• কৈশোর ও স্কুল ড্রেসকোড


    4    740

    August 3, 2018

     


    আজ থেকে তেরো বছর আগে একজন শিক্ষিকা হিসাবে বীরভূমের বড়া গ্রামের একটি স্কুলে যোগ দিয়েছিলাম। সেই সময়েই প্রথম আমার নজরে আসে স্কুলের গন্ডির মধ্যে লিঙ্গের মাপকাঠিতে ‘ড্রেসকোড’ নির্ধারণের বিষয়টি। স্কুলে হোক বা স্কুলের বাইরে, পোশাক হবে আরামদায়ক, স্বচ্ছন্দ, সুবিধাজনক আর রুচিসম্মত- ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী সবার ক্ষেত্রেই তাই। কিন্তু আদতে ব্যাপারটা সেরকম ঘটে না।

    বর্ষাকালে বৃষ্টি পড়লে বীরভূমের বড়া গ্রাম ভরে থাকে এঁটেল কালো কাদায়। তখন গ্রামের রাস্তাঘাটে চলতে গেলে পায়ের গোড়ালি অব্দি কাদাতে বসে যেত। বলাবাহুল্য প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্যে ‘গ্রাম সড়ক যোজনা’-র পাকা রাস্তাটি তখনও হয়নি। তা, সেই হেন কাদা ডিঙিয়ে, ঝমঝমে জল-বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের ছাত্রীরা সুদূর চন্ডীপুর, বেলগ্রাম(তখনও ছেলে-মেয়েরা বহুদূরের এইসব গ্রাম থেকে পড়তে আসত) এবং আশেপাশের বড়া, ডোংরা ইত্যাদি এলাকা থেকে স্কুলে আসতো শাড়ি পরে (নবম শ্রেণী থেকে শাড়ি ছিল স্কুলের ছাত্রীদের জন্য ধরাবাঁধা পোশাক)- ওদের ওই বয়সের বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া লজ্জা, সম্ভ্রম সামলাতে সামলাতে। ভিজে কাপড় জামাতেই অতঃপর টানা সাড়ে পাঁচ ঘন্টার স্যাঁতস্যাঁতানি। ছাতা থাকলেই বা কী? ওই বৃষ্টিতে হাঁটু অব্দি শাড়ি, শায়া, কিছুটা আঁচল এবং কাঁধ-সংলগ্ন কাপড় ভিজে গিয়ে গায়ের সাথে এমন ভাবে লেপ্টে থাকত, যা বয়ঃসন্ধির ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের পক্ষেই অস্বস্তিকর। তবে অস্বস্তিটায় শাস্তি পেত শুধু মেয়েরাই। তার কারণ, ছেলেদের পোশাক ততদিনে হাফপ্যান্ট ছাড়িয়ে ফুলপ্যান্ট হলেও জল-বৃষ্টিতে সেদিনও, আর আজও, ছেলেরা (এবং সমস্ত পুরুষ শিক্ষক ও কর্মীরা) প্যান্টের পা গুটিয়ে হাফ-প্যান্ট করে নেয়। আর ছেলেদের শার্ট ভিজে গিয়ে গায়ের সাথে লেগে গেলেও তা নিয়ে কটাক্ষ, বাঁকা মন্তব্য বা শুধুমাত্র তারিয়ে দেখার রেওয়াজ এখনও গ্রাম সমাজে নেই। সম্ভবত শহরেও নেই।

    আমাদের পরের প্রজন্ম, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের এই সমস্যাগুলি স্বভাবতই গোচরে আসা উচিত ছিল স্কুল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু কর্তৃপক্ষ, পুরুষ ও মহিলা শিক্ষকরা, গ্রামের মাতব্বর মানুষজনেরা কেউই আমল দেননি বিষয়টায়। সুতরাং ওভাবেই চলছিল। স্কুলের নির্ধারিত পোশাকে ছাত্রীদের অসুবিধে আমার চোখে পড়ছিল। সে তুলনায় ছাত্ররা ছিল স্বচ্ছন্দ। নিজের স্বাচ্ছন্দ্য এবং ব্যক্তিগত পছন্দের অধিকারের প্রশ্নটি আমি মুলতুবি রেখে প্রথম একবছর টানা আমি শাড়ি পরে স্কুলে গেছি আর অপেক্ষা করেছি সঠিক সময়ের। পরের বছর নতুন সেশনে ছেলে-মেয়েদের ভর্তির সময় স্কুল কর্তৃপক্ষ, আমার অন্যান্য সহকর্মী, যে ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস এইট/নাইনে উঠল তাদের অভিভাবক এবং এলাকার মানুষজনের কাছে আমার ভাবনা ও মতামত প্রকাশ করলাম। প্রস্তাব রাখলাম, স্কুলে ক্লাস এইট থেকে টেন অব্দি মেয়েদের ড্রেসকোড বদলানো দরকার। এরকম সামাজিক ও কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ধর্মীয়-ট্যাবু সঞ্জাত লিঙ্গভিত্তিক ইস্যুগুলির পরিসরে কামারের এক ঘা দিলে অনেকসময়েই ফল উল্টো হতে পারে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই মাটি বুঝে বুঝে পা ফেলা। বললাম, অষ্টম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত মেয়েদের স্কুলড্রেস বাধ্যতামূলকভাবে শাড়ি না রেখে বিকল্প হিসাবে থাক সালোয়ার-কামিজ। নতুন বছরে ভর্তি শুরু হবার আগেই ক্লাস এইট, নাইন ও টেন এর দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ঘরে গিয়ে খাতায় ছবি এঁকে সালোয়ার-কামিজ ও ওড়নার কোনটা কি রঙ হবে তা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। অনুরোধ জানিয়েছিলাম তাঁদের, এটা যেন জনে জনে অবহিত করা হয়।

    কিন্তু অবহিত হলেই যে সেটা প্রতিদিনের চর্চায় লাগু হয়ে যাবে, এরকম সরল সমীকরণে গ্রামের জনজীবন চলেনা। পুরোনো একটা প্রথা ভাঙার কথা বলা হচ্ছিল- গ্রামের অল্পবয়সী, স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের সুবিধার্থে। অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষিকা, অন্যান্য শিক্ষাকর্মী, গ্রামের সাধারণ মহিলা-পুরুষ, এমনকি সেই অষ্টম থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্রীদেরও চোখ-মুখ থমথম করছিল। অথচ, সংখ্যায় এখনকার তুলনায় অনেক কম হলেও, ততদিনে কিন্তু এ তল্লাটের গ্রামগুলিতে দেখছি মেয়েরা চুড়িদার (তখনও ‘লেগিংস’ আসেনি ফ্যাশানে। ওরা সালোয়ার-কামিজকেই চুড়িদার বলত), নাইটি বা ম্যাক্সি, এমনকি অল্পবয়সী কেউ কেউ জিন্স টপও পরছে। উৎসব-অনুষ্ঠানে যাচ্ছে বা বোলপুরে পড়তে যাচ্ছে। হলেই বা! স্কুলের মতো জায়গায় সেই সব পোশাকের প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা তো দেওয়া হয়নি। তাই হুট করে স্কুল থেকে সেসব বিকল্প পোশাকের ছাড় দেওয়া হলেও সেটা নিয়ে তারা স্বভাবতই খানিক সন্দিগ্ধ ও দ্বিধান্বিত। তবু, একজন দু’জন করে নতুন ড্রেসকোড মেনে স্কুলে আসা শুরু করল। স্বাচ্ছন্দ্য আসছিল তাদের হাঁটা-চলায়, খেলাধূলায়। কেউ কেউ যুক্তি দেখাতো, যা আংশিক সত্যও বটে, ওদের দিদি বা কম বয়সী মাসি-পিসির পাশ করে যাবার পর পরিত্যক্ত শাড়িটি স্কুলড্রেস হিসাবে ব্যবহার করতে পারলে আর নতুন করে কিনতে হয় না। বলতাম, বেশ তো। ওটা কাটিয়েই নাহয় সালোয়ার-কামিজ করিয়ে নিস; শুধু দরজির খরচটুকু লাগবে। কাজ হয়নি। তবে, নিয়মটা চালু হল। স্বপ্নটা বাস্তবায়িত হতে সময় লেগেছিল অনেকটাই।

    বেশ ক’বছর আমাদের স্কুলে খেলার মাস্টারমশাই এসে যাবার পর ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সমানতালে খেলাধূলোয় এগিয়ে এসেছে। ওদের প্রতিটি ক্লাসের জন্য আলাদা আলাদা রঙের খেলার পোশাক নির্দিষ্ট রয়েছে যেগুলো পরেই ওরা ওদের খেলার ক্লাস করে, স্পোর্টসের মাঠে শর্টস আর জার্সি পরে লং জাম্প দিতেও এই প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরা আর পিছপা নেই। এখানে বলা দরকার, এই খেলোয়াড় মেয়েদের অধিকাংশই আসে চন্ডীপুর গ্রামের মুসলমান পরিবার থেকে। স্কুলের পোশাকের বিষয়টা অনেকখানি সহজ ও সাবলীল হয়ে এসেছে। নিজেদের ব্যক্তিপরিচয় নিয়ে তাদের মধ্যে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে। আমার সহকর্মীদের মধ্যেও ক্রমশঃ স্কুলে আসার জন্য নিজেদের পোশাক সংক্রান্ত গোঁড়ামি কমেছে। এলাকার মানুষও এই পেশার সঙ্গে পোশাকের সম্পর্কহীনতা দিনে দিনে উপলব্ধি করছেন; অনেকটাই কমে এসেছে বাঁকা মন্তব্য, ভ্রূকুঞ্চন, পুরুষদের কুৎসিত, অভদ্র, অসংগত প্রশ্ন ও তার জবাদিহির রেওয়াজ।

    পাঠভবনে স্কুলের পোশাকে ছাত্রীরা। ১৯৮৩ সাল।

    তবে ইদানিং আবার একটা পিছন দিকে হাঁটার প্রবণতা টের পাচ্ছি। সমাজনির্মিত যে লিঙ্গ-পরিচিতি, সেখানে বরাবরই লিঙ্গভিত্তিক বিধিনিষেধের একটি প্রধান অংশ মেয়েদের পোশাক-আশাক। তার প্রতিফলন স্কুল নামক ‘সামাজিক’ প্রতিষ্ঠানেও বলবৎ। ইদানিং আমার স্কুলে লক্ষ্য করছি সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণির মেয়েরা স্কার্ট-ব্লাউজ পরছে ঠিকই, কিন্তু তার সাথে স্কার্টের নিচে নানা রঙের পা ঢাকা লেগিংস পরে আসছে। শুধু আমার স্কুল বলে নয়, এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে একই বয়সী ছেলে ও মেয়ের জন্য পোশাকের বিধি পাল্টে যাচ্ছে খোদ রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের বিশ্বভারতীতে- তাঁর অতি যত্নের পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রে। আমি ও আমার মেয়ে, আমরা দুজনেই পাঠভবনের প্রাক্তন ছাত্রী। ‘আনন্দ পাঠশালা’ নামে বিশ্বভারতীর যে কিন্ডারগার্টেন অংশ, তাতে শিশুদের জন্য কোনো ড্রেসকোড ছিল না কখনও। যার যেমন খুশি হাতাওলা, হাতকাটা, লম্বা, খাটো রঙবেরঙের জামা পরে শিশুরা স্কুলে আসত ওই দু’বছর। এমনকি লিঙ্গের ভিত্তিতেও কোনও বাধ্যবাধ্যকতা ছিল না। পাঠভবনে ক্লাস টু থেকে এইট অব্দি মেয়েদের সাদা শার্ট ও হলুদ স্কার্ট। শীতকালে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে চরম ঠান্ডা পড়লে ক’টা দিন স্কার্টের তলায় স্ল্যাক্স, ফুলপ্যান্ট বা সালোয়ার পরা হত। শীত কমলেই আবার পা খালি। অথচ, এখন পাঠভবনের সিক্স থেকে এইট অব্দি ছাত্রীদের জন্য নতুন করে নির্ধারিত পোশাক হল সালোয়ার কামিজ!

    সালোয়ার কামিজে পাঠভবনের ছাত্রীরা। ২০১৮ সাল।

    বীরভূমের বড়া গ্রামে আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে আমি শাড়ির বদলে সালোয়ার-কামিজের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলাম। সেই বদল ছিল স্কুলের ছাত্রীদের সুবিধার্থে। কিন্তু সেই একই বীরভূমে, সারা বিশ্বে বিদিত বিশ্বভারতীর মত প্রতিষ্ঠানে ছোট মেয়েদের স্কার্ট-ব্লাউজ পরে স্কুলে আসার স্বাচ্ছন্দ্যে নতুন করে এই হস্তক্ষেপ কার স্বার্থে? স্কার্টের বদলে পা ঢাকা সালোয়ার কিম্বা স্কার্টের তলায় লেগিংস পরে এই ‘লজ্জানিবারণ’ কোন লজ্জার দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের? বেগম রোকেয়া চিত্রিত অবরোধবাসিনী –দের যুগে নাকি রাসসুন্দরী দেবীর আমার জীবন-এ রান্নাঘরেও একবুক ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে রাখা জীবনের দিকেই আবার ফিরে যাচ্ছি আমরা? স্কুলের পরিসরে শিক্ষা আর সচেতনতার পথে পা বাড়ানোর দিনগুলোতে ছাত্রীরা যদি ‘ড্রেসকোড’ এর অজুহাতে আবার ফিরে যায় পরাধীন বন্দীদশায়, তাতে আর যারই হোক সেই স্কুলপড়ুয়া কিশোরীদের কোনও স্বার্থসিদ্ধি হতে পারে না।

     
     



    Tags
     



    Comments (4)
    • বীরভূম জেলার বড়া গ্রামের স্কুলের লেখা পড়ে খুব ভালো লাগল। লজ্জানিবারণের জন্য মেয়েরা এখন লেগিংস পড়ছে এই ভাবনার পরিবর্তন হলে ভালো হয়।

    • লেখা পড়ে ভালো লাগল।ছোটো পোশাক নিয়ে মানুষের মনে যে ধারনা আছে তার পরিবর্তন হলে ভালো লাগবে ।

    • ছেলে-মেয়ে উভয়ে নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী পোশাক পরতে পারে, তবে শালীনতা বজায় রেখে।

    • জরুরি লেখা। এক ই সঙ্গে আমার মনে হয় স্কুলে ক্রস ড্রেসিং এর স্বাধীনতা খুব দরকার। মেয়ে মানেই সে আজীবন স্কার্ট পরবে তাই ই বা কেন? ছেলে মেয়ে উভয়ের ই ইচ্ছে মতন ইউনিফর্ম বাছা উচিত

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics