• বৈষম্যের আকাশ


    7    277

    May 16, 2017

     

    আমি তখন ২৬। এসএসসি পরীক্ষায় মাধ্যমে বিদ্যালয়ে নিযুক্ত হওয়ার পথে। প্রথমত ইণ্টারভিউ-এর পর নাম আদৌ মেধাতালিকাভুক্ত হবে কি না তা নিয়ে বিস্তর জল্পনা। কিছুদিন প্রতীক্ষার পর নাম এসে গেলে মেয়েদের স্কুল নাকি ছেলেদের স্কুল তা নিয়ে বাড়ীর লোকদের ভয়ানক টেনশন। আসলে যে মেয়ে বাড়ীতে মাছ, দুধ, পেন নিয়ে দাদার সাথে সমান ভাগের জন্য লড়াই চালিয়েছে সে ছেলেদের এক্সক্লুসিভ ছাপ্পামারা বিদ্যালয়ে কি পরিস্থতি সৃষ্টি করবে তা নিয়ে বাবা বেজায় বিষন্ন হয়ে পড়েন। মা নিজের পুত্রসন্তানের অধিকারের বৈধতা নিয়ে ওভারসেন্সেটিভ ছিলেন তাই বুঝতে পারেন নি মেয়ের অধিকারের সীমানা ঠিক কতটা এনক্রোচ করা হয়েছে। মায়ের নিজের কাছে তার অ্যাটিচিউড খুব স্বাভাবিক ছিল। খোকন সোনা মাছ ধরতে যাবে তা নিয়ে আজীবন ব্যস্ত ছিলেন। মেয়ে স্বভাব দুয়োরানী তাই ভাগ্যে সুখ থাকলে হবে নইলে নয় - এ ছিল মূল ভাবনা।

    যাক অবশেষে স্কুলে জয়েন করার পর মা খুব খুশি হলেন কেননা কালো মেয়ের জন্য জামাই খোঁজার শক্ত কাজটি তাঁদের আর করতে হবে না হয়তো । মা বিশ্বাস করতেন চাকুরিরতা মেয়েদের জন্য ছেলে খুঁজতে হয় না। তাছাড়া পণের টাকা  লাগার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।বাবার আশঙ্কা একদম আতঙ্কের রুপ নিল। সত্যিই আমি বয়েজ স্কুলের শিক্ষিকা হলাম। প্রথম দিন প্রধান শিক্ষক জানালেন সালোয়ার নয় শাড়ী। বললেন বিদ্যালয়ে ছাত্রী রয়েছে ছাত্রের সাথে কিন্তু বিদ্যালয়টি কো-এড নয়। যাক প্রথম বাণেই আমি বিদ্ধ ছিলাম এত যে বাকীটা আর মন দিয়ে শুনিনি।

    আমাকে যে স্টাফরুমটি চিনিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেখানে লেডি টিচার ও জেন্টস টিচার এক ঘরেই বসেন। মেয়েদের জন্য আলাদা ঘর নেই কিন্তু ছেলেদের জন্য একটি ঘর ছেড়ে দেওয়া আছে। বেশ অবাক হলাম দেখে। কিন্তু সেজন্য শিক্ষিকাদের কোনো আপত্তি নেই জানতে পেরে বিস্মিত হলাম। সহকর্মীদের সাথে পরিচয়ের প্রক্রিয়াটাও একটু অন্যরকম। স্বামী কি করেন? কোথায় থাকেন? বাড়ী থেকেই যাতায়াত নাকি এখানে থাকবেন? কেউ জিজ্ঞাসা করল না কোন ইউনিভার্সিটি, কোন ইয়ারে পাশ! প্রথম দিন ক্লাস সেরকম দেওয়া হয়নি। জয়েনিং রিপোর্ট নিয়ে একটি ক্লাস করে, প্রাথমিক পরিচয় সেরে সোজা বাড়ী ফিরলাম। আমার হাসব্যান্ড খুব স্মার্টলি বলল বেশি পড়াতে হবে না, যাবে চেয়ারে বসে থাকবে। মেয়েরা স্কুলে খুব বেশী পড়ায় না। পরের দিন থেকে আমার নেলপালিশের উপর ফতোয়া জারী করে ঘর ছাড়ল।

    উপহাস আর উপদেশের ভারে জীবন চাপা পড়েছে সেই কবে থেকেই। দাদার ট্রিটমেন্ট সবসময় কলকাতায়। আমারটা স্থানীয় চিকিৎসক। দাদার জন্য ভালো মিষ্টি, মাছ, ফল, মায়ের স্নেহের হাত। আমার অসুখে সারাদিন মশারী, একা। দাদার জন্য সুদৃশ্য টিফিন বক্স, রোদ্রৌজ্জ্বল স্টাডি রুম, আমার তা নেই। দাদা রাজহাঁস। চেহারা, আভিজাত্যে ভরপুর। নামের পাশে সর্বদা সোনার মত মুল্যবান ধাতুর উপস্থিতি। আমি মেয়ে তায় কালো সুতরাং ভালোবাসা, স্নেহের ভাগে ঢ্যাঁড়া। দাদার জন্মদাগে সে উর্ত্তীর্ন, আমি ডাহা ফেল। মা বলতেন ছেলের জন্য জামার রঙ-এর সমস্যা নেই, লাল টুকটুকে ছেলে কিন্তু মেয়ের জামা কেনা খুব সমস্যা। লেডিজ টেলারের কাছে আবার জামা তৈরীর অর্ডার দিতে হবে, বাবা বলতেন ছেলের মত প্যান্ট পরলে বাপু আমার সাথে বেরোবে না! সব দলা পাকিয়ে আসে গলার কাছে।

    পরদিন স্কুলে যাওয়ায় আগে মা জানালেন, জামাই জানিয়েছে ব্লাউজ হাই নেক ছাড়া চলবে না, হিল একদম নয়, অতিরিক্ত গয়না খুলে যেতে হবে, স্কুল তো শো করার জায়গা নয়। আমি মায়ের অসহায় মুখের দিকে তাকালাম! মহিলারা কত সহজে স্বামী, পুত্র, জামাইয়ের স্পোক্সম্যান হয়ে ওঠেন! কখনো এদের সঙ্গে চলা প্যারালাল মানুষ তাদের ভাবায় না! ভাবতে মানা কেননা মানুষ বলতে তারা পুরুষ চেনে হয়তো। পুরষকে এমন এক বৈশিষ্ট্যের রুপ দিয়ে এসেছে সমাজ যা মানুষকে ছাপিয়ে যায়। বাবা-দাদা-স্বামী এই সম্পর্কের মর্যাদাকেও কিছু ক্ষেত্রে অতিক্রম করে তাদের পুরুষের ভূমিকা।

    স্কুলে গিয়ে ক্লাস নিতে গিয়ে দেখি ছেলে, মেয়েদের আলাদা সারিতে বসানো হয়, তবে এক ঘরে। মেয়েরা ওড়না সামলাতেই ব্যস্ত, ছেলেরা চারদিক দেখতেই ব্যস্ত। কিছু মেয়ের চোখে অপার বিশ্বাস আর স্বপ্ন, ছেলেদের চোখে অ্যাডভেঞ্চার, ম্যাডামের ক্লাস! মেয়েরা পড়া বলতে উঠলেই ছেলেদের চাপা হাসি, রিমার্কস। মেয়েটি সতর্ক, পোশাক যেন ঠিকঠাক থাকে,পড়া ভুল বললেও চলতে পারে! বড় হয়ে যে পাড়া দিয়ে পথ চলা সেখান থেকেই ইভটিজিং শুরু, শ্রেণীকক্ষে তার শেষ। আবার বৃত্তাকারে চলে সেই পরিক্রমা প্রতিদিন, নিয়ম করে। এটাই স্বাভাবিক ছেলেরা বলবে, মেয়েরা শুনবে। সরব আর নীরবতায় কি ফারাক!

    খোঁজ নিয়ে জানলাম মেয়েদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন বা আলাদা ফার্স্টএইডের ব্যবস্থা নেই। তাদের এমার্জেন্সীতে বাড়ী পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মেয়ের দায়িত্ব আজীবন মায়েদের হাতে তুলে দিতেই স্বস্তি। মেয়েদের বাথরুমের দরজায় অশ্লীল সব লেখা। মেটানো হয় না বা বাথরুমের লেখকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে এমন নোটিশও করা হয় না। ছেলেদের বাথরুমের দরজা ততটা অপরিচ্ছন্ন নয়। অমুক প্লাস তমুকের বাইরে তেমন কিছু লেখা নেই। দেবী আরাধনায় সরস্বতী পুজা করা যায় বিদ্যালয়ে কিন্তু হাজার হাজার ছাত্রীর মর্যাদা রক্ষায় দেওয়াল লিখন মেটানো সম্ভব নয়। প্রশ্ন তোলায় জবাব আসে সব স্কুলেই আছে, কলেজে, সিনেমা হলে তো আরও বেশী থাকে। মেয়েদের নিজের অধিকার ও অস্তিত্বের সীমানা দেখালেই যে এভাবেই যুক্তি হারায় সমাজপতি তথা অথরিটি সে তো চেনা গল্প।

    মেয়েদের জিজ্ঞাসা করে পরে জানতে পেরেছিলাম তাদের যে সহপাঠী বা সিনিয়ররা উত্যক্ত করলে অনেকেই তা বাড়ীতে প্রাথমিকভাবে জানায় না। স্কুলে জানালেও তাদের কোনো শাস্তি দেওয়া হয় না। ছেলেদের গার্জেন কল করে বলা হয় আজকের যা যুগ দেখুন কি করা যায়! মেয়েদের পরিবারকে সতর্ক করা হয় মেয়েকে কদিন সঙ্গে নিয়ে যাতায়াত করুন।

    সেফটির পরিভাষা চিরকাল এ দেশে অবরোধ। আপনি অসুরক্ষিত মানে আপনার দায়। কন্যাদায়ের ভার লাঘবের ঠিকানাটাও আপনি খুঁজতে বাধ্য থাকবেন নইলে আপনি ভিক্টিম। ছেলে অপরাধী হলেও অ্যাডভান্টেজে থাকা আপনার জন্মগত অধিকার এবং তা জেনার্যা্লি হরণযোগ্য নয় বলেই প্রতিষ্ঠিত। তবু বৈষম্যের আকাশে অপ্রতিবাদী উড়ান জারী রাখাই মেয়েদের নৈতিক কর্তব্য। জেন্ডার দৃষ্টিকোণের এ এক বিকলাঙ্গ সত্য। সেই মাটিতেই মেয়েদের সহনের হাজার দৃষ্টান্ত লিপিবদ্ধ, প্রতিবাদের খতিয়ান সাদা খাতার মত বেবাক, বেআব্রু।         

     
     



    Tags
     



    Comments (7)
    • “বৈষম্যের আকাশে প্রতিবাদী উড়ান জারী রাখাই মেয়েদের নৈতিক কর্তব্য” – একটা ‘অ’ কেটে দিলাম! আপনার অনুপ্রেরণায় অন্তত আপনার ছাত্রীদের উড়ান জারি থাক…

    • অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ লেখা। বেশ ভালো। এই সময়কে প্রতিফলিত ও বিদ্ধ করে।
      লেখিকাকে ধন্যবাদ।

    • অসম্ভব ভালো একটা দিক তুলে ধরেছ। কবে যে এই বৈষম্যের দিন শেষ হবে কে জানে। কিংবা আদৌ কি শেষ হবে?

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics