• ভূমিকন্যাদের কথা (চতুর্থ পর্ব)


    2    387

    September 5, 2017

     

    ছবি - www.survivalinternational.org

    বাস-ওঠানো বসত গড়ার খেলা

    মনে করুন, একটি নদী বয়ে যাচ্ছে। বয়ে যাচ্ছে সেই কোন্‌ কাল থেকে। কখনো তার জল বন্যায় ভাসায় মোহানা অঞ্চল, কখনো নদীর ধারে চাষের জমি জল পায় না। মানুষকে আরও একটু ভাল জীবনের সন্ধান যাঁরা দেওয়ার কথা ভাবেন, সেই সব মন্ত্রী এবং উন্নয়নের কারিগররা একদিন ঠিক করেন, নদীতে একটা বাঁধ দেওয়া যাক। নকশা তৈরি হয়, মাপজোখ হয়, টাকাপয়সার জোগাড়যন্ত্র হয়, একদিন প্রস্তাব পাশ হয়ে তৈরি হতে থাকে বাঁধ। যাদের জমি বাঁধের জলে তলিয়ে যাবে, যাদের ঘর এবং ভিটেমাটি ডুববে, অথবা আধডোবা হবে, তাদের সঙ্গে পরামর্শ করার কোনও প্রথা নেই, কারণ এতো এগিয়ে চলার বন্দোবস্ত। চাষিরা জল পাবে, ক্ষেত দু’-ফসলি হবে, বন্যা নিয়ন্ত্রিত হলে কমে যাবে ক্ষয়ক্ষতি, পশু আর মানুষের জীবনহানি, তার জন্য কিছু মানুষকে ত্যাগ তো স্বীকার করতেই হবে। যাদের গলার জোর কম, অথবা যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে, যারা জানে না কি করে কথা আদায় করে নিতে হয়, ত্যাগ স্বীকারের ব্যাপারটা তাদেরই নিজেদের জীবনে শামিল করে নিতে হয়।

    এ পর্বে যদিও কেবল বাঁধের জন্য ঠাঁইনাড়াদের কথাই বলব, কিন্তু ব্যাপারটা যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প—যাতে সরকারের জমি দরকার হয়, যেমন খনি, ভারী শিল্প, রাস্তাঘাট—সবেতেই অল্পবিস্তর একইরকম।

    এখন তো মোটামুটি এমনিই হয়ে গেছে, যে, যারা সম্পন্ন, তাদের অধিকাংশই চলনশীল। এক গ্রামে, বা এক শহরে বসে থাকলে উন্নতি করা কঠিন। কাজেই গ্রাম ছেড়ে শহর, শহর ছেড়ে অন্য রাজ্য, দেশ থেকে বিদেশে গিয়ে উপার্জন করার প্রবণতা বেড়েছে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে। আদিবাসী সম্প্রদায়ও শিক্ষিত, কিন্তু তুলনামূলকভাবে তাঁদের অন্তর্প্রজন্ম চলনশীলতা অনেক কম। গড় নিলে দেখা যাবে তিন প্রজন্মের ব্যবধানে একটি আদিবাসী পরিবার হয়ত ১৫-২০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করেছে। তার বড় কারণ আদিবাসীরা জড়িয়ে থাকেন তাঁদের নিকটবর্তী পাহাড়, নদী, জঙ্গল এবং নিজস্ব গ্রাম সমাজজীবনে। প্রকৃতি ও নিজস্ব সমাজের সঙ্গেই তাঁদের আজন্ম অন্তরঙ্গতা। কাজেই সার্বিক উন্নয়নের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে যখন আদিবাসীদের ঠাঁইনাড়া হতে হয়, তখন তাদের দুর্দশার অন্ত থাকে না। এই দুর্দশা এবং তার ফল হিসেবে নতুন বসতে জীবন আরম্ভ করার যন্ত্রণা সবচেয়ে বেশি ভোগ করতে হয় মেয়েদের।

    চিরচেনা বসতেই যেখানে অরণ্যে ঢোকার পথ প্রায় রুদ্ধ, জঙ্গলের চৌকিদার আর রেভিন্যু আফিস হুড়ো নিয়ে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, জমি কম বলে অন্যের ক্ষেতে মজুরি করতে হয়। কার্যকরী শিক্ষা মজবুত নয় বলে পণ্যের বা শ্রমের দাম পাওয়া দুষ্কর, সেখানে নিজেদের আজন্ম দেখা আশ্রয় ছেড়ে ভিন্‌ গাঁয়ে শিকড় গাড়ার চেষ্টা যেমন কষ্টের, তেমন অপমানের। আদিবাসী অঞ্চলে ঘরের ও বাইরের কাজের পঁচাত্তর ভাগ যে মেয়েরা করেন, এই অপমান ও কষ্টের ভাগ তাঁদের প্রায় পুরোটাই নিতে হয়।

    ওড়িশায় বাঁধ প্রকল্পের বাস্তুচ্যুত মানুষদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি এই দুটো নাম খুব প্রচলিত—উঠা গাঁ আর বসা গাঁ। যেখান থেকে মানুষ বসত ছাড়ে, সেটা উঠা গাঁ, আর যেখানে গিয়ে বসত করে, সেটা বসা গাঁ। বসা গাঁয়ে আগে থেকেই মানুষ বসত করে আসছে, উঠা গাঁয়ের লোকেদের তারা ভাল চোখে দেখে না, নানাভাবে তাদের সঙ্গে লড়াই করে, অপমান করে।

    নীতি যাঁরা তৈরি করেন, সেই নীতি যাঁরা কার্যকরী করেন তাঁরা কেউ উচ্ছিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চান না। গত পনের বছরে জাতীয় এবং রাজ্য স্তরে পুনর্বাসন নীতি গৃহীত হয়েছে, তাতে কয়েকটা রূপরেখা আছে। কীভাবে পুনর্বাসন পরিকল্পনা হবে, কীভাবে তাতে মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করা হবে। কিন্তু যেকোন নির্মাণ প্রকল্পেই ইঞ্জিনিয়ার ঠিকেদার সিমেন্ট কংক্রিট লোহার ছড়ের দাপট এত বেশি, যে ভাল তত্ত্বাবধান না হলে এই সব প্রক্রিয়া কেবল দায়সারা নিত্যনৈমিত্তিকতায় পরিণত হয়ে যায়।

    আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে কোরাপুটের কালাহান্ডি জেলা সংলগ্ন দুর্গম অঞ্চলে গিয়েছি, আদিবাসী মেয়েদের সংগঠনের সঙ্গে কথা বলতে। তখন ওখানে শিশুমৃত্যুর হার—হাজারে একশো ষাট, দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ছোট দলে বসে আলোচনার সময় প্রকট হয়ে পরে—দশজনের মধ্যে ন’জন আদিবাসী রমণীরই কোল খালি করে চলে গেছে একটি সন্তান। ম্যালেরিয়া, আন্ত্রিক, টিবি ও মেনিনজাইটিসে যেখানে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়, সেখানে স্বাস্থ্যকর্মীরা কেবল জন্মনিয়ন্ত্রণের টার্গেট হিসেবে মায়েদের খোঁজেন কেন?

    কালাহান্ডির অনাহার নিয়ে তখন খুব খবর হত—কিন্তু অনেকেই জানতেন না, কোরাপুট, কালাহান্ডি, বলাংগির ও সম্বলপুরের সন্নিহিত অঞ্চলগুলি আসলে একটিই দুর্দশাগ্রস্ত বলয়—যেখানে অর্ধাহার, শিশুমৃত্যু, ভূমিহীন ক্ষেতমজুরের গ্রাম ছেড়ে যাওয়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলি একইরকম। এইসব সমস্যাকে তীব্রতর করেছে প্রায় অশক্ত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, জনসংগঠনের অভাব এবং পুঞ্জীভূত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী স্থানীয় প্রশাসন।

    নদীর ধার থেকে চত্‌রণ ঘাস তুলে বেঁধে ঝাঁটা তৈরি করে হাটে বিক্রি করে আদিবাসী মেয়েরা—তাতেও বেধেছে বনজ সম্পদ নিগম ও জঙ্গল বিভাগের সঙ্গে লড়াই। ওগুলি নাকি বনজ সম্পদ, মেয়েরা তুলতে পারবে না। নিগমের কাছ থেকে ঠিকা নিয়েছে বহিরাগত ঠিকাদার—তারা ট্রাকে করে ঘাস তুলে নিয়ে যাবে। ব্যবসায়িক লোভে অরণ্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নানা বাধানিষেধে আদিবাসীর সঙ্গে অরণ্যের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। মেয়েরা বলছিল – নবরংপুরে খুব বড় জলসেচন ও বিদ্যুৎপ্রকল্প এসেছে ইন্দ্রাবতী নদীর উপর। গত দশ বছরে ইন্দ্রাবতীর তিনটি জলাধারকে জায়গা দিতে উচ্ছিন্ন হয়েছে শ’খানেক গ্রাম, হাজার হাজার মানুষ। ডুবে যেতে বসেছে দুর্লভ অরণ্যভূমি।

    মানুষের হাটে টাকাপয়সা কম। শেষদিন পর্যন্ত জমি আঁকড়ে বসে থাকে তারা—উঠবে না এখান থেকে। শেষে যখন উঠে যাওয়া অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়, জল ফণা তুলে দাঁড়ায়—চাষের জমি, জঙ্গল, বসত বাড়ি সব ডোবাবে বলে, তখন আর অন্যত্র জমি কেনার সামর্থ্য থাকে না। আত্মীয়কুটুম্ব, হাসি উৎসবে ভরা গ্রামটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়—অন্যত্র বসত করতে গিয়ে। উঠা গাঁয়ের মেয়েদের রোদনের ধ্বনি কানের ভিতর ঢুকে আছে আমার। ভাঙা বাড়ির কড়ি বরগা, শস্য, বৈহস, পাখির খাঁচা, গোরু বাছুর নিয়ে পিতৃপুরুষের গ্রাম ছেড়ে তারা যখন বার হয়, তখন কান্নার ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে।

    মেয়েদের দলের নেত্রী ‘কুই’ আদিবাসী সুমনী মোড়িয়া আমাকে বলছিল, ইন্দ্রাবতী প্রকল্পের বাস্তুহারা বেশ কিছু পরিবার কালাহান্ডির থুয়ামুল রামপুর অঞ্চলে এসে বসত করেছে—তাদের জীবন এখনও ভাঙাচোরা—এরই মধ্যে সার্ভের খবর এসেছে, কোরাপুটের কাশীপুর অঞ্চলে অক্সাইটের খোঁজ পড়ে গেছে। এবার আবার ঠাঁইনাড়া হতে হবে গ্রাম কে গ্রাম। কেউ বিশেষ কিছু জানে না সঠিকভাবে, তাই ভুল বোঝাবুঝি চরমে উঠেছে। সরপঞ্চ বলছে, পঞ্চায়েত সেক্রেটারি বলছে, বক্সাইট খনির জন্য রাস্তা চওড়া হবে, উঠে যেতে হবে এই গ্রামের লোককে। ডুমেরকণা গ্রামের বুধবারী মাঝি আমাকে এসে জিজ্ঞেস করল—কী ভেবেছ তোমরা, সরকারী লোকরা? আমরা কি মেঠো ইঁদুর? এবার গর্ত করে মাটির তলায় সেঁধোব? মাটির উপর কেবল তোমরাই থাকবে বুঝি? একই পরিবার একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে কোন সতর্কীকরণ ছাড়াই, তার কারণ প্রশাসনের চরম ঔদাসীন্য এবং উত্তরদায়িত্বের অভাব। মেয়েদের কাছে উন্নয়ন যোজনা রূপায়নের খবর এসে পৌঁছয় না অথচ সমস্যার মকাবিলা—খাদ্যসংগ্রহ, বাঁচার সংগ্রাম, সন্তানপালন তাদেরই করতে হয়। পঁচিশ বছর আগে যে আদিবাসী মেয়েদের দল এই বোঝাপড়ার কাজটা ভালভাবে করতে চাইছিল, আজ তাদের কোন অস্তিত্ব নেই। পঞ্চায়েতের হাতে অনেক টাকা, পুঁজির নখওয়ালা যারা প্রসারিত অরণ্যে পর্বতে—খনিজ সম্পদের সন্ধানে—কিন্তু এ এক অসম যুদ্ধ। জনসংগঠনের দায়িত্ব আজ কারো হাতে নেই। আছে ভোটের জন্য মানুষকে ভাগাভাগি। তাতে মানুষের ক্ষমতায়ন হয় না।

    গত দু দশকে কালাহান্ডির উন্নয়ন হয়েছে শিক্ষার ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্য, খাদ্যশস্যের আবণ্টনে। আদিবাসী সম্প্রদায়ও তার ভাগীদার হয়েছে। কিন্তু ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বাইরেও মানুষকে নানা উন্নয়নের প্রশ্নে সংগঠিত করার প্রয়োজন। এ কাজ করার মানুষের সংখ্যা কম। ইন্দ্রাবতী জলসেচন প্রকল্পে চাষের জল এসেছে, সবুজ, শস্যশ্যামল হয়েছে ভূমি। কিন্তু যে সব চাষি প্রকল্পের আওতায় ছিল, তাদের সবাই জমির মালিক নেই আর। শোনা যায়, আইনসংগত না হলেও, বেনামী বেআইনি হাতবদল হয়েছে ইন্দ্রাবতীর জলসিঞ্চিত জমি। অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে সম্পন্ন চাষিরা এখন এর বেশ কিছু অংশ চাষ করে। ওই হাতবদল ঠেকানো যেত, যদি মানুষের সঙ্গে, মানুষের মধ্যে কাজ করা যেত।

    কিছুদিন আগে নিয়মগিরি পাহাড়ে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। ডোঙ্গরিয়া কন্দ মেয়েরা তাঁতে বোনা মোটা সুতোর চাদরে রঙিন সুতোর নকশা তোলে, মোটা সূচে। অনেকদিন ধরেই তাদের হাতে বোনা নকশী শালে শীত ভাঙে নিয়মগিরি পাহাড়ে। কিছু শাল বাইরের বাজারেও বিক্রি হয়। এবার তাদের শালের কথা শুধোতে বলল, ঘরে শাল নেই, আমাদের মন খারাপ। মন খারাপ কেন? শীতের দিনে, গাছপালার ফাঁক দিয়ে এসে পড়া মলিন রোদে পাশাপাশি বসে আছে একদল মেয়ে। তাদের মধ্যে যেমন বয়স্করা আছেন, তেমন কিশোরীরাও। সবার মুখ গোমড়া। নিয়মগিরি পাহাড়ে বক্সাইট নিষ্কাশনের বিরোধে বেদান্ত কোম্পানির সঙ্গে আদিবাসী জনসম্প্রদায়ের লড়াই চলছে বেশ কিছুদিন হল। নিয়মরাজার রাজ্য পৃথিবীর বুকে স্বর্গতুল্য নিয়মগিরি কালাহান্ডির লাঞ্জিগড় থেকে কোরাপুটের রায়গড়া পর্যন্ত সবুজ বঙ্কিম রেখায় ছড়িয়ে আছে এক বিশাল টিয়াপাখির ডানার মতন। সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দিয়েছে স্থানীয় গ্রামসভা রাজি না হলে এই নিষ্কাশন চলবে না। গ্রামসভা রাজি হয়নি—তাদের উপর নানা চাপ বাড়ছে, বহু প্রলোভন। শোনা যাচ্ছে মাঝে কিছুদিন থেমে থাকার পর বেদান্ত আবার চেষ্টা করছে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার—যাতে গ্রামসভাকে বলা হয় তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিচার করতে। সবাই চিন্তায় আছে, এবার কিভাবে চাপ আসে, কিভাবে প্রলোভনের জাল বিছানো হয়। নিয়মগিরির ঢালে হয় হলুদ, আদা, কমলালেবু, আনারস, ধান। সবই প্রাকৃতিক। কৃত্রিম সারের স্পর্শহীন। প্রতি পরিবারের আছে একটি করে পাহাড়। সবাই নিজের নিজের পাহাড়ে চাষ করে। রাজস্ব বিভাগ তাদের চাষের জমি হিসেবের খাতায় লিখে রাখেনি—ইচ্ছে করেই। যে চাষ করে দশ একর, তার জমি লেখা আছে আড়াই একর—যাতে অধিকার সাব্যস্ত করা মুশকিল হয়ে পড়ে।

    বক্সাইট খনন যদি আরম্ভ হয়ে যায়, তবে ভেঙেচুরে নষ্ট হবে এই স্বর্গ, কেবল স্বর্গ নয় মানুষের বহু শতাব্দী ধরে পাতানো সংসার। আর এই সব ভাঙাচোরা রক্তমাখা টুকরো আঁচলে কুড়িয়ে তুলে আবার জুড়তে হবে মেয়েদেরই। তাদের মন খারাপ হবে না এই ভেবে? কিভাবে তারা শালের জমিতে তুলবে রঙিন সুতোর নকশা?

    কুড়ি বছর আগে মহারাষ্ট্রের সীমাসন্নিহিত জেলা নন্দুরবারে, সুপ্রিম কোর্টের পাঠানো একজন বিচারপতির বেঞ্চের শুনানিতে আমাকে কেউ ডাকেননি, আমার কোন ভূমিকা ছিল না। আমি শুধু শুনছিলাম মানুষের কথা আর ঘুরেছিলাম গ্রামে। নর্মদা বাঁধের উচ্চতা বাড়ালে যেসব জমি জলমগ্ন হবে সেই চাষিদের পুনর্বাসন সম্পূর্ণ হয়েছে কিনা দেখতে এসেছেন বিচারপতি। তাঁকে ঘিরে রাজস্ব বিভাগের ও পুলিশের বিরাট দল। জমির বদলে জমি দেওয়া তো সম্ভব নয়—অত জমি কোথায়? তাই নগদ টাকায় সামান্য কম ফসলি জমি কিনে উঠে যেতে মানুষ নারাজ, তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে হবে টিনের ঘর ছাওয়া কলোনিতে, সেখানে পুরনো গাছ কই, নদী কই, তাদের আজন্ম দেখা পরিবেশ কই—এই নিয়ে বিক্ষোভ চলছে মানুষের মনে। এঁরা সব আদিবাসী ভীল, কথা বলেন মারাঠিতে নয়, আহিরাণি ভাষায়। সে ভাষা না বোঝেন কমিশন, না রাজস্ব বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা। বাস্তুচ্যুত মানুষের অধিকার লোপের প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ মাইকেল সার্নিয়া সেই কবে লিখেছেন—ভূমিহীনতা, গৃহহীনতা, কর্মহীনতা, উপার্জনহীনতা এবং সর্বোপরি স্বরহীনতা। এই স্বরহীনতা যে কি বস্তু স্বচক্ষে দেখেছিলাম, যখন, মেধা পাটকরের নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের কার্যকরতারা কমিশনের সঙ্গে কথা বলতে উঠলেন। ইংরেজি বলতে বা বুঝতে পারছিলেন না স্থানীয় ভীল পুরুষ মহিলারা। আপত্তি তুললেন, অতিরিক্ত জেলাশাসক। মহামান্য বিচারপতি, এঁরা কেন কথা বলছেন? কমিশন বললেন, ঠিক! স্থানীয় মানুষ নিজেরাই বলুক।

    ঘরভর্তি মেয়ে পুরুষ একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেদের অভিযোগ জানাতে লাগলেন। সমবেত কণ্ঠে। আহিরাণি ভাষায়। যে একটিমাত্র ভাষা এঁরা বলেন, তাতে।

    কমিশন বললেন, এ কি! সবাই মিলে একসঙ্গে কথা বলছ কেন? এক এক করে বলো!

    সবাই এর ওর মুখে তাকালো, তারপর লজ্জায়, সংকোচে পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল ভীলেরা। কেউ কথা বলতে পারল না।

    তারপর আরম্ভ হল সরেজমিন জমি দেখার পর্ব। উঁচু নীচু পাথুরে পথ ধরে চলেছে কমিশনের লালবাতি লাগানো গাড়ি, পিছনে পিছনে রাজস্ব বিভাগের গাড়ি ও জিপ, সেপাই সান্ত্রীরা। হেঁটে দৌড়ে পিছন পিছন আসছে দলে দলে মেয়ে পুরুষ, যাতে জমিতে ওদের আগে কমিশন পৌঁছতে না পারে, যাতে রাজস্ব বিভাগের দেওয়া ভুল খতিয়ান কমিশনের কানে আগে না পৌঁছয়। নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের নেত্রী সুরেখা আসন্নগর্ভা। যেকোনো সময় শিশুর জন্ম হতে পারে। ভারী শরীর নিয়ে তিনিও পায়ে হেঁটে দৌড়ে দৌড়ে চলেছেন মেয়েদের সঙ্গে। এ কি অসম যুদ্ধ, এ কি মরণপণ দৌড়—যাদের উৎখাত করা হবে, তাদের সঙ্গে সরকারের বাহুবলের প্রতিযোগিতা! দেখছি আর ভাবছি, এঁরা কি পারেন না, একটু ধীরে, এই সরেজমিন দেখার পর্ব সবাইকে সঙ্গে নিয়ে করতে? এত কষ্ট দিচ্ছেন কেন?

    ওইভাবে ছুটতে ছুটতেই সুরেখার প্রসব বেদনা উঠল। একটি বড় গাছের নীচে শুয়ে পড়লেন সুরেখা। আর ভীল মেয়েরা কমিশনের গাড়ির মিছিলের পিছনে হাঁটা ছেড়ে দিল। তারা ছুটে এল, গাছের চারপাশে নিজেদের রঙিন ওড়না, পুরুষদের পাগড়ির ঘের টাঙিয়ে তৈরি করল সবুজ নীল হলুদ খয়েরির এক স্পন্দমান বলয়। কিছুক্ষণ পর নবজাতিকার ক্রুদ্ধ কান্নায় জেগে উঠল নর্মদা সন্নিহিত পল্লীর দুপুর। সে তার জন্মের ভূমি ছাড়বে না, এখানেই থাকবে, বাঁচবে এই কথা জানাতেই যেন এসেছে এই মেয়ে। ভীল রমণীরা অসংখ্য আদিমাতার মতন ঘিরে আছেন প্রসবভূমি, রক্ষা করছেন মা ও নবজাত শিশুকে। একটি নতুন মানবজীবন তাদের কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে গেছে অন্য এক আশাদীপ্ত চেতনায়, ভুলিয়ে দিয়েছে চাষ জমি আর ভিটেমাটি বাঁচানোর লড়াই। ওই বীররমণীদের কথা আজ মনে পড়ে গেল, দেশের ৭০তম স্বাধীনতা বর্ষ উদ্‌যাপনের সময়।         

     
     



    Tags
     



    Comments (2)

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics