• মাতৃভূমি-র মেয়েরা : লোকো-পাইলট সৌমিতার সাথে কথোপকথন


    0    94

    December 20, 2018

     

    [ মূল ইংরেজি লেখাটি দ্য ওয়্যার-এ ১৮ নভেম্বর, ২০১৮-য় প্রকাশিত হয়েছে। সৌমিতা রায়ের সাথে সাক্ষাৎকার-এর ভিত্তিতে লেখা এই প্রবন্ধটি লিখেছেন ইন্ডিপেন্ডেণ্ট জার্নালিস্ট প্রিয়দর্শিনী সেন। মূল ইংরেজি থেকে 'এখন আলাপ'-এ প্রকাশিত এই বাংলা অনুবাদটি করেছেন সর্বজয়া ভট্টাচার্য। প্রবন্ধের সাথে ব্যবহৃত ছবিগুলিদ্য ওয়্যার থেকে নেওয়া। ছবিগুলি তুলেছেন প্রিয়দর্শিনী সেন। ]  

     

    চোখ প্রেশার গেজের দিকে, দু’হাতে দক্ষতার সাথে চালনা করছেন প্রধান গিয়ার — সৌমিতা রায়-এর এই ছবি একটু অন্যরকমই বটে। কিছুক্ষণ থামলেন সৌমিতা। তারপর ইঞ্জিন চালু করলেন। এক অভিজ্ঞ লোকো-পাইলটের মত সৌমিতা রায়ের ট্রেন শিয়ালদা স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়ল। মাতৃভূমি লোকাল। “এই ট্রেনের ‘কর্তা’-রা সবাই মহিলা – গার্ড, সহকারী, লোকো-পাইলট এবং যাত্রী। পুরুষদের এখানে প্রবেশাধিকার নেই”, গ্রাম বাংলার সবুজের মধ্যে দিয়ে ট্রেনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বললেন সৌমিতা।

    তবে বাংলার লোকাল ট্রেন ব্যবস্থার সাথে এটা সৌমিতার প্রথম অভিজ্ঞতা নয়।

    নদিয়ার একটি ছোট শহরের ৩১ বছরের এক বাসিন্দার পদোন্নতি হয় – ইস্টার্ন রেলের প্রথম মহিলা লোকো-পাইলটের পদ পান তিনি। তাঁর পর থেকে বিভিন্ন ট্রেনের লোকো-পাইলট হিসেবে তিনি কাজ করেছেন।

    সৌমিতা জানাচ্ছেন, ট্রেন চালানোর এই সিদ্ধান্ত তিনি সচেতন ভাবেই নিয়েছেন। ভারতের রেল পরিষেবায় যে পুরুষতন্ত্র একেবারে গেঁথে আছে, তাকে তিনি কিছুটা ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন। “কে বলেছে যে শুধু পুরুষরাই ট্রেন চালাবে? আমি এই ধারণাকে আঘাত করতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম অন্য মেয়েরাও যেন এই কাজ করতে উৎসাহ পায়।”

    সৌমিতা রায়

    তবে আমলাতন্ত্রে ডুবে থাকা রেল পরিষেবার এক পদ থেকে উর্ধ্বতন পদে পৌঁছনো একেবারেই সহজ কাজ ছিল না। ২০১০ সালে সৌমিতা চাকরির পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হন এবং ইস্টার্ন রেলওয়ে’র সহকারী কো-পাইলট হিসেবে কাজে যোগ দেন। তারপর, ২০১৬ তে তিনি মালগাড়ির চালকের পদ পান। “আমাকে খুব তাড়াতাড়ি লাইন অপারেশন, সিস্টেম কন্ট্রোল, আর পার্কিং-এর কাজ শিখে নিতে হয়েছিল। তার ওপর আবার অনেক ম্যানুয়াল মুখস্থ করতে হত,” বলছেন সৌমিতা।

    সৌমিতাকে মানসিক পরীক্ষাও দিতে হয়েছে – তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, মনোযোগ, নির্ভরযোগ্যতা, এবং আপৎকালীন সমস্যাকে মোকাবিলা করতে পারার ক্ষমতা যাচাই করা হয়েছে এই সব পরীক্ষায়।

    “ওর প্রচন্ড মনের জোর আর একাগ্রতা। সব বিষয়ে একদম স্থির থাকা আর যাত্রী নিরাপত্তা নিয়ে ওর ভাবনাটা দেখার মত। এই পরীক্ষাগুলোতে আসলে ওর চরিত্রের আসল দিকটাই বেরিয়ে এসেছে,” বলছেন রজনীশ সিং – তিনি শিয়ালদা স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তরের বড় কর্মকর্তা।

    তাই সৌমিতার পদোন্নতিতে রেলের আধিকারিক এবং কর্মচারীরা বেশ আনন্দিত। মাতৃভূমি লোকালের গার্ড ও সৌমিতার সহকর্মী সবিতা সাউ-এর মতে সৌমিতার পদোন্নতির ফলে রেলের কাজে মহিলাদের সম্মান বেড়েছে।

    শিয়ালদা স্টেশনে সৌমিতার সংবর্ধনার সময়ে অনেক মেয়েরা এগিয়ে এসে বলে যে তারাও লোকো-পাইলট হতে চায় এবং সৌমিতার দেখানো পথে হাঁটতে চায়। কয়েকজন তো সৌমিতার কাছে তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি জানার আবদারও করে। ব্যাণ্ডেলের একটি হাই স্কুলের ছাত্রী ভারতী দে বলছে, “চালকের আসনে বসার স্বপ্ন আমার অনেক দিনের। সৌমিতা সেটা করে দেখিয়েছে। আমি ওকে আমার মেন্টর হিসেবে চাই।”

    সবিতা জানাচ্ছেন যে যাত্রীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সৌমিতার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পেরে তিনি এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত। “কর্মীদের মধ্যে অভিজ্ঞতার দিক থেকে সবচেয়ে প্রবীণ হওয়ায় আমিই সব দেখাশোনা করতাম। কিন্তু এখন আমরা কাজ ভাগ করে নিতে পারি। ভারতের রেলে সৌমিতার মত আরও মেয়েদের দরকার, যারা আত্মবিশ্বাসী এবং চটপটে”, বলছেন সবিতা।

    পুরুষ-প্রধান এই পেশায় সৌমিতার উত্থানে তাঁর পাশে থেকেছেন তাঁর পরিবার। তাঁর স্বামী, বরুণ মোদক জানাচ্ছেন, “সৌমিতার ছোটবেলা বেশ কষ্টের মধ্যে কেটেছে। এখন ও ওর স্বপ্নকে সত্যি করার চেষ্টা করছে। ওর মত আরো মেয়েদের প্রয়োজন, যারা পুরুষতন্ত্রকে এভাবে ধাক্কা দেবে। আমরা সব সময়ে ওর সিদ্ধান্তের পাশে দাঁড়াবো।”

    বরুণের কথার সুর সৌমিতার গলাতেও। সৌমিতা নিজে জানাচ্ছেন, যেখানে উনি বড় হয়েছেন, সেখানে ‘মেয়েদের চাকরি’ বলতে বোঝায় ইস্কুলে পড়ানো। কিন্তু সৌমিতা যখন নদিয়ায় একটি ইস্কুলে শিক্ষকতা করতে শুরু করেন, ওনার মনে হয়েছিল যে কাজের ক্ষেত্রে ওনার হয়ত আরও কিছু করার আছে। “আমার ভেতরে একটা অংশ অতৃপ্ত থেকে যাচ্ছিল। বাঁধাধরা ছকের বাইরে কিছু একটা করার ইচ্ছে ছিল আমার।”

    পরিবারের সমর্থনকে সাথে নিয়ে ঝাঁপ দিলেন সৌমিতা। সৌমিতার কাজের জন্য সপ্তাহে ছ’দিনের অনুপস্থিতিতে তাঁর তিন বছরের ছেলের দেখাশোনা করেন তাঁর পরিজনেরাই।  

    তবে ছক ভাঙার এই প্রয়াসে যে কোনও সমালোচনা শুনতে হয়নি তা নয়। রমেশ দাস নামের এক রেল কর্মচারীর মতে যদি সৌমিতা মন দিয়ে কাজ না করেন তাহলে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। “এই কাজটাতে অনেক ঝুঁকি রয়েছে। সামান্য ভুল থেকেও সাংঘাতিক ক্ষতি হতে পারে। কিছু কাজ পুরুষদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া ভাল”, বলছেন তিনি।

    সৌমিতা একদিক থেকে একমত। ট্রেন চালানোতে ঝুঁকি তো রয়েছেই এবং তার সাথে রয়েছে এক ধরণের মানসিক চাপ। “আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা, বা হামলার জন্য সবসময় তৈরি থাকতে হয়। যতদূর সম্ভব দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলার চেষ্টাই করতে হয়, কিন্তু নিজের চারপাশে একটা প্রতিরোধের দেওয়াল তোলাটাও জরুরি।”  

    সৌমিতার বিশ্বাস, সাত বছর আগে, তাঁর ট্রেনিং-এর সময়ে তিনি এই প্রতিরোধের দেওয়ালটা তৈরি করে ফেলতে পেরেছিলেন। তবে বাস্তবে এর প্রথম পরীক্ষা হয়েছিল সেপ্টেম্বরে, যখন তিনি পাশের ট্র্যাকে একজন পুরুষকে আত্মহত্যা করতে দেখেন। “আমি ট্রেন থেকে নেমে কি করে তাৎক্ষণিক মেমো লিখতে হয় শিখি। জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে এই সরু সুতোর ওপর দিয়ে হাঁটাই এই পেশার সবথেকে কঠিন দিক।”

    শুধু দুর্ঘটনা নয়, কোনো যাত্রী যদি অসভ্যতা বা অভদ্রতা করেন, সেই বিষয়টাও দেখতে হয় সৌমিতাকেই। “হাজার হাজার যাত্রীকে দেখা তো খুবই কঠিন কাজ, বিশেষ করে যদি ট্রেন দেরি করে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত সমস্যার মোকাবিলা করার ট্রেনিং আমরা পাই, আর যদি প্রয়োজন হয় তাহলে রেলের প্রোটেকশান ফোর্সের সাহায্যও নিয়ে থাকি,” জানাচ্ছেন সৌমিতা।

    দৈনিক যাত্রীরাও স্বীকার করছেন যে সব ট্রেনেই প্রচন্ড বিশৃঙ্খলা হয়, এবং শুধু মহিলারা মিলে যে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে পারেন, এটা প্রশংসনীয় একটা ব্যাপার। অ্যাকাউন্টস অফিসার মঞ্জু রায় মাতৃভূমিতে রোজ যাতায়াত করেন। তিনি জানালেন যে সৌমিতা আসার পর থেকে যাত্রীদের নিজেদের আরো নিরাপদ বলে মনে হয়। “অন্য ট্রেনে আরো বিশৃঙ্খলা হয়। এই ট্রেনে চাপলে মনে হয় আমরা একটাই পরিবার একসাথে কোথাও যাচ্ছি। সৌমিতার দক্ষতার পাশাপাশি ও অনেক মেয়েকে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছে।”

    কিন্তু সৌমিতা কখনোই তাঁর সাফল্যকেই শেষ কথা বলে মনে করেন না । সৌমিতা মনে করেন, ট্রেন চালানো বাদ দিয়েও, তাঁর নিয়মনিষ্ঠ জীবন কাটানো উচিত। তাই তিনি যোগাসন করেন এবং মনঃসংযোগ বৃদ্ধি পায় এমন সব এক্সারসাইজ করেন।

    সম্ভবত তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই অনেক মেয়ে এখন ট্রেন-চালকের কাজ করতে উৎসাহী হয়েছে। ইস্টার্ন রেলের তালিকায় সহকারী লোকো-পাইলটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। মেয়েরা প্রোটেকশান ফোর্সের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।   

    সৌমিতার মতে, “যে সব মেয়েরা এরোপ্লেন বা জাহাজ চালান, তাঁদের সঙ্গে এক ধরণের গ্ল্যামারের ধারণা যুক্ত। কিন্তু রেলের চালকরা কখনোই একই সম্মান পান না। যখন আরো মেয়েরা এগিয়ে আসবে, তখন এই ধারণা পাল্টাবে।”

    মাতৃভূমি লোকালে যাত্রীরা
     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics