ছেলেভুলোনো ছড়ায় মেয়েরা কোথায়?
6 951স্বাধীনতার বচ্ছরকার উদযাপন এলে দেশাত্মবোধক গানগুলো ধুলো ঝেড়ে বাক্স থেকে বের করা হয়। পাড়ায়-পাড়ায়, স্কুলে-স্কুলে ‘ধন ধান্যে...’, ‘অ্যায় মেরি বতন কে লোগো...’-র ঢল নেমে যায়। আমার মেয়েও গান গাইল এবার স্কুলের ১৫ অগাস্টের অনুষ্ঠানে। শুনলাম খুব মন দিয়ে গাইছে, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি...’। যতবার শুনি চোখে জল এসে যায়, কিন্তু এবার কেমন খটকা লাগল! কেন খটকা? আসলে ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি
"বারো লক্ষ তেত্রিশ কোটি, রইল মা তোর বেটা বেটি
মাগো তাদের নিয়ে ঘর করিস মা বউদের করিস দাসী"
কিন্তু মেয়ে গাইছে ‘ওদের’ করিস দাসী। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, স্কুল থেকে এটাই দিয়েছে। মানে ‘বউদের’ দাসী করার এই নারী-অবমাননাকর ভাষ্যটি শুধরে নেবার একটা ছোট কিন্তু জরুরি পদক্ষেপ। জরুরি এই কারণে যে এখানে শিক্ষার্থী ছোটরা। তাদের শেখাটা গোড়া থেকেই ঠিকঠাক হওয়া দরকার। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল কবি যশোধরা রায়চৌধুরীর একটি অভিজ্ঞতার কথা। কর্মসূত্রে যশোধরা যখন রাঁচি থাকত, তখন হিন্দিভাষী আয়ার কাছে ওর ছোট্ট মেয়েটি একটি ছড়া শিখেছিল। সেটি অনেকটা এইরকম-
‘বাপ কা পয়সা গোল গোল
মা কি রোটি গোল গোল’
‘গোল’ এর জ্যামিতিক ধারণা শিশুমনে গেঁথে দিতে গিয়ে এটাও ঢুকিয়ে দেওয়া হল বাবা পয়সা উপার্জন করে আর মা রান্না করে। কিন্তু তাহলে তো শৈশবের অবিমিশ্র আনন্দের শরিক ছড়াগুলো অর্ধেকের বেশি ফেলে দিতে হয়। কিংবা ‘স্যানিটাইজ’ করে বিশুদ্ধ মিনারেল ওয়াটারের মতো একটা স্বাদগন্ধহীন জিনিস বানাতে হয়!
খেয়াল করে দেখুন, বাংলায় কিন্তু মেয়েদের জন্য কোনও ছড়াই লেখা হয়নি। কারণ তার নামই হচ্ছে 'ছেলে-ভুলোনো' ছড়া! অবশ্য ছড়া দিয়ে মেয়েদের ভুলোনোর দরকারটাই বা কি? কারণ শৈশবেই তো তাদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে! যে ছড়াটি শুনে একটি বাঙালি শিশু সাহিত্যের প্রথম স্বাদ পায় সেটি হল –
"চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে কদমতলায় কে?
হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে সোনামণির বে"
সোনামণি বা খুকুমণিদের কিন্তু বিয়ের প্রসঙ্গ ছাড়া ছড়ায় কোন জায়গাই নেই। ছড়ায় কেবলই খোকা বা খোকনসোনাদের মুহুর্মুহু বর্ণময় উপস্থিতি। তারা ক্ষীর নদীর কূলে মাছ ধরতে যায়, বারবারই যায়, কোলাব্যাঙে ছিপ আর চিলে মাছ নিয়ে গেলেও তাদের ক্ষীরনদীতে যাওয়া কেউ আটকাতে পারে না, কেউ বকেও না ছিপ বা মাছ হারানোর বা চুরি যাওয়ার জন্য –
''খোকা যাবে মাছ ধরতে ক্ষীরনদীর কূলে
ছিপ নিয়ে গেল কোলাব্যাঙে আর মাছ নিয়ে গেল চিলে''
তাদের কপালে চাঁদমামাকে পর্যন্ত ‘টি’ দিয়ে যেতে হবে, খোকাবাবুদের এমনই প্রতাপ!
''আয় আয় চাঁদমামা টি দিয়ে যা
চাঁদের কপালে চাঁদ টি দিয়ে যা''
এদিকে খুকুদের কপাল খালিই পড়ে থাকে, বোধহয় সিঁদুর ছাড়া সেখানে সবই নাপাক! কন্যাশিশুরা শুধু অসূর্যম্পশ্যা নন, অচন্দ্রম্পশ্যাও! ওদিকে, খোকারা নাচেন। আর সে নাচ দেখার জন্যে ভোঁদড়কে ডাকা হয়!
''ওরে ভোদঁড় ফিরে চা খোকার নাচন দেখে যা''
বোঝাই যাচ্ছে ভোদঁড়টি খোকার নাচ দেখতে তেমন আগ্রহী ছিল না; কিন্তু খোকাকে তুষ্ট করতে মায়ের চেষ্টার খামতি নেই। কিন্তু বাংলা ছড়ায় কোনও নৃত্যরতা কন্যা দেখেছেন কি? অথচ বাংলার গৌড়ীয় নৃত্য বহু প্রাচীন। এই নাচ নেচেই নাকি বেহুলা স্বর্গের দেবতাদের মন জয় করে লখিন্দরকে বাঁচিয়ে এনেছিলেন। তার মানে মেয়েদের আর সব গুণপনার মতো নাচটিও স্বামী ও সংসারের সুরাহা-র জন্য।জনপ্রিয় লোকগানে অবশ্য নৃত্যপটীয়সী ‘সোহাগ চাঁদবদনী ধনি’-র কথা আছে। আজকাল রিয়েলিটি শো তে ছোট ছোট মেয়েরা এই গানের সঙ্গে বেশ নাচে। তাই দেখে আমার ধারণা হয়েছিল এটি বোধহয় শিশুকন্যাদের নাচ। ও হরি! একটু মন দিয়ে শুনে দেখি কোথায় কি! এ তো বলছে
''যেমনি নাচেন নাগর কানাই তেমনি নাচেন রাই
একবার নাচিয়া ভুলাও তো দেখি নাগর কানাই''
এ তো রাই বিনোদিনী রাধার নৃত্য, যা নেচে তাঁকে কৃষ্ণকে ভোলাতে হবে! তবে, একটি ছড়ায় শিশুকন্যার নাচের চমৎকার ছবি পেয়েছি, সে নাচ আপন খেয়ালে নাচা, কাউকে ভোলানোর জন্যে নয়,
''ধেই নেচেছে রাঙ্গা পায়
ঘাঘরা কিনে দেয় না মায়
আসুক তাঁতি বুনুক সুতো
ঘাঘরা কিনে দেব রে পুতো''
আমার দিদিমা (আমার দেখা অন্যতম সূক্ষ্ণবোধসম্পন্ন মানুষ) ছাড়া আর কারো মুখে এ ছাড়া শুনিনি। আমি যেমন এটা আমার ছোটবেলায় শুনেছি, তেমনি আমার মেয়েও শুনেছে তার দিদার মুখে। তবে লিখতে লিখতে ছড়াটিকে আর অত সরল বলে মনে হল না। মেয়ে যতই ভালো নাচুক, মা সহজে তার ঘাঘরা কিনে দেন না, ছেলে হলে হয়তো চট করে তার জরি বসানো পোশাক চলে আসত। তাছাড়া ঘাঘরা কেনার আর্থিক ক্ষমতা বা সিদ্ধান্ত মার কাছে নেই। আর এ ছড়া তো তীব্র বস্ত্র সংকটের কথাও বলে- তাঁতি এসে সুতো বুনলে তবে ঘাঘরা তৈরি হবে! তবু বলব বাংলা ছড়ায় এই ছড়াটি একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। বাকি সব ছড়ায় কেবল খুকুদের বিয়ে বিয়ে আর বিয়ে –
''দোল দোল দুলুনি
রাঙা মাথায় চিরুনি
বর আসবে এক্ষুনি
নিয়ে যাবে তক্ষুনি''
কেমন একটা গৌরব না? এক্ষুনি বর এসে নিয়ে যাবার মধ্যে! আমার কিন্তু হাড় হিম হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় এই বঙ্গের উজ্জ্বল পুরুষটির মায়ের বিয়ের গল্প –
রবীন্দ্রনাথের মা সারদা। নেহাত ছোট্ট মেয়ে, খেলছিলেন বাড়িতে। ঘটকী দেখে পছন্দ করে সোজা উঠিয়ে আনল তাঁকে। স্নানে গিয়েছিলেন সারদার মা। ফিরে এসে মেয়েকে দেখতে না পেয়ে আছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদতে কাঁদতে প্রাণটাই বের হয়ে গেল তাঁর। এ ঘটনাটি লিখে গেছেন সম্ভবত জ্ঞানদানন্দিনী। এমন না জানি কত অন্ধকার লুকিয়ে আছে উজ্জ্বল প্রদীপের নিচে।
"যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে
যমুনা যাবে শ্বশুরবাড়ি কাজিতলা দিয়ে"
এই যমুনা নিশ্চয় কিঞ্চিৎ লেখাপড়া জানত, নইলে তাকে সরস্বতী বলা হবে কেন? কিন্তু যতই লেখাপড়া করুক, বিয়ে ছাড়া তার অন্য গতি নেই। আর ছড়ার মেয়েরাও এত ফেলনা যে এক পাত্রে তিনজনকে পাত্রস্থ করা যায়, পাত্র শিবঠাকুর হলেই বা!
''বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদে এল বান
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল
তিন কন্যে দান''
তবে আশার কথা, তিন কন্যের ভাগ্য একরকম নয়। এক কন্যে রাঁধেন তো আরেক কন্যে খান, আর এক কন্যে, তার বাপ বুঝি দেবী চৌধুরানির সতীন সাগরের বাপের মতো মস্ত বড়লোক, তিনি রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যাবার ক্ষমতা ধরেন। এই অভিমানী কন্যেকে ফিরিয়ে আনতেই কি শ্বশুরবাড়ি ছোটেন শিব? বউ-এর চলে আসার পেছনে বধূ নির্যাতনের ঘটনা থাকা খুবই সম্ভব, তবু জামাই আদর কমে না তাতে!
''শিব গেল শ্বশুর বাড়ি বসতে দিল পিঁড়ে
জলপান করিতে দিল শালিধানের চিঁড়ে
শালিধানের চিঁড়ে নয় রে বিন্নিধানের খই
মোটা মোটা সবরি কলা, কাগমারি দই''
জামাই হোক বা ছেলে, তাদের খ্যাঁটনের দেদার ব্যবস্থা ছড়া-র দুনিয়ায়। আর তা খোকা স্তর থেকেই শুরু। অবন ঠাকুরের ‘ক্ষীরের পুতুল’-এ আছে
''কোলা ব্যাঙে ছিপ কেড়ে নিলে খোকাবাবুরা ক্ষেপ্ত হয়ে ঘরে এলেন, মা তপ্ত দুধ জুড়িয়ে খেতে দিলেন।''
শুধু কি মা? বনগাঁবাসী মাসি-পিসি তো খোকাদের খাওয়ানোর জন্যই খইয়ের মোয়া গড়েন। খোকা আর নন্দগোপাল এখানে একাকার। এ যেন ‘তালের বড়া খেয়ে নন্দ নাচিতে লাগিল’ সিনড্রোম। অন্যদিকে মেয়েরা যে কী খাচ্ছে ছড়ায় তার কোনও হদিশ নেই। তাদের রাঁধতে বাড়তে দেখা গেছে, বেগুন কুটতেও।
''পানকৌড়ি পানকৌড়ি ডাঙ্গায় উঠোনা
তোমার শাশুড়ি বলে গেছে বেগুন কুটোনা''
তরকারির খোসা সরু বা মোটার ওপরও বউয়ের বাপেরবাড়ির গুমর বিচার হয়-
''তুমি কেমন বড়মানুষের ঝি
কাঁচকলাটা কুটতে দেখে খোসায় বুঝেছি''
লাউ রাঁধার ধরন-ধারণ নিয়ে ছড়ায় চমৎকার শাশুড়ি-বউমা দ্বৈরথও ধরা পড়েছে-
''লাউ করে হাউ হাউ কে রেঁধেছে?
আমি তো রাঁধিনি বাবা, বউ রেঁধেছে,
আহা তাই তো আবাগি লাউ মধু হয়েছে''
কিংবা
''মা রান্ধে যেমন তেমন বুন রান্ধে পানি
আবাগী যে রাইন্ধা রাখে চিনির টুকরাখানি''
কিন্তু এমন রাঁধন-বাড়নে ব্যস্ত মেয়েরা দিনের শেষে কী খান ছড়াকাররা খোঁজ করেন নি। এমনকী একটা নাড়ু মোয়াও কেউ তুলে দেয়নি খুকুমণিদের হাতে। কমলাপুলির দেশে বিয়ে হওয়া পুঁটু কী খেয়েছে কে জানে! অথচ খুকুদের পাহারা দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসার জন্যে আম কাঁঠালের বাগান দেবার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু খুকুদের কেউ একটুকরো আম বা এক কোয়া কাঁঠাল হাতে করে তুলে দেয়নি। ছড়ার এই খুকুমণি, পুঁটু বা যমুনাবতীই কি ফিরে এসেছে সাহিত্যের দুর্গা হয়ে? যাকে বনে-বাদাড়ে ঘুরে গাছের তলায় পড়ে থাকা পাখি বা বাদুড়ে ঠোকরানো ফলপাকুড় খেয়ে পেট ভরাতে হয়? কে জানে দুর্গা ম্যালেরিয়ার মারা গেছিল না নিপা ভাইরাসে!
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Comments (6)
-
-
এই ছড়াগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে যে ছড়াগুলোর মধ্যে ছেলেদেরই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।সমাজে ও পরিবারে ,মেয়েদের নয়।আমার মনে হয় ছেলে বা মেয়ে উভয়কেই সমদৃষ্টিতে দেখা উচিত।কোনো একজন কে বেশি প্রাধান্য দেওয়া ঠিক নয়।
-
সত্যি ই তো এই ছড়ার মতো সমাজে ,ও পরিবারে মেয়েদের বিভিন্ন রকম ভাবে অবহেলা করা হয়।
আমার মতে ,সে বা সেই মেয়েটি যেন সমাজে বা পরিবারে অবহেলিত না হয়। -
Asadharon !!! Asa kori ebar meyeder niye aro kichhu chhora lekha hobe.
-
Love it
-
এটা শুধু বাংলার সমস্যা নয় হয়তো, সমস্ত বিশ্বেই এই সমস্যা, মোটামুটি যা জানি।
চমৎকার লেখা, তৃষ্ণা, যথারীতি।
Leave a Reply
-
ছোটো থেকেই প্রতিটি শিশু কন্যা কে শুনতে হয়,তার বিয়ে হয়ে যাবে পরের বাড়িতে ।তার হাতে তুলে দেওয়া হয় রান্নাবাটির জিনিসগুলো । খাবার এলে তার কথা আর মনে থাকে না ।
নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখা——বিমলার অভিমান
বিমলা অভিমান করে বলেছে ————
খাবো নাতো আমি–
দাদা কে অতোটা ক্ষীর ,অতো খানা অবনীর
আমার বেলাই বুঝি ক্ষীর মাত্র নামই।
যার যতো ফরমাশ সব বিমলা কে করতে হয় , তাতে বিমলা বাঁচুক বা মরুক ।