ওদের কাশবন ফুলে ভরে উঠুক
5 265এক বিপর্যস্ত সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা হাটঁছি।এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে একদিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়ে প্রশ্ন-তোলা মানুষেরা খুন হচ্ছেন, আরেক দিকে পাড়ায় পাড়ায় দাঙ্গা বাধানোর অপচেষ্টা অব্যাহত।এরই মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মেয়েরা দৈনন্দিন রুটিরুজির লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।কীভাবে?একটু খতিয়ে দেখা যাক।
আড্ডা হচ্ছিল লক্ষীকান্তপুরের সেলিনা, পার্কসার্কাসের পরভিন, রাজাবাজারের ইসমত, বহরুর মমতাজ, মল্লিকপুরের আমিনাদের সঙ্গে।প্রত্যেকেরই বয়স ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে। এই পরিবর্তিত সময়ে দাঁড়িয়ে তাদের অভিজ্ঞতা কী? কোনো অসুবিধে? কোনো বিপত্তি? নাকি সবকিছু যেমন চলছিল তেমনই চলছে? মোটেই না। পরিবর্তন হয়েছে বৈকি! লক্ষীকান্তপুর লোকালে উঠলে পরিবর্তন টের পাওয়া যায়। সেলিনার সুবিধে হল সে বোরখা পরে না। পোষাক-আসাকে সে হিন্দু না মুসলিম বোঝার উপায় নেই। অতএব তাকে হিন্দু ধরে নিয়েই সহযাত্রীরা ঘৃণার বিষ ছড়ায় রেলগাড়ি জুড়ে। ভীড়ের জন্য সে প্রায়ই যাত্রী কামরায় না উঠে মালবাহী কামরায় ওঠে। এই সেদিনও, ঈদের আগের দিন, সে মালবাহী কামরায় উঠেছিল। হঠাৎ রেলগাড়িতে ফিসফিসিয়ে ধমকি এল, ‘মোল্লারা মাংস নিয়ে উঠতে চাইলে, মোটে উঠতে দিবি না’। কে বলছে? কে বলছে এমন কথা? অনেকেই বলছে এবং সত্যিই পার্ক সার্কাস থেকে মাংস নিয়ে সেদিন ট্রেনে উঠতে দেওয়া হয়নি মুসলমান ব্যবসায়ীদের।
আমিনাও বোরখা পরে না। সালোয়ার কামিজ, জিন্সের প্যান্ট আর ফ্যাশনেবল টপ প’রে আমিনা কলকাতায় গাড়ি চালানো শিখতে আসে। অদ্ভুত ব্যাপার হল, একটু আধুনিক পোষাক পরলেই মেয়েদের আর মুসলমান ভাবে না ট্রেনের সহযাত্রীরা। সেলিনা, আমিনাদের হিন্দু ধ’রে নিয়ে তাদের সামনেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা উগরে দেয় হিন্দু দিদিমণিরা।
জিজ্ঞেস করি, কি ধরণের ঘৃণা? সে কি আর একরকম? নানা ধরণের ঘেন্না, ব’লে ওঠে ওরা সমস্বরে। মল্লিকবাজারের কাছে একটি বড় শিশু হাসপাতাল আছে। সেখানে যাওয়ার জন্য বাচ্চা কোলে গাঁগঞ্জের মুসলমান মেয়েরা ট্রেনে ওঠেন। ওদের দেখলেই ইস্কুলের দিদিমণিরা নাক সিঁটকান। ইস কি নোংরা! গায়ে নিশ্চই গন্ধ! গজগজ করতে থাকেন নিত্যযাত্রীরা, ‘মোল্লানিরা দুনিয়ার বাচ্চা নেবে আর হাসপাতালে যাবে! নার্সিংহোম যাওয়ার টাকা নেই, নোংরা, গায়ে গন্ধ!’ হ্যাঁ, মুসলমান মেয়েদের নাকি ব্যঙ্গ ক’রে ‘মোল্লানি’ ডাকে রেলগাড়ির নিত্যযাত্রীরা। আরও আছে। পাছে তারা পাশে বসেন, তাই ট্রেনের জানলা দিয়ে মুসলমান মেয়েদের দেখলেই সিট দখল ক’রে নেয় সহযাত্রীরা। সেলিনাদের যেহেতু পোষাক দেখলে মুসলমান বোঝা যায় না, তাই অ্যাডভোকেট দিদিমণি ওদের বলে, ‘তোমরা ব’সে পড়ো তাড়াতাড়ি, ওরা ওঠার আগে।’ মনে মনে হাসে সেলিনারা। সুখের হাসি নয়, বিষাদের হাসি।
পরভিন, রুকসানার বাড়ি শহরের মধ্যেই। পরভিন বলে, ওদের পাড়ায় মসজিদের সামনে একটা ভ্যাট(জঞ্জাল ফেলার জায়গা)আছে। এবছর বকরি ঈদের কদিন আগে হঠাৎ সেখানে কারা যেন এসে মন্দির তৈরীর উদ্যোগ নেয়। সে নিয়ে কি ঝামেলা! মা তো তারপর পারভিনকে কিছুদিন বাড়ি থেকে বেরতেই দেয় নি। রুকসানার গলায় গলায় বন্ধু যে মেয়েটি সে হল ধর্মে হিন্দু। আগে রুকসানা নিয়মিত বন্ধুর বাড়ি যেত। কিন্তু ইদানিং বন্ধুর মায়ের ব্যবহারে কেমন যেন পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। গায়ে মাখেনি রুকসানা। কিন্তু একদিন কাঁচুমাচু মুখ ক’রে ওর বন্ধুই বলল, ‘বাবা-মা চায় না তুই আমাদের বাড়ি আসিস। তোরা নাকি গরু খাস’! শুধু রুকসানার বন্ধুর বাবা-মা নয়, আশপাশে অনেকেই নাকি ওদের নাক কুঁচকে বলে, ‘এ্যাই, তোরা নাকি গরু-মোষ খাস? ইশ! কি ক’রে খাস রে?’ সেলিনার রাগত উত্তর, ‘আচ্ছা দিদি, আমরা গরু না খেলে কিভাবে ওরা জুতো, ব্যাগের চামড়া পাবে? কবে ভাগাড়ে একটা গরু মরবে, সেই অপেক্ষায় তো ওদের থাকতে হবে!’
সেলিনার কথা শুনে চোখে জল এল। নিজেদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে কি বিড়ম্বনায় পড়েছে বেচারীরা! যে খাবার ওদের কাছে মহাভোজ, আমাদের নবমীর বলির পাঁঠা খাওয়ার মত ফূর্তিতে, কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার কথা, আজকের অঘোষিত হিন্দু ভারতে সেই খাবার ওদের মুখে তুলতে হচ্ছে লুকিয়ে, অপরাধীর মত। শুধু খাওয়া দাওয়া কেন, নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই আজ এদেশে সন্ত্রস্ত, জড়সড় সাধারণ মুসলমান মানুষ, নির্দিষ্টভাবে মেয়েরা। এমনিতেই রাস্তাঘাটে, স্কুল-কলেজে, অফিস-কাছারিতে মুসলমান মেয়ে খুঁজে পাওয়া ভার। তার মধ্যে আবার এই অপমান, ভয় মাথায় নিয়ে কোন মেয়ে কলেজে পড়তে যাবে? পারভিনের মা যেমন পাড়ায় দাঙ্গার সম্ভাবনার পর থেকেই পারভিনকে বেশি বেরতে দিতে চান না, একটু ফিরতে দেরি হলেই চিন্তা শুরু করেন। মেয়েরা প্রত্যেকেই বললেন, বাড়ি থেকে বেরনো নিয়ে পরিবারের নজরদারী বেড়েছে হালে।
এখানেই চিন্তার কথা। বাড়ি থেকে না বেরলে আমিনাদের বিকাশ কিভাবে হবে? তারা লেখাপড়া শিখবেন কীভাবে? তারা রোজগার করবেন কীভাবে? আনন্দ ফূর্তিই বা করবেন কেমন ক’রে? মেয়েদের, সে যেকোনো ধর্মেরই হোক না, গতিবিধিতে নিয়ন্ত্রণই তাদের খাটো ক’রে রাখার প্রধান অস্ত্র। তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার ভয় এই নিয়ন্ত্রণকে ক’রে তোলে দ্বিমাত্রিক। মুসলমান মেয়েরা যখন পথেঘাটে চলাফেরা করেন, তখন আর সব ধর্মের মেয়েদের মত একদিকে মেয়ে ব’লে তাদের বুকের কাছে ফাইল ধ’রে পথ হাঁটতে হয়, অন্যদিকে মুসলমান মেয়ে ব’লে তাদের ধর্মীয় চিহ্ন লুকিয়ে চলতে হয়, অথবা ধর্মীয় পরিচয়ের ভার নিয়ে পথ চলতে হয় বিড়ম্বিত পদক্ষেপে।
চা, চানাচুর আসে আসরে। চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করি, আগেকার সঙ্গে এখনকার, মানে এই বছর দু-তিনেকে অবস্থার আর কিছু বদল টের পাও? কথা বলতে শুরু করল মমতাজ। মমতাজ আসে দক্ষিণ ২৪ পরগণার বহরু থেকে। বহরু শুনেই আমি নড়েচড়ে বসি। বহরু আমার একাধারে মাতৃভূমি ও পিতৃভূমি। আমাদের দেশ। ঐ গ্রামেই আমার বাবা-জ্যাঠা হায়দরদা-র (আদরের নাম হৈদরদা)কোলেপিঠে বড় হয়েছেন, আমার মায়ের প্রথম দোল খেলা ঐ গাঁয়ের বোসেদের দোলমঞ্চে। আমার জেঠুর কবিতায় বারেবারে উঠে এসেছে এই গ্রামের মানুষজন, গাছগাছালি, দোখনো শব্দবন্ধ। আমার দাদামশায়ের মূর্তি আছে এই গ্রামের স্কুলে। এককালে ঐ গ্রামেরই ফুটবল মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছে আমার মামা আর তার প্রাণের বন্ধু মিয়াজুদ্দিন শেখ, মায়ের মিয়াজদা। ছোটবেলায় ঠাকুমার সঙ্গে কত গেছি দেশের বাড়ি। অতএব বহরু শুনে আমি উদ্বেলিত হব বৈকি! ক্ষীণ আশা নিয়ে মমতাজকে জিজ্ঞেস করি, বহরুর কি খবর? মমতাজ ব’লে চলে, ‘আমাদের গ্রামে, দিদি, আগে আমরা আলাদা ক’রে মনেই রাখতাম না যে আমরা মুসলমান। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। এবছর ঈদের আগে, থানা থেকে খবর এসেছিল, মহল্লায় কতগুলো গরু মরছে, তার খবর থানায় জানিয়ে আসতে হবে। সে নিয়ে পাড়ায় কি উত্তেজনা’। মমতাজ বলে, এসব তাদের মোটে ভাল লাগে না। সমস্বরে ওরা বলে ওঠে, আমরা মানুষ, আমরা তো সবাই সমান। আমাকে প্রশ্ন ক’রে, ‘কেন এরকম হচ্ছে এখন? মোদী কি সব মুসলমানকে হিন্দু ক’রে দিতে চাইছে, দিদি’?
আমাদের আলাপচারিতা ক্রমশ ভারী হ’য়ে উঠছিল। একটু মজা করার জন্য জিজ্ঞেস করি, কি রে পুজোয় কি প্ল্যান? একগাল হাসি সেলিনাদের। কেউ কিনেছে প্লাজো তো কেউ কিনেছে ল্যাহেঙ্গা। ঈদে ওদের দু’-তিনটে ক’রে নতুন জামা হয়। একটা ঈদে পরে, বাকিগুলো রেখে দেয় পুজোর জন্য। পুজোয় সারা রাত ঠাকুর দেখার প্ল্যান সবার। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে আড্ডা মারার, রোল খাওয়ার, ফেসবুকে ছবি আপলোড করার সুখস্বপ্নে ওরা মাতোয়ারা। জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না, দুর্গা তো হিন্দুর দেবী, তোরা তো মুসলমান...
ওদের পুজো ভালো কাটুক। ওদের কাশবন ফুলে ভরে উঠুক।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Comments (5)
-
-
ধর্ম নামক এই বিষবৃক্ষের বাড়বাড়ন্ত আর ভালো লাগেনা……. সকলের কাশবন হেসে উঠুক উৎসবের আনন্দে!!!!
-
রাজনৈতিক কারণেই ধর্মকে জিইয়ে রাখা হয়
-
আমার এক প্রিয় অনুজ বন্ধুর বাড়িতে গরুর মাংস ঢোকে না। ও খায়ও না। কিন্তু সবাই ধরেই নেয় যে বকরি ঈদ এ ওদের বাড়িতে গোস্ত হবেই। মাংস হয়, কিন্তু সেটা পাঁঠার মাংস। এবারে ওদের বাড়িতে অনেকটা মাংস বেঁচেছিল, রান্নাটাও জবরদস্ত হয়েছিল কিন্তু ওকে বাড়ি থেকে কিছুতেই আনতে দিল না। ট্রেনে করে আসবে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে…কোন প্রাণে বাবা মা সাহস করে আনতে দেন টিফিন বক্সে করে বাড়িতে রান্না মাংস? মেয়েটা শহরে এসে মায়ের হাতের রান্না দু একদিন রেখে খেত, খাওয়াত বন্ধুদের …তা আর হল না। অন্যবার হলে এই নিয়ে কত কথা বলতাম ওকে- না আনার জন্য যাচ্ছেতাই করতাম…কিন্তু যে স্নেহজাত অধিকারে সেই ‘যাচ্ছেতাই’ করতে পারি…সেই স্নেহজাত শঙ্কাতেই এবারে চুপ করে থাকতে বাধ্য হলাম আর শুধু বললাম, হ্যাঁ মা বাবাকে আর দোষ দিই কি করে বল?… মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগে শোনা ফারহার কথা। ওকে এমনকি টিফিন বক্সে করে রুটি তরকারিও আনতে দেন না এখন মা -বাবা। বিশেষ করে গত ঈদ এ জুনেইদ কে পিটিয়ে মেরে ফেলার পর থেকেই এই আতংক চেপে বসেছে সবার মধ্যে। আমার ১৩ বছরের ভাইঝি স্কুলে ওর বন্ধুর সঙ্গে এমনি গল্প করতে করতে নিজেদের পছন্দ অপছন্দ মেলাতে মেলাতে জিজ্ঞেস করেছে ‘তোর কিসের মাংস খেতে ভাল লাগে? আমার তো চিকেন’…আর উত্তরে বন্ধুটির অস্বাভাবিক রেগে যাওয়া দেখে ও হতভম্ব হয়ে যায়। ও কি করে জানবে যে আজকের ভারতে ও আর ওর বন্ধুর কোন মাংস ভাললাগের মত আপাত নিরীহ আর নির্দোষ প্রশ্ন এখন কি ভীষণ আতঙ্কের চোরা স্রোত বইয়ে দেয় ওর সেই বন্ধুর শিরদাঁড়ায়…কারণ তাঁর ধর্মের নাম ইসলাম, সে মুসলমান… এ থেকেই তো বোঝা যায় যে কি পরিস্থিতি সৃস্টি হয়েছে এই বন্ধু, বোনের মত, ভাইঝিপ্রতিম, কন্যাসম ছেলে মেয়েগুলোর! তবু এরা পুজোয় নতুন জামা কিনবে, এগরোল খাবে, হৈ হৈ করবে, হাসবে… করুক… কাশফুলকে হার মানিয়ে দিক ওদের ঝকঝকে দাঁতের সারি…যাবতীয় সাম্প্রদায়িকতাকে হারিয়ে দিক ওদের আর আমাদের একজোটে একসুতোয় বেঁচে থাকা আর দৈনন্দিন জীবনযাপন। দোলন দি… তোমাকে আর সেলিনা, মমতাজ, আমিনাদের অনেক ভালবাসা আর শুভেচ্ছা জানালাম। এতকিছুর পরেও যে ওদের মনে ঘৃণার বদলে ভালবাসার ঠাঁই রয়ে গেছে… সেই ভালবাসাকে আমার কুর্নিশ। জানিয়ে দিও।
-
খুব সুন্দর লেখা। কোথায় চলেছি আমরা! কেমন করে রুখবো এই ঘৃণার বিষবৃক্ষের বাড়বাড়ন্ত? বড় অসহায় লাগে!
Leave a Reply
-
পরিস্থিতি ক্রমশঃ আরও বদতর হবে এ বিষয়ে মাশাল্লাহ্ কারুর কোনো রকম সন্দেহের গুঞ্জাইশই নেই!
কাদের ভারত,কবে মহান হবে,এসব প্রশ্নের উত্তর নীল আকাশ ছোঁয়া কাশবনের দোলায় লুকিয়ে আছে।যেদিন সলমা চুমকি বসানো জরদৌসী রাতের আসমানে ও গিয়ে ঈদের চাঁদকে বলবে,মুবারক হো” ওমনি ছুটির বাঁশীর সুর লাগবে ঢাকের কাঠিতে।
কি জানি চুমকিদি…….কবে।
তোমার কলম আরও লিখুক।ভালবাসা।