সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবিরোধী উদ্যোগ : আশার আলো ও কিছু প্রশ্ন
3 265
।। ১ ।।
আমি - ‘লেক গার্ডেনসে আছি। মোমিনপুর কীভাবে যাবো?’
সাবিরদা - ‘অটো ধরে তারাতলা চলে এসো। ওখান থেকে মোমিনপুরের বাস পেয়ে যাবে।’
আমি - ‘মোমিনপুরে নেমে কোথায় আসতে হবে?’
সাবিরদা - ‘নেমে কাউকে জিজ্ঞেস কোরো হোসেন শাহ পার্ক, দেখিয়ে দেবে। পার্কের সামনে এসে একটা ফোন কোরো।’
গত ২১শে মে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উদ্যোগ’-এর উদ্যোগে সন্ধ্যাবেলা একটি আলোচনাসভার আয়োজন করা হয় মোমিনপুরের হোসেন শাহ পার্কের লাগোয়া বাড়ির উঠোনে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা, মসজিদের ইমাম, রাজনৈতিক কর্মী, এবং শহর ও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিভিন্ন পেশার জনা তিরিশেক মানুষ; কেউ সরকারী কর্মচারী, অধ্যাপক, রাজনৈতিক কর্মী, সমাজকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী প্রমুখ। আমার মতো এঁদের মধ্যে অনেককেই ফোনে মোমিনপুর আসার উপায় বাতলে দিয়েছিলেন সাবিরদা, সাবির আহমেদ। এই আলোচনাসভার অন্যতম উদ্যোক্তা, প্রতীচী ট্রাস্টের সাথে যুক্ত গবেষক এবং ‘এবং আলাপ’-এর সদস্য। কিন্তু কেন? কেন আমরা জানি না মোমিনপুর কীভাবে যেতে হয়? শিয়ালদহ থেকে গার্ডেনরিচ যায় কত নম্বর বাস? পার্ক সার্কাসে একটা আস্ত ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস আছে জানি? না, জানি না। কারণ এই জায়গাগুলোয় কখনও যাইনি, যাওয়ার দরকার পড়েনি। তাই খিদিরপুর, মোমিনপুর, মেটিয়াব্রুজ কখনও বালিগঞ্জ, গোলপার্ক, যাদবপুর হয়ে ওঠেনি আমাদের কাছে।
আলোচনার শুরুতে সাবিরদার গলায় এই অপর হয়ে যাওয়ার অভিমান সুক্ষ্ম আকারে হলেও ফুটে ওঠে। সাম্প্রতিককালে দেশে তথা রাজ্যে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাপরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলের সচেতন মানুষ প্রতিবাদ করেছেন, পথে নীমে মিছিল করেছেন, প্রচার অভিযান চালিয়েছেন। কিন্তু চেনা অ্যাজিটেটিভ ফর্মগুলোর থেকে এই ‘এসো কথা বলি’ শীর্ষক উদ্যোগ যে অনেকটাই আলাদা, তা শুরুতেই স্পষ্ট করে দেন উদ্যোক্তারা। বক্তা-শ্রোতার চেনা গণ্ডি ভেঙে গোল করে বসেন সকলে, যাঁরা একাধারে বক্তা এবং শ্রোতা। স্থানীয় বাসিন্দা এবং আগত অতিথিরা সকলে ভাগ করে নেন তাঁদের অভিজ্ঞতা, আশঙ্কা ও আশার কথা। আকাশে ক্রমশ অন্ধকার ঘনিয়ে এলেও এক নতুন সম্ভাবনার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আলোচনাসভা। ‘এসো কথা বলি’ উদ্যোগ আরও বেশি করে আয়োজনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন সবাই। পুরনো পড়শিকে নতুন করে চেনার আনন্দ বুকে আঁকড়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরেন সকলে।
।। ২ ।।
২১শে মে-র আড্ডাতেই স্থির হয়েছিল রমজান মাসে কোনও এক সন্ধ্যায় মিলিত হবেন সকলে, একসাথে পালন করা হবে ইফতার। সেই মত ১১ই জুন খিদিরপুরে আয়োজন করা হয় ‘দোস্তি কি ইফতারি’ অনুষ্ঠানের। আড্ডা, আলাপ-আলোচনার পাশাপাশি ইফতারে অংশগ্রহণ করা, এবং পড়শির ধর্মীয় আচার সম্পর্কে অজ্ঞতা দূর করে আরও কাছাকাছি আসা – এই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। এবারের উদ্যোগের আয়োজনে ছিল স্ন্যাপ, এইমস ও রাইট ট্র্যাক নামে তিনটি সংগঠন। ‘এসো কথা বলি’-র এই দ্বিতীয় উদ্যোগে আগেরবারের মত হাজির ছিলেন অধ্যাপক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, স্থানীয় বাসিন্দারা। আলোচনার পাশাপাশি খিদিরপুরের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিয়ে চারজন তরুণ ফটোগ্রাফারের ছবির প্রদর্শনীও আয়োজন করা হয়। আয়োজকরা বছরের শেষে ‘খিদিরপুর ফেস্টিভাল’ করার ইচ্ছাপ্রকাশ করে আলোচনা শেষ করেন। প্রতিবেশীর উৎসবে অংশগ্রহণের তৃপ্তিটুকু সাথে করে বাড়ি ফেরেন সকলে।
।। ৩ ।।
‘দোস্তি কি ইফতারি’-র পর সকলে আমরা যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আয়োজকরা ব্যস্ত ছিলেন কলকাতার বাইরে এইধরনের উদ্যোগ আয়োজনের প্রস্তুতিতে। এরই মধ্যে এগিয়ে আসছিল খুশীর ঈদ। শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায় ব্যস্ত মানুষজন। এরই মধ্যে একটা খবর এল হরিয়ানা থেকে। দাদা ও বন্ধুদের সাথে ঈদের জামা কিনে ফেরার সময় ছুরির আঘাতে খুন হয়েছে ১৬ বছরের হাফিজ জুনেদ, ব্যস্ত অসাওতি স্টেশনে। ক্রমশ দেশজুড়ে বাড়তে থাকা আকলাখদের তালিকায় নতুন নাম সংযোজিত হল জুনেদের। নিত্যযাত্রীরা পাশ কাটিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা লাগালেন, প্ল্যাটফর্মে রক্তের দাগ শুকোতে লাগল, স্টেশনমাস্টার বললেন তিনি কিছুই দেখেননি।
কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ না দেখে থাকতে পারলেন না। ঈদের মাত্র কয়েকদিন আগে দেশজুড়ে নেমে এল শোকের আবহ। তথ্যচিত্রনির্মাতা সাবা দেওয়ানের একটি ফেসবুক পোস্ট দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিক্ষিপ্ত ক্ষোভকে একসূত্রে গাঁথে। এপ্রিলে পেহলু খান ও জুন মাসে জুনেদের হত্যার প্রতিবাদে দিল্লির নাগরিকদের একজোট হওয়ার ডাক দেন সাবা। এই ডাকে একে একে সাড়া দেয় দেশের বিভিন্ন শহর। রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রশ্রয়ে সংখ্যালঘুদের উপর বেড়ে চলা হিংসা তাঁদের নামে চালানোর প্রতিবাদে #NotInMyName স্লোগানকে সামনে রেখে ২৮ জুন দেশের বিভিন্ন শহরে মিলিত হন নাগরিকেরা। দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, ব্যাঙ্গালোরের প্রতিবাদসভা খবরের কাগজে সবার আগে জায়গা করে নিলেও পাটনা, লখ্নৌ, তিরুবনন্তপুরম, জয়পুরেও নিজেদের মত করে গানে, কবিতায়, স্লোগানে, পোস্টারে প্রতিবাদ ব্যক্ত করেন মানুষ। লখ্নৌতে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, ব্যবসায়ী এবং আর বিভিন্ন পেশার মানুষ হাতে কালো ব্যাজ বেঁধে প্রতিবাদে সামিল হন। কেরালার ত্রিবান্দ্রামে সেক্রেটারিয়েটের সামনে বিকেল পাঁচটায় প্রায় ২০০ জন মানুষ সমবেত হন এবং গোটা দেশে গোরক্ষার দোহাই দিয়ে যে হিংসার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে তার প্রতিবাদ করেন। ত্রিবান্দ্রামের প্রতিবাদসভায় সাবিত্রী রাজীবন, আয়াপ্পা পানিক্কর, বিচ্চু থিরুমালা, ফৈজ আহমেদ ফৈজের কবিতা পাঠ করে মানুষ হিংসা ও সঙ্কীর্ণতার উর্ধে এক ঐক্যবদ্ধ সমাজের ভাবনা তুলে ধরা হয়। পাটনায় গান্ধী ময়দানের কারগিল চকে সাধারণ মানুষ প্ল্যাকার্ড, পোস্টার হাতে নীরব প্রতিবাদ ব্যক্ত করেন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আইপিটিএ-এর পক্ষ থেকে একটি পথনাটকও অভিনীত হয়। পশ্চিমবঙ্গেও ২৮ জুন কলকাতার পাশাপাশি শান্তিনিকেতনেও ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা তাঁদের প্রতিবাদ জানাতে সমবেত হন। ২৮শে জুনের পর বহরমপুরে ৫ জুলাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে স্কোয়ার ফিল্ডের চারদিকে মিছিল করেন সাধারণ মানুষ।
পুলিশের অনুমতি পেতে দেরি হলেও অবশেষে ৮ জুলাই গুজরাতের আমেদাবাদে সেখানকার সাধারণ মানুষ নেহরুনগরে রানি ঝাঁসির মূর্তির কাছে মিলিত হন। প্রতিবাদসভায় উপস্থিত ছিলেন উনা দলিত আন্দোলনের মুখ জিগনেশ মেভানি এবং আরও বিভিন্ন সমাজকর্মী, শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীরা।
।। ৪ ।।
সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে নিত্যনৈমিত্তিক করে তোলার অপচেষ্টার বিপ্রতীপে আমাদের কাছে আশার আলো ‘এসো কথা বলি’-র মত উদ্যোগ, যা খুব ছোট পরিসরে হলেও, এই মেরুকরণের প্রক্রিয়াকে সমূলে উৎখাত করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এই লেখাটি লেখাকালীনও দক্ষিণবঙ্গের একপ্রান্ত ক্রমশ এই মেরুকরণের প্রকোপ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভোজপুরি সিনেমার দৃশ্য, ২০০২-এর দাঙ্গার ছবিকে বসিরহাটের ছবি বলে প্রচার করা হচ্ছে। মেরুকরণের এরকম কয়েকটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও অধিকাংশই যে সফল, তা বাসে-ট্রামে কান পাতলেই বোঝা যাচ্ছে।
দাঙ্গার পরিবেশ যেকোনো জায়গায় আপাতভাবে হঠাৎ শুরু হয় বলে মনে হলেও, তার কাঠখড় অনেককাল আগে থেকেই মজুত করা হয়, ফুলকি সফল হলে তখনই তা খবর হয়। সেই কারণেই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এই আদানপ্রদানের আপাত ফল চাক্ষুষ না হলেও এর প্রভাব হতে পারে দীর্ঘসূত্রী। যদি আমরা প্রতিবেশীকে জানার এই উদ্যোগকে, বা এইধরনের যেকোনো উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, প্রতিবেশীকে চেনার সুস্থ, মানবিক উদ্যোগকে কোনও আয়োজনের পর্যায় থেকে অভ্যাসে পরিণত করতে পারি, তাহলে সেটাই দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। শান্তিমিছিল বা প্রতিবাদ অবশ্যই জরুরি, কিন্তু শুধু প্রতিক্রিয়া জানানো ছাড়া আর কি সদর্থক উদ্যোগ নেওয়া যায়, তা ভেবে দেখা আশুপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। গোরক্ষার রাজনীতি শুধুমাত্র জাতীয় স্তরে এক ভীতির বাতাবরণ তৈরি করছে তাই নয়, সমান্তরালে ঘটে চলা আরও অনেক ঘটনাক্রম থেকে সফলভাবে আমাদের চোখ সরিয়ে দিচ্ছে। দেশের এক নাগরিককে মানবঢাল হিসাবে ব্যবহার করে জিপে বেঁধে টহল দেওয়া, আত্মহত্যায় মৃত কৃষকদের খুলি ও হাড় নিয়ে প্রতিবাদ, বস্তারে একের পর এক মানবাধিকার সংগঠনগুলির প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি ঘটনা কখনই জাতীয় স্তরের জনমানসে আলোড়ন তুলতে পারেনি। প্রতিবাদের ভাষা বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্নই রয়ে গেছে। কেন আমাদের স্বর ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি, সেই প্রশ্নের উত্তর আমাদের সকলকে একসাথেই খুঁজতে হবে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিভিন্ন উদ্যোগগুলি নেওয়ার পাশাপাশি। ফের কোথাও কোনও দাঙ্গাপরিস্থিতি তৈরি হওয়ার অপেক্ষা করলে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Comments (3)
-
-
সুদীপ,
ভালো লিখেছো। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা উত্থাপন করেছো। -
প্রতিবেশী মানে তো এক অর্থে ভাই। তা ভাইকে জানার জন্যও ঘটা করে আহ্বান করতে হচ্ছে। দুর্দিন কতখানি এগিয়ে এলে অবস্থা এমনতর হয় তা বলতেলে বোঝাতে হবে না। সত্যিই পারস্পরিক বিশ্বাসের স্তর হঠাৎ করে একধাপে অনেকখানি নেমে গেছে। কিন্তু না, হঠাৎ করে নয় দীর্ঘদিনের অবহেলায় আর অল্প কয়েকদিনের কিছু (অ ) মানুষের কপটতায়। নিজের মায়ের পেটের ভাইও আজ অনেক দূরের। প্রতিবেশীকে জানুন তাই এক অতি জরুরি উদ্যোগ। বাঁচ। হ্যাঁ, অবশ্যই সুস্থভাবে বাঁচতে।
Leave a Reply
-
এই উদ্যোগটাকে আরো বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে…আরও অনেক ভাবনাও আছে…