• একটি ক্ষমতায়নের আখ্যান


    0    139

    May 25, 2018

     

    বয়স্কদের বাজার নিম্নগামী৷ তারা অনাধুনিক, রক্ষণশীল, হিংসুটে ও ক্রোধতাড়িত৷ তারা ভালবাসার বিরোধী৷

    আদর ও চুমু বিরোধী৷ তাদের জোটে না তাই তারা খিঁচিয়ে আছে!

    রামগড়ে দুষ্টু বাচ্ছাকে শান্ত করতে মা বলতেন 'ঘুমিয়ে পড় নয়ত গব্বর আসবে!'

    আজ চুম্বনরত যুগলকে ফচকে বন্ধু বলছে 'চুমু মৎ খা! বুঢঢা আয়েগা!'

    অন্যদিকে কমবয়সীরা আধুনিক, প্রগতিশীল, উদার ও শান্তিপ্রিয়৷

    এই গোলমেলে বাইনারী আপন করেছে সমাজ৷ সে নতুন কিছু না৷ গোলমেলে বাইনারি সহজপাচ্য৷ জনতা জনার্দন চিরকাল সহজপাচ্যকে ভালোবেসেছে৷ যা কিছু জটিল তাই এলিট! আর এলিট মানেই শ্রেণীশ্রত্রু, এ কে না জানে? আমি মেনোপজীয় নারী অবিশ্যি এঁটে উঠতে পারছি না এই বাইনারির সাথে! চোখে পড়ে যাচ্ছে অনেক গন্ডগোল! ঐ যে আধুনিক ছেলেটি প্রকাশ্যে তার বান্ধবীর ঠোঁটে ঠোঁট, জঙ্ঘায় হাত, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তার কব্জিতে রঙ ওঠা লাল সুতো, আঙুলে ধারণের আংটি!

    যে মেয়েটি আমার মেনোপজড মুখের দিকে করুণার দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে তার আদর-প্রত্যাশী স্তন নিবেদন করছে প্রেমিকের উদগ্রীব থাবার কাছে, তার কূর্তির হাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে মাদুলি ও মন্ত্রপূত শিকড়ের অমোঘ কম্বিনেশন! এরা আধুনিক? দু'দিকে মাথা নাড়ি, তলিয়ে যাই হতভম্ব!

    আমি বেড়ে উঠেছি সেই সাতের দশকে যখন গড়পড়তাকে প্রশ্ন করায় ছিল আমাদের আধুনিকতার প্রকাশ! আমাদের চারপাশে তখন সেই সব কাকুরা যারা ক্রমাগত বলে চলেছিলেন, সমাজে অসাম্যই আসলে সবচেয়ে অশ্লীল! সেইসব কাকুদেরও হাত উঠত বৈকি! হাতে উঠত ভয়ঙ্কর অস্ত্রও! তবে তা ছানাপোনাদের বিরুদ্ধে নয়! সিস্টেমের বিরুদ্ধে! কাকুদের আকুতি ছিল অসাম্যের বিরুদ্ধে৷ আদরের বিরুদ্ধে নয়!

    সময় পাল্টে যায়৷ সেই সময়ের সেই ছানাপোনারাই আজকের বয়স্করা! আমরাই এখন জায়গা পেয়েছি ঐসব প্রৌঢ়দের দলে! আমরাই আজ হয়েছি কাকুর দল!

    অবাক হয়ে 'আজকের কাকুদের' দেখি আর ভাবি 'কোথায় গেল কাকুগুলো সব?'

    'Where have all the flowers gone?'

    পিট সিগারের বিলাপ হারিয়ে যাওয়া ফুলের দলের দলের জন্য, বিয়ে হয়ে যাওয়া যুবতীদের জন্য, অযথা যুদ্ধে মৃত তরতাজা যুবকদের জন্য আর শেষ হাহাকার ঐ শহীদ বেদীতে শ্লেষের মতন ছড়িয়ে থাকা ফুলগুলোর জন্য! আপাত দৃষ্টিতে যুদ্ধ-বিরোধী এই গানেও লেগে গেছিল সে যুগের হাওয়া৷ সে হাওয়ায় যুবতী নারী অন্য পুরুষের স্ত্রী হয়ে হাতছাড়া হয়ে যায়! আর যুবক পুরুষ জীবন খোয়ায় এস্টাব্লিশমেন্টের হয়ে যুদ্ধে গিয়ে! বাইনারি, বাইনারি! তা সে যাক! হচ্ছিল মেনোপজের কথা, চলে এলাম বহুদূর! কাকু হয়েছি, এইটুকু ভীমরতি তো সইতেই হবে!

    চল্লিশের মাঝামাঝি এসে মাঝেমধ্যে একটা শঙ্কা উঁকি দিত মনের মাঝে! মেজোপজের শঙ্কা! হরমোন হরমোন, তোমার মন নাই? কেন ছেড়ে যেতে চাও মোরে? তুমি ছেড়ে গেলে কী লইয়া বাঁচিব? আমার মতন নাস্তিকের তো রামনাম বা কৃষ্ণনাম জপে মন উঠবে না! যে যৌনতার অপার Stress release তাতেও কি পড়বে না দাঁড়ি?

    দিন যায়৷ এই বছরের প্রথম মাসে তিনি অদৃশ্য হলেন! আমি কাকু হলেম৷

    'বন্ধু তিনদিন তোর বাড়িতে গেলাম দেখা পাইলাম না' কেস বলা যেতে পারে! ডেট মনে রাখার দায়িত্ব নেই! ব্যাগের ভিতর স্যানিটারি ন্যাপকিন নেওয়ার ঝক্কি নেই, কেরালায় বেড়াতে গিয়ে পুরুষের ইউরিনালে ঢুকে ঘামতে ঘামতে প্যান্টিতে তিনটে রুমাল দিয়ে টেম্পোরারি অ্যারেঞ্জমেন্টের দায় নেই! সেবার হরমোন চুক্কি দিয়েছিল, একদিন আগে চোখ মটকে গোল খাইয়ে দিয়েছিল৷ আমি ছিলাম অপ্রস্তুত!

    একদিক দিয়ে দেখতে গেলে দায়মুক্ত৷ কিন্তু তবু মনে জাগে হাহাকার! তাহলে কি সব শেষ হয়ে গেল? ওয়াক্ত নে কিয়া ক্যায়া হাসি সিতাম, তুম রহে না তুম! হম রহে না হম?

    প্রতিদিন ঘুম ভাঙতে লাগল 'সে কি এল! সে কি এল না!' ভাবনায় ডুব দিয়ে মন লাল বলে!

    দিনের প্রথম জলত্যাগের সময় সে কি হাপিত্যেস দৃষ্টি! ঐ বুঝি দেখা যায় উষার সোনার বিন্দু! ও সোনা তুই কি তবে ছেড়ে গেলি এক্কেবারে!

    রক্ত-অদর্শনে মন যে একটুও খারাপ হয়নি তা বলতে পারি না! আমার পিরিয়ডস শুরুর আগের রাতে সাধারণত পায়ে একটা কটকটে ব্যথা হয়৷ ওটাই আগাম সিগনাল৷ এ বছরের প্রথম মাসে অনেক অমন কটকটে পা ব্যথা চুককি দিয়ে গেল৷ ও রক্তদর্শনের হুইসিল ব্লোয়ার নয়, ও সম্ভবত গেঁটে বাতের আগমনী বার্তা! সে যা হোক৷ মাস পেরিয়ে গেল, তিনি এলেন না! স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বন্ধুদের পাকড়াও করা গেল ফোনে৷ তারা বয়স জানতে চেয়ে কেঠো গলায় জানিয়ে দিল 'হুম! সময় হয়েছে!'

    কাঁপা কাঁপা গলায় সেই প্রশ্নটা করেই ফেললাম 'হ্যাঁ রে! যৌন-জীবনে কি দাঁড়ি পড়ে গেল তবে'?

    ডাক্তারদের মুশকিল বা বৈশিষ্ট হচ্ছে তারা হরগিজ ঝেড়ে কাশবে না! নানান প্যাঁচ খেলাবে কথার৷ তাতে তুমি বুঝলে ভালো, না বুঝলে আরো ভালো! এরা নেহাৎ বন্ধুলোগ আর আমিও ছেড়ে দেনে-ওয়ালা নই৷ আমি তাদের সুললিত কথার ফাঁকে হাহাকার করে উঠি 'ওরে, থাকবে না যাবে, এক কথায় বল!'

    'তোর যেন জীবন-মরণের প্রশ্ন মনে হচ্ছে!' ফুট কাটে বন্ধুটি!

    আমি আর্ত স্বরে বলি 'আলবাৎ'!

    সে খ্যাকখেকিয়ে হাসে৷ বলে 'চেম্বারে চলে আয়!'

    আমি বিরস মুখে ফোন রেখে দিই!

    বিকেলের দিকে হাঁটতে বেরোই লেকের দিকে৷

    বিকেলে জলের ধারে এক অদ্ভুত বাতাস বয়৷ টুকরো-টুকরো আদরের ভাঙা কথা, ভাঙা বাক্য শোনা যায়৷ বেশ লাগে৷ মনে হতে থাকে যৌনতার চেয়ে জীবন বড়! কিন্তু সিনিক মন নিজেকেই চোখ ঠেরে বলে 'সান্ত্বনা দিচ্ছ হে?'

    বুঝি নিস্তার নেই৷ মেনে নিতে হবে এ অমোঘ বিদায়৷

    সব কিছুই সয়ে যায় শেষ পর্যন্ত৷ সইয়ে নিতে নিতে ভুলে যাই কেমন ছিল আগেরটা!

    সব গেল সব গেল ভাবটা কোথায় হারিয়ে গেল একদিন৷ তারপর ভুলেই গেলাম আমি এখন কাকু হয়ে গেছি!

    কিন্তু ভেবে দেখলাম কাকু হিসেবে আমি নম্বর পাচ্ছি না৷ কারণ আমার মধ্যে কোন কাকু-সুলভ গাম্ভীর্য নেই৷ এমন কি 'হায় কিছুই তো আর নেই!' ভাবও নেই৷ যৌন-ইচ্ছেও দিব্যি জাগছে৷ হাতের কাছে প্রেমিককে পাওয়া গেলে তেমন কোনো সমস্যাও হচ্ছে না!

    তবে বদল ঘটছিল অন্য জায়গায়৷ চিরকেলের নিরাসক্ত আমি, খেলা ছেড়ে দিতে চাওয়া আমি অনুভব করছিলাম আমার জীবন থেকে আকাঙ্ক্ষাগুলোর রঙ যেন একটু একটু পাল্টাচ্ছে! ক্ষমতার প্রতি আমার কোনো কালে লোভ ছিল না৷ হঠাৎ দেখলাম লোভ জাগছে আধিপত্যের!

    আরে! এটা আমি নাকি? আমার ভিতরেও ছিল প্রভু হওয়ার সখ?

    অপরাধবোধে দীর্ণ হতে থাকি কিন্তু এটাই যে সত্যি! এটাই তো আমি!

    মনকে শাসন করি কারণ ক্ষমতা প্রদর্শনকে আমি চিরকাল ঘৃণা করে এসেছি৷

    এই শাসন আর উপভোগ এই দুই বিপরীত অনুভব নিয়েই আমার এই কাকু হয়ে ওঠা৷

    প্রতিনিয়ত বদলের নাম জীবন৷ মেনোপজ ও তজ্জনিত মানসিক ও শারীরিক বদল নেগোশিয়েট করতে করতে এই আমার বেঁচে থাকা! এই আমার মেনোপজ নির্মিত পাল্টে যাওয়ার স্বীকারোক্তি৷

    আঃ! কী সুন্দর এই বেঁচে থাকা!

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics