নজরে বিজ্ঞাপন: নিরমা-র হেমা-রেখা-জয়া-সুষমা
1 170ইদানীং হাটেবাজারে সর্বত্র ‘নারীশক্তি’-র জয়জয়কার দেখে পালানোর পথ পাইনা। নারীশক্তি, বা ‘গার্ল পাওয়ার’, যাই বলুন না কেন – মানেটা দাঁড়ায় একই; সর্বগুণসম্পন্না এই আধুনিকা ঘরে-বাইরে সমানভাবে সফল। এই দশভুজার দশ হাতে স্যাফোলা অয়েল, স্যামসাং-এর স্মার্টফোন, লাইজল-এর বোতল, তানিস্ক্-এর হিরের ব্রেসলেট, কী নেই? এবং অবশ্যই পরিধানে ল্যাবকোট, গলায় স্টেথোস্কোপ শোভা পাচ্ছে, বাজাজের স্কুটি বিশ্বস্ত বাহন। এই অতিমানবী পারেননা এবং করেননা, এমন কোনো কাজ নেই।
এসব ভাবতে ভাবতেই দেখি নিরমা-র বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে টিভিতে। সেই কোন ছোটবেলা থেকে এই সাবানগুঁড়োর সঙ্গে একরকম বড় হয়ে ওঠার কারণেই, ‘ওয়াশিং পাউডার নিরমা’-র সুরটা কেমন যেন নস্টালজিক করে দেয়। কিন্তু পর্দার দিকে মনোযোগ দিতেই তাজ্জব হয়ে গেলাম। এ তো সেই চিরচেনা সাদা ফ্রক পরা ঘূর্ণায়মান মেয়েটা নয়! রাস্তার পাশেই কোনও এক জায়গায় অ্যাম্বুলেন্স-এর চাকা কাদায় ফেঁসে গেছে। একগাদা লোক (বেশিরভাগই পুরুষ) গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছেন, অনেকে আবার ফোনে ছবি বা ভিডিও তুলতে ব্যস্ত। অ্যাম্বুলেন্স-এর ঘুরন্ত চাকার থেকে খানিকটা কাদা ছিটকে এসে এক কেউকেটা গোছের ধোপদুরস্ত ভদ্রলোকের জামার হাতায় লেগে যাওয়ায় তিনি যারপরনাই রাগত। এই ডামাডোলে লম্বা ট্র্যাফিক জ্যাম বেঁধেছে। এমন সময়ে হেমা, রেখা, জয়া এবং সুষমা তাঁদের গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে এই দৃশ্য দেখে, অবশেষে আস্তিন গুটিয়ে, কোমরে আঁচল জড়িয়ে নিজেরাই এক-হাঁটু কাদায় নেমে অ্যাম্বুলেন্সটিকে ঠেলেঠুলে উদ্ধার করে দিয়ে, কর্দমাক্ত জামাকাপড়ে রাস্তায় উঠে এসে ‘বীর’-এর মতো হাঁটা দেন। আর হ্যাঁ, যাওয়ার আগে সেই ধোপদুরস্ত ভদ্রলোককে তির্যক কটাক্ষে অপ্রস্তুত করে দিয়ে যেতে ভোলেন না।
৮০-র দশকে নিরমা-র বিজ্ঞাপন
নিরমা-র এই নতুন রূপে আগমন চমকপ্রদ বইকি! নব্বই দশকের বিজ্ঞাপনটি ছিল অনেকটাই আলাদা। সেটি শুরু হত জিমনাস্টিক বা এয়ারোবিকস-এর ধরণে নৃত্যরত মহিলা এবং পুরুষদের দিয়ে। পুরো বিজ্ঞাপন জুড়ে অনেকটাই ছিল নাচ, ঝকঝকে গাউন, সালোয়ার কামিজ, বা শাড়ি পরিহিতা হাস্যময়ী নারীরা। এও দেখানো হত যে নিরমা সাবান জলে গুলে তার বালতি-উপচে-পড়া ফেনা এবং ময়লা পরিষ্কার করার গুণ দেখে মুগ্ধ হয়ে উঠছেন নানা বয়সের, নানা বেশভুষার গিন্নীরা। অর্থাৎ কাপড় কাচাটাকে তখনও খুব পরিষ্কারভাবেই মেয়েদের ডিপার্টমেন্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে।
সেই তুলনায় একটু আগে টিভিতে দেখানো নতুন নিরমা-র বিজ্ঞাপনটা এক হিসেবে বৈপ্লবিক নয় কি? কোথায় গেল সাবান-গোলা বালতি? একমুখ হাসি নিয়ে কাপড় কাচতে বসা গৃহিণীরা? তার বদলে চারজন অফিসযাত্রী মহিলা (তাঁরা গাড়িও চালান) বিপত্তি দেখে একসঙ্গে মিলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। বিশেষ দ্রষ্টব্য, সেখানে প্রচুর পুরুষ উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু কেউই গাড়িটাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাননি। সকলেরই কাদার ভয়!
নিরমা-র নতুন একটি বিজ্ঞাপন
তার মানে দু’মিনিটে কতগুলো স্টিরিওটাইপ ভাঙা হল? একই সাথে বলে দেওয়া হল, মহিলারা ফুলের ঘায়ে মোটেই মূর্ছা যাননা, রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে তাঁরা পুরুষদের সমান (এক্ষেত্রে তাদের চেয়েও বেশি) স্বচ্ছন্দ, তাঁদের উপস্থিত বুদ্ধি প্রশংসনীয়, এবং সবচেয়ে বড় কথা – তাঁদের গায়ের জোর পুরুষদের তুলনায় কোনও অংশে কম নয়। একটা মারুতি ভ্যানকে একহাঁটু কাদার থেকে টেনে তোলা কি মুখের কথা? এরকম এক বিজ্ঞাপন দেখে সত্যিই মন ভাল হয়ে যাচ্ছিল। তবে কিনা, দু-একটা বিষয়ে কিন্তু-কিন্তু থেকেই যাওয়ায়, আরও একটু ভাবতে হল।
'গার্ল পাওয়ার' না ফেমিনিজম
হেমা, রেখা, জয়া এবং সুষমারা শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, কুর্তা, এবং টপ পরিহিতা - হয়ত বিভিন্ন রুচি এবং সংস্কৃতিমনস্কতার পরিচায়ক হিসেবেই। নব্বইয়ের দশকের হেমাদের কেমন দেখানো হয়েছিল? - তাঁরাও কিন্তু নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। হেমা ট্র্যাকস্যুট পরে জিমে শরীরচর্চা করছেন, রেখা ঘাঘরা পরে গরবা খেলছেন, জয়া শাড়ি পরে হাতে ফাইল নিয়ে অফিস যাচ্ছেন, এবং সুষমা হুড-খোলা গাড়ি চালাচ্ছেন। অর্থাৎ, আপনি যত আধুনিকা হন, যতই ‘লিবারেটেড’ হন, নিরমা দিয়ে কাপড় কাচতে আপনাকে হবেই – কারণ ‘সবকি পসন্দ নিরমা’। তবে এখনকার হেমাদের সঙ্গে তখনকার হেমাদের ফারাকটা কোথায়? নারীশক্তি না নারীবাদ?
আমার রিডিং অবশ্য আশাপ্রদ। নতুন বিজ্ঞাপনে হেমা-রেখা-জয়া-সুষমা কারোরই গার্হস্থ্যজীবন কেমন তা দেখানো হয়নি। এঁরা বিবাহিত, না অবিবাহিত, একা থাকেন নাকি পরিবারসহ, কিছুই বোঝা যায় না। অর্থাৎ, দর্শকদের এটা কখনোই ভাবতে বাধ্য করা হচ্ছে না যে এঁরা ঘরে এবং বাইরে সমান এক্সপার্ট – তাঁরা কাদায়-পড়া গাড়ি উদ্ধার করতে পারেন, কিন্তু কাপড় কেচে ঝকঝকে করতে পারেন কিনা তা জানার উপায় নেই (ফলে প্রয়োজনও নেই)! এইটুকু পরিষ্কার যে এঁদের সবার পছন্দ নিরমা - কিন্তু সেটা নিজে হাতে ব্যবহার করে, নাকি ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে, নাকি কাজের মাসির হাতে তার ফল দেখে, তা কে জানে! এমনকি, বাড়ির কোনো পুরুষও যদি ওঁদের কাদামাখা কাপড়গুলো কেচে দেন, কার কি বলার আছে? মোদ্দা কথা হল, হেমা-রেখা-জয়া-সুষমা খুবই সজাগ এবং তৎপর নাগরিক – ভাল গৃহিণী কিনা, সে প্রশ্ন এই সাবানের বিজ্ঞাপনে সম্পূর্ণ অবান্তর। এঁরা দশভুজা নন – একা হাতে নয়, চারজনের মিলিত চেষ্টাতেই গাড়িটি উদ্ধার হয় – কিন্তু সাধারণ মানুষ হয়েই তাঁরা এই একটি ঘটনার মাধ্যমে দেখিয়ে দিলেন, তাঁরা সশক্ত। চমকপ্রদ বইকি!
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
খুব ভাল, বিশ্বাসযোগ্য রিডিং । এই ধরণের আরো অনেক বিজ্ঞাপন বা প্রমোশোনাল ভিসুয়ালস নিয়ে লেখা পেলে খুব ভাল হয়। ধন্যবাদ ।
সৌমিক নন্দী মজুমদার