• আমরা সুন্দরবনের আদিবাসী বটে গো


    0    497

    January 19, 2018

     

    মাঘ মাস পড়েছে। ধান কাটা শেষ। মাত্র দিনপাঁচেক আগে পৌষের শেষ দিনে বালিদ্বীপের আদিবাসী পাড়ার মানুষজন উদযাপন করলেন টুসু পরব, যে পরবে তাঁদের ঘরের লক্ষী ‘টুসু’কে নিয়ে তাঁরা গান বাঁধেন, গান করেন। সে গান ভেসে আসে অন্যান্য পাড়ার মানুষজনের কানে। তাঁদের প্রতিবেশী ‘সুন্দরবন বিজয়নগর দিশা’-র মেয়েরা ও লাবনী জঙ্গীর সঙ্গে বালিদ্বীপের আদিবাসী পাড়ার গানের দলের কথোপকথন। 

    এম এ ক্লাসে পড়বার সময় আমার প্রিয় অধ্যপক একটা গল্প পড়তে শিখিয়েছিলেন, একটা রুপকগল্প“আদিম পৃথিবীতে যখন মানুষের ভাষা, গোষ্ঠী, ধর্ম, জাতের ভিন্নতা ছিল না সে সময় ব্যবিলন শহরে একদা সকল মানুষ মিলে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে, তারা ঠিক করে তারা স্বর্গের সিঁড়ি নির্মাণ করবে; আর এভাবেই পৃথিবীর মানুষের কাছে আসবে স্থায়ী শান্তি। এই ভাবনা থেকে সকলে যখন একত্রীত হয়ে স্বর্গের সিঁড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করে দিল, ক্ষমতাবান ঈশ্বর আশংকিত হলেন এবং এই সিঁড়িটা যাতে কখনোই নির্মিত না হয় তার ফন্দি আঁটলেন। সিঁড়িটা যারা নির্মাণ করছিল তাঁদের সকলের ভাষা ভিন্ন করে দিলেন। নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন ভাষার কারনে একে অপরকে বুঝতে সমস্য তৈরি হল; তাঁদের মধ্যে তৈরি হল ভুল বোঝাবুঝি এবং একে অপরের সাথে দূরত্ব। যা ক্রমাগত নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষকে প্রশ্রয় দিল; আর নিজেদের মধ্যেকার এই বিবাদের ফলে মানুষেরা আর কোন দিন স্বর্গের সিঁড়ি ( আল্টিমেট পিস) নির্মাণ সম্পূর্ণ করতে পারল না”। এই গল্পটা মিথিকাল/রূপকথা তবে এই গল্পটার সাথে ক্ষমতার রাজনীতি এমনভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে বারবার নানা ভাবে ফিরে আসে; নানা কোন থেকে বুঝতে সাহায্য করে আমাদের সংঘর্ষের বাস্তবতাকে। আমাদের প্রতিবেশীর সাথে দূরত্ব তৈরির অলিখিত ষড়যন্ত্র গুলোকে। একে অপরের প্রতি বিচ্ছিনতাবোধের বাস্তব চিত্রটা আমারা আমাদের চারিপাশে উপস্থিত দেখতে পাবো, একটু চোখকান খোলা রাখলেই।

    সুন্দরবনে বালিদ্বীপ আমাদের মুক্ত শিক্ষাঙ্গনের একটি অঞ্চল বলে মনে হয়। যেখানে দিশার সাথে যুক্ত তাপসীদি, শ্যামলীদি, মৌমিতা,অয়ন্তিকা, সুমনা, অন্নপূর্ণার কাছে যেমন প্রতিদিন কিছু না কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখেছি। আরও বেশী শিখেছি যাদের সাথে আমরা কথা বলেছি। দিশার মেয়েদের সাথে তাঁদের উভয় পক্ষের সহজসরল কথোপকথনের মধ্যে উঠে এসেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক; যেখানে এই ক্ষমতার রাজনীতির জটিল দিকগুলো অদ্ভুত সরলতা নিয়ে উঠে এসেছে বারবার। আর আমরা একটু একটু করে শিখেছি ক্ষমতার পরিভাষা; দেখেছি ক্ষমতার রাজনীতির নানা স্তরগুলো। টাওয়ার অব বেবেলে ঈশ্বর ছিলেন; আমাদের বাস্তবের জীবনে আছেন বিভিন্ন স্তরে ক্ষমতাবানেরা। যারা অন্যান্য অঞ্চলের মতোই সফল হয়েছেন বালি দ্বিপের আদিবাসী, মুসলমান, খ্রিস্টান, উদ্বাস্তু মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে। অলিখিত নিয়মে তারা ও তাঁদের পাড়াগুলো আলাদা হয়ে উঠেছে; যদিও তাঁদের লড়াই একই; পেটের তাগিদে তারা বাঘের মুখে যায়, নদীর বুকে যায়। একইভাবে দ্বিপের আদিবাসী, মুসলমান, খ্রিস্টান, উদ্বাস্তু মানুষের সব ঘর থেকে সন্তানেরা আজ ফারাকে চলে যায় পেটের তাগিদে; বেঁচে থাকার লড়াই একই তবে কোথাও যেন অদৃশ্য দেওয়াল আছে; একে অপরকে চেনা, বোঝার ক্ষেত্রে। তবে এই আশা নিয়ে সুন্দরবনের বুকে বারবার ফিরে যাবো এটা দেখার জন্য যে দিশা ও এবং আলাপের যৌথ উদ্যোগে এই ‘আলাপ-পর্ব’ হয়তো একটু একটু করে নিজেদের মধ্যেকার এই অদৃশ্য দেয়ালগুলো অতিক্রম করে চলবে।

    আমরা তাই প্রথমপর্বের এই লেখাতে আমাদের মধ্যে হওয়া কথোপকথনগুলোকে সরাসরি উল্লেখ করছি। সুভাষদা টুসু, ঝুমুর গানের দলের একমাত্র পুরুষ, ও ঢোল বাদক। বৃদ্ধ এই মানুষটি কখনো সন্দেহ করছেন, কখনো অনুরোধ, কখনো আবদার; সব মিলে মিশে সময়ের সাথে একটু একটু করে আমরা পরিচিত হচ্ছি একে অপরের সাথে; এই অংশে তাঁর সাথে অন্যান্যরা মিলে এই কথোপকথনগুলো হয়েছে।

    সুভাষদা - এবারে এবারে বাপ-ঠাকুরদা-রা চলে গেলো; যাবার পরে তারা আমাদের তে সেভাবে শিখিয়ে যায়নি; তাঁদের যাবার পরে এই সমস্ত আমরা জানতে পেরে করছি।

     - বাপ ঠাকুরদা এই গান করতেন?

    - করতো তবে কম; তখন তো আর এইসব ছিল না।

    - আমরা ছেলেপুলে হয়ে বুঝতে পারছি এখন যে আমরা আদিবাসী; আমাদের নিজেদের একটা জিনিসকে ধরতে হবে; রাখতে হবে। চিহ্নটা আমাদের থাক। আমরা কোথাও যায় না যায়; জিনিসটা থাকলে অন্তত লোকে জানতে পারবে সুন্দরবনের এই জায়গাতে আদিবাসী আছে যারা কিছু করে।

    - ও আচ্ছা আপনারা আগে তবে টুসু, ঝুমুরগান করতেন না?

     - আগে বাবা ঠাকুরদা রা করতো; ওঁরা করতো তো সেইটেকে আমরা দেখে শিখলাম, তখন তো দল ছিলাম না; আমি বুড়ো মানুষ এঁদের কে বললাম; গোসাবা অঞ্চলে অনেক জায়গাতে ছুটে এঁদের কার্ড করানো হল; ওপর লাইন পর্যন্ত গেছে। এঁদের কথা বলবো কি আমি তো এঁদের দলের মধ্যে নে। বাজাতে বললে বাজিয়ে আসি। এঁদের আবার যন্ত্রপাতির কমাকম। যন্ত্রপাতি নেই বললেই চলবে।

     - সুকুমার বাবু যিনি একটা মাদল আর ঢোল দিয়েছিলেন। মাদলটা মাটির জিনিস থাকে না; ঢোলটা আছে, সে ঢোলটা আসবে এখনি। আমাদের এখানে; ওটা রেখে দিয়েছি ওটাই আছে। এদের জিনিসপত্তর না থাকলে তো একটা সংগঠন করা যায় না। বলুন শুদু মুখে কিছু হবে আমি একটা ঢোল নিয়ে নিলাম তাতে কোন মধুর সুর এলো না তাতে আর দু-একটা যন্ত্রপাতি থাকলে তাহলে এসব গানে বেশ মানুষ হয়। নইলে একখানা ঢোল নিয়ে আমি বাজাবো কোন মুল্য হবে কি।

     - কোথাও অনুষ্ঠানের জন্য গেছেন?

     - অনুষ্ঠানের জন্য আমি যায়নি, এনারা এই বাবুরা যায়। বলে দাও এদিকে এসো কোথায় যাও বলে দাও; আমি যায় না।

     - চোখে ঠিক মতো দেখতে পাই না তো।

     - আপনারা এসেছেন; যে কোন একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন তো? সেই উদ্দেশ্যটার কারণটা শুনেছি তো ? কিন্তু তের ভেতর আমাদের একটা কোন জিনিস নেই; এইবারে তোমরা কি করতে পারেন সেই নিয়ে আমরা একটু শুনতে চাই। কি করবেন আমাদের নিয়ে একটু বলুন, শুনি।

    শ্যামলি দি ও তাপসীদি যথাক্রমে নিজেদের মতো করে সরল ও আপনমানুষের মতো করে যেন দায়িত্ব নিয়ে নিল এই দূরত্বকে কিছুটা মুছতে। তারা বলল আমরা আজ একে অপরের সাথে কথা বলতে এসেছি; আমাদের নিজেদেরকে জানা বোঝা এই সময়ে কেন জরুরী এই বিষয়গুলো তাঁরা একে অপরকে বলে চলল।

     - এইবারে বলি কি আপনারা এতো কিছুর পর এই যে এসছেন আমাদের দিক থেকে একটা আশা বলুন, যে কিছু একটা যন্ত্র আমাদের দলকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যদি পাওয়া যায়। আমরা তো দুর্বল মানুষ।

     - মাদল খুবই একটা মাটির জিনিস, ঢোল, কাঠ, কর্তাল, হলে বেশ ভালো হয়। কিংবা দুজাল ঘুঙ্গুর সেটাও পায়ে দিয়ে নাচতে ভালো লাগবে। সেসব খুব ভালো জিনিস, আপনারা এসছেন যখন তাই আমাদের যেটুকু বক্তব্য বলে নিলাম।

    তাপসীদি, শ্যামলিদি বললেন আমরা সবরকম চেষ্টা করবো, যাতে আপনাদের কিছু একটা বাদ্যযন্ত্র দিতে পারি, আমরা দিশার অফিসে ও এবং আলাপে এই কথাটা জানাবো।

    সুদীপের দিকে তাকিয়ে সুভাষদা আরও কিছু জানতে চাইলেন; সুদীপ নিজের মতো করে কিছুটা বলল যে ‘আমাদের পক্ষে কতটুকু আর কি করা সম্ভব! আমরা কি করতে পারি। তাঁদের সাথে আমাদের এই কাজটা কীভাবে সম্পর্কিত, কেন ‘এবং আলাপ’ ও সুন্দরবনের দিশার সাথে যুক্ত মেয়েরা এই নতুন খোঁজ করবার চেষ্টা করছি। আপনাদের টুসু ঝুমুর গান মাটির গান, যার লেখার হরফ নেই। আপনাদের শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই সংস্কৃতির কথা আমরা শুনতে চাই, শোনাতে চাই।

     - কেমন করে গান বাঁধেন, কীভাবে মহড়া হয়; উৎসবে হোক বা ক্যাসেটে ঝুমুর, টুসু গান এলেও;  গানের পিছনে থাকা মানুষদের জীবন জানতে চাওয়া আমাদের উদ্দেশ্য।

     - ঠিকই আছে, এখন একটা কথা কি, টুসু গান বলতে; টুসু গান একটা আলাদা, ঝুমুর গানও আছে। দুটো আলাদা ভাগ আছে, টুসু পুজোর সময় টুসু গান করা হয়।

    আমরা আরও জানতে চাইলাম আপনারা কখন গান বাঁধেন সারা বছর গান বাঁধেন না কি, শীতকালে মেলার সময়।

     - না না , আমাদের সংক্রান্তি, টুসু পুজোর সময় ধান কাটা হয়ে গেলে, বসে একটু আলোচনা হয়। লোকজন মিলে সবাই কোন গানগুলো করা হবে, কোনগুলো ভুলে গেছি, কোন গানগুলো করতে হবে, ঠিক করা হয়। শুধু টুসু গান করলে হবে না ঝুমুর গানও লাগাতে হবে। সামনের পৌষ মাসে টুসু পুজো হবে, এখন ঝুমুর করি।

     - টুসু কে ছিলেন?

     - টুসু আমাদের লক্ষ্মী, ঘরের মেয়ে।

     - আচ্ছা আমরা শুনেছি এসব গানবাজনা নিয়ে গিয়ে আবার ব্যাবসা করে, আমি বাপু বলেই ফেললাম যা মনে এলো।

     - আপনারা গান না করলেও হবে, আপনারা যদি মনে করেন এমন হয় তবে গান করতে হবে না আপনারা নিজেদের জীবন নিয়ে কিছু বলুন। গানের জীবন নিয়ে কিছু বলুন।

     - বাপঠাকুরদা তো কিছু করে যাননি এই এটুকু জায়গায় নিজেরা থেকে এমন করে কেন বলছি জানেন? আমরা যদি একটু ভালো গান করি তবে অন্তত লোকে জানবে সুন্দরবনে ঐ অঞ্চলে কিছু আদিবাসী আছে যারা ঐ গানটান করে।

     - আপনাদের গান সারা বছর হয় না বিশেষ কোনো সময়ে বেশি হয়?

     - টুসু পুজোর সময় কালীপুজোর সময় ব্যপকভাবে হয়। ঝুমুরটা কোন দল হিসাবে কেউ নিয়ে গেলে সারা বছরভর থাকে। টুসুপুজোর নিজেদের বাড়ি বাড়ি টুসুগান হয়। বাউনি হয়ে গেলে, ক্যানিং আরও কিছু এলাকা থেকে বায়না করে নিয়ে যায় লোকে।

     - আপনাদের ছেলেমেয়েরা যে টুসু, ঝুমুর গান করে, তাতে কিছু পরিবর্তন কি এসেছে, নাকি আগে যেমন হত তেমনই আছে?  

     - হ্যাঁ আমাদের সাথে করে কেউ কেউ।

     - হুম বদল বলতে আমরা তো এখানে বাঙালী পাড়াতে থাকি সবাইকে বাঙালী কথা বলতে হয়। আদিবাসী কথা আর আদিবাসীরা বলতে পারে না। তবু গানের মধ্যে কিছু কিছু বলা যায়। ওগুলো বলা হয়। কিন্তু এমনি আর বলতে পারিনি।

     - লোকশিল্পীদের নাম নথিভুক্ত হচ্ছে আপনাদের কিছু সুবিধা হয়েছে?

     - অনেক অনেক কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়, ১২ জনের গ্রুপ ছিলাম। ক্যানিং-এ পাঁচ জনকে ডেকে নেয়। একজন বেহালা নিয়ে যায়, সবাইকে কার্ড দেয়নি। কিছুই হয়নি, শুধু পরীক্ষাই নিয়ে গেছে।

     - আপনাদের যে এই বাজনার কথা বলছি কার্ড থাকলে ভাতা পেলে তো চাইতাম না। সে টাকার মধ্যে থেকেই কিনে নিতাম। সেসব তো কিছু হচ্ছে না।

     - মুসলিম পাড়ার সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কেমন? ওদের কোন উৎসবে, গানের অনুষ্ঠানে যান না?

     - ওদের না; ওরা কিছু করে না, ওদের যা হয় ঐ মউলুভ, মন্দির করে গেছে নামাজ টামাজ করে, আজান দেয়, ওদের আরও ওইসব কি হয় নাকি রিদ্‌ রিদ্‌ আর কি জালসা মালসা হয় আমরা তো যাই না, ওসবের ভিতরে ঢুকি না। আর আমরা তো হিন্দু জাতি।

     - তোমাদের কি কি উৎসব হয়? টুসু পুজো হয় আর এমনি কি কি পুজো হয়?

     - দুর্গাপুজো হয় কালীপুজো হয়, আমাদের তুমাদের মতোই সব পুজো হয়।

     - আমরা যেটা করি তোমরাও সেটা কর, আমরা কেউ আর পর নেই।

     - মানে হিন্দু আর আদিবাসীরা?

     - হ্যাঁ হিন্দু আর আদিবাসীরা কেউ বলতি পারবিনি আমরা আলাদা, আমরা সব একই হয়ে গেচি। মন্দির আছে।

     - হ্যাঁ কালীমন্দির আছে, শীতলা পুজো হয় আর হরিপুজো হচ্ছে, মনসাপুজো হচ্ছে।

     - বনবিবি?

     - বনবিবিটা নেই আমাদের, যেটা নেই মিথ্যে কথা কেন বলবো!

     - বনে যান না?

     - যায় কয়েকটা ব্যাটাছেলে যায়, বনবিবির গানটান অল্প হয়।

     - দূর্গাপূজা, বাসন্তীপূজা?

     - দূর্গাপূজা হয় অনেকদিন ধরে, বাসন্তীপূজো তো জন্মকাল থেকে দেখে আসছি।

    এরই মধ্যে লক্ষ্মীদিদি (নাম পরিবর্তিত) যখন এলেন গোসাবা থেকে; সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের ঘারে তুলে নিয়ে একটা অসাধারণ নেতৃত্বের সাথে আমাদের কথোপকথনকে টেনে নিয়ে গেলেন অন্য পর্যায়ে। টাওয়ার অব বেবেলের ক্ষমতার রাজনীতিকে যেন তা মাত দিতে পারে। মনে হল যেন এই পৃথিবীতে অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন ভাষা নয়; মাত্র দুটো ভাষা রয়েছে একটা ক্ষমতাবানের ভাষা একটা ক্ষমতাহীনের। তবে দুটোর মধ্যেই বিশেষ কিছু ভয়ংকর ‘শক্তি’ থাকে, যখন সেটা প্রকাশিত হয় সেটা ক্ষমতার ভাষা হয়ে ওঠে। লক্ষ্মীদিদিরা বারবার নিজেদের দুর্বল বলছেন ঠিকই; একথা সত্যি যে তাঁদের ভাষাকে খুন করা হয়েছে তাঁদের অর্থনীতিক মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে; তাঁদের সেখানো হয়েছে তারা প্রান্তিক, অশিক্ষিত, আদিবাসী জনজাতি তারা দুর্বল। কিন্তু লক্ষ্মীদিদিদের ক্ষমতার একটা ভাষা আছে সে ভাষা যেদিন এই উপরওলার ক্ষমতার ভাষার সাথে লড়াইয়ে নামবে সেদিন মৃতপ্রায় বালি দ্বিপের আদিবাসী মানুষেরা একটা নতুন ইতিহাস লিখবে। আমাদের জানতে হবে লক্ষ্মীদিদিদের ভাষাতে ক্ষমতাটা কোথায়? আমরা এই কথোপকথন অনুসরণ করলে হয়তো আন্দাজ পাবো; নিপীড়িত, শোষিত মানুষের ভাষার লড়াইয়ে শক্তির উৎসটা কি আর কোথায় রয়েছে।

     

    দিদি : কানার রাত দিন সমান, তখনকার দিনে আমরা লেখাপড়া শিখতে পারিনি। আমার ঠাকুরদা, ঠাকুমারা যেভাবে গান বা চলাফেরা শিখিয়েছে আমরা সেভাবে শিখেছি।

    এই গত দুবছর হচ্ছে আমরা একটা দল করে ক্যানিং এর বিকাশ কেন্দ্র ওখানে ফরম ফিলাপ করেছিলাম, পাঁচজনের পরীক্ষা নিয়ে আমার একাকে বেছে রবীন্দ্রসদনে নিয়ে গেল, পুরনো শিল্পীদের দিয়ে আমাদের গান শেখানো হচ্ছে, তো সে কি গান- গাছ লাগানো স্কুলের ছেলেদের সাতশো টাকা করে দেওয়া হয় সে নিয়ে কন্যাশ্রী নিয়ে, ধানচাষে ধান দেওয়া হচ্ছে; এসব নিয়ে গান শিখাচ্ছে আর একটা বই দিয়েছে সে বইয়ে গান লেখা আছে। তারপর বলছে যে এগুলো শোনানোর পরে যদি কেউ ঝুমুর গান শুনতে চায় তা শুনিও।

    তো সেই জন্যই বলছি তোমরা কিভাবে এসছো, কোথা থেকে আসছে কারা আসছে জানার প্রয়োজন আছে আমার।

     - জোর করে যে গান করতে বলছে, শিখতে বলছে, ঝুমুর গান পরে করে আগে এই গান গুলো করতে বলছে, সেখানে আপনাদের কি মনে হচ্ছে?

     - সেটা এখন কি বলবো বল! আমরা একটা জায়গায় পৌঁছেছি, যাদের কাছে গেছি, যেখানে গেছি তাদের কথা শুনতেই হয়। তা ওরা এখন শোনাচ্ছে। ঝুমুর গানের মধ্য থেকে বা সবরকম শিল্পী গেছে ৮০০ জন। সবজনকেই তো তারা শেখাচ্ছে। তোমরা এইভাবে এইগুলো গাইবে বলে।

     - আপনারা কোন প্রকল্প থেকে আসছেন তাই জানা দরকার, তাহলে সেইরকম গাইবো।

     - আমরা কোনো এমন প্রকল্প থেকে আসিনি, আর আমরা কোনভাবে উপর থেকে বলব না আপনারা কোন গান করবেন, এবং আপনারা যদি গান করতে চান তবেই করুন, জীবনের সাথে গান কিভাবে মেশে সেটা যদি বলেন। গান আপনারা কি শোনাতে চান?

     - তোমরা কি শুনতে চাও! (হেসে)

     - আচ্ছা অল্পবয়সী যারা এ পাড়াতে, তাঁদের কোন দল আছে?

     - তাহলে একথাটা যখন উঠে এসেছে আসল কথাটা বলতে হয়, অল্পবয়সী বলতে এখনকার যেমন আমরা এখানে কম আছি, বাঙালিদের সাথে মিশে আছি। যেখানে যেখানে বেশী আছে তাদের কথাও বুঝতে পারবে না, গানও বুঝতে পারবে না। আর যারা বাঙালিদের সাথে মিশে আছে তাদের কথাগুলো একটু বোঝা যাবে। আমরা নিজেরাও আজকাল বুঝতে পারি না।

     - নিজেদের ভাষার জন্য খারাপ লাগা আছে?

     - এটাই তো গল্প, তাও আমরা তো কিছু করছি। আমাদের পেটের ছেলেমেয়েরা একবারে শিখছেনা, ওসব লজ্জা করে। আমার পেটের ছেলেটারই কথা বলি ‘ও বলে ওসব গান বাজনা করবা না’। আমি বলি এটা আমার জীবনের শখ। সবকিছুর মধ্যে আমার এটা শখ, তবু করতে দিতে চায় না। তাহলে তাদের পেটের ছেলেমেয়েরা তো একটুও কিছু জানবে না। যেগুলো আমাদের ঠাকুরদা- ঠাকুমা থেকে পেয়েছি, আমাদের দিয়ে শেষ সেসব।

     - নতুন দল বলতে এই আমরা, ও পাড়াতে একটা হচ্ছে বলে শুনছি এখন গান করতে গেলে নাকি সব পড়াশুনো নষ্ট হয়ে যাবে, তাই করে না এসব।

     - আপনারা কি গান শুনতে চান? ঝুমুর না টুসু!

     - আপনার ইচ্ছে।

     - তাহলে ঠাকুরের গান দিয়ে শুরু করি।

     মাঝে শ্যামলীদি তাপসীদিদের সাথে কথোপকথন – টুসু পরবের সময় আমাদের বাড়ি পর্যন্ত গানের শুর শোনা যায়, আসা হয় না। মাইকে শোনা যায়, কাছে শুনিনি।

     - তা আসোনি কেন! দূর থেকে শোনো, কাছে তো আসো না। তোমার বেলায় আমরা যাই যখন তখন তো কিছু হয়না!

     - তখন এতো ঠাণ্ডা পড়ে বেরনো হয়না আর।)

     - শীতকালে আমরা কতো দূরে দূরে চলে যাই তুমাদের গান শুনতে।

     - হটাৎ কেউ বলতে বললে একটু আধটু ভুল হয় কিন্তু,

    (ঢোলের শব্দ দিয়ে মহড়া)

    ভুলো না ভুলো না লক্ষ্মী ভাঙা পালকি দেখে গো

    হায় হায় ভাঙা পালকি দেখে গো,

    আয়না বসা পালকি দেবো

    শহরও বেড়াতে গো

    শহরও বেড়াইবে লক্ষ্মী

    খিদে পেলে খাবে কি!

    হায় হায় খিদে পেলে খাবে কি!

    আনো লক্ষ্মীর ঘাড়ের গামছায় রসের মিঠাই বেঁধে দিই

    ভুলো না ভুলো না লক্ষ্মী

    ভাঙা পালকি দেখে গো-

    আয়না বসা পালকি দেবো-

     - লক্ষ্মী শহর মানে কোলকাতায় বেড়াতে যায়, এমনই সাধারণে বলে। তা এইভাবে করে আমাদের কথা বলা আছে। গরীব জীবনে ঘরের মেয়েকে তো গাড়ি দিতে পারবো না! তে যাচ্ছ ঠিক আছে, শহরে কিন্তু ভাঙা পালকি টেকে ভুলোনা, শহরে ঘুরে এসো।

     - ঠিক আচে ঝুমুর গানে যাবো নাকি! বাজাও, 

    শাঁখা ভাঙলে দিদি চুড়ি ভাঙলেই,

    শাঁখা ভাঙলে দিদিগো চুড়ি ভাঙলে

    এমনও নিলো শাড়ি ঘামে ভিজিলেই

    দিদিগো এমনও লিলো শাড়ি ঘামে ভিজিলেই

    ওই নিলো নিলো নিলো শাড়ি

    মাথায় নিলো দইয়ের হাড়ি

    কোথায় যাচ্ছগো দিদি লালও পিয়ারী।

    ওই কানেরই কদম ফুলটা দিয়ে রাখো মোরি।

     

     - হয়েচে, এবার আমার বাপ ঠাকুরদা রা যেটা জঙ্গলে যায় সে জঙ্গলের একটা গান করচি,

    সন্তানের মুখে অন্ন দিতে

    পিতা গেল বাঘের মুখে

    মাতা গেল নদীর মুখে আর তো ফিরে এলো না

    কবির কথায় নদীর কথা – বৃক্ষ গো-

    আমরা সুন্দরবনের আদিবাসী বটে গো

    আমরা সুন্দরবনের আদিবাসী বটে গো

     - আমি পড়াশুনো ক্কিছু জানিনা, আইলার পড় মন থেকে দুটো গান এসেছিলো নিজে থেকে বলি, আগে দুঃখের গানটা বলি, 

    আইলা আশি ছিল ঘরবাড়ি সব ভাঙে গেল

    বানেতে ভাসাইয়ে লিলো প্রাণকে প্রাণকে

    ভাইস্যে যায় কতো সুন্দর শিশু যে

    ভাইস্যে যায় কতো সুন্দর শিশু যে

    মা বসে কান্দে বসে নদীরও কিনারাতে

    মা বসে কান্দে বসে নদীরও কিনারাতে হায়রে হায়

    বলে আইরে বাছা আইরে আমার কোলেতে রে কোলেতে

    তোকে ধরে জুড়ায় জীবন জ্বালাকে।

     - এই গানটা করলে আমার চোখে জল আর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এ গানটা আমি হঠাৎ করতে চাই না। করতে গিয়ে আটকে যায়। আরেকটা আছে - আইলা হবার পরে, 

    আইলা দিয়েছে জোগান, বান তুলেছে তুফান

    দুই বন্ধু মিলে সে যে জ্ঞান পরিণাম দিয়ে গেছে শ্মশানে

    ও এমন একটা মিষ্টি মধুর দিনে।

    আইলা হবার পরে দুদিন অনাহারে

    চলেছি রাস্তার ধারে প্রিয়জন না পেয়ে

    চলরে ভাই একসাথে ওই চলবো, এই কোদাল ঝুড়ি হাতে করি চলবো।

    বৃক্ষরোপণ করবো মোরা গড়বো

    এই সোনার সুন্দরবন সবুজ গড়বো।

    বোকার মতো প্রশ্ন ছিল আমার- আপনার নিজের লেখা?

     - (হেসে) না লিখতে পড়তে তো জানি না নিজেদের অভিজ্ঞতা। আইলায় তো কাজ ছিল না, গাছটাছ সব মরে যায়, প্রিয়জনেদের খোঁজ এসব দেখে এই গান বাঁধা।

     - আইলার পরে কি সুন্দরবন পাল্টেছে?

     - অনেকটাই পাল্টেছে, আগে খাবারের জন্য মানুষ হাহাকার করতো। এখন আইলার চাল পাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত আইলার চাল পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও ছেলেরা টাকা, মেয়েরা কন্যাশ্রী পাচ্ছে, সাইকেল পাচ্ছে। আগের থেকে অনেক কিছু পাল্টে যাচ্ছে। এতে করে অনেক সুবিধা বেড়েছে। আমরা দেখেছিতো আমাদের বাবা-মাকে, এক সাঁঝ খেয়ে আরেক সাঁঝ পেটে হাত দিয়ে পরে থাকতে হতো। সেটা এখন লোকে হ্যালাফ্যালা করে ভাত খেতে পাচ্চে, কাজে কম্মেও লোক এখন বাইরের দিকে চলে যাচ্চে।

     - এই বাইরে যাওয়া নিয়ে গান আছে? 

     - হ্যাঁ আচে সেসব তো এখন মনে পরচে না।

     - ও সাউরি তুমি এবারে একটা গান শোনাও তো; তা লজ্জা লাগচে? উরাও তো মানুষ আমাদের মতোই মানুষ উদেরকে লজ্জা কি?

    আবার গান শুরু হল যার দুটো লাইন কঠিনভাবে আঘাত করতে পারে।

    আরে মুরারে কঠিনও জাতি

    ঘারে কুদাল হাতে লাঠি

    আরে মুরারে কঠিনও জাতি... 

    এইভাবে প্রতিটা গানে সেখানকার মাটি, নদী, জঙ্গলের সাথে মিশে আছে লড়াই আর প্রেম। এগুলো মিলে যখন একটা পুড়নো ঢোল আর মেহগিনি গাছের পাতারা বাতাসের স্পর্শ নিয়ে মায়ার প্রকৃতি গড়ে তুলেছে; তখন মনে হল আসলেই এই পৃথিবীতে ভাষা দুটো। ক্ষমতার ভাষা আর ক্ষমতাহীনের ভাষা; তবে ক্ষমতাহীনের মধ্যেও ক্ষমতা শব্দটা উপস্থিত। শুধু একটু চোখ মেললে দেখা যাবে অগণিত মানুষ এগিয়ে আসছে কোদাল, লাঠি হাতে। জমিতে কচি ধানে তখনও হাওয়ারা খেলবে, নদীর রঙ এরকম রূপোলী সোনালি থাকবে সূর্যের রঙ মিশে। শুধু শব্দ, বর্ণ, ভাষারা নতুনরূপে আওয়াজ হয়ে গর্জে উঠবে, অথবা সুর হয়ে বিঁধে থাকবে। রচিত হবে নতুন ইতিহাস, রচনা করবে ওই মানুষেরাই।

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics