স্নেহলতাদের আমরা ভুলে গেছি কেন? (প্রথম পর্ব)
2 516
গত বছর দশেকে পণপ্রথা নিয়ে কোনও গল্প-উপন্যাস পড়েছেন? বাংলা ভাষায়? অনেক ভেবে-চিন্তেও আমার পাঠোৎসাহী বন্ধু-সহকর্মীরা মনে করতে পারলেন না। কী আশ্চর্য, তাই না? মহিলা লেখক নিশ্চয়ই কমেনি বরং বেড়েছে, নারীচরিত্র-প্রধান গল্প-উপন্যাসও লেখা হচ্ছে বেশি। আর নারী অধিকার তো ফিকশন, নন-ফিকশন সব ক্যাটাগরিতে টপ সেলার। অথচ মেয়েদের স্বাধীনতা, সক্ষমতার একেবারে গোড়ায় ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে যে প্রথা, যা সদ্যোজাত সন্তানের প্রতি মায়ের মনও বিষিয়ে দেয়, তরুণ-তরুণীর জীবনে প্রেমকে ‘এলেবেলে’ করে দেয়, তা কী করে প্রায় গা ঢাকা দিল বাংলা সাহিত্য থেকে?
প্রশ্নটা আরও অবাক করছে এই জন্য যে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গোড়াপত্তন থেকে পণপ্রথা নিয়ে প্রায় ধারাবাহিক ভাবে লেখা হয়ে এসেছে। সৌভাগ্যক্রমে তার কালানুক্রমিক বিবরণ নথিবদ্ধ করার জরুরি কাজটি সেরে ফেলেছেন গবেষক মালেকা বেগম। বাংলাদেশের ‘দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস’ থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘যৌতুকের সংস্কৃতি’ (২০০৬) বইটির পরিধি বৃহৎ। রামমোহন রায় থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অবধি দেড়-দুই শতকে নাটক, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, চিঠিপত্র, গল্প-উপন্যাসে পণপ্রথা নিয়ে কী লেখা হয়েছে তার বিবরণ মেলে তাতে। এটাই মালেকার বইটির দুই-তৃতীয়াংশ। তার সঙ্গে রয়েছে আরও দুটি অধ্যায়। একটি বাংলাদেশের সাহিত্যে যৌতুকপ্রথার চিত্র। অন্যটি সমাজচিত্র — সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর, সরকারি-অসরকারি সংস্থার তথ্য, আর পায়রাবন্দ ইউনিয়নে একটি সমীক্ষার ভিত্তিতে বাংলাদেশে পণপ্রথার বিস্তার তুলে ধরেছেন লেখক। সাহিত্য আলোচনা বা সমাজবীক্ষা, দুটো ক্ষেত্রেই তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে অতটা জোর দেননি মালেকা, যতটা দিয়েছেন অনুসন্ধান আর সংকলনের পরিশ্রমসাধ্য কাজে। সব মিলিয়ে বইটি হয়ে উঠেছে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি রেফারেন্স। বঙ্গদেশে পণপ্রথা বুঝতে চাইলে সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, সাহিত্য বা সমাজ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের যা একবার উল্টোতেই হবে। এ পার বাংলায় ইদানীং কালের মধ্যে এমন বইয়ের সন্ধান পাইনি (পাঠক জানলে অনুগ্রহ করে খোঁজ দেবেন)।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকের লেখাপত্রে দেখা যায়, পণপ্রথার বিরুদ্ধে আপত্তিটা আসছে কৌলীন্যপ্রথা, বহুবিবাহ, সতীদাহের মতো বিধিনিয়মের প্রতিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে। গোটা বিষয়টিই অমানবিক, বর্বরোচিত, লিখছেন রামমোহন, ডিরোজিও, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ সমাজ-সংস্কারের অগ্রণী ব্যক্তিরা। তা বলে সাধারণ মানুষ কলম ধরেননি, তা-ও নয়। মালেকা দেখেছেন, কৌলিন্যপ্রথার বিরুদ্ধে প্রথম মতামত ছাপা হয়েছিল ১৮১৮ সালে সমাচার দর্পণ পত্রিকায়। তারপর থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত একান্নটি বহুবিবাহ-পণপ্রথা বিরোধী চিঠি প্রকাশিত হয় চব্বিশটি পত্রিকায়। ঈশ্বরচন্দ্র যখন বহুবিবাহ বন্ধ করার জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ দাবি করে পুস্তিকা লিখছেন, তখন তার উদ্দেশ্য প্রতিপক্ষ ও স্বপক্ষের যুক্তির বিচার হলেও পণপ্রথার মর্মান্তিকতা নিয়ে না লিখে যেন পারেননি —
‘‘কন্যার যত বয়োবৃদ্ধি হয়, পিতার সর্বশরীরে শোণিত শুষ্ক হইতে থাকে। যার কন্যা, তার সর্বনাশ, যার পুত্র তার পৌষ মাস। ... এ বিষয়ে বরপক্ষ এ রূপ নির্লজ্জ ও নৃশংস ব্যবহার করেন যে তাঁহাদের উপর অত্যন্ত অশ্রদ্ধা জন্মে। কৌতুকের বিষয় এই, কন্যার বিবাহ দিবার সময় যাঁহারা শশব্যস্ত ও বিপদগ্রস্ত হন, পুত্রের বিবাহ দিবার সময় তাঁহাদেরই আর এক প্রকার ভাবভঙ্গী হয়।’’ সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। ২০০২-০৪ সাল নাগাদ রংপুরের কাছে পায়রাবন্দে মালেকা বেগম এক হাজার জন এমন মহিলার সঙ্গে কথা বলেছেন, যাঁদের মেয়েরা যৌতুকের জন্য নির্যাতিতা হয়েছে, তালাকও পেয়েছে অনেকে। এদেরই প্রায় আটশো পরিবারে যৌতুকের জন্য চাপের ফলে ছেলের বউ বাপের বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি গিয়ে দেখা যাচ্ছে, সতীদাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কুলীনপ্রথা, বহুবিবাহের প্রকট কদর্যতা ক্রমশ স্তিমিত হতে শুরু করেছে কলকাতায়। কিন্তু পণের দাপট কমেনি। আমাদের প্রজন্মের অনেকেরই পণপ্রথার সঙ্গে প্রথম পরিচয় পাঠ্যসূচিতে ‘গল্পসংকলন’ বইয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘দেনা-পাওনা’ গল্প দিয়ে। বাড়ি বিক্রি করে মেয়ের বাপ শ্বশুরবাড়ির দশ হাজার টাকা পণের খাঁই মেটাতে চান, মেয়ে নিরুপমা আপত্তি করে, ‘আমি কি কেবল একটা টাকার থলি?’ শ্বশুরবাড়ির অনাদরে নিরুপমার মৃত্যু, এবং সেই অবিস্মরণীয় শেষ লাইন, ‘এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়।’ গল্পটার প্রথম প্রকাশ ১৮৯১ সালে। ঠিক দশ বছর পর নিজের কন্যা মাধুরীলতার বিয়ের সম্বন্ধ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে চিঠিতে লিখছেন, তিনি যৌতুকের জন্য দশ হাজার টাকা পর্যন্ত চেষ্টা করতে পারেন। ‘‘দশ হাজারের উপর আবার আরও দুই হাজার চাপাইয়া ব্যাপারটাকে কুৎসিত করা হইয়াছে। পরমাত্মীয়কে প্রসন্ন মনে দান করিবার সুখ যে আর রহিল না, আমাকে পাক দিয়া মোচড় দিয়া নিংড়াইয়া লওয়া হইল।’’ পাত্রের মা নাকি বিশ হাজার টাকাই পণ চেয়েছিলেন। যেন দশ বছর আগের গল্প অভিনয় হচ্ছে বাস্তবে। রবীন্দ্রনাথের আরও ছ’-সাতটি গল্পে পণের নির্দয়তা উঠে এসেছে।
আবার রবীন্দ্রনাথের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়, শাশুড়ি সারদা দেবী তাঁর বিয়ের গয়নাগুলি নিয়ে নিয়েছিলেন, যেহেতু সত্যেন্দ্রনাথকে শ্বশুর বিলেত পাঠাননি, দেবেন্দ্রনাথই পাঠিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ পরে জানতে পেরে পুত্রবধূকে হিরের কণ্ঠী উপহার দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে চেয়েছিলেন।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই হাতে কলম তুলে নিয়েছে মেয়েরা। ১৮৫৬ সালে কৃষ্ণকামিনী দাসীর ‘চিত্ত-বিলাসিনী’ বইটাকে সাধারণত মেয়েদের লেখা প্রথম বাংলা বই বলে ধরা হয়। আর সেখানেই শুরু বরপণের দোষ আর কুলীন ঘরের মেয়েদের কষ্ট নিয়ে লেখার শুরু। কেবল মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য কেন নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে, সে প্রশ্ন উঠছে আত্মকথা, চিঠি, প্রবন্ধ, উপন্যাসে। দেশের দুর্দশার সঙ্গে মেয়েদের দুর্দশার সম্পর্কও তাঁরা খুঁজছেন। ষাট বছর বয়সে জ্যোতির্ময়ী দেবী (১৮৯৪-১৯৮৮) লিখছেন, ‘‘উৎপীড়িতা, বিবাহক্ষেত্রে উৎকোচের অর্থসংগ্রহে অসমর্থ ঘরের কুমারী ও বিবাহিতা কিংবা অপহৃতা, পতিতা — এই পাঁচ শ্রেণীর পঞ্চমুণ্ডি আসনে বসে দেশ শবসাধনা ক’রে আধ্যাত্মিক মোক্ষলাভের ধ্যানে মগ্ন।’’ মানোদা, হেমন্তবালা, অমিয়বালা, আশালতা সেন, উনিশ শতকের কত না মেয়ের আত্মকথায় পণপ্রথার অমানবিকতা উঠে এসেছে। সাধনা পত্রিকায় ১৮৯৩ সালে শরৎকুমারী চৌধুরাণী লিখছেন ‘কন্যাদায়’ নিবন্ধ। ‘শুনিয়াছি কোন কোন বুদ্ধিমান বর যতক্ষণ না টাকা গণনা শেষ হয় ততক্ষণ ছানলাতলার পিড়ায় উঠিয়া দাঁড়ান না, ভয় পাছে কন্যাটি সমর্পণ করিয়া কন্যাকর্তা টাকা কিছু কম দেন — তখন তো ওই অপদার্থ মেয়েটা ফেরত যাবে না।’ বিশ শতকে সেই প্রতিবাদী স্বর বয়ে চলেছে ইন্দিরা দেবী, রোকেয়া সাখওয়াত হোসেন, সীতা দেবী, শান্তা দেবী, প্রতিভা বসু, প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর কলমে।
প্রজন্ম বদলে যায়, সাহিত্যে পণযন্ত্রণা বদলায় না। এমনকী তার সাংসারিক রূপটা পর্যন্ত প্রায় এক থাকে। দশ হাজার টাকা পণ বাকি থাকায় যে দশা হয়েছিল নিরুপমার, আড়াইশো টাকা বাকি থাকায় সেই একই দশা বিশের দশকে বিভূতিভূষণের ‘পুঁইমাচা’ গল্পে অকালমৃতা ক্ষেন্তির। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ি, প্রবোধকুমার সান্যাল, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, সবার লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে ছেলের বিয়েতে পণ নেওয়ার গল্প। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘সম্পর্ক’ মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাতে বিপত্নীক বাপের দ্বিতীয় বিয়ের গল্প।
সে ছবি কি বদলেছে? উত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে থাকাই ভাল। বিয়ের আগে দরকষাকষি, বিয়ের পর ‘অ্যাডজাস্ট’ করার মরিয়া চেষ্টা এবং আরও টাকার জন্য বাপের কাছে মেয়ের আবেদন, কিছু টাকা দিয়ে কিছুদিন শান্তি কেনা, অচিরেই ফের শুরু নির্যাতনের এপিসোড। অবশেষে রণে ভঙ্গ দিয়ে ব্যাক টু বাপের বাড়ি, না হলে দাঁত চেপে পড়ে থাকা শ্বশুরবাড়িতে। ঘরে মার খেয়ে বাইরে হাসিমুখে সুখী দাম্পত্যের অভিনয়। শেষ অবধি পোড়া দেহ, রক্তাক্ত মুখ, ঠিকরোনো চোখ, বেরিয়ে-আসা জিভ নিয়ে মর্গে। মেয়েদের উজ্জ্বল মার্কশিট, বাপের টাকা, নিজের মাস-মাইনে, কিছুই এই চেনা ছক বদলাতে পারছে না। খবরের কাগজ তার সাক্ষ্য দিচ্ছে প্রতিদিন। কখনও কম পণের লোভে বালিকা বিবাহ খারিজের খবর। কখনও পণের দরাদরিতে বিরক্ত বধূর বর বাতিলের খবর। কখনও পোস্টগ্র্যাজুয়েট কন্যার ঝুলন্ত বা দগ্ধ দেহ উদ্ধারের খবর।
কত গল্প। অথচ তার কোনওটাই উঠে আসছে না গল্প-উপন্যাসে। কবে যেন সাহিত্যে তামাদি হয়ে গিয়েছে পণপ্রথা, তার বিষাক্ত ফুল-ফল। মেয়েদের জীবনে বহুতর, বিচিত্র সংঘাত জুড়ে রয়েছে নানা লেখায়। যার অনেকগুলি অতি সংবেদনশীল। বিবাহিত সম্পর্কের মধ্যে যৌন-নির্যাতন এসেছে বাণী বসু, সুচিত্র ভট্টাচার্যের লেখাতে। মেয়েদের যৌন-ইচ্ছার স্বাধীনতা, সমকামিতা, তৃতীয় লিঙ্গের যৌনতা, এমন বিষয়ও উঠে এসেছে স্বপ্নময় চক্রবর্তী, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তিলোত্তমা মজুমদারের গল্পে। অথচ ইতি-উতি দু’চারটি ছোট গল্প ছাড়া পণপ্রথা নিয়ে লেখালেখির স্রোতটি যেন অন্তঃসলিলা হয়ে গিয়েছে নব্বইয়ের দশক থেকে।
এখন তার যেটুকু প্রকাশ, তা মেয়েদের প্রতি হিংসা নিয়ে আলোচনার একটি মাত্রা হিসেবে। সেখানেও তার স্থান একটু পিছনের দিকে। বাইরের কর্মজগতে মেয়েদের স্থান খুঁজে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ যত গুরুত্ব পেয়েছে, সংসারী মেয়ের ঘ্যানঘ্যানে দুঃখের গল্প তত সরে গিয়েছে পিছনে। গেদে-কামদুনি, পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণ থেকে দিল্লির নির্ভয়া, যা কিছু আলোড়িত করেছে একবিংশের ভারতকে, সে সবই অপরিচিত লোকের দ্বারা পাঠরতা বা কর্মরতা তরুণীকে ধর্ষণ ও খুন। শিশুকন্যাদের উপর নির্যাতন কিছুটা তবু প্রচারের আলোয় এসেছে, সেই সঙ্গে জেন্ডার নিয়ে আলোচনায় অবশেষে প্রবেশ করেছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের উপর নির্যাতন। কিন্তু আশ্চর্য, দেবযানী বণিক কিংবা সুরূপা গুহ হত্যা মামলা আশির দশকে যে ভাবে কলকাতাকে উত্তাল করেছিল, তেমন ভাবে আর কোনও বধূহত্যার মামলা উত্তেজিত, ক্রুদ্ধ করেনি শহরের মানুষকে। গত বছর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্রী মিতা দাসের অকালমৃত্যুর পর ছেলেমেয়েরা ফুঁসে উঠেছিল বটে, তবে সে আলোচনাও প্রধানত ‘ভায়োলেন্স এগেন্স্ট উইমেন’-এর ছকে পড়ে গেল। যার মূল কথা, দোষীর শাস্তি চাই। শাস্তিবিধানের সরকারি কলকব্জাগুলো চটপটে হওয়া চাই। এর একটা আন্দাজ মেলে ফেসবুকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে। তাঁরা নির্যাতনে মৃত মেয়েদের আত্মীয়দের নিয়ে একটি সভার আয়োজন করেছিলেন। তার প্রেক্ষিত তৈরি করছে এই পোস্ট (অক্টোবর ২০, ২০১৬)। একটা অংশ এই রকম —
‘আমরা মনে করি, এই আন্দোলন হতে পারে দ্বিমাত্রিক। এক দিকে সে সুবিচারের দাবিটুকু জানাতে পারে প্রশাসনের কাছে। অন্য দিকে, বৃহত্তর ভাবে তার কর্তব্য যৌন হিংসার বিরুদ্ধে সমাজ জুড়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রবর্তনা, যাকে অনায়াসেই যুক্ত করে নেওয়া যায় দেশের চলতি ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গে, তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে। ২০১২ সালে নির্ভয়া গণধর্ষণের পর জেন্ডার জাস্টিসের যে বয়ানগুলি ভারতের নানা ক্যাম্পাস থেকে উঠছে,আশা করা যায় সেই পরিসরেরও অংশী হতে পারবে এই সংগ্রাম, যা নির্দিষ্ট কোনও পরিসীমায় আবদ্ধ না থেকে হয়ে উঠতে পারবে অসংখ্য নামহারা মিতা, নাজিয়া বা পায়েলদের পার্টিসিপেশনে মুখর, মিতা-নাজিয়ার ক্রমমুক্তির স্বার্থে। ’
মোট চারশো বিয়াল্লিশ শব্দের এই পোস্টটিতে ‘পণ’ শব্দটি এসেছে একবার, ‘যৌন হিংসা’ তিন বার, ‘গার্হস্থ্য হিংসা’ চারবার। মিতা ও তার মতো আরও সাতটি মেয়ের মৃত্যুর তুলনা করা হয়েছে নির্ভয়ার খুন এবং দিদি রিঙ্কুর শ্লীলতাহানি আটকাতে গিয়ে নিহত রাজীব দাসের ঘটনার সঙ্গে। বোঝা যায়, এখানে ‘হিংসা’ একটি বৃহত্তর ফ্রেম তৈরি করছে যার মধ্যে নারী নির্যাতনের প্রায় সব ‘ভ্যারাইটি’ ফিট করে যাচ্ছে। যৌন হিংসা আসতে পারে ঘরে বা বাইরে, দুটোর মোকাবিলা হবে একই দর্শনে, একই উপায়ে। পণপ্রথাকে মেয়েদের অবমূল্যায়ন এবং বিপন্নতার একটি মৌলিক, গঠনগত কারণ বলে চিহ্নিত করার প্রয়োজন এখানে অনুভূত হচ্ছে না। যে ভাবে গণধর্ষণের মোকাবিলা হবে, সে ভাবেই পণপ্রথারও। এই নিরিখে অপরিচিত ধর্ষক এবং পরম-পরিচিত স্বামী, দুজনে একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে, কারণ তারা দুজনেই নির্যাতনকারী। আলাদা আইনের ধারা প্রয়োগ হতে পারে, কিন্তু আদতে অপরাধ এক বলে শাস্তিযোগ্যতাও এক। এই হল বয়ান।
মনে হতে পারে, তা মন্দ কী? মেয়েদের শান্তিতে-স্বস্তিতে বাঁচার অধিকার যে ভঙ্গ করবে, রাষ্ট্র তাকেই শাস্তি দেবে। তা-ই তো হওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা একটা আছে। সে বিষয়ে আগামী পর্বে বিশদে আলোচনা করা যাবে।(চলবে)
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Comments (2)
-
-
লেখাটা খুব জরুরি। কেন আজ পণ নিয়ে উচ্চস্বর গায়েব ভাবতে গিয়ে দুটি কথা মাথায় আসে। বেসিক্যালি কুপ্রথা আপরুটেড হয় তখন যখন সর্বস্তরের মানুষদের সমস্বর কে এক জায়গায় আনা যায়। এক্ষেত্রে কন্যার বাবা লুজার আবার সেই বাবা যখন পুত্রের তখন সে গেইনার। হিসেব বরাবর নয় লাভ। ক্ষতির অঙ্ক নেই বললেই চলে। মেয়ে তার ইন লজ এর হাউসে কেমন আছে সেটা তো তার পারসোনাল লস বা ইমোসন্যাল ব্যালন্সের ইস্যু। আবার এক সন্তান নিউক্লিয়ার সোসাইটির বাড়বাড়ন্ত হালচিত্র। সেখানে কন্যার একমাত্র উত্তরাধিকার। বাবা-মা ভরে দেন গয়নাপতি,ফার্নিচার। ছেলে হলে স্পষ্ট পণের দাবী না থাকলেও পছন্দের নানা শর্ত। যেমন মফস্বলের মেয়ের বাবার কাছে কলকাতায় একটি সেল্টার চায় মানে ফ্ল্যাট। লাভের অঙ্কের পারস্পরিক সমঝোতা পণকে নিরুপমার যন্ত্রনা থেকে সরিয়ে এনে লাকজুরিয়াস লাইফের এক চাবিকাঠিতে এনে থামিয়েছে। ছেলে কিনবো, মেয়ে বেচবো তাই ইভিলস এখন ব্রাত্য নয়, জীবনচর্চায় অঙ্গীভূত। দেওয়া, নেওয়ায় চাপ নেই। আভিজাত্য আছে, লাভালাভের হিসেব ঠিকঠাক থাকছে।
Leave a Reply
-
সামাজিক, পারিবারিক জীবনে এক সমস্যা ‘পণ’। এবং সে বিষয়ে, রচনা নিয়ে স্বাতী’র বক্তব্য বেশ তথ্যসমৃদ্ধ।
সঙ্গে জীনাত এর মন্তব্য বেশ বিশ্লেষণ মূলক!
ভাল লাগল !