• নজরে বিজ্ঞাপন : জামার ময়লা, মনের ময়লা ও ঘড়ি ডিটার্জেন্ট


    0    47

    December 5, 2018

     

    সেই ‘গল্প হলেও সত্যি’-র মুশকিল আসান ধনঞ্জয়কে মনে আছে তো? ‘মাইনে কত নেবে’ এ প্রশ্নের উত্তরে সে যখন বলে ‘কুড়ি টাকা বলছেন? সে কী করে হয় বাবু? ... বারো টাকা দেবেন।’, তখন গোটা পরিবারে কেমন অমলিন হাসি ছড়িয়ে পড়ে! আসলে মধ্যবিত্তের সুখী গৃহকোণে কাজের লোক সবসময় অস্বস্তির কাঁটার মতই খচখচ করে। তাকে ছাড়া সংসার অচল, আবার একটু বেশি মাইনে, দু'দিন বেশি ছুটির দাবিতে মধ্যবিত্ত খাবি খায়।

    কথাগুলো মাথায় এল ঘড়ি ডিটার্জেন্টের দিওয়ালি উপলক্ষ্যে একটি বিজ্ঞাপনটি দেখে। কাজের মেয়ে মিনুর তৎপরতায় বিরক্ত বাড়ির ছেলে, তরুণ প্রভু রোহন। মিনু পাখা বন্ধ করে ঘর ঝাঁট দিতে এলে তার প্রিয় ঘুমের দফারফা হয়, মিনুর মোছা মেঝে মাড়িয়ে দিয়ে সে অনায়াসে তার মাকে বলতে পারে, মিনু ‘ফির সে কর দেগি’। এহেন রোহনকে 'সবক' শেখাতে তার মা এক ফন্দি আঁটেন। দিওয়ালির আগে সহাস্যে পুত্রকে জানান, এবার বাড়ির কাজ তাকেই করতে হবে, মিনুকে দিওয়ালি উপলক্ষে ছুটি দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে হুমকিও দেন যে কাজ না-করলে দিওয়ালির হাতখরচ মিলবে না। অগত্যা রোহন আনাড়ি হাতে ঘর সাফ করার কাজে লেগে পড়ে। কিন্তু অনভ্যাসের ফোঁটা যে কপালে চড়চড় করবেই! মা এসে বলেন ঠিক মিনুর মত হচ্ছে না। ছেলের উত্তর, তাহলে মিনুকে দিয়েই করিয়ে নাও না! ঠিক এই মূহুর্তে মায়ের ডাকে মিনু-র নাটকীয় প্রবেশ। অভ্যস্ত হাতে সে নিখুঁত ভাবে পাখা সাফ করে দেয়।

    এখানেই মিনুর কাজের গুরুত্ব কতটা সেটা মা তাঁর ছেলেকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। মিনুকে দিওয়ালির উপহার আর বখশিশ দেওয়ার সময় রোহন তার নিজের হাতখরচের টাকাও তার সঙ্গে যোগ তো করেই, উপরন্তু তার এতদিনের হ্যালাচ্ছেদ্দার পাত্রী মিনুকে ‘মিনুদিদি’ সম্বোধন করে তাকে যেন ‘অলমোস্ট ফ্যামিলি’ করে তোলে। শেষে আবার আসরে মা। ‘কাম কি অ্যাহমিয়ৎ’ বোঝার আর ‘মন কা ময়েল’ ধুয়ে ফেলার আর্জি জানিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ।

    মিনিটের তিনেকের বিজ্ঞাপনটি জানিয়ে দেয়, কায়িক শ্রমের উপর আমাদের দৈনন্দিন জীবন নির্ভরশীল সেই শ্রমকে মূল্য দেওয়া প্রয়োজন। চোখের আড়ালে যারা ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের রোজকার জীবনে নানান মুশকিল আসান করে দিচ্ছে, তাদের মুখে একটু হাসি ফোটানোর দায়ও যে আমাদেরই, সেকথাও বলে। তার সঙ্গেই গৃহকর্ম যে শুধুই 'মেয়েদের ডিপার্টমেন্ট' নয়, সেই বার্তাটুকুও দিতে ভোলে না। তাই বিজ্ঞাপনটিতে কোথাও বাড়ির কর্ত্রীর সঙ্গে কাজের মেয়ে মিনু এক বিন্দুতে এসে দাঁড়ায়। সংক্ষেপে, গৃহকর্মে মেয়েলি কাজ কিংবা ‘ও তো যে কেউ পারে’ বলে অবহেলা করবেন না।

    তবে, এহ বাহ্য! এর ফলে মিনু বা তার কর্ত্রী কারুরই অবস্থানের কোনো হেরফের ঘটছে না। মিনুর আর্থ-সামাজিক অবস্থান তার জন্য ঠিক করে দিয়েছে অন্যের জন্য কায়িক শ্রম দেওয়ার ভূমিকা, তাই তাকে করে যেতে হবে। তবে খানিকটা সহমর্মিতা সে পেতেই পারে এই যা! আরও লক্ষণীয়, গোটা বিজ্ঞাপনটিতে মিনু প্রায় নীরব, তার হয়ে যুক্তিগুলো পেশ করছেন গৃহিণী স্বয়ং। আবার মনে পড়ে যাচ্ছে একটা পুরনো ছবির কথা। ‘শশীবাবুর সংসার’-এ বাড়ির কর্তা ছবি বিশ্বাস দায়ে পড়ে কাজের লোক খুঁজতে বেরিয়ে হাজির হন গৃহভৃত্যদের এক ইউনিয়নের দপ্তরে। কিন্তু ‘বাড়ির চাকর’ পেতে গেলে ফর্ম পূরণ করতে হবে শুনে কর্তার ক্রুদ্ধ প্রস্থান। আসলে গৃহকর্মকে কেন্দ্র করে পারিবারিক লেনদেনের মূল কাঠামোটা বজায় রেখে কাজের লোকের প্রতি একটু সহানুভূতির ‘লিপ সার্ভিস’ তো দেওয়াই যায়, কিন্তু তা বলে সে যেন নিজের মুখে তার দাবি-টাবিগুলো পেশ না করে!

    যাচাই ক'রে তবে পণ্যে আস্থা রাখার (‘প্যাহলে ইস্তেমাল করেঁ, ফির বিশওয়াস করেঁ) পাঁচপেঁচি স্লোগান থেকে বেরিয়ে এসে ঘড়ি ডিটার্জেন্ট একটু সামাজিক সচেতনতার বার্তা দিল। চেনা গণ্ডীর মধ্যেই যদি কাজের লোকের জন্য আরেকটু মানবিক পরিসর তৈরি হয়, ক্ষতি কী!

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics