঁরা শিক্ষকদের সংখ্যা কমাবেন। তাই পার্টটাইম শিক্ষকদের ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। তাই আমাকে তার পরেরদিনই স্কুলের দেওয়া ল্যাপটপও ফেরত দিয়ে দিতে বলা হয়। মানে চার তারিখে বই বেরোনোর পর, সাত তারিখে আমার হাতে রিলিজ লেটার ধরিয়ে দেওয়া হলো। আমার সমস্ত কলিগরাও এই ঘটনায় খুব শকড হয়েছিলেন। এরপর আমি ঘটনাটা ‘প্রান্তকথা’, যে সংগঠনের সাথে আমি যুক্ত, তাঁদের জানাই। তাঁরা সেই সময়ে আমার পাশে ছিলেন। কয়েকদিন আমি মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলাম, যে আমার সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে একটু সময় লাগে। তারপর, আমি সিদ্ধান্ত নিই, যে এইভাবে চুপ করে গেলে হবে না। চুপ করে গেলে এইধরনের বৈষম্যের ঘটনা চলতেই থাকবে। তারপর তো, গোটা ঘটনাটা মিডিয়ার দৌলতে সামনে আসে। অনেক মানুষ আমার পাশে এসে দাঁড়ান। এবং এই সময়েই এমন অনেকের কথা আমি জানতে পারি, যাঁরা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কারণে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে হেনস্থার শিকার হয়েছেন।

    সুদীপ – এই মুহূর্তে ঘটনাটি কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে?

    অভিজিৎ - আমার আইনজীবী বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে চিঠি পাঠিয়েছেন। সেই সংস্থাগুলি সম্ভবত স্কুলকে শোকজও করেছে। আনন্দপুর থানায় অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ এখনো ঘটনাটিকে লঘু করার চেষ্টা করে চলেছে। আরেকটা বড় ডেভেলপমেন্ট হয়েছে, সেটা হলো, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অধ্যাপক, কিছু সমাজকর্মী, সাইকোলজিস্ট মিলে মডার্ণ হাই স্কুল ফর গার্লস-এ একটি কনভেনশনের আয়োজন করেন, যেখানে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক, প্রিন্সিপালরা যোগ দেন। স্কুলে জেন্ডার সেনসিটাইজেশন এবং ক্যুইর সেনসিটাইজেশন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে আলোচনা হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কমলা গার্লস স্কুল এবং ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কিন্তু সেখানে আসেনি। এছাড়া ধরো, আমাকে বার করে দেওয়ার পিছনে অভিভাবকদের একটা অংশের ভূমিকা থাকলেও কিছু অভিভাবক ঘটনাটিকে একেবারেই ভালো চোখে দেখেননি। এছাড়া, স্কুলের অ্যালামনিদের মধ্যেও একটা বড় অংশ এ বিষয়ে নিজেদের ক্ষোভ ব্যক্ত করেছে। তাই, এরপর কি হবে জানি না, কিন্তু আমি ও আমার আইনি পরামর্শদাতা যাঁরা আছেন, আমরা এই ঘটনার শেষ দেখতে চাই। তাই যদি প্রয়োজন হয়, আমি হাই কোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট অবধি যেতে রাজি আছি। কারণ কোনও মানুষের জেন্ডার বা সেক্সুয়ালিটির জন্য কর্মক্ষেত্রে এইধরনের প্রান্তিকরণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

    সুদীপ – তুমি কি এরপর অন্য কোনও স্কুলে শিক্ষকতার কাজে যোগ দিতে চাও?

    অভিজিৎ - না। দেখ, আমি অনেক স্কুলে চাকরি করেছি। আর কোনও প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করার ইচ্ছা আমার আর নেই। আপাতত আমি প্রাইভেট টিউশন পড়ানোর যে কাজ করছি, সেটাই মন দিয়ে করতে চাই। আরেকটা কথা আমি বলতে চাই, এই গোটা লড়াইয়ে আমার স্টুডেন্টরা কিন্তু ভীষণভাবে আমার পাশে ছিল। ছাত্রছাত্রীদের সমর্থন আমি সবসময়েই পেয়েছি। তো, এখন আমি যে টিউশন সেন্টারে পড়াচ্ছি, সেখানে আমি যথেষ্ট খুশি। পাশাপাশি, লেখালিখির কাজটাও যথেষ্ট মন দিয়ে করতে চাই। তাছাড়া নাচটাও আরও সিরিয়াসলি করতে চাই।

    সুদীপ – ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার সময়ে, পরিবারের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন ছিল? সেটা সময়ের সাথে কীভাবে বদলেছে?

    অভিজিৎ - আমার ছোটবেলার কথা আমি সবটাই প্রায় এই বইতে লিখেছি। তবে, একটা কথা বলব, আমার এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলির আচরণ আমার প্রতি দু’ দিন আগে পর্যন্ত যা ছিল, কোনও পারিবারিক অনুষ্ঠানে দেখা হলে বিভিন্ন মস্করা করা ইত্যাদি, সেটাই আমূল পাল্টে যায় এই বই বেরনোর পর। অনেকেই নিজে থেকে এসে আমার সাথে কথা বলেন, আমার লেখার প্রশংসা করেন। আর সত্যি কথা বলতে, আমার নিজের পরিবারের মধ্যেও কোথাও হয়ত একটা বাধা ছিল, যা এই বইটা কোথাও আমাকে অনেকাংশেই কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। যেমন আমার বোনের সাথে চিরকালই আমার খুব ওপর-ওপর কথা হত। শেষ এক বছরে বইয়ের প্রস্তুতির সময়ে, আমি ওর মধ্যে অনেকটা পরিবর্তন দেখেছি। আর স্কুলের ঘটনাটা ঘটার পর আমার মা, পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা পুরোপুরি আমার পাশে ছিলেন। আগে যখন কোথাও কাজের পরিবেশ পছন্দ না হওয়ায় আমি কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি, তখন বাড়িতে আমাকে মানিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনাটা ঘটার পর বাড়ির লোকজন বুঝতে পেরেছিলেন, যে আমি মানিয়ে নেওয়ার বহু চেষ্টা করা সত্ত্বেও আমাকে অন্যায়ভাবে বার করে দেওয়া হয়। তাই বইপ্রকাশ ও স্কুলের ঘটনা আমাকে অনেকটাই পরিবারের কাছাকাছি এনেছে।

    সুদীপ – তোমার নাচ শুরু করার সময়কার কথা একটু বলো।

    অভিজিৎ - ২০০৬ সাল থেকে আমি নাচ শেখা শুরু করি। সেটা এম. টেক শেষ করে চাকরি করতে শুরু করার পর। নাচ নিয়ে আমার ভাবনার অনেকটাই আমি বইতে লিখেছি। তার কিছু অংশ একটু পড়ে শোনাতে চাই।

    সুদীপ – হ্যাঁ নিশ্চয়।

    অভিজিৎ - “নাচের কথা বলতে গিয়ে কত কথা চলে এল। আসলে নাচ কোনোদিন নিয়ম করে না করলেও ... আমার জীবনের সাথে এমনভাবে এই ছোট্ট দুটি অক্ষর জড়িত, যে কয়েকটি সাধারণ কথায় তা ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। নাচ যে আমার অন্তরমহলে কীরকম বাঙময়রূপে বিচরণ করত, তা দেখার একমাত্র পথ ছিল, বন্ধ ঘরের দরজার পিছনে, কিংবা বাথরুমের আরশির আড়াল থেকে আমার অবচেতনের সুযোগ নিয়ে আমার একলা আমির নিশ্চিন্ত ভিডিওগ্রাফ শ্যুট করা। যা আমি জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারতাম না, প্রকাশ করার কথা ভাবতেও পারতাম না। না পেরে ওঠার পিছনে যে যুগান্তকারী বাধা ও বিপত্তি ছিল। তাই আমি নিজের অন্দরমহলে, অন্তরমহলের (ঋতুপর্ণের থেকে ধার করা শব্দটি) সবকটি দোর খুলে দিয়ে এক অবিন্যস্ত দ্বিধাহীনতায় মেলে ধরতাম। এই যে নিজের কাছে নিজেকে মেলে ধরা, নিজের সঙ্গে কথা বলা, নিজের একান্ত অনুভূতি ও মুহূর্তগুলিকে প্রকৃতরূপে চোখে দেখা, চেখে দেখা, এ যে কি অপূর্ব অনুভূতি, তা আমার মতো দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে যারা হঠাৎ করে মাধুরী বা রেখা হয়ে গেছে কখনো, এবং তাদের তাৎক্ষণিক ক্যারিশমায় মানসলোকের পৃথিবীটাকে এক লহমায় হেলিয়ে দিয়েছে, তারা জানে।”

     

    ©এবং আলাপ ও সংশ্লিষ্ট ব্লগার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। লেখা পুনঃপ্রকাশের জন্য www.ebongalap@gmail.com –এ ইমেল করুন। 

     
     



    Tags
     



    Comments (2)
    • আপনার লড়াই সফল হোক। বইটা কোথায় পাওয়া যায়?
      রংগন চক্রবর্তী

    • ভালো লাগলো পরে…তোর লড়াই সার্থক হোক…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics