• বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মানচিত্র বদলে দেওয়া পঞ্চকন্যা : ফিরে দেখা ২০১৭


    1    159

    January 5, 2018

     

    রেললাইনে পাতা লোহার পাতের সংকোচন-প্রসারণ দেখে খুব ছোটবেলায় বিজ্ঞানে ঔৎসুক্য জেগেছিল বাসন্তী গুহঠাকুরতার। সঠিক পরিবেশ পেলে তিনি হয়তো পদার্থবিদ হতেন। লীলা মজুমদারের পটদিদি সংসারের নানা সমস্যায় যেসব মুশকিল আসান দিতেন, শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও তাতে আশ্চর্য ফল পাওয়া যেত। সেসব বুদ্ধি কাজে লাগালে চমৎকার সব গ্যাজেট বানানো যেত। অর্থাৎ পটদিদি ছিলেন  প্রযুক্তিবিদ্যার আকর, যাঁর জ্ঞানবুদ্ধি কাজে লাগানোর মতো পরিণত হয়নি সেযুগের সমাজ।

    ‘সেকালে রেফ্রিজারেটর ছিল না কারো বাড়িতে; মধুপুরে সহজে বরফও কিনতে পাওয়া যেত না। পটদিদি বলেন, ‘সে কি! জল ঠান্ডা করতেও জানিস না? এক কলসি জলের চারদিকে সপসপে ভিজে তোয়ালে জড়িয়ে চড়চড়ে রোদে বসিয়ে রাখ ঘন্টাখানেক। বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যাবে’ বাস্তবিকই তাই। করে দেখেছি। তোয়ালেও শুকল, জলও হিম’। কিংবা ‘আরেকবার বলেছিলেন, ‘লঙ্কার গন্ধ চাই, কিন্তু ঝাল হলে চলবে না? সে আর এমন কি শক্ত! রান্না হয়ে গেলে, কড়াইসুদ্ধ ঝোল নামিয়ে, ঐ টগবগে গরম ঝোলে গোটা বারো বোঁটা সুদ্ধ ঝাল কাঁচা লঙ্কা ছেড়ে ঢাকা দিয়ে দিবি। ৫ মিনিট বাদে লঙ্কাগুলো তুলে ফেলে তরকারি ঢেকে রাখিস। সুগন্ধে ভুরভুর করবে।’

    পটদিদি কিন্তু সাধারণ মেয়ে নন, ভারতের প্রথম মহিলা অঙ্ক গ্র্যাজুয়েট। মাথাখানা ছিল অঙ্কে ঠাসা। তাতেও কিন্তু তাঁর প্রথাগত বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদ হবার পথ সুগম হয়নি। মেয়েদের সব ব্যাপারটাই যেন শখে, পেশাদার হবার সুযোগ বা দায় তাঁদের নেই। এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে, আবিষ্কারের পেটেন্ট নেননি বহু নারীবিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদ; সচেতনতার অভাব, পারিবারিক চাপ বা পুরুষ সহকর্মীর ঈর্ষা—এমন অনেক কারণ আছে তার পেছনে। এমন ঘটনা আকছার ঘটেছে খোদ বিলেতেই।

    সেখানে ভারতের ছবিটা আরও হতাশাব্যঞ্জক হওয়াটাই স্বাভাবিক। পরিসংখ্যান বলছে ভারতবর্ষে শতকরা ৫১.৪ জন নারী সাক্ষর। এর মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসে মাত্র ১ শতাংশ। মাত্র ২৩ শতাংশ মেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। যত উঁচুতে যায়, লিঙ্গ ব্যবধানও বেড়ে যায়। তাই দেখা যায়, বিজ্ঞান প্রযুক্তির আঙিনায় স্নাতক-স্নাতকোত্তরের তুলনায় গবেষকের সংখ্যা অনেক কম, আরও কম উচ্চপদে আসীন নারীবিজ্ঞানীর সংখ্যা। এই প্রবণতাকে বোঝানো হয় যে রেখাচিত্র দিয়ে তার নাম সিজার ডায়াগ্রাম। সেখানে দেখা যাচ্ছে ফ্রান্সে এই বৈষম্য সবচেয়ে কম আর জাপানে সবচেয়ে বেশি। ফ্রান্সে ড্রপ-আউট  ফ্যাক্টর সবচেয়ে কম, আর তার কারণ আশির শতকে গৃহীত প্রোঅ্যাক্টিভ নীতি। আশার কথা এই তালিকার মাঝামাঝি জায়গায় আছে আমাদের দেশ। তবে যে নামগুলো সবাই জানে চেনে, সেই সুনীতা উইলিয়ামস বা কল্পনা চাওলা—এঁদের মেকিং কিন্তু ভারতবর্ষে নয়, সেটা মনে রাখতে হবে। তাঁরা ছাড়াও কিন্তু বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছেন অনেক কন্যারত্ন। ২০১৭ তেও তাঁরা আলো ছড়ালেন।

    যেমন টেসি টমাস। এপিজে আব্দুল কালামের নাম যেমন ‘মিসাইল ম্যান অব ইন্ডিয়া’ তেমনি টেসি ‘মিসাইল ওম্যান অব ইন্ডিয়া’। এদেশের ব্যালিস্টিক মিসাইলের প্রথম সারির বিশেষজ্ঞ টেসি ডিআরডিও অর্থাৎ ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের অগ্নি-৪ প্রকল্পের প্রকল্প আধিকারিকও বটে। তিনিই প্রথম নারী যিনি ক্ষেপণাস্ত্র বিষয়ক দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর আরেক নাম খুব সঙ্গত কারণেই অগ্নিপুত্রী। ডিআরডিও-র দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি কাজ করেছেন গাউডেন্স কন্ট্রোল, ইন্টারনাল নেভিগেশন, ট্র্যাজেক্ট্রি সিমুলশন ও মিশন ডিজাইন নিয়ে। দক্ষিণ কেরলের মেয়ে টেসি বেড়ে উঠেছেন মুক্ত পরিবেশে, যেখানে নারী-পুরুষের মতই সমান তালে এগোতে পারেন।

    টেসির মতোই প্রিয়ম্বদা নটরাজনও দক্ষিণের মেয়ে। তাঁর জন্ম কোয়েম্বাটরে। তাঁর বাবা-মা শিক্ষাজগতের মানুষ। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রোনমি ও ফিজিক্সের অধ্যাপক প্রিয়ম্বদার কাজ ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি নিয়ে। কৃষ্ণগহ্বর কীভাবে তাদের জীবদ্দশায় মাস জড়ো করে—এ নিয়েও তাঁর কাজ আছে। প্রিয়ম্বদার আর একটি বিশেষত্ব, তিনি এই কঠিন ব্যাপারস্যাপার সাধারণ পাঠকের জন্য সহজ করে বুঝিয়েছেন তাঁর বইয়ে। বইটির নাম Mapping the Heavens : The Radical Scientific Ideas that reveal the Cosmos। প্রকাশক ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস।

    আরেক দক্ষিণের মেয়ে পদ্মশ্রী ওয়ারিয়র। তাঁর জন্ম বিজয়ওয়াড়ায়। দিল্লির আইআইটি ও পরে কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি যোগ দেন ইলেক্ট্রিক কার কোম্পানি নিও-তে। ফরচুন ম্যাগাজিন তাঁকে ‘কুইন অব দা ইলেক্ট্রিক কার বিজ’-এর শিরোপা দিয়েছে। তাঁর ঝুলিতে আছে মোটোরোলা, মাইক্রোসফট, ইনফোসিসে অসাধারণ সাফল্যের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা।

    শুধু মহাকাশ বা পদার্থবিদ্যা নয় ভারতীয় নারীর জয়জয়কার জৈবপ্রযুক্তিতেও। যেমন কিরণ মজুমদার শ। তিনি এদেশের সবচেয়ে বড় জৈবপ্রযুক্তি সংস্থা বায়োকনের প্রতিষ্টাতা। একটা ছোট্ট গ্যারেজে এর সূচনা। টাইমস তাঁকে জায়গা দিয়েছে বিশ্বের ১০০ জন সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায়। ফোর্বসের গ্লোবাল পাওয়ার লিস্টে পৃথিবীর ১০০ সবচেয়ে ক্ষমতাময়ী নারীর মধ্যেও তিনি। কাজের বাইরে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্যে তাঁর মমতা। প্রতি বছর তিনি এক লাখ গ্রামের মানুষকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য বীমা দিয়ে থাকেন।

    সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষত ফেসবুকে মেয়েদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। সেলাইকল আর টাইপরাইটারের পর মেয়েরা যে যন্ত্রটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকে তার নাম কম্পিউটার। প্রথম আধুনিক কম্পিউটার এনিয়াক বসান ছিল কয়েকটা ঘর জুড়ে। অজস্র তার লাগিয়ে তাকে চালাতে হত। ভারি জটিল সেই কাজ। সেখান থেকে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আজকের হাতের নাগালে ডেস্কটপ, ল্যাপটপে পৌঁছনো। আর সেই কম্পিউটারের হাত ধরেই এল সাইবার ফেমিনিজম, সাইবার স্পেসের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক নিয়ে যে তত্ত্বের উদ্ভব।

    যে মেয়েরা এতদিন কেঁদেককিয়ে এক চিলতে নিজের ঘর পায়নি, তাদের জন্য অপরিসীম গুরুত্ব এই সাইবার স্পেসের। সাইবার শব্দটি প্রথম পাওয়া গেল ১৯৮৪ সালে উইলিয়াম গিবসনের নিউরোম্যান্সার উপন্যাসে। আর সাইবার ফেমিনিজম শব্দটি প্রথম আনলেন অস্ট্রেলিয়ার ভিএনএস ম্যাট্রিক্স কালেক্টিভ ১৯৯১ সালে সাইবার ফেমিনিস্ট ইস্তাহারে। এর সংজ্ঞা দিলেন ক্যারলিন গুয়ার্টিন—সাইবার ফেমিনিজম হচ্ছে অস্তিত্ব, লিঙ্গ, শরীর এবং প্রযুক্তির পারস্পরিক সংযোগ ও ক্ষমতার সমীকরণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে বুঝে নেবার একটি পথ।  এর উদ্ভব ১৯৯২ সালে বিশ্বের তিনটি প্রান্তে একই সঙ্গে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া আর ব্রিটেন। কানাডাতে ন্যান্সি প্যাটারসন লিখে ফেললেন সাইবারফেমিনিজম বলে একটি নিবন্ধ, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে চার সদস্যের ভিএনএস ম্যাট্রিক্স লিখলেন সাইবারফেমিনিস্ট ম্যানিফেস্টো যার উদ্দেশ্য - "to insert women, bodily fluids and political consciousness into electronic spaces." একই বছরে ব্রিটিশ কালচারাল থিওরিস্ট স্যাডি প্ল্যান্ট পশ্চিমী সমাজে প্রযুক্তির ওপর নারীর প্রভাব নিয়ে কথা বলার সময় ব্যবহার করলেন সাইবারফেমিনিজম শব্দটি। তবে দিনদিন সাইবার ফেমিনিজমের মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে নারী শুধুই যেন এর গ্রাহক হয়ে গেছে। সেই প্রেক্ষিতে রুচি সাংভি একজন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ফেসবুক সংস্থা যে প্রথম নারী ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়োগ করে, তাঁর নাম রুচি সাংভি। অর্থাৎ নারী শুধু ফেসবুক ব্যবহারকারী নয়, তার নিয়ন্ত্রক।  ফেসবুকের গোপনীয়তা নিয়ে প্রচুর ভাবনাচিন্তা আছে তাঁর। সাইবারস্পেস যে বড্ড মাচো এমন অভিযোগ তো আছেই। এর পুরুষ পক্ষপাতিত্ব নিয়ে শেরি টার্কল বলেছেন, ‘The hackers would deny that there is a macho culture, the pre occupation with winning and of subjecting oneself to increasingly violent tests make their world peculiarly male in spirit, peculiarly unfriendly to women’

    প্রায় এক কথা বলেছেন ক্যান্ট্রোউইজ, ‘Computer culture is created, defined and controlled by men. Women often feel about as welcome as a system crash.’

    কেবলই জয় আর দমনের এই পুং ইচ্ছে কি মেয়েদের এখনো সাইবার স্পেসে অনেকটাই ব্রাত্য করে রাখেনি? অধিকাংশ কম্পিউটার গেমে নারী যৌন প্রতিমা ছাড়া আর কিছু নয়। দিন দিন তাকে ঘিরে ট্রোলিং ও আরও বিভিন্ন সাইবার ক্রাইম বাড়ছে। সাইবার দুনিয়ার দখল নিতে গেলে শুধু ইউজার নয়, আরও অনেক বেশি নারী-উদ্ভাবক চাই। মানে by the women for the women to the women।  সেই পাওয়ার শিফটে কিন্তু রুচি সাংভির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

    কল্পবিজ্ঞান লেখিকা উরসুলা লেগুইন একবার বলেছিলেন, ‘উই আর ভলক্যানোজ। হোয়েন উই উইমেন অফার আওয়ার এক্সপেরিএন্স অ্যাজ আওয়ার ট্রুথ, অ্যাজ হিউম্যান ট্রুথ, অল দা ম্যাপ্স চেঞ্জ।’

    টেসি টমাস, প্রিয়ম্বদা, পদ্মশ্রী, কিরণ, রুচি এবং আরও অনেকে এদেশের বিজ্ঞান প্রযুক্তির মানচিত্রটাই বদলে দেবেন, আজ না হোক, কাল। ২০১৭ সেই আশাই জাগাল।

     
     



    Tags
     



    1 Comment

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics