• এক পশলা বন্ধুত্ব


    0    183

    October 4, 2018

     

    শুক্রবারের সন্ধে মানেই রান্নাঘরে তোড়জোড় শুরু পুরোদমে। এ সপ্তাহে রাজসিক পোলাও-মাংস তো পরের শুক্রবার রুইমাছের কালিয়া বা সাদাসিধে আলুপোস্ত। গরম ভাতে ঘি আর আলু-র পাশে পাঁঠার মাংস — সপ্তাহান্তের প্রবাসী বাঙালি জীবনে এর বেশি চাওয়া বোধহয় নেই। আমাদের গোটা সপ্তাহের ব্যস্ততা যেন এই শুক্রবারে এসেই গা এলিয়ে দেয়।

    আমরা, মানে আমরা ৬ জন। পঞ্চপাণ্ডব আর আমি একা কুন্তী(!)। কুন্তী, কারণ মাতৃসুলভ বকাঝকা থেকে জোর করে পটল খাওয়ানো সবই আমার দায়িত্বের অন্তর্গত। যদিও দায়িত্বের ভাগাভাগি বিষয়ে আমাদের মধ্যে প্রবল গণতান্ত্রিকতা। রান্না বেশিরভাগ দিন আমিই করি (করতে ভালোবাসি বলে, আমি একা মেয়ে বলে মোটেও নয়), তবে অনিরুদ্ধ মাঝে মাঝে আমার কাজ কমায়। ওর হাতে তৈরি মাংসের কোফতা, এগ-চিকেন রোল খোদ কলকাতাকে মনে করিয়ে ছাড়ে। আমার মত অনিরুদ্ধও রান্না করতে ভালোবাসে। কলকাতা গেলেই ব্যাগবন্দী করে আনে কাঁচালঙ্কা থেকে ঝর্না ঘি! যাকে বলে পুরো শিল্পী!

    তবে আমাদের দলে শিল্পীর কোনও অভাব নেই। দলের আরেক পাণ্ডব - কাগজে কলমে নাম দেবাঞ্জন। আর সাপ্তাহিক আসরে তার নাম ‘C33’। কেন, তা আমি জানিনা। ঐতিহাসিকদের মতে, কোনও এক কাল্পনিক রোবটের স্মৃতিতে সে নিজের এমন নামকরণ করেছে। আমাদের কোনও আপত্তি নেই তাতে। আমি অন্তত নির্দ্বিধায় ওকে C33 বলেই ডাকি। পেশায় গবেষক C33 গান গায়, গিটার বাজায়।

    এরপর আসা যাক সপ্তর্ষির কথায়। একাধারে দলের অভিনেতা, নাট্যকার, পরিচালক এবং ‘বিবেক’। বিবেক, কারণ সপ্তর্ষিই একমাত্র ব্যক্তি যে সারা সপ্তাহ আমাদের মত গাধার খাটনি খাটার পরেও খোদ জার্মান বিয়ারের ছায়াটুকুও স্পর্শ করেনা। কেন কে জানে! কিন্তু রান্না শেষ হয়ে যাবার পরেই “খাওয়া যাক?” উক্তিটি সে-ই সবার প্রথমে উচ্চারণ করে।

    তারপর অরিন্দমদা। দলে আমি সর্বকনিষ্ঠ, তবু একমাত্র অরিন্দমদাকেই ‘দা’ সম্বোধন করি কেন, সেটা নিয়ে অনেক জল্পনা করেও কোনও নির্দিষ্ট উত্তরে পৌঁছনো যায়নি। অরিন্দমদা হচ্ছে যাকে এককথায় ‘ভালো ছেলে’ বলা যায়। আমার অসংখ্য বোকা বোকা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে শুরু করে সুযোগ পেলেই নতুন রেসিপি পরীক্ষা করা, সবেতেই অরিন্দমদার ধৈর্য্য দেখার মত।

    আর সবার শেষে, দলের ‘চিফ’ দেবায়ন। অত্যন্ত মেধাবী দেবায়ন বহির্বঙ্গে বড় হলেও অনেক ঘরে-জন্মানো বাঙালির তুলনায় বেশি বাঙালি। শুধু তাই নয়, দেবায়নের হাতের কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানী সত্যিই দারুণ!

    এই পঞ্চপাণ্ডবের সাথে আমি ভিড়লাম কী করে সেটা মূল প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো, পাঁচখানা দামড়া ছেলের দলে আমি টিকে আছি কী করে। টিকে আছি বলা ভুল হবে। বলা উচিত বেশ আনন্দেই আছি। আছি, কারণ এদের কেউই আমায় সারাক্ষণ মনে করায় না আমি কোনও অংশে তাদের থেকে ‘আলাদা’ বা ‘নিকৃষ্ট’। দেশে থাকাকালীন দেখেছি, মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদেরও লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হতে হয়, যদিও এই দুইয়ের কোনও তুলনা চলে না। কিন্তু শুক্রবারের আড্ডায় কয়েক ঘন্টার জন্য হলেও ভুলে যাই ‘একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারেনা’-র সংস্কৃতি। ভুলে যাই রান্নাঘরে কার অগ্রাধিকার। তবে মাঝে মাঝে সত্যিই মনে হয়, ইস! যদি আরও কয়েকটা মেয়ে থাকত আমাদের দলে! কিছু কিছু কু-তর্কে দলভারী হত আমার! বলা বাহুল্য, এই আফসোস তেমন গুরুতর নয়।

    গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের এই হট্টগোল-হুল্লোড়ের মাঝে এক পশলা ফেলে আসা বাড়ি-র আভাস। গুরুত্বপূর্ণ, ভুল-বোঝাবুঝির পরেও হেসে বিয়ার-পোলাও এগিয়ে দেওয়া। আর সব কিছু ছাপিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ছেলে-মেয়ে-জাত-ধর্ম-ভাষা-বয়স নির্বিশেষে নিছক বন্ধুত্ব - যা দেশে হোক বা বিদেশে, আজ প্রায় অবলুপ্তির পথে।

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics