• "জেন্ডার কখনো আমাদের বন্ধুত্বে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি।"


    0    562

    August 1, 2017

     

    আগামি ৬ই আগস্ট ফ্রেন্ডশিপ ডে বা বন্ধুত্ব দিবস। কিছু উজ্জ্বল বন্ধুত্বের গল্প ভাগ করে নেওয়ার জন্যে আমরা আপনাদের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলাম। সামাজিক লিঙ্গনির্মাণের ধারণাকে নাড়িয়ে দেওয়া কোনো উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা ৩০০ শব্দের মধ্যে লিখে পাঠাতে বলা হয়েছিল। আপনারা যাঁরা আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে লেখা পাঠিয়েছেন, তাঁদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ। যে লেখাগুলি আমরা পেয়েছি তার মধ্যে থেকে নির্বাচিত কয়েকটি এখানে প্রকাশ করা হল। আপনারা পড়ুন, মতামত জানান এবং ব্লগের নীচে কমেন্টের জায়গায় ছোট্ট ছোট্ট গল্প/অভিজ্ঞতা অবশ্যই পোস্ট করতে পারেন। বন্ধুত্ব নিয়ে আলাপচারিতা চলতে থাক।

    বিশালাকার কো-এড স্কুলটার বয়েস তখন মাত্র দেড় বছর । প্রিন্সিপাল দিল্লিতে ওয়ার্কশপে, কাজেই পুরো দায়িত্ব আমার ওপর । লাঞ্চ ব্রেকে রাউন্ডে বেরিয়েছি তিনতলার করিডোরে,  ক্লাস সেভেন-সি ঘরের দরজা বন্ধ। বেশ একটু রাগ হল, এতবার করে বলা আছে কোনো ক্লাসরুমের দরজা যেন বন্ধ না থাকে...!!! দিলাম সজোরে ধাক্কা..
    ... টিচার্স টেবিলের সামনে একটা মেয়ে হাপুস্ নয়নে কাঁদছে, আর তাকে ঘিরে দুটি মেয়ে আর একপাল ছেলে দাঁড়িয়ে। এমনিতেই এই স্কুলে ছেলের সংখ্যা মেয়েদের তুলনায় বেশি, এখন যেন আরো বেশি মনে হল। কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? হুড়মুড় করে খুব চিন্তাচ্ছন্ন মুখে এগিয়ে এলো জনাতিনেক ছেলে।
    - 'ম্যাম, দেববাণীর কাছে কোনো এক্সট্রা স্কার্ট নেই, কিভাবে বাড়ি যাবে ও? কিভাবেই বা এখন টিফিন খাবে বাইরে গিয়ে? অন্য ক্লাসের সবাই যে দেখে নেবে ওর জামায় দাগ!!!'
    বুঝলাম আচম্বিতে ক্লাস চলাকালীন ঋতুমতী হয়ে পড়ায় সমস্যা।
    গুটি গুটি পায়ে ততক্ষণে এসে জমেছে মেয়ে দুটিও...
    -  'ইনফার্মারীতে সেফটিপিন বা সুঁচ-সুতো পেলাম না, আপনার কাছে আছে, ম্যাম? তাহলে দাগগুলো ঢেকে দেওয়া যেত।'
    স্কুল অফিসে ফোন করে একপাতা সেফটিপিন আনালাম স্টক থেকে। তখনো  লাঞ্চ ব্রেক চলছে। সেফটিপিন হাতে পেতেই অদ্ভুত তৎপরতায় তিনজন ছেলে বসে গেলো দেববাণীর স্কার্টের  দাগ ঢাকতে। বাকি মেয়েদুটো আর ছেলেরা একে অন্যের কোমর ধরে মুহূর্তে একটা বৃত্ত বানিয়ে ফেলল যাতে একনজরে বাইরে থেকে কেউ কিছু ঠাহর করতে না পারে। দেববাণীর কান্নাও ততক্ষণে কমে এসেছে।
    ভালো লেগেছিল সেদিন এই সহমর্মিতা এবং বন্ধুকে বিপন্মুক্ত করবার সমবেত ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। ওদের সবে তখন রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেম বা বায়োলজিক্যাল ফিচারসগুলো পুঁথিগতভাবে জানার শুরু, কিন্তু কান-ফিসফিস এবং অযথা মুচকি হাসির হাতছানি এড়িয়ে বা রটন্তী গল্পের জোয়ারে ভেসে না গিয়ে, যেভাবে একঝাঁক কিশোর সেদিন দেববাণীর সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলো তা আজও ভাবলে ভালো লাগে ।
    পরে একদিন দেববাণীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'তুমি সেদিন অত কাঁদছিলে কেন?'
    সরল মেয়েটা বলেছিলো, 'মাই মম সেইড, পিরিয়ড ইজ ডার্টি , বাট আকাশ এন্ড সৌপ্তিক মেড মি আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট ইটস নাথিং বাট এ ফিসিওলজিক্যাল চেঞ্জ ইন এভরি গার্ল টু বি এ ওম্যান।'
    ভালো থাকুক ওরা, দীর্ঘস্থায়ী হোক ওদের এই বন্ধুত্ব, শেয়ারিং, কেয়ারিং এন্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইচ-আদার ।

    অনন্যা চ্যাটার্জী

    সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় দ্বিধা উপন্যাসের সুমনের (চলনজনিত প্রতিবন্ধকতার শিকার) চরিত্রে তাঁর এক বন্ধুর প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছিলেন। সেখানে সুমনের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্বের মাঝেও, একটি প্রশ্ন সযত্নে উঠে আসে, সত্যিই কী তিনি কখনও সুমনকে (বৃহত্তর অর্থে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত বন্ধুকে) বুঝতে পেরেছিলেন? ‘চল সুমন গঙ্গার ধার থেকে হেঁটে আসি; বলেই জিভ কেটে ফেলতাম’। -সেই চেতনার পশ্চাতে সুমনকে বোঝার সমস্যা ছিল। সুমন মনে মনে কষ্টানুভূতি বহন করতে পারে, এই অনুভবেই মনটা খারাপ হয়ে যেত। আসলে বন্ধুত্বের সীমারেখায় আপাতভাবে ‘স্থান-কাল-পাত্র’ বা ‘জাতি-ধর্ম-লিঙ্গে’র সীমারেখা গুরুত্বহীন মনে হলেও, প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে তা সর্বৈব ভিন্ন। প্রতিবন্ধকতার বন্ধুত্বের জগতে চেতন বা অবচেতন মনে শারীরিক প্রতিচ্ছবি বেশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।  

    যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়াকালীন এক সহপাঠী সহসা প্রশ্ন করেছিল, ‘তুই কেমন বন্ধুত্ব চাস? তোকে কি সবার মত সমান করে দেখবো, নাকি ‘আলাদা’ ভাবে’? প্রশ্নটা শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাইলাম এই ‘আলাদা’ ব্যাপারটা কিরে? উত্তর এলো (কিছুটা হকচকিয়ে), ‘যেমন সমাজে প্রতিবন্ধীদের দেখা হয় আর কি!’ বুঝতে পারলাম সচরাচর প্রতীয়মান দয়া, করুণা, অবহেলাকেই ইঙ্গিত করছে। ছোটবেলা থেকেই  বন্ধুত্বের পরিসরে প্রতিবন্ধকতাজনিত বিচ্ছিন্নতা বা বৈষম্য একাধিকবার প্রত্যক্ষ করেছি বলেই, খুব সহজে সব কিছুকে যেন মানিয়ে নিতে শিখেছিলাম। একইসঙ্গে মানসিকতাকে করেছিলাম বজ্রকঠিন, যেখানে সব আঘাত মিশে যেত বন্ধুত্বের অসীম সীমানায়। ‘ভেঙেছো কলসির কানা, তাই বলে কী প্রেম দেব না’-র মত করে ক্ষুদ্র হৃদয়কে বৃহত্তর আঙিনায় যুক্ত করার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছি জীবনে দিয়ে অক্লান্তভাবে। তাই বেশী কথা না বাড়িয়ে, শুধু বললাম, ‘বন্ধুত্ব হয় মনে; শরীরে নয়’। আজও সেই চেতনা বহন করি বলেই, জীবনে কোনদিন বন্ধুত্বের অভাব হয় না। তাই আমার শিক্ষক রসিকতা করে বলেন, ‘ডাক্তার থেকে ডাকাত’ সব বন্ধুই তোমার জীবনে আছে।

    ছোট থেকেই তথাকথিত অপ্রতিবন্ধী বন্ধুদের সঙ্গে বড় হওয়ার জন্য প্রতিবন্ধকতার বন্ধুত্বের যে পৃথক জগৎ থাকতে পারে, তা কল্পনাতীত ছিল। তবে তথাকথিত অপ্রতিবন্ধকতার চিন্তাভাবনায় ‘প্রতিবন্ধকতার নিজস্ব জগতের বন্ধুত্বকে’ই বেশী আলোকিত করে দেখানোর প্রবণতাও একেবারে নতূন নয়। প্রসঙ্গক্রমে বিখ্যাত হিন্দি ছবি দোস্তি-র (১৯৬৪) কথা আসে, যেখানে চলনজনিত প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের গভীর বন্ধুত্ব দেখানো হয়েছে। আবার বাংলা সাহিত্যেও প্রতিবন্ধকতার বন্ধু বলতে হয় নির্জন প্রকৃতি বা অপর প্রতিবন্ধী মানুষই কল্পিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুভাকে দেখা যায় সঙ্গীহীন, সাথীহীন নির্জন প্রকৃতিকে আপন করে নিতে। আবার মতি নন্দীর ছোটবাবু উপন্যাসে ‘বামন’ দীপাঞ্জনের বন্ধুত্ব হয় ‘পোলিও আক্রান্ত’ মালার। ফলে ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিবন্ধকতার বন্ধুত্ব একটা গতানুগতিক চেতনার মধ্য দিয়ে যে প্রবাহিত হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

    বুবাই বাগ

    ছোটবেলা থেকে আজ অবধি পাঁচ-ছয়বার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বদল করা হয়ে গেছে আমার। বিভিন্ন শহরে থাকার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। বারো বছর বয়সে যখন প্রথম বোর্ডিং স্কুলে গেলাম, তারপর থেকেই একা থাকার অভ্যেস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। য়ুনিভার্সিটির দিনগুলো প্রায় পুরোটাই একা-একা নিজের দায়িত্বে কেটেছে। আমাদের দেশের মেয়েদের ভাগ্যে এত স্বাধীনতা বিরল, সেকথা এখন বুঝি।

    কিন্তু পাঁচটি স্কুল, দুটি বিশ্ববিদ্যালয়, চারটি শহর, এবং পঁচিশ বছর পরেও গুটিপাঁচেকের বেশি বন্ধু নেই আমার। সুপরিচিতদের কথা নয়, সুহৃদের কথা বলছি। বলে রাখা দরকার, এই গুটিপাঁচেকের ভিতর সকলেই মহিলা।

    বন্ধুত্ব কখনও হিসেব কষে হয় না। আমার ক্ষেত্রেও হয়নি। মেয়েদের সঙ্গে আমি বরাবরই খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করি। আজীবন কো-এডুকেশান স্কুল কলেজে পড়া সত্ত্বেও, একজন পুরুষকে একশো শতাংশ বন্ধু বলতে পেরেছি বলে মনে পড়ে না। এইসব পুরুষের কিছুজন এককালে যখন কিশোর ছিল, তখন আমরা সতীর্থ ছিলাম। দিব্যি মনে আছে, বোর্ডিং-এ কিছু মেয়ের সঙ্গে বেশ অম্লমধুর বন্ধুত্ব ছিল তাদের; সেই বন্ধুত্ব এখনও বর্তমান, ফেসবুকে গেলেই দেখতে পাই। মজার কথা, আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার বাসনা কারুর ছিল না। এক কিশোর আমাকে দেখলেই ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়তেন। আরো কিছুজন নাকি আড়ালে বলেছিলেন ‘উও বহুত জ্ঞান বাঁটতী হ্যায়।’

    বাবার সঙ্গে এই নিয়ে একদিন কথা হচ্ছিল; তিনি এক বিচিত্র উত্তর দিলেন। বললেন, ‘আসলে তুমি তো ঠিক মেয়ের মতো মানুষ হওনি, তাই ওরা একটু কন্‌ফিউজড্‌।’

    বলা বাহুল্য, সবথেকে বেশি কন্‌ফিউজ্‌ড আমি। ‘মেয়ের মতো’ মানুষ হওয়া কিরকম মানুষ হওয়া? সে উত্তর অবশ্য বাবার কাছে পাওয়া গেল না।

    মেয়েরা কিন্তু আমার ‘মেয়ের মতো’ মানুষ না হওয়ায় কিছুমাত্র বিচলিত নয়।   

    ঈশানী

    মালদার এক স্কুলে পড়ি, ২০০২ সাল । ইলেভেনে আমার আর্টস আর জেসির সায়েন্স । ওদের বাড়িতে পেইংগেস্ট থেকে পড়ার সুবাদে আমাদের দুটো আলাদা সেকশান, আলাদা সিলেবাস, আলাদা ক্লাস –এক ছাদের নিচে মিতালী পাতালো।

    সেই সোনাঝরা দিনগুলোয় যখন ইচ্ছে-ডানার ভরে উড়ে বেড়াতাম তখনই ওর ক্লাসের মনীষা, গার্গী, নিহারুল, তাপস, রাহুল, অমর্ত্যদের সাথে আমার ক্লাসের লিপি, রুহি, ইব্রাহীমদের বন্ধুত্ব হয়েছিল। বড় নির্ভেজাল বন্ধুত্ব ছিল আমাদের গ্রুপের। বেশিরভাগই মেসে থাকত। ফলে বাড়ির অযৌক্তিক অনুশাসনগুলো খুব একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, তাই বলে অকাজ কুকাজেও মন সায় দিত না।

    ২০০৪ যখন কলকাতায় কলেজে ভর্তি হলাম, পুরোনো বন্ধু খুঁজতে গিয়ে তাপস আর ইব্রাহীমের দেখা মিলল। এই সময় ফেলা আসা বন্ধুদের মিস করার ব্যাপারটা প্রথম অনুভব করি। জেসি আমার বরাবরের বেস্ট ফ্রেন্ড। কলকাতার হোস্টেল থেকে নিয়মিত চিঠি পাঠাই। ফোনবুথ থাকলেও মনের কথা অক্ষরে প্রকাশের মধ্যে একটা আলদা তৃপ্তি ছিল। জেসিও আমার পাল্লায় পড়ে চিঠি লিখতে শুরু করল। কথার পিঠে কথা বসিয়েই জানা গেল তাপসের সাথে ওর মিস্টিমধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

    প্রিয় বন্ধু প্রেমে পড়েছে, বিশাল আনন্দ। তার উপর তখন হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কটা এত আকছার ঘটত না। ফলে আলাদা আকর্ষণ। আমাদের তিনজনের মধ্যে সম্পর্কটা একটা প্যাশনেট বন্ডিঙে চলে গেল। তাপসের মেস গড়িয়ায়, জেসির হোস্টেল মালদায়, আর আমার হোস্টেল পার্ক সার্কাসে। কলেজ ফেরত আমাদের বিকেলগুলো কাটত কোহিনুর রেস্টুরেন্টে কাবাব-পরোটা ও STD কলে তিনজনের কলকল কথায় - ফ্রেন্ডশিপ ডেটিং!

    ওদের প্রেম বেশ জমে উঠেছে, এমন সময় তাপসের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয় । কিন্তু বাড়িতে জানালে ঝামেলা হবার ভয়ে অন্যান্য বন্ধুরাই সমস্তটা সামলায় । রুবি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে সুস্থ তাপসকে অসুস্থ বানিয়ে অজয়নগর ওর মাসির বাড়ি নিয়ে যাওয়া, নতুন করে চেকআপ করানো ইত্যাদি নিয়ে বেশ নাটুকে ছিলাম আমরা। সাক্ষী ছিল সায়েন্স সিটি, হাইল্যান্ড পার্কের ফেম সিনেমা আর অগুনতি রেস্টুরেন্ট।

    চাকরি পাওয়ার পরে বাড়ির অমতে ওদের দু'জনের বিয়েতে এবং পরবর্তি সেটলমেন্টেও ওদের পাশে থেকেছি। আজও আমাদের বন্ধুত্ব একইরকম অমলিন । ৮-৯বছর ধরে জমানো নিউইয়ার কার্ড বা গিফটগুলো সেই রঙিন দিনগুলোর সাক্ষ্য দেয় ।

    সারিতা আহমেদ

    কোথায় ঠিক মনে নেই, সম্ভবত ফেসবুকে, একটা লেখা দেখেছিলাম। ‘বন্ধুর সংখ্যা কমতে শুরু করলে বুঝবে বয়স বাড়ছে’। বয়স বাড়ার কোন্‌ কুফলে বন্ধু কমে, আমার জানা নেই। তবে কমে এটা ঠিক। শুধু সংখ্যা নয়, সারল্যও কমে অনেক ক্ষেত্রে। ছোটবেলায় যে অনুভূতিগুলো জীবনমরণের সমস্যা তৈরি করত, এখন সেগুলো রোমন্থন করলে মুচকি হাসি ভেসে ওঠে নিজের অজান্তে।

    রিনিকে (আসল নাম গোপন থাক) আমি চিনতাম ছোটবেলা থেকে। অঙ্কুরদার কাছে আমরা আঁকা শিখতে যেতাম। তারপর আমাদের দুজনের মায়েরা আবিষ্কার করেন যে তাঁরা একই স্কুলে পড়তেন। দুই বন্ধুর পুনর্মিলনে আমরাও সঙ্গী হলাম। রবিবারে সপরিবারে একে অপরের বাড়ি মধ্যাহ্নভোজন, সিনেমা দেখতে যাওয়া ইত্যাদি, ইত্যাদি। একবার বোধহয় পিকনিকেও যাওয়া হয়েছিল।

    তারপর যা হয়। পড়াশুনার চাপ বাড়ল, এবং দুজনেরই বাল্যকালীন শিল্পচর্চার ইতি ঘটল। দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতাও অনভ্যাসের অজুহাতে বিজয়া দশমীর ফর্মালিটিতে এসে ঠেকল। বছরখানেক পর সেটাও বন্ধ হয়ে গেল।

    এইসবই ক্লাস থ্রিয়ের মধ্যে। এরপর রিনির সাথে দেখা দুলালবাবুর টিউশনে। আমরা তখন নাইন। হাফ ইয়ারলির পর ভর্তি হল রিনি। ততদিনে আমার বয়েজ স্কুলের, খেলার মাঠের, পাড়ার বন্ধুদের গ্রুপ তৈরি হয়ে গেছে। ওই টিউশনেও স্কুল আর খেলার মাঠের কয়েকজন মিলিয়ে একটা দল ছিল। সাইকেল নিয়ে একসাথে হইহই করতে করতে ফেরা। কিছু মেয়ে ছিল টিউশনে। তাদের সাথে কথা ছিল সীমিত।

    রিনি আসায় ব্যাপারটা পুরো পাল্টে গেল। পুরনো বন্ধুর দেখা পেয়ে আমরা দুজনেই বেজায় খুশি। মাঝেমধ্যে একসাথে ফিরতাম টিউশন থেকে। দুলালবাবুর বাড়ির দুটো গলি পরেই যে দারুণ ফুচকা পাওয়া যায়, ওর পাল্লায় পড়ে জানলাম। বাড়ির যোগাযোগটা এইবার সেভাবে আর তৈরি হয়নি নতুন করে।

    যে কারণে এত কথা বলা, সেই ঘটনাটা ঘটল নাইনের অ্যানুয়াল পরীক্ষার আগে। আমার খুব ভাল এক বন্ধু ছিল সোহম (এই নামটাও গোপন রইল)। পড়াশুনা, আড্ডা, খেলাধুলা, প্রথম সিগারেট সবই একসাথে। পরীক্ষা শুরুর আগে একদিন ল্যান্ডলাইনে ফোন করে বললে দেখা করার জন্য। পরীক্ষার আগে দেখা করা মানে গুরুতর বিষয়, তাই গেলাম। মাঠের কোনার মন্দিরের পিছনে দু’ রাউন্ড সিগারেট খেয়ে, নশ্বর জীবন কত কষ্টের, সেই নিয়ে ওর হাজারো অনুভবের কথা বলে, শেষমেশ আসল কথাটা পাড়ল।

     -ভাই, তোকে একটা সত্যি কথা বলতে চাই। আমাকে যদি ভুল না বুঝিস।’

     -‘আরে বল না! আমি তোকে তো অনেকক্ষণ ধরেই বলছি বলতে।’

     -‘আমি... আমি... আমি রিনিকে ভালবেসে ফেলেছি রে!’

     -‘ওহ, এই ব্যাপার?’

     -‘আমায় ভুল বুঝিস না। আমি জানি তোরা...’

     -‘আমরা কি?’

     -তোরা পছন্দ করিস একে অপরকে।’

     -‘আমরা?! ধুস, ও তো ভাল বন্ধু হয়।’

     -‘মানে?’

     -‘হ্যাঁ, আমি তো ওকে ছোট থেকেই চিনি। আমরা একসাথে...’

    সোহমকে সেদিন কিছুতেই এই বন্ধুত্বের ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে পারিনি। আমি নিজেও কখনও ওইভাবে ভেবে দেখিনি তার আগে। রিনি আর সোহম দুজনের সাথেই যোগাযোগ আছে এখনও, তিনজন তিন শহরে থাকি আমরা। এক্ষেত্রে বন্ধুবিয়োগ না হলেও সেই সারল্যকে এখনও মিস করি মাঝেমধ্যে।

    অনির্বাণ সেন

    আমরা তখন ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। একদিন বিকেলে ইউনিভার্সিটির মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ শুনি গেটের বাইরে হইচই চিৎকার। আমরা সকলে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন হইচইয়ের অংশ ভেবে নিয়েই প্রথমে পাত্তা দিইনি, কিন্তু আমাদেরই এক বন্ধু সন্দেহের জন্য দৌড়ে গেটের বাইরে যায়। আমরাও নেহাত কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্য তাকে তাড়া করি। গিয়ে দেখি আমাদের বন্ধুর সন্দেহই ভয়াবহভাবে সত্যি হয়েছে। এক ব্যক্তি, তিনি সাইকেল চালাচ্ছিলেন, বাসের ধাক্কার তিনি পড়ে গিয়ে চাকার তলায় কাটা পড়েছেন, সবথেকে বেশি চোট লেগেছে তাঁর পায়ে, পুরো রাস্তা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার (এখন যদিও মনে হয় আশ্চর্যের কিছুই নেই) যে কেউই এই যন্ত্রণায় কাতরানো ব্যক্তিকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসছেন না। বাসের ড্রাইভার পালিয়েছে, বাসটি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়েছে এবং প্রবল যানজট। কৌতূহলী জনতার ভিড়ের মধ্যে থেকেও কেউ এগিয়ে এসে কোনও ট্যাক্সি থামানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন না। আমরা সেই চেষ্টাই করতে শুরু করি যাতে তৎক্ষণাৎ কোনও গাড়ি থামানো যায়। তখনই দেখি আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন এক অপরিচিতা, সম্ভবত চাকুরিরতা এক তরুণী। যখন আমরা একটি ট্যাক্সি থামাতে সমর্থ হই, তখন তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ওই ব্যক্তিকে গাড়িতে তুলে দেন এবং গাড়ির সামনের সিটে বসেন এই বলে যে আমরা যেন সেই নিকটতম হাসপাতালে চলে আসি। আহত ব্যক্তির পায়ের অবস্থা এত খারাপ ছিল যে ট্যাক্সির পিছনের দরজা বন্ধ না হওয়ার দরুন আমাদের এক সতীর্থকে ট্যাক্সির দরজা ধরে প্রায় কিলোমিটার রাস্তা ছুটতে হয়েছিল। আমাদের নিকটতম নার্সিংহোমে গিয়ে হতাশ হতে হয়, কারণ আহত ব্যক্তির অবস্থা দেখে নামমাত্র ‘ফার্স্ট এড’ করেও এমারজেন্সি ট্রিটমেন্টের বদলে তাকে ভর্তি নিতেই অস্বীকার করে, এবং আমরা তাকে এক অ্যাম্বুলেন্সে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালেনিয়ে যেতে (দুরত্ব প্রায় তিরিশ মিনিট) বাধ্য হই। সেই তরুনিএই সময়েও ওই ব্যক্তির সাথে অ্যাম্বুলেন্সে যান এবং আমার এক বন্ধুও তার সাথে যায়। রাস্তায় যেতে যেতেই (আমরা একটি ট্যাক্সিতে অ্যাম্বুলেন্সকে ফলো করছিলাম) শুনি যে যাত্রাপথেই ওই আহত ব্যক্তি মারা গিয়েছেন এবং তরুণীটি অত্যন্ত ভেঙে পড়েছেন। যখন আমরা তাকে এসএসকেএম হাসপাতালে দেখি তখন তিনি নিজের স্থিরতা ফিরে পেয়েছেন। তিনি বলেন যে আমাদের দায়িত্ব মৃত ব্যক্তির বাড়ির লোককে খবর দেওয়া। এতে আমরা সম্মত হলেও হাসপাতালের এক তরুণী ডাক্তার যথেষ্ট সহানুভূতির সাথেই আমাদের বলেন, যে আমরা ইতিমধ্যেই আমাদের যথাসাধ্য করেছি। আমাদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না কিন্তু ওই ব্যক্তির প্রাণ বাঁচাতে আমরা সক্ষম হইনি। এরপরে যখন ব্যাপারটা পুলিশ কেসের আওতায় আসবে তখন বিনা কারণে আমাদের হেনস্থা সহ্য করতে হবে। এই যুক্তিতেই দলের মধ্যে মতামতের একটি বিভাজন হয়। কেউ চাইছিলাম বেরিয়ে আসতে, কেউ চাইছিল ওই ব্যক্তির পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। তার মধ্যেও চোখে পড়েছিল আমাদের সঙ্গী সেই তরুণীর মানবিকতা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা। যখন মর্গে গিয়ে ওই ব্যক্তির মৃতদেহ একটু সরিয়ে রাখার দরকার পড়ে তখনও ওই তরুণী এগিয়ে যেতে পিছপা হননি, যেখানে আমরা ট্রমার জন্যেই হোক বা অনর্থক শুচিবায়ুতা, আমার সাহসে কুলোয়নি। আমরা শেষ পর্যন্ত এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসি। পরে জানতে পারি যে ওই ব্যক্তির পরিবারবর্গ সেই রাতেই খবর পেয়েছিলেন এবং মৃতদেহ সনাক্তকরণ ও সংগ্রহ করেছিলেন। তারপরে আর কোনোদিন সেই অপরিচিতা তরুণীর সাথে যোগাযোগ হয়নি, যদিও আমাদের সেইদিনের এক সতীর্থের সাথে তিনি একবার দেখা করেনব এবং সংক্ষিপ্তভাবে সেই দিনের স্মৃতি ভাগ করে নেন। ওই ব্যক্তির স্মরণসভায় আমরা নিমন্ত্রিত হই, ওই তরুণী সেখানে যাননি। আমি জানি না এই সাময়িক ঐক্য বা সহযোগিতার উপাখ্যানে জেন্ডার রোল সম্পর্কে কোনও বার্তা আছে কিনা, কিন্তু এইটুকু জানি যে ওইদিনের সেই ভয়াবহ স্মৃতি আমার কাছে বন্ধুত্ব ও মানবিকতার এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

    নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

    দু'দিন কথা না হলে ওদের মনে হয় এক শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। এখন আর আগের মত দেখা হয় না। তবুও যেটুকু হয় সেসব নানা ছুতোয়। কখনও ঝগড়া হলে কখনও বা ভুল বোঝাবুঝি মেটাতে, কখনও বা বই দেওয়া-নেওয়ার ছুতো। যাও বা দেখা হয়, মাঝে থাকে মাসখানেকের অপেক্ষা।

    আবির আর মউ- আমার এই বন্ধু আর বান্ধবীটির কথা হচ্ছিল এতক্ষণ। পরিচয় বছর তিনেক আগের কোনো এক শীতের দিনে, তখন মরশুম শুরু সবে। কুয়াশামাখা সকালে ঘুমে ঢুলে পড়া পড়ার ব্যাচে মউকে প্রথম দেখেছিল আবির। ছেলেটা বরাবরই লাজুক তাই সেবার ও পারেনি মউয়ের সাথে প্রথম সাক্ষাতের শুরুয়াত করতে। তবে ওদের বন্ধুত্বটা হয়েছিল - কিভাবে তা আমার স্পষ্টভাবে মনে নেই।

    মউকে ভাল লেগেছিল আবিরের। পারেনি ওকে বলতে, বলেছিল আমাকে। মউয়ের ভাল লেগেছিল ওর লাজুকতা, আমি বুঝেছিলাম। জল অনেক দূর গড়িয়েছে, ওরা এখন একটা সম্পর্কের মধ্যে। যদি ভাবো তথাকথিত প্রেম ভালোবাসা তবে ভুল করবে। ওদের সম্পর্ক প্রেমের অনেক ঊর্ধে, বন্ধুত্বের গন্ডিতেও সীমাবদ্ধ নয়। মউ হয়ে উঠেছিল লাজুক ছেলেটার সবচেয়ে কাছের অনুভূতি, আর আবির মেয়েটার সবচেয়ে বড় বিশ্বাসের জায়গা।

    অনেক কথা হত ওদের,অনেকরকমের। দুজনেই খুব ভাল ছিল একসাথে। এর খাতা ওর কাছে ওর বই এর কাছে। এমনকি পড়ার ব্যাচে চিরকুট লিখেছে ওরা, আমি দেখেছি। একবার ব্যাচে স্যার সবার ফোন নম্বর নিচ্ছিলেন। যেই মউ বলেছে ওর নম্বর...আবির দেখি একবার আওড়াল দুবার আওড়াল - 'আমার মুখস্ত হয়ে গেছে', বলেই বলে দিল নম্বরটা। সেদিন আমরা ওকে খুব খেপিয়েছিলাম।

    আমাদের যখন ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, অনেক সাধ্যসাধনার পর মউ ফেসবুকে এল। আবিরের সঙ্গে এখন সারাদিনই কথা হয় ওর।

    'খেয়ে নে যা রাত হলো অনেক।'

    'তুই আগে।'

    'না তুই।'

    'তুই না খেলে খাবোনা।'

    'চল, একসাথে যাই?'

    একদিন কি নিয়ে যেন কথা কাটাকাটি হয়েছিল ওদের মধ্যে।  মউয়ের চোখে জল, আবিরের খাওয়া বন্ধ। সবাই ভাবল, গন্ডির বাইরে গড়ে ওঠা সম্পর্ক, গণ্ডিরই ফাঁপরে পড়ে ভেঙে গেল বোধহয়। কিন্তু না, হয়নি কিছু সেবার।

    তারপর আবার একদিন তুমুল ঝামেলা, এবার হোয়াটসঅ্যাপে ঝরে পড়ল জমে থাক অভিযোগ, ভেঙে পড়লো অভিমান। এই ঝামেলা কার্যকরী হলো বেশ। ওদের দিল এক নতুন জন্ম। নামকরণ করেনি ওরা নিজেদের, হয়ত করবে না কোনোদিন তবে এখন ওরা আবার আগের মত সাবলীল। দুজন খুব ভালোবাসে একে অপরকে। 'Boyfriend-girlfriend'-এর তুচ্ছ তকমা ওরা দেবে না, লোকে দেবে অবশ্য,অনেকে পারলে ওদের বিয়েই দিয়ে দেয়। কিন্তু আমি দেখেছি, ওরা ওসব চায় না, ওরা চায় একে অপরের আকাশের নীলে ভেসে যাওয়া স্বাধীন গাঙচিল হয়ে ভালোবাসতে। যে ভালোবাসাকে বাঁধবে না কেউ, সে খুঁজে নেবে নিজের পথ। এখন ওদের অপেক্ষার সময়।

    দেখা করবে খুব শিগগির, ওই যে, দু'দিন দেখা না হলে ওদের যে মনে হয় এক শতাব্দী পেরিয়ে গেছে।

    সপ্তর্ষি ঘোষ

    ২০০৯ সালের কথা। আমরা চার বন্ধু একটা ওয়ার্কশপ সেরে ফিরছি বাসন্তী হাইওয়ে দিয়ে। গাড়িতে আমরা তিনজন মেয়ে ও একজন ছেলে। ছেলেটি—মানে মধ্যবয়সি ভদ্রলোকটি বসেছে সামনে। তার পাশে চালকের আসনে বছর পঁচিশেকের একটি ছেলে। সন্ধে সাতটা হবে আন্দাজ। হাইওয়েতে আলো নেই বললেই চলে। হঠাৎ গাড়ির সামনে এসে পড়লেন এক সাইকেল আরোহী। ড্রাইভার ছেলেটি ব্রেক কষে কোনোরকমে একটি দুর্ঘটনা এড়াল। সাইকেলে যিনি ছিলেন তিনি সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই আবার উঠে পড়লেন এবং সাইকেল নিয়ে রাস্তার পাশে তাঁকে সরে যেতে দেখা গেল। আমরা জিজ্ঞেস করে নিশ্চিন্ত হলাম যে তাঁর বেশি লাগেনি। অতএব আবার গাড়ি স্টার্ট দেওয়া হলো। মিনিট পনেরো-কুড়ি বাদে গাড়িটা যখন মালঞ্চীবাজারের কাছাকাছি, তখন দেখি দু-পাশ থেকে দুটো মোটসাইকেল আমাদের গাড়িটাকে চেপে ধরবার চেষ্টা করছে। ব্যাপার কী?

    কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে মোটরসাইকেল আরোহীরা আমাদের গাড়িটা জোর করে থামালো। গাড়ি থামামাত্র তারা দাবি করতে লাগলো টাকা। কেন? না আমাদের গাড়ির ধাক্কায় ওই সাইকেল আরোহী নাকি আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাই টাকা চাই। আমরা বললাম যে হাসপাতালে চলুন তবে, অথবা থানায়। সেখানে সত্যি যাচাই করে তারপর চিকিৎসার টাকার ব্যবস্থা করব। কিন্তু তারা নারাজ। এইসব বাগবিতণ্ডার মধ্যেই দেখি জনা পঞ্চাশেক লোক জমা হয়ে গেছে! ড্রাইভারটি ছেলেটির অবস্থা কাহিল। ভয় কাঁপছে। ড্রাইভারকে টেনে নামাতে জনতা তখন উদ্যত। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল দু-পাঁচ সেকেন্ড। কাছেই বানতলা। ১৯৯০ সালে কাজ থেকে ফেরার পথে বানতলাতেই তিনজন মহিলাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আক্রমণ করা হয়। গাড়ির ড্রাইভার ও একজন মহিলা মারা যান। বানতলার কথা মনে পড়তেই তাই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। যাই হোক, পেছনের সিটে বসা আমরা তিন বন্ধু দেরি না করে গাড়ি থেকে নামলাম আর ড্রাইভারকে বললাম, ‘তুমি একদম নামবে না, যা করার আমরা করছি’।

    তিনজন মহিলাকে মাঠে নামতে দেখে জনতা একটু থমকালো। গাড়ির সামনের সিটে বসে থাকা দুজন পুরুষকে একটু ভয়ঙ্কর চোখে তারা যখন দেখছে, আমরা তিন গুণ্ডা গাড়ির বনেটে হাত রেখে সমস্বরে বললাম, ‘পেশেণ্টকে না দেখে টাকা আমরা দেব না। চলুন’। তারা আরো দু-তিন মিনিট টাকা আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে, অবশেষে রণে ভঙ্গ দিল। ভীড় পাতলা হলে আমরা গাড়িতে উঠলাম। ড্রাইভার ছেলেটি আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে স্টার্ট দিল। এবার সামনের সিটে বসা আমাদের বহুদিনের পুরোনো বন্ধুর দিকে আমরা মন দিলাম। ‘কী হলো, তোর? ঠিক আছিস তো?’বন্ধু-পুরুষটির স্বীকারোক্তি, ‘তোরা যখন গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালি আমি ঠাকুরের ছবিটা মানিব্যাগ থেকে বের করে নাম জপছিলাম। উফ! ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো’।

    এই হলো জেন্ডার। জেন্ডার কখনো আমাদের বন্ধুত্বে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। বরং নারীত্ব ও পৌরুষের ধারণাকে বার বার নতুন করে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে।

    স্বাগতা বর্মণ

    ১৯৭৬। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ কলকাতা তখনও কো-এড হয়নি, সম্ভবত তার পরের বছর থেকেই হবে, কিন্তু তাতে আমার লাভ বা লোকসান কিছুই হয়নি। আমাদের সময় অবধি যাদের এলেম ছিল তারা লোরেটো হাউসের মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাত, আমাদের মত আনস্মার্ট বেঙ্গলি মিডিয়াম থেকে আসা ছেলেরা, কবরখানা পেরিয়ে মল্লিক বাজারের মোড় থেকে এইট বি ধরে রেফিউজি কলোনির বাড়ি ফিরে যেত।  ইংরেজিতে এমএ নিয়ে যাদবপুরে ভর্তি হলাম। ক্লাসে মেয়ে থাকবে শুনে তেমন কিছু উৎসাহিত হইনি। সেন্ট জেভিয়ার্সে থাকতে কারমেলে পড়া একটি মেয়ের জন্যে জীবন দিয়ে দিচ্ছিলাম, তেমন কিছু এগোয়নি। তবে ছোটবেলা থেকেই জানতাম মেয়েরা প্রেমিকা হয়, বন্ধু হয় বলে কোনও ধারণা ছিল না। পাড়ায় দেখতাম আমাদের চেয়ে একটু বড়রা অনেকেই প্রেম করে, ঝামেলা হয়, কারও কারও বিয়ে হয়, বেশিরভাগেরই হয় না। কেউ কতটা সেক্স হল তার গল্প বলে, কেউ বলে না। তখন বিজয়গড়ে অনেকেই প্রেমিকাকে ‘পুলি’ বলে রেফার করত। মানে, ঠেকে এসে জিজ্ঞেস করত, ‘আমার পুলিটারে দেখসস’? মানে আমার প্রেমিকা গেল নাকি এ দিক দিয়ে? আমরা জ্ঞান অনুযায়ী তথ্য দিতাম। কথাটা বেশ বিশ্রী, তখন অতটা বুঝিনি, এখন কেমন কানে লাগে।

    যাই হোক, যাদবপুরে ক্লাস করতে এসে প্রথম দিনেই আমার বন্ধু মিলে গেল। কী কান্ড, প্রেমিকা নয়, মেয়ে বন্ধু। তার নাম সুতপা নিয়োগী, আমরা ওকে টোপি বলে ডাকতাম। এখনও মনে আছে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার করিডর ধরে বাঁ দিকে এগোলে ঝিলের দিকের রেলিংটার কাছে দাঁড়িয়েছিল, একটা জিনস আর কালো টি শার্ট পরে। টোপি যাদবপুরেই বিএ করেছিল বলে জানতো সব। আমি একটু নার্ভাস ছিলাম, উল্টোদিকের ঘরেই ক্লাস ছিল, পাশাপাশি বসিনি বোধহয়। কিন্তু তার পর মিলনদার ক্যান্টিন, নাথুদার অ্যামিনিটি সেন্টার, এসএফআইয়ের পোস্টার লাগাতে রাত জাগা, সব কিছু করে টোপি আমার দারুণ বন্ধু হয়ে গেল। সম্পর্কটাতে ছেলে-মেয়ে জাতীয় যৌনতা বা রোম্যান্টিক মুগ্ধতা ছিল না, ছিল একদম সহজ সরল মেলামেশা, আড্ডা, সব কিছু নিয়ে কথা বলতে পারার ভরসা আর আনন্দ। তখন অতটা হয়ত বুঝিনি, এখন মনে হয় এই বন্ধুত্ব আমাকে জীবনে মেয়েদের সঙ্গে মিশতে, মেয়েদের সমান সমান ভাবতে কতটা সাহায্য করেছিল। কারণ মাতৃজ্ঞান বা প্রেমিকা জ্ঞানে ঠিক সেটা বোধহয় হয় না। আতুপুতু নয়, নকল ভদ্রতা নয়, কিছু সাজা নয়, একেবারে নিজেকে নিয়েই মেশা।

    রংগন চক্রবর্তী

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics