• খবরে জেন্ডার - ৭


    1    247

    October 17, 2017

     

    দুর্গাপুজোর ছুটির রেশ কাটিয়ে আবার নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছেন সবাই। যদিও এই সপ্তাহেই আবার কালিপুজো ও ভাইফোঁটার জোড়া ছুটি। প্রতি বছরের মত এবছরেও কলকাতা ও জেলার বিভিন্ন নামী, কম-নামী পুজোর উদ্যোক্তারা নিজেদের মত করে তাক লাগানোর চেষ্টা করেছেন মণ্ডপ, আলোকসজ্জা, প্রতিমার ভাবনা ও সামগ্রিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে। পাঁচ-ছ’ দিন ধরে নামা মানুষের ঢল বছরভরের পরিশ্রমকে করেছে সার্থক। তবু নিছক চোখ ধাঁধানো কারিগরি দক্ষতার বাইরে কিছু পুজো অন্যরকম ভাবনার শরিক হয়েছে। মাতৃরূপের রূপায়নের চেষ্টায় অনেকেই ভাঙার চেষ্টা করেছেন সর্বজনবিদিত প্রচলিত ছক। যেহেতু ব্যাপক অংশের মানুষ এই উৎসবে যোগ দেন, তাই যেকোনো ব্যতিক্রমী ভাবনা জনমানসে সীমিত পরিসরেও প্রভাব ফেলতে বাধ্য। এবারের খবরের জেন্ডারে তাই এমনই কিছু ছকভাঙা প্রচেষ্টার খবর তুলে আনা যাক।

    নলিন সরকার স্ট্রিট সার্বজনীন দুর্গোৎসব

    উত্তর কলকাতার হাতিবাগান এলাকার নলিন সসরকার স্ট্রিট সার্বজনীন দুর্গোৎসবের এই বছরের থিম ছিল ‘মা তুমি কার?’ মনোবিকাশ কেন্দ্রের আদলে তৈরি এই মণ্ডপ মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের অজস্র চিঠি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, যেন তারা মা-কে চিঠি লিখেছে। সেই চিঠি ও ডাকবাক্সের সাথে ছিল অজস্র হাত, যারা কিনা গরাদ ধরে অপেক্ষমান তাদের মায়ের জন্য। দুর্গাপুজো আমরা আপাতভাবে সকলের যোগদানের উৎসব বলে ভাবলেও সমাজের চিরঅবহেলিত এই অংশ কখনোই এই আনন্দের ভাগীদার হয়ে উঠতে পারে না। সেই কথা মাথায় রেখেই এই পুজোর উদ্বোধনেও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন শহরের মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুরা।

    কাঁকুড়গাছি মিতালী সংঘ

    ‘উপাচারে বন্দী’ নামের থিমের মাধ্যমে মিতালী সংঘ তুলে ধরতে চেয়েছিল লিঙ্গবৈষম্যের সেই মূল ধারণাকে—মেয়েদের মা-রূপে আরাধনা করার কথা মুখে বলা সত্ত্বেও আজও সমাজে লিঙ্গসাম্য অধরাই থেকে গেছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের এই বন্দীদশাকেই মণ্ডপে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন শিল্পীরা। অজস্র খাঁচা ও শিকলের মোটিফ দিয়ে তৈরি এই মণ্ডপ দুর্গাপুজোর আনন্দোদযাপনের মাঝেও এই জরুরী প্রশ্নগুলি তুলে ধরতে পেরেছেন।

    হালসিবাগান দুর্গোৎসব

    হালসিবাগান দুর্গোৎসব এই বছর নারী নির্যাতনের বিভিন্ন দিকগুলি তাদের মণ্ডপসজ্জায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল। গার্হস্থ্য হিংসা, ডাইনি সন্দেহে বধূনির্যাতন, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি বিভিন্ন ঘটনাকে চিত্রিত করা হয়েছিল। মূল মণ্ডপে ছিল অজস্র হাতে ভর্তি, যার মাঝে সন্ত্রস্ত দেবীমূর্তি। প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে মেয়েদের উপর চলতে থাকা নির্যাতন এবং পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসনের ভয়াল এবং অস্বস্তিকর দিকটি মণ্ডপসজ্জায় তুলে এনেছিলেন শিল্পীরা, যা একাধারে দর্শকদের ভাবতে এবং প্রশ্ন করতে বাধ্য করে থাকবে।

    কলেজ স্কোয়ার সার্বজনীন দুর্গোৎসব

    এই দুর্গোৎসবের উল্লেখের কারণ কিছুটা ভিন্ন। প্রতি বছরই কলেজ স্কোয়ার দুর্গোৎসব কমিটি কোনো বিখ্যাত মন্দিরের আদলে বিশাল মণ্ডপ তৈরি করে থাকেন। কিন্তু এই বছর কলেজ স্কোয়ারের মণ্ডপ তৈরি হয়েছিল রাজস্থানের রানি সতী মন্দিরের আদলে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই মন্দিরে যাঁর আরাধনা করা হয়, সেই রানি সতী, মতানুসারে যাঁর নাম নারায়ণী দেবী, তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় সহমরণের সিদ্ধান্ত নেন। গোটা দেশে বহু বছর আগে সতীপ্রথার মত বর্বর প্রথা নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আজও রাজস্থানের বিভিন্ন প্রান্তেই রানি সতীকে তাঁর মহান বলিদানের (!) জন্য আরাধনা করা হয়। দুর্গাপুজো প্রথাগতভাবে দেবীশক্তির আরাধনা হওয়া সত্ত্বেও দেবী সতী মন্দিরের আদলে মণ্ডপ বানিয়ে উদ্যোক্তারা ঘৃণ্য সতীপ্রথাকেই মহিমান্বিত করে ফেললেন না তো? সচেতন নাগরিক মহলে এই প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।  

    দুর্গাপুজোয় বিজ্ঞাপনে

    দুর্গাপুজোয় কলকাতা শহর আক্ষরিক অর্থেই শঙ্খ ঘোষের কবিতা হয়ে ওঠে। ব্যানার, ফ্লেক্স, হোর্ডিং-এ শহরকে মুড়ে ফেলে হরেকরকম জিনিসের ছোট-বড় কোম্পানিগুলি। লাখো লাখো মানুষের নজর কাড়ার এই তো সেরা সুযোগ! রাস্তা, পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন কিছুই বাদ থাকে না। এরই মধ্যে কিছু বিজ্ঞাপন প্রচলিত চেনা ছকের বাইরে গিয়ে তোলে নতুন কিছু প্রশ্ন, প্রদীপের তলার আঁধারের মধ্যে থেকে তুলে আনে না দেখা রত্নগুলি। দিনের শেষে সমস্ত বিজ্ঞাপনেরই লক্ষ্য বাণিজ্য হলেও কুরুচিকর বিজ্ঞাপনের ভিড়ে এই হাতে গোনা কাজগুলি অল্প হলেও মন ভাল করে দেয়।

     

    কলকাতার একটি নামকরা গহনা প্রস্তুতকারক সংস্থা এই বছর পুজোর বিজ্ঞাপনে তুলে ধরেছিল কুমোরটুলির তিনজন মহিলা মৃৎশিল্পীর কথা, যাঁরা হাজারো বাধার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও পারিবারিক এই পেশাকে আপন করেছেন, এবং যথেষ্ট দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। মৃৎশিল্পী মালা পাল, চায়না পাল ও কাকলী পালের জীবনের সংগ্রামের কথা তুলে ধরে তাঁদেরকেই এই বছর পুজোয় প্রচারের মুখ হিসাবে নির্বাচিত করে ওই সংস্থা। শহরের বড় বড় হোর্ডিং-এ ভেসে ওঠে এতদিন অবধি খ্যাতির আড়ালে থাকা এই মৃৎশিল্পীদের।

     

    সিঁদুরখেলাকে অনেকেই দুর্গাপুজার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করেন, যেখানে মহিলারা একে অপরকে সিঁদুর মাখিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন। যদিও এই আনন্দে রূপান্তরকামী মহিলা, বিধবা বা তথাকথিত পারিবারিক কাঠামো যেসকল মহিলাদের জায়গা করে দিতে অপারগ, তাদের এই সিঁদুরখেলায় অলিখিতভাবেই প্রবেশ নিষেধ। এই পৃথকীকরণের বিপরীতেই উদ্যোগ নেয় দেশের প্রথমসারির একটি সংবাদমাধ্যম। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, সোহিনী সেনগুপ্ত, গার্গী রায়চৌধুরি এবং মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিজ্ঞাপনে কবিতার মাধ্যমে এতদিন ধরে বঞ্চিত বিভিন্ন স্বরকে তুলে ধরেছেন, এবং সকলকেই আনন্দ উদযাপনে একসাথে শামিল হয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যেকোনো প্রান্তিক গোষ্ঠীর কথা তুলে ধরা, এবং মূলস্রোতের অংশ করতে উদ্যোগী হওয়া প্রশংসার দাবি রাখে। তা সত্ত্বেও সিঁদুর হিন্দু, বিবাহিত এবং সধবা মহিলার marker হিসাবেই প্রচলিত, এবং সিঁদুর খেলাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে ধরা কোথাও সিঁদুরের সাথে যুক্ত এই ধারণাগুলিকেই জোরদার করে প্রতিষ্ঠা করা। প্রশংসার পাশাপাশি উক্ত বিজ্ঞাপনের এই সীমাবদ্ধতাটিও চিহ্নিত করা জরুরী।  

     

     
     



    Tags
     



    1 Comment
    • সবাই পুজো দেখে, সকলে মাতে নতুন ভাবে। কিন্ত আলাপের এই দেখা আর এক নতুন ভাবে চিনতে শেখায় আলোর পাশে অন্ধকারে থাকা তাঁদের যাঁরা প্রকৃত আলোকময়ী-দীপান্বিতা… অসাধারণ বিষয় ভাবনা।

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics