ধ্বস্ত
1 207
অ্যালা-রঙা দেওয়াল। ম্যাড়মেড়ে হলদে আলো, বাল্বের। লাল সিমেন্টের আঁধার মেঝে। নীল পুরাতন মশারি। আর তারই মাঝে এক কমলা রঙের শরীর—এক নারী। এর আর কোনো পরিচয় আছে কি? আছে নিশ্চয়ই। বৌদি। এই পরিচয়ে অবশ্য সে একটা মামুলি মহিলা মাত্র—যার চোখ ঘষা কাচের মতো। তাতে মরা মাছের দৃষ্টি। অস্বস্তি আর দ্বিধায় ভরা হাবভাব। প্রতি পদে জড়তা ও অপরাধবোধ। আসলে, জামাকাপড় অঙ্গে থাকা আর না থাকা—এই দুয়ের মধ্যে আশমান-জমিন ফারাক। অনেকদিনের আগ্রাসী চেষ্টায় ওই খোসাগুলো ছিঁড়ে ফেলা গেছে—রাতের মতো। তারপর এই উদ্ভাস। এখনো অবশ্য মালটা মাঝে মাঝেই গ্যাঁ গোঁ করে। কিন্তু শেষ অব্দি...
একদা এ-ঘরের চৌকাঠ ডিঙোতে গেলে অনুমতি লাগত। দাদার। দাদা তখন এখানকারই সোনার দোকানের কারিগর ছিল। কিন্তু পরে দিল্লিবাসী হওয়া ওই স্বর্ণকারটির ফোনানুরোধ আসে—ঠিকভাবে রেবার যেন দেখভাল করা হয়।তা সে কাজটা ভালোই হচ্ছে বটে। অনুরোধের পরপরই অনুরোধকারীটি বছর তিনেক হলো একেবারেই হাওয়া। মোটে যেন পিকচারেই নেই। কোনোদিন ছিল কি? যদি ছিলই, তো, তিন বছর আগে ব্যাটা গেল কোথায়? এতদিন আছেটা কোথায়? আর ফিরছেনাই বা কেন? এসব যুক্তির ছুরি দিয়ে রেবাকে চিরে চিরে জেরবার করে দিতে বেশ ভালই লাগে। অনেক ঘুরিয়েছে এই মহিলা। তারপর এক্কেবারে সরাসরি আক্রমণ। তবেই না সাফল্য এল! আহা! বেড়ে!
আর এই নাটকীয় ঘরের বাইরে আছে বারান্দাজাতীয় একটা কিছু, যেখানে এক খোঁড়া-চেয়ারের হেলে পড়া উপস্থিতি। অফিস থেকে ফিরে এই চেয়ারই হয়ে ওঠে ভাবনা-স্থান। অফিস? অফিসই বটে। অট্টহাসি হাসা যেতে পারে! এক অভিজাত কুত্তা-ক্লিনিকের দারোয়ান কিংবা গার্ড কিংবা বেয়ারা কিংবা পশু-ডাক্তারদের হেল্পার। তবে বকশিসটা মন্দ নয়।
বারান্দার নোনাধরা পাঁচিলে হাতের ভর রেখে ভাঙা চেয়ারে আয়েস করার সময় গায়ে-মাথায় আলো ফ্যালে চাঁদ। মৃদু আলোয় দেখা যায়, কে যেন ন্যাতানো গোলাপের ধ্বস্ত টবটা যত্ন করে টেনে এনে রেখেছে ইট-সাজানো নকল সিঁড়ির ধাপটার কাছে। কে আর! রেবাই হবে। আর যাই হোক, অনুর পক্ষে তো এটা করা সম্ভব নয়।
যাকগে, যাকগে, যাকগে। বোর হয়ে যাচ্ছে। মাথার মধ্যে হিজিবিজি সংখ্যার মিছিল চলেছে। এক...দুই...চোদ্দো...কুড়ি...পঞ্চাশ...একশো। উঃ! অনিচ্ছাকৃত গণনার প্রবল অস্বস্তি থেকে বাঁচার জন্যই নিজেকে এক ধাক্কায় চেয়ার থেকে ঠেলে তুলে চ্যাঁচাতে হয়, "কী হলো কী? খেতে দিতে এত দেরি!"
মিটমিটে রান্নাঘর থেকে রেবার ফিসফিস শোনা যায়, "দিয়ে দিয়েছি। চলে এসো।"
রান্না ঘরে দুটো পিঁড়ি পাতা। মুখোমুখি। দুটো থালায় রুটি। কুমড়োর তরকারি। আচার।
চরম অল্প আলো, দুটো মানুষ, খাদ্য সামগ্রী, থালা, জলের জগ—সবকিছুই যেন তৈরি হয়েছে রান্নাঘরের জীবন্ত দেওয়াল থেকে, যা কিনা তেলকালিতে কালো চিটচিটে। কোনো ঘর্মাক্ত কালো মানুষের গা যেন। বিজবিজ, চিটপিট করছে ঘামে। আর এই তেলকালির ঘাম? কোনোদিন যাওয়ার নয়। অটুট। এর বুনিয়াদ বড় শক্ত। আগের আমলের স্থায়ী পাতা-উনোন থেকে এর সূত্রপাত। তারপর তোলা-উনোন। তারপর কেরোসিনের স্টোভ। কালির প্রলেপ বাড়ছেই।
মুখোমুখি দুটি প্রাণী এবং অবিরত কচমচ রুটি খাওয়ার শব্দ। একসময় নৈঃশব্দ ভাঙার জন্যেই যেন প্রশ্ন করা হয়, "অনুর খাওয়া হয়েছে?"
- "হ্যাঁ। রুটি নরম করে তরকারি দিয়ে খাইয়ে দিয়েছি। এ-এই এক ফোঁটা খেয়েছে।"
- "সারাদিন করো কী? রুগীর সেবাযত্নও ভাল করে করতে পারনা!"
- " না...মানে...আমিতো..."
- "চুপ। তোমাকে খাওয়াচ্ছি পরাচ্ছি মাগনা নাকি?"
রেবা নীরব। হয়তো চোখে জলও আসে। কিন্তু পরিষ্কার কিছু বোঝা যায় না কালো দেওয়ালের উৎপাতে।
রেবাবৌদিকে পেছনে ফেলে বাপের তৈরি পুরনো বাড়িটার বারান্দার খসখসে চলটা-ওঠা মেঝে দলেমচে থেঁতলে এগিয়ে যাওয়া চলতে থাকে অনুর ঘরের দিকে ।
- "কেমন আছ আজ?"
প্রশ্নটা তারই উদ্দেশ্যে যার নাম অনু। যার কঙ্কাল চাদর ঢেকে পড়ে আছে তক্তপোষে। এবং যার চোখ সাদা। বড় বড়। কোটরগত। তাকিয়ে আছে সিলিং-এর দিকে। অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটার কোনো উত্তর পাওয়া গেল না । কীই বা হবে এসব বেকার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে? এই প্রশ্নগুলো আসলে সংসারের অকেজো বস্তুর মতো, যারা দল বেঁধে বাড়ির আনাচেকানাচে জমে থাকে। কাজে লাগে না, অথচ ফেলাও হয় না । উত্তরের অপেক্ষা না রেখে এগুলো কিছু সামাজিক প্রশ্নমাত্র। এর ওপর সত্যি সত্যিই কোনও সিরিয়াস কিছু নির্ভর করে না।
ঘেমো প্যান্ট-সার্ট উড়ে উড়ে এসে ঝপাঝপ পড়ছে অনুর তক্তপোশের সঙ্গে ইংরাজি এল্ অক্ষরের মত করে রাখা অপর তক্তপোশে। এটাতে শোয়ার লোকটি, যে এখন জামাকাপড় ছুঁড়েছে, কখনোই এখানে সারারাত কাটায় না। তা সময়টা বছরখানেক হবে। হয় প্রথম রাতে এ ঘরে অনুপস্থিত থাকে। নয়তো মধ্যরাত বা শেষরাতে থাকে পলাতক।
এখন এই মুহূর্তে কান্নার বদলে হাসি পাচ্ছে অনুর। কঙ্কালটা তো আসলে মানুষেরই। মেদ-মাংসই শুধু কমে গেছে, এই যা। আর সবই তো আছে। ইচ্ছে, স্বপ্ন, অনুভব, ঈর্ষা, চেতনা, দ্বন্দ্ব। এইসব নিয়ে চাদরের তলায় সারাদিন এপাশ ওপাশ। সোজা হয়ে দাঁড়ানো বা হাঁটার ক্ষমতাহীন এক ক্রমপঙ্গু রোগী। তার আবেগ, বাঁচার আগ্রহ সবই রেবাকে ঘিরে। রেবা সবকিছু করিয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু মিষ্টি কথাও বলে যায়। মশারি ফেলে প্রতিটা ধার ঠিকঠাক গোঁজা হলো কিনা পরখ করে দেখে নেয়। ছাড়া-বাসি যা কিছু সব কেচেকুচে সাফা করে। তবুও ঘরের মধ্যে টিকটিকি-আরশোলা-ইঁদুররা ঘুরে বেড়ায়। আর বাটি-চামচটা মাথার কাছে বালিশের পাশে স্থির হয়ে থাকে। ওটা খুব কমই বাজায় অনু। অফিস-ফেরত কোনো হুকুমদার থাকলে তো আরোই বাজায় না। গত গ্রীষ্মের এক রাত তাকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দিয়ে গেছে।
সেই রাতে দুরন্ত গরমের ছটফটানি তো ছিলই। আর ছিল জলতেষ্টা। যেন বুক চৌচির হয়ে যাবে। জল শেষ। বাটি-চামচ বাজিয়ে বাজিয়ে ক্লান্ত। শব্দটা বেশ খানিকক্ষণ ধরে ঠনঠন করে বোকার মতো কেঁদে মরছিল। কেউ কি নেই? কেউ কি শুনতে পাচ্ছে না! সমস্ত মনোযোগ একত্র করে অনু তখন গড়ান দেয়। একরকম বাধ্য হয়েই। বেঁটে তক্তপোশ থেকে মাটিতে। তারপর গড়িয়ে গড়িয়ে হেঁচড়েমেচড়ে দরজার ধারে। প্রচণ্ড ঝনাৎকারে বাটি, চামচ, গ্লাস, ঢাকনি এদিকওদিক ছিটকে পড়ে। আর... আশ্চর্য! দরজাটা বাইরে থেকে আটকানো ছিলো। গোঙানি-চিৎকার করে ওঠে অনু। তার আর্ত হাহাকার সবকিছুকে কাঁপিয়ে ছাপিয়ে যায়। তখন হঠাৎ ধুপধাপ আওয়াজ করে কারা যেন ছুটে আসে। কারা? দুটো শরীর! দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে। একটির দেহে কোনোমতে গামছা-লুঙি গিঁট বাঁধা। অপরজনের অঙ্গ ঘিরে শাড়ির এলোমেলো প্যাঁচ আর অবিশ্বাস্য এক আঁচল বিশাল সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছুটে এসেছে শাড়ির মালিকের পিছুপিছু। যেন বনমানুষেরা দৌড়ে এসেছে হুলুস্থুল চুল ও ঘর্মাক্ত কলেবরে।
- " হুড়কো আটকে দিয়েছিলে কেন? কী করছিলে তোমারা?" গুঙিয়ে ওঠে অনুর জড়ানো আড়ষ্ট গলা।
উত্তর কিছু ছিল না। প্রয়োজনই বা কি, জবাবের? ওদের হাতে চ্যাংদোলা হয়ে অনু আবার বিছানায় ফেরত হয়। জল দেওয়া হয় তাকে। বাসনগুলো পড়েই থাকে মেঝেতে।
- "আবার নামলে গলা টিপে মেরে ফেলব।"
চাপা হুঙ্কারে বক্তা ক্রুদ্ধ শ্বাস ফেলতে ফেলতে কাপড় সামলাতে থাকা রেবাকে থাবড়া মারতে মারতে নিয়ে চলে যায়। খোলা পড়ে থাকে দরজা, অবহেলায়। হুড়কোর চেয়েও শক্তিশালী কিছু অনুকে থামিয়ে রেখে দেয়। কোটরগত সাদা সাদা চোখে চেয়েই থাকে সে। তখন দৃষ্টি সিলিং-এর দিকে ছিল না। খোলা দরজা দিয়ে সোজা বেরিয়ে গিয়ে এঁকেবেঁকে অন্ধকারে ঠেকে যায়। জমাট বাঁধা কালো শূন্যতা অসীম ক্ষমতা নিয়ে দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ।
আর সেই দামাল যুগল তখন অন্য ঘরে সশব্দে দোর দিয়েছে। সেখান থেকে ক্ষীণ নারী-কান্নাও চুঁইয়ে আসে, যা অনুর ঘরে পৌঁছোনোর আগেই বাতাসে নিকেশ হয়ে যায়।
এরপর থেকে আর কোনোদিন ভুল হয়নি। অনু কাউকে ডাকেনি। বেঁচে থাকার অসীম নেশা কঙ্কালটির। যা হোক হজমযোগ্য কিছু খেতে পাওয়া, তেষ্টা পেলে জল পাওয়া, পিঠের তলায় নাতিপরিষ্কার কিছু ন্যাকড়াচোকড়া পাওয়া, মাথার ওপর ছাদ আর শরীরের ওপর একটি চাদর পাওয়া। এছাড়া চাই অন্তর্বাসহীন একটি ম্যাক্সির আবরণ। আর চাই স্নান ও প্রাকৃতিক প্রয়োজনে কারোর বিশ্বাসযোগ্য সহায়তা। এগুলো ছাড়া আর কিই বা চাহিদা থাকতে পারে?
*****
বেশ কিছুদিন ধরে বৃষ্টি চলছে এবার। সবকিছু ভাসিয়ে নিতে চায়। ন্যাতানো গোলাপের ধ্বস্ত টবটা গতকাল দেহ রেখেছে। নকল সিঁড়ির ধাপের ইট এলোমেলো হয়ে গেছে। বারান্দার নোনাধরা দেওয়াল শ্যাওলায় হয়ে গেছে সবুজ। খোঁড়া চেয়ারটার স্যাঁতস্যাঁতে শরীরে সাদাটে ছাতা পড়েছে।
প্যান্ট গুটিয়ে, ডানা জ্যাবড়ানো ছাতার তলায় প্লাস্টিকের ঠোঙা পরা মুন্ডুটা বাঁচতে বাঁচাতে বাড়ি এসে আশ্চর্য দৃশ্য দেখা যায়। অ্যালা-রঙা লাল-মেঝের ঘরের দরজায় পর্দা টানা। হলুদ আলোটুকুর আভাস আছে কিন্তু বাল্বটা পর্দার আড়ালে। কে টেনে দিয়েছে পর্দাটা? দরজার কাছে একজোড়া পুং-জুতোও রাখা আছে।
এত বড় আস্পর্ধা! কী ব্যাপার? রক্তের ভেতরে শিং বাগিয়ে উঠেছে নিজ-অঞ্চল চিহ্নিতকারী ষণ্ডা বাইসন। আকস্মিক উন্মত্ত ক্রোধে প্রাণীটি বাক্যহারা। ছুটে যাচ্ছে, পর্দাটা ছিঁড়ে ফেলতে হবে এক্ষুনি। আর সমঝে দিতে হবে গোপনচারীদের।
ষণ্ডা বাইসন ঘরে ঢুকে থমকে যায়, অকস্মাৎ। হাতের মুঠো থেকে আলগা হয়ে যায় পর্দা। দেখা যায় হলুদ আলোয় নীল মশারি টাঙাচ্ছে রেবা। গায়ে নতুন ছাপা শাড়ি। সিঁদুরে লাল ব্লাউজ। মোড়ায় বসে বিড়ি খাচ্ছেন সেই তিনি, সোনা-কারিগর—দাদা।
- " হঠাৎ! না বলে কয়ে! এতদিন পরে? কী ব্যাপার?"
অত্যন্ত উষ্মার সঙ্গে কথাগুলো বলা হলেও বাইরে শোনাল খুবই মিনমিনে।
জবাব দিতে সময় নিচ্ছে দাদা। গভীর ভাবে ভাবছে কিছু। ইতস্তত করছে। বিড়ি ধরা রোগা আঙুল ও হাতটা কাঁপছে অল্প অল্প।
- "রেবাকে নিয়ে যাবো ওখানে। কয়েকটা কাজ ঠিক করেছি ওর জন্যে। একা পেরে উঠছি না রে। দুজন মিলে কাজ করলে তবেই ওখানে টিকে থাকা চলে। "
- "তাছাড়া উনি অসুস্থ।" রেবার গলায় উদ্বেগ ও কান্না।
- "কী হয়েছে?"
- "কী জানি!"
- "রক্ত পরীক্ষা হয়েছে?"
- "গিয়ে করাবো। শরীর খুব দুর্বল।"
- "বৌদির কাজটা কী?"
- "বাড়ি বাড়ি রান্না। চারটে রান্নার কাজ জুটিয়ে রেখেছি। টাকা ভালো দেবে। আরও ক’টার খবর আসছে। "
- " এত বাড়ি রান্না করে... বৌদি কি..."
- "আমি পারব।" ফুঁসে উঠছে রেবা।
- " ভাবিস না অনুর জন্যে। রেবার গাঁ সম্পর্কের এক দিদিকে খবর করা হয়েছে। গরিব বিধবা। খেতেই পায় না প্রায়। এক কথায় রাজি। দু-এক দিনের মধ্যেই আসবে। এলে আমরা যাবো।"
- "শা-ল-লা ! এক দিনে এত কাণ্ড হয়ে গেল! অনুর জন্যে কাউকে আসতে হবে না।"
রেবা কেঁদে ফেলে, "ওরকম বোলো না। কেউ একজন দেখভাল না করলে ও তো মরে যাবে।”
- "ও শালি মরে যাক। কোনো হোটেল বা হাসপাতাল এখানে খোলা হয়নি।"
- "বেশ তো, আমাদের ঘরটা কাউকে ভাড়া দিয়ে দিস। রেবার জন্যেও তো তোর অনেক খরচ হয়েছে।"
- " সেটা অন্য কথা।"
রেবা জোর দিয়ে বলে, “কিচ্ছু অন্য কথা নয়। আমার বদলে আরেকজন আসছে। কিসের অন্য কথা? আমি যা খেয়েছি সেও তাই খাবে।"
- "আঃ, থামো না।" বলে ভাইয়ের কাছে দাদা উঠে আসে, "শোন ছোটু, টাকা যা পারব দিয়ে যাব তোকে। তোর কাছে কিছুটা তো ধার শোধ হবে আমার।"
- "হ্যাঁ, যা হোক রুটির টুকরো ছুঁড়ে দেবে দাও। আমি তো একটা কুত্তা ছাড়া আর কিছু নই।"
আজ কঙ্কালের সঙ্গে রাত্রিবাস। গোটা রাত। অনুর বিছানায় মশারি ফেলে অন্যটাতেও টাঙাতে এসেছিল রেবা। রে রে করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। সারারাত ইঁদুর-টিকটিকি-আরশোলাদের খুটখাট-টিকটিক-ফড়ফড় আর মশার পিনপিনানি। মনে হচ্ছিল, একটা পুরুষ-লাশ পড়ে গেলে পড়ে যাক এক্ষুনি, তারপর নীল মশারির ভেতর কমলা নারীকে একা পাওয়া যাবে। মাথার ভেতর সংখ্যারা অনবরত উচ্চারিত হচ্ছিল। বারো তেরো চোদ্দো পনেরো... তিরিশ... বত্রিশ... সাতচল্লিশ আটচল্লিশ...। নিম্নচাপের আর্দ্র ভ্যাপসা গরমে দমবন্ধ হওয়ার দশা। ওঃ ওঃ, এই গরমে সেদ্ধ হওয়ার থেকে কী করে বাঁচা যায়? বাইরে ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি। আজ শালা রেগেমেগে খাওয়াও হয়নি। পেট থেকে তেতো-কিছু মুখে উঠে আসছে। সাতাত্তর আটাত্তর... পঁচানব্বই... একশো। বাড়িটাই ধ্বসে যাক শালা। ভেসে যাক সবকিছু জলের তোড়ে। তখন সময় আসবে নিয়মের বাইরে কিছু করার। তখন কাউকে কারোর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে বানের জলে ভেসে পড়াও যেতে পারে। এই সব ছেলেমানুষি চিন্তা কপাল কোপাচ্ছিল সারাক্ষণ। ওঃ! মা!
ক’দিন পরে, সন্ধ্যে পেরিয়ে সে রাতটা ছিল চাঁদ-ঝলমলে। আদিগঙ্গার ব্রিজের রেলিং-এ হেলান দিয়ে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল। রঙচঙে মেয়েরা চকমকে পোষাকে সিগন্যাল দিচ্ছিল ঘনঘন,
- "আরে, চু-ম-মা, বসবি আয়।
- "এ ডার্লিং, হিজড়া আছিস নাকি রে? আ-ব্-বে, শুবি? ঘর আছে।"
- "ও ঘুঙরি, দেকচিস না ব্যাটার পকেট ফুটো। মাল নাইরে হে হে হে হে। শুদু দেকচে।"
- "এই শালা, হ্যাট্। ভাগ্ হিঁয়াসে। আধাঘন্টা হো গিয়া।"
সব শালা রাক্ষসীর দল। কান নামিয়ে ল্যাজ গুটিয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। আজ বিধবা মালটা আসছে। ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে শালিকে। মজাক্ পায়া! অন্যের পয়সায় খাবে দাবে, মস্তি মারবে? বালিশ চাপা দিলেই হবে অনুকে। সব ঝামেলা শেষ। লাশকে বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ? বাড়িটা কোনো মর্গ নয়, হুঃ!
বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে চোখে পড়ে ভাঙা টব দড়ি দিয়ে বেঁধে খাড়া করা হয়েছে। তাতে একটা কাঠি পোঁতা, যেন শিগগিরই নতুন কোনো গাছ লাগানো হবে। সিঁড়ির নকল ধাপের ইটগুলো সুছাদ ভাবে সাজানো। কে করল কাজটা? প্রশ্ন না করতেই ভেসে এল রেবার গলা, "দিদিকে দিয়ে করিয়েছি। সব বুঝে নিয়েছে, অনুর। দিদি এদিকে এসো।"
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলো একজন। দাঁড়াল রেবার পাশে। দুস্থ বিধ্বস্ত চেহারা। পরনে রেবার পুরনো শাড়ি। ঢলঢলে ব্লাউজটা কাঁধ থেকে গেছে খসে। খোলা কাঁধে এসে পড়েছে চাঁদের আলো। হাতজোড় করে মাথা নুইয়ে বলল,
- "নমস্কার।" গলাটা মিঠে। "আমার নাম মিনতি ।"
সদ্য সাফাই করা খোঁড়া চেয়ারে বসতে না বসতে চা এসে গেল। সঙ্গে লেড়ো। মিঠে স্বরটা বলল,
- "রাত হয়ে গেছে তো, একটু পরেই খেতে দিয়ে দেব, হ্যাঁ? অনুকে খাইয়ে, শুইয়ে দিয়েছি।"
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Apurbo…….jibaner bastab chhobi.