• এখন নিজস্ব এক নতুন যৌবন


    3    1020

    July 20, 2018

     

    [এই লেখায় ব্যবহৃত স্কেচগুলি শিল্পী অরুন্ধতী রায়চৌধুরি (১৯৩৫-২০০৮)-র। আপাতভাবে এই লেখার বিষয়বস্তুর সঙ্গে  এসব ছবি-র কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। তবু, এই ছবিগুলি মেয়েদের কথাই বলে। বলে সেই নারীর গল্প যে একজন মা, একজন সঙ্গিনী হওয়ার পাশাপাশি গড়ে তোলে একান্ত নিজের এক জগৎ। সবক'টি ছবিতেই যেন স্ত্রী, মা, সংসারের সর্বময় কর্ত্রীর অবয়বে কোথাও লুকিয়ে আছে সেই স্বাধীন নারীসত্তা - তার যৌবন কিম্বা তার মধ্যবয়স। শিল্পীর আত্মজা যশোধরা রায়চৌধুরি-র সৌজন্যে পাওয়া এই ছবিগুলো লেখার সাথে মিলেমিশে হয়ত মধ্যবয়সের চেনা কিন্তু অচেনা অনুভূতি নিয়ে মা আর মেয়ে-র এক কাল্পনিক কথোপকথন হয়ে উঠবে।]

    শুরু করি এক অকবিতা দিয়ে। যেটা কোনদিন ছাপার ইচ্ছা ছিল না তাই বালিশের তলায় থুড়ি কম্পিউটারের অন্য ওয়ার্ড ফাইলের তলায় রেখেছিলাম -

    যে যৌবন ক্ষুধাময়, যে যৌবন দুঃখময়, সে যৌবন গত।

    এখন নিজস্ব এক নতুন যৌবন

    এ যৌবনে আলো আসে নিজের শরীর থেকে : প্রায়।

    শুধু তার উৎসমুখ বহু :

    মেডুসা মুন্ডের মত এ যৌবন কথা বলে অসংখ্য মাথায়।

     

    এ যৌবনে কাম এলে, কামের তীব্রতা

     কৈশোরের বহুগুণ।

    এই তবে শেষ কামড়,

    নতুন বোতলে ভরা পুরোনো আচার?

    কাঁচা উচ্ছ্বসিত কাম ? উহুঁ

    ঘাঁটা, কনফিউজড কাম ? না না

    ক্লেশভরা টিনেজ কাম : সেও কোন ছার!

     

    সমস্ত কামের ক্রমপ্রসারিত, ক্রমশ পাতিত

    ক্রমশ ক্রিস্টাল হওয়া নির্যাস, শুধু অন্তঃসার ।

     

    মেনোপজ সিনড্রোম

    বিষয়টা তত গুজগুজ ফুসফুসের, চাপা ঢাকার নয়। সেই কবে থেকে শুনছি, সে আসছে , সে আসছে।  মুনমুন সেনের একটি বক্তব্য পড়েছিলাম, পোস্ট মেনোপজাল মেয়েদের উৎসাহিত করতে… জীবনকে এনজয় করো টরো বলা ছিল। অনেক বেশি পড়ে ফেলেছি সারা জীবনে মেনোপজ নিয়ে, বিদেশি লেখাপত্র… পিএমটি বা প্রি মেনস্ট্রুয়াল টেনশনের সময়ে জাজ ম্যাডামের দেওয়া জাজমেন্টকেও তুড়ি মেরে ওড়াতে বা চ্যালেঞ্জ করতে শোনা গেছে মার্কিনদের। কে না জানে দিজ মার্কিনস আর ক্রেঁজি!

    ওদের সবেতেই বাড়াবাড়ি, আমাদের ব্যাদে লেখা নেই কিছু, তাই ভারতীয়দের সঙ্গে মার্কিনদের  সবটাই কিছু মিলবে না সবার। এবং বিষয়টাকে লার্জার দ্যান লাইফ করেও দেখার কিছু নেই । কেননা, ওই যে, যুক্তি! আমাদের মা-মাসিরা এসবকে পাত্তা দিতেন না। দিদা-ঠাকুমারাও না।

    মেলে নি আমারও বটে। শুধু বছর খানেক “ওটা থেমে যাবার” স্বস্তিতে চোনা ঢেলে হঠাৎ ওটা শুরু হলে আবার ডাক্তারকে ফোনও করেছি। অথবা থেমে যাবার আগে উপুড়হস্ত হয়ে যদি আমার সিস্টেম গাদা গাদা রক্ত ঢালে, আর মরণ কামড়ের জন্য আমার দীর্ঘকালের দাগহীন জীবনে হঠাৎ অফিসের সিটের সাদা তোয়ালেতে দাগ লাগে, রাগ হয় কি না?

    মা মাসিদের কথাই যদি বলো, ওঁদের না বলা বেদনা তখন বুঝিনি। মেজাজ তো ওঁদের এমনিই সদা তিরিক্ষি থাকত। কতটা মেনোপজের কারণে আর কতটা গ্যাস-কেরোসিন-জল-ইলেকট্রিক অমিল হবার কারণে, কে বলে দেয়? হ্যাঁ, আমার তো মনে হয় আমাদের স্মৃতিতে যত ঝাড় খাওয়ার অভিজ্ঞতা, মায়ের হাতে… সবটাকেই পিএমটি বলে দাগিয়ে দিতে পারলে সেই অল্প বয়সে সেলফ এসটিম বাড়ত বই কমত না। কিন্তু ‘হোলিয়ার দ্যান দাউ’ মায়েরা, বকাবকির ক্ষেত্রটি এমনই বাগিয়ে বসেছিলেন, এতটাই মরালপিসিমা , নীতিমাসিমা ছিলেন চারিদিকে , যে সবাই পিএমটি-র শিকার বললে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যেত।

    দ্বিতীয় বয়ঃসন্ধি

    আসলে প্রথম বয়ঃসন্ধিতে ঠিক যতখানি ঘাবড়ে গেছিলাম , যা যা সমস্যা হয়েছিল, এই দ্বিতীয় বয়ঃসন্ধিতে এসে আরো ঢের বেশি সমস্যার মুখোমুখি পড়লাম। সমস্যা বাইরের নয়, ভেতরের। মানে ওই সব মাসিক বন্ধ হবার ফলে শারীরিক ঝড়, ঝাপটা, সেসব কিছুই না। আসল সমস্যা হচ্ছে মানসিক। ভীষণ ভালনারেবল কেন যে, কেন যে আবেগতাড়িত এত, মুড সুইং কেন, এসব বুঝিনি প্রথমে, পরে বুঝলাম হরমোন কা খেল!

    হরমোন বল তো হরমোন, যৌনতা বল তো যৌনতা। সারাজীবন দিয়ে জীবনকে বোঝার চেষ্টায় শরীরের অনিবার্য ভূমিকা বল, তো তাই।

    আসলে ওসব বাজে কথা। ওই যে, মেনোপজের পর চেহারা অসুন্দর হয়ে যায়। খসখসে হয় । চুল উঠে যায়। ওসব হট ফ্ল্যাশ, ওসব নির্ঘুম রাত। সেগুলো তো এল, কিন্তু একা তো এল না। এল প্রেমে পড়ার, প্রেম পাওয়ার, তীব্র বিভ্রান্তিময় কামনাবাসনা নিয়ে। সারা রাত জেগে থাকলাম শুধু না, কেবলই প্রেমের স্বপ্ন দেখে দেখে জেগে থাকলাম। 

    লিখে ফেললাম, একটি মধ্যবয়সী কবিতা

     

    আসলে মধ্যবয়স সত্য, আসলে হরিনাম সত্য,

    আসলে সত্য মাধবরঙ্গ

    সত্য জীবনে কিচ্ছুটি না থাকা

    জীবনের সবচেয়ে মধ্যখানটায় ফোঁপরা হয়ে যাওয়া সত্য...

    সত্য তোমার ও আমার সমস্ত মনোভার

    আমাদের সমস্ত জটিল কুটিল অস্থির সময়

    আসলে সত্য আমাদের সব রকমের হুঙ্কার ও ইগোট্রিপ।

     

    আসলে গাড়ি সত্য, গাড়ি তে চেপে ফুটানি সত্য

    দুইধারে ঢালু পাড়ি সত্য, বাড়ি সত্য, ই এম আই সত্য

    আসলে সত্য বাথরুমের ফিটিংস

     

    ফিটিংসের কাঁধে মাথা রেখে তোমার কাঁদাটি সত্য না,

    অন্ধকার পাড়ি দিতে দিতে ‘বাড়ি কই!’ ভেবে তোমার চাওয়াটি সত্য না

    বিছানা ও বালিশের মোহে তোমাকে, আসলে তোমাকেই, ভাবাটি সত্য না।

     

    আসলে মধ্যবয়স সত্য, তবু কৈশোর, যা আমাদের কল্পনায়

    আসলে মধ্যবয়স সত্য, তবু প্রেম , যা আমাদের কল্পনায়

    আসলে মধ্যবয়স সত্য, ক্ষমতার কলকাকলি সত্য,

    আসলে আয়ুর শেষভাগ সত্য, যৌবনের শেষ পাদ সত্য,

    আসলে ফুরফুর হাওয়া, সান্ধ্য, প্রবল গ্রীষ্মের পর, সত্য...

     

    আমার তোমার দিকে ঘুরে তাকানো, তোমার আমার দিকে ঘুরে তাকানো, আদৌ সত্য না...

    কল্পনার হাতে নিজেদের তুলিয়া দেওয়া অপর্যাপ্ত মিথ্যার হাতে

    নিজেদের ছাড়িয়া দেওয়া, সত্য না সত্য না সত্য না...

    স্পষ্ট বুঝতে পারি, কেন আদিযুগে , মানে আমার মা মাসিদের যুগে এই বয়সেই ধর্মে কর্মে মন দিতে বলত, কেন গুরুকরণ, সুন্দর কোনও এক গুরুপাদপদ্মে প্রণিপাত। কামকে সাব্লিমেট করে ধর্মে নিতে হত। গুরু কিম্বা সাধুবাবাদের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়াও, আমার আগের প্রজন্মের, বা তারও আগের প্রজন্মের কাছে মধ্যবয়সের মানে ছিল, রঙিন থেকে সাদা বা হালকা রঙ এর জামাকাপড়ে উত্তরণ, মা-মাসি-দিদাদের স্টিরিওটাইপে ঢুকে পড়া, এমনকি বানপ্রস্থের কল্পনা অথবা “চাবি বউমার হাতে দিয়ে ঠাকুরঘরে আশ্রয় নেওয়া” মানে যাবতীয় কনট্রোল গুলো থেকে কেটে পড়া। বাধ্যতামূলকভাবে এসব করতে হলে তা যে কত বড় শাস্তি! যাইহোক, ভালোর মধ্যে  আমাদের প্রজন্ম সে সব ছেড়ে ফেলেছে বাসাংসি জীর্ণানি-র মত।

    কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, এই ধকধকে, অনিশ্চিতিময়, বস্তুবাদী মধ্যজীবনগুলো পেয়েছে। যা নাকি বড্ড ঝামেলার। কেননা, দ্বিতীয় বয়ঃসন্ধিতে, কাম আন-ম্যানেজেবল। একেবারেই। কখনো রাগ, কখনো কান্না, কখনো বিরক্তি, কখনো ডিপ্রেশন।

    শরীরে সে বৃত্তাকার আসাযাওয়া… সেই যে তেরো চোদ্দতে এসেছিল ঘোর ঘোর যৌবনের কাল… এক গাদা বিভ্রান্তি, পড়ায় মন না বসা, যার তার প্রেমে পড়া নিয়ে। আর এই এতটা কাল খররোদ্দুরের মত অন্যমনস্ক যৌনতা নিয়ে কাটিয়ে, যাবার বেলায় মরণ কামড় দিচ্ছে যৌবন … বলছে, আমাকে ভাল করে দেখলেই না তুমি।

    ওগো যৌনতা, ওগো যৌনতা মোর, এখনি অন্ধ, বন্ধ কোর না পাখা।

    না শুষ্কতার ভয় না। বরং ব্যাগে করে সর্বদা বইতে হবে না স্যানিটারি ন্যাপকিন, এই আনন্দে আকুল হচ্ছিলাম। কিন্তু মধ্য থেকে দেখা হয়ে গেল ত্রিশ বছরের পুরোনো এক কোন প্রেমেপড়া লোকের সঙ্গে হঠাৎ কোনও জমায়েতে। ও মা, একেবারে সেই আঠেরো বা ষোলর মত কুলকুলিয়ে বইতে লাগল করুণাধারা, আর চলে যেতে যেতে দিন বলে গেল, ইঃ আমাকে কেউ ভালবাসেনা, আমাকে কেউ দেখেনা, আমার সারাদিনের কাজ আর কাজের মধ্যে কোমরব্যথায় সেঁক তাপ দেয়না।

    ভেবেই হু হু কান্না। আর তারপর সেই মেসি ব্যাপার। সেইসব ঘেঁটে ফেলা। ঠিক যা করে বয়ঃসন্ধির লোকেরা।

    নিজেকে স্খলিত পতিত ভাবতে বাধ্য হচ্ছিলাম যখন, তখন দেখলাম এই ফেজ নিভে আসছে আবার। বছর তিন চারেকের মধ্যে, এই বিভ্রান্তি, এই বেদনা, এই প্রেম প্রেম হাহাকার কমে আসছে দেখছি। সেই যে লিখেছিলাম, নিজেই নিজেকে দেখছি একাধিক প্রেমের শব ঘাড়ে করে মরুভূমির মত জীবন পেরিয়ে যাচ্ছি, সে মরুপাথার পেরোনো এবার বুঝি সমাপ্ত।

    এখন থেকে সব জানা বোঝা শেখা কথা নির্লিপ্ত মনে অন্যদের বলে যাব। যদি অন্য কেউ নিজেকে দোষ না দিয়ে বোঝে যে, উত্তর পঁয়তাল্লিশ- প্রাক পঞ্চাশ বিভ্রান্তি আর যাতনা আসলে কিসসু না, শুধু এক হরমোন চক্রের খেলা!

    অন্য সব ভয়

    আসল ভয় যৌবন চলে যাবার, প্রেম হারিয়ে যাবার। না, সামাজিক ভয় তো আছে। বাসে ট্রামে দিদি থেকে বউদি আর বউদি থেকে হঠাৎ মাসিমা হয়ে যাবার ভয়। অথবা, বুড়ি, আধবুড়ি, ঐ মহিলাটা, প্রৌঢ়াটি, এইসব ডাকের ভয়। যৌবনহীন ঢিলে ইলাস্টিকের মত চেহারা হয়ে যাবার ভয়। মা-মাসিরা সাদা শাড়ি পরতে শুরু করত, নিজেরাই নিজেদের যৌবন চলে যাওয়াকে পেনসিল দিয়ে দাগা বুলোবার মত করে। আমরা রঙিন শাড়ি পরি, বেশি বেশি করে লিপস্টিক মাখি, ভুরু প্লাক করি, গ্রুমিং বাড়াই। কেননা সময় পালটে গেছে। আমাদের এসেছে ধনতান্ত্রিক বস্তুতান্ত্রিক সমাজের অদেখা শাসন… বুড়ো হওয়া চলবেক নাই!

    পুরুষের পজ

    মহিলাদের স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়, পুরুষেরটা যায়না। মধ্যবয়সে পুরুষের আসে মৃত্যুচিন্তা, আসে নানা ক্রাইসিস। ঘন ঘন বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককারী, কনসেন্টের তোয়াক্কা না করে মেয়েবাজি করা অথবা পিডোফিল মধ্যবয়সী পুরুষকে ধরে জেলে পুরতে আমরা আনচান করছি। কিন্তু আচ্ছা আচ্ছা শান্ত ও সুপরিশীলিত পুরুষের জীবনেও চলে কামের ঝড়। এবং মৃত্যুর অদ্ভুত এক ভয় ঘিরে ধরে তাদের। এই অনুভবটুকু পেয়ে, সার বুঝলাম এইই যে, মধ্যবয়স এক বিপন্ন বিস্ময়।

    শেষ করি রোশনারা মিশ্র-র মধ্যজীবনে (কাব্যগ্রন্থ- মজ্ঝিম পন্থা, 'সপ্তর্ষি প্রকাশন')কবিতা দিয়ে।

     

    মধ্যজীবনে

    আমি তোর প্রেমে পড়লাম মধ্য জীবনে।

    তোর সেই প্রেমিকদের হয়ে আমি তোর সঙ্গে শুলাম মধ্য-জীবনে।

    যে যার জীবন ছেড়ে এসে আমার ভেতরে তারা পৌঁছল মধ্য-জীবনে।

    আমাকে খুঁড়ে খেল,যে সুড়ঙ্গে কৈশোরে তাদের যে কী ভীষণ কৌতূহল ছিল

    আমার ভেতর তারা জানালা বসিয়ে কথা বলল নিজের ভেতরে।

    রফা আর দরাদরি, দোষারোপ, কান্নাকাটি শেষ হলে তবে

    উঠে এসে গলা জড়িয়ে নিজেদের শোওয়াগুলো শুয়ে নিল একে একে

    আমার একার এই মধ্য-জীবনে।

     
     



    Tags
     



    Comments (3)
    • লেখা তো ভাল বটেই, ছবিগুলো অপূর্ব।
      রংগন চক্রবর্তী

    • কী ভালো লাগলো..
      কিছু জানা কিছু অজানা তথ্য….
      ছুঁয়ে গেল..

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics