বিকল্প যৌন/লিঙ্গ পরিচয়ে বাঁচতে চাওয়া মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকট
0 465
সম্প্রতি কাজের সূত্রে লন্ডনে গিয়ে, আমি একটি পত্রিকায় একজন ‘সহমর্মীকে’ নিয়ে একটি লেখা পড়ি, যিনি অন্যের অনুভূতি পুরোপুরি নিজের করে অনুভব করতে পারেন। প্রবন্ধে এমনটাও বলা হয়, যে এইধরনের সহমর্মী মানুষেরা পেশাদার কাউন্সেলার, বা বলা যেতে পারে মনোবিদদের মত করে কাজ করে থাকেন।
সহমর্মিতার মত বিষয়কে আদৌ বিপননযোগ্য দক্ষতা হিসাবে দেখা যেতে পারে কিনা, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ থাকলেও লেখাটি আমার বেশ অন্যরকম লেগেছিল। লেখাটি পড়ার সাথে সাথে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল আমার হায়দ্রাবাদের এক বন্ধুর কথা। একাধারে শিল্পী ও ক্যুইর অ্যাকটিভিস্ট সে বন্ধু কিছুদিন আগে আত্মহত্যা করে। নিজের পরিবারকে লেখা শেষ চিঠিতে সে জানিয়েছিল ৪০ বছর বয়স হওয়ার পরও তার মনে হচ্ছে যে তার কেরিয়ার কোনোদিকেই এগোচ্ছে না, নিজের ব্যক্তিগত ও পেশাগত কোনো জীবনেই সে থিতু হতে পারছে না, এবং সে বেঁচে থাকার জন্য কোনো আশার রসদও খুঁজে পাচ্ছে না।
এই ঘটনায় আমরা অনেকেই মর্মাহত হয়েছিলাম। আমি জানতাম ও খুব একটা ভাল অবস্থায় নেই কিন্তু এরকম একটা কিছু ঘটতে চলেছে তার বিন্দুমাত্র ইঙ্গিত পাইনি। শুধু একজন ভাল শিল্পী এবং আর্ট কিউরেটর নয়, এই মুহূর্তে ও দেশের হাতে গোনা শিল্পীদের মধ্যে একজন ছিল যে ‘ক্যুইর আর্ট’ নিয়ে কাজ করছিল, বা বলা যেতে পারে, ক্যুইর সংবেদনশীলতার প্রকাশ নিজের শিল্পকর্মের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছিল। শিল্পচর্চার এই পথ নিঃসন্দেহে কঠিন, এবং এর ফলে ওকে হয়ত হতাশার সম্মুখীনও হতে হয়। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও ওর মধ্যে অসাধারণ কৌতুকবোধ ছিল। তাই ঠিক কী কারণে ও আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়, তা হয়ত চিরকাল অজানাই থেকে যাবে। কিন্তু অনেকেই সন্দেহ করেছিলেন ওর আত্মহত্যার সাথে নিশ্চই ওর সমকামী হওয়ার কোনও যোগাযোগ থেকে থাকবে। এই সমস্ত জল্পনায় অন্যান্য সম্ভাব্য কারণের বদলে সকলের মুখ্য আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে তার সমকামিতা। ‘সহমর্মী’দের নিয়ে লেখাটি পড়ে যেরকম সন্দেহ জেগেছিল, একইরকম অনুভূতি হয়েছিল সেইসব মানুষের জল্পনা শুনে। মৃত মানুষের জন্য সকলের এই সহমর্মিতা, উদ্দেশ্য সৎ হলেও, আদৌ কি কার্যকরী?
একথা ঠিক যে বিকল্প যৌনতার মানুষদের বিভিন্ন ধরনের মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার সাথে লড়াই করতে হয়। ডিপ্রেশন এবং আত্মহত্যার ভাবনা সেই তালিকায় একদম প্রথমের দিকেই থাকে। কিন্তু বহুদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রমাণ থেকে দেখা গেছে ধকল, দুশ্চিন্তা এবং খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় । এইসব সমস্যা যে কোনো মানুষেরই হতে পারে, তাঁর জেন্ডার বা যৌনতার অভিমুখ যাই হোক না কেন, এবং গোটা বিশ্বের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ামক সংস্থাগুলি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে কারোর জেন্ডার বা যৌনতার অভিমুখ অন্যরকম হওয়াটা কোনও মানসিক বিকৃতি নয় এবং এগুলি কখনও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ হতে পারে না। কিন্তু ভারত ও অন্যান্য দেশে গবেষণায় দেখা গেছে ক্যুইর মানুষরা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পরিমাণে মানসিক রোগে ভোগেন, এবং এর সাথে সামাজিকভাবে তাঁদের একঘরে করে দেওয়া, ও তাঁদের প্রতি বৈষম্যমূলক এবং হিংসাত্মক আচরণের সরাসরি যোগাযোগ আছে, যা কারোর ক্ষেত্রে জীবনভর স্থায়ী হতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ টি. এস. সত্যনারায়ণ রাও এবং কে. এস. জেকব তাঁদের গবেষণাপত্র হোমোসেক্সুয়ালিটি অ্যান্ড ইন্ডিয়া-তে (ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ সাইকায়াট্রি, জানুয়ারি-মার্চ ২০১২ সংখ্যায় প্রকাশিত) বলেছেন, “অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, সমকামী ও উভকামী মানুষেরা অন্যান্য মানুষের মত একইধরনের মানসিক সমস্যায় ভোগেন। তবে, এইসকল যৌন পরিচয়ের জটিলতা বুঝতে গেলে প্রয়োজন, সহিষ্ণুতা, সম্মানবোধ এবং যৌনতার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সূক্ষ্ম বোধ। প্রথাগত ডাক্তারি পরীক্ষানিরীক্ষার নিয়মিত প্রক্রিয়ার উর্ধে উঠে একজনের জীবনযাপনের স্বাচ্ছন্দ্য, স্বকীয়তা, সম্পর্ক, সামাজিক সমর্থনের নিরিখে তাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সমকামী মানুষদের জীবনে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, যার মধ্যে রয়েছে নিজের সমকামী অনুভূতিকে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব, এই অনুভূতির কথা প্রকাশ্যে আনার জটিলতা ও প্রকাশ হওয়ার পর বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হওয়া।”
ইউকে-র দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এবছর মে মাসে এই প্রসঙ্গে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধের শিরোনাম এলজিবিটি পিপল আর প্রোন টু মেন্টাল ইলনেস : ইট’স আ ট্রুথ উই শুডন’ট শাই অ্যাওয়ে ফ্রম (এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষের ক্ষেত্রে মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি : আমাদের এই সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া উচিত নয়)। প্রবন্ধটি ২০১৫ সালে সেন্টার ফর ডিজিসেস কন্ট্রোল নামক মার্কিন সংস্থা পরিচালিত সমীক্ষার ভিত্তিতে লেখা। সমীক্ষাটিতে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, ক্যুইর কিশোরকিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা চারগুণ বেশি। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, প্রবন্ধে একথাও বলা হয়েছে ক্যুইর মানুষদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সাপোর্ট ফোরাম স্টোনওয়াল-এর ৮৬% কর্মী মানসিক সমস্যার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে।
এমনটাও হতে পারে যে সমাজে একঘরে হয়ে যাওয়া বা বিভিন্নধরনের বৈষম্যের অভিজ্ঞতার ফলে একজন ক্যুইর মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা আরও বড় আকার ধারণ করে। তার আশেপাশের মানুষজন বলতেই পারেন যে তার বিকল্প যৌন পরিচয়ের দরুন মানসিক অসুস্থতা নিয়ে দ্বিধার কোনও অবকাশ নেই।
তা সত্ত্বেও সমস্ত ক্যুইর মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যহানি এবং আত্মহত্যার (বা আত্মহত্যার চেষ্টার) জন্য বিকল্প যৌন পছন্দের প্রতি সমাজের সংকীর্ণ মনোভাবকেই শুধুমাত্র দায়ি করলে তা সমস্যার সরলীকরণের দোষে দুষ্ট হবে। এখানে আমি উল্লেখ করতে চাই যে আমিও ডিপ্রেশনে ভুগি। আমি একজন ‘ক্যুইর’ এবং আমি জেন্ডার ও সেক্সুয়ালিটি নিয়ে কাজ করি। সম্ভবত নিজে ডিপ্রেশনে ভোগা এবং অন্য যারা ডিপ্রেশনে ভুগছে তাদের সাহায্য করার ফলে আমি নিজের অনুভূতিগুলোকে অন্যভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি।
আমি যখন আমার ডিপ্রেশনের কারণ খুঁজে বার করার চেষ্টা করি, তখন আমার যৌন পরিচয় সম্পর্কে সামাজিক বৈষম্যই একমাত্র কারণ হিসেবে উঠে আসে না। একজন দীর্ঘদিনের অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে নিজের যৌনতা সম্পর্কে রাখঢাক আমি করি নি। যেহেতু আমি একজন পুরুষ এবং শ্রেণী ও জাতের নিরিখে সুবিধাজনক অবস্থানে আছি, কিছু সূক্ষ্ম বৈষম্যের বাইরে আমাকে খুব বেশি কিছুর সম্মুখীন হতে হয় না। অধিকাংশ ‘ক্যুইর’ মানুষের থেকে আমার অভিজ্ঞতা তাই আলাদা। আমার ডিপ্রেশনের প্রধান কারণগুলি অন্যরকম—আমার ঘরে রোদ না আসা থেকে শুরু করে বাড়ি বদলাতে না পারাও এর মধ্যে পড়ে। খবরের কাগজের শিরোনামগুলোও আমার ডিপ্রেশন বাড়ায়।
অনেক সময়ে ডিপ্রেশনের কারণ আমার বৃদ্ধা মায়ের দেখাশোনা, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে একার হাতেই করতে হয়; আবার কখনও একা একা কনসালটেন্সি অ্যাসাইনমেন্টের কাজ করা। একা এসব করতে করতে আগে এনজিও-তে বড় টীমের সাথে কাজ করার কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু আমি আর ওই ধরনের কাজ করতে চাই না। ফলে স্ববিরোধী ভাবনাচিন্তা কাটিয়ে উঠতে আমাকে অনেকটা সময় ব্যয় করতে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমি এই মুহূর্তে একটি জেন্ডার এবং যৌনতা বিষয়ক প্রকাশনা ও প্রচারমূলক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তৈরির চেষ্টায় আছি, যেখানে প্রতিষ্ঠানগত আইন এবং সরকারী দীর্ঘসূত্রিতার নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়াতে হচ্ছে।
আরেকটি বিষয় হল, আমার বয়স হচ্ছে (আমি প্রায় ৫০) এবং শরীর ও ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের অবস্থা আর আগের মত থাকছে না। যখন আমাকে কলকাতার মত শহরের ভাঙাচোরা রাস্তা, ফুটপাথ দিয়ে এগোতে হয়, তখন চারপাশে যেন হতাশার বাতাবরণ তৈরি হয়। আবার লন্ডনের বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনের খাড়াই এস্কালেটরে ওঠার সময় ভার্টিগোর কারণেও আমার অবস্থা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়।
আমি নিজের কাজ নিয়ে যতই মেতে থাকি না কেন, ভবিষ্যতের নিরাপত্তা—আর্থিক ও সামাজিক—আমার মনকে ভারাক্রান্ত করে। তাছাড়া, প্রায়শই আমার ছোটবেলার স্মৃতি হঠাৎ এসে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়—যার ফলে অনেক সময় আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোনও কাজ করতে পারি না। অনেকসময় মেঘলা আকাশ এবং শান্ত দুপুরে লোকাল ট্রেনের আওয়াজ ছোটবেলার স্মৃতি ডেকে আনা এবং ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। তারপর আস্তে আস্তে মাথার মধ্যে সবকিছু দলা পাকিয়ে যায়, এবং ঠিক কী থেকে সবকিছু শুরু হয়েছিল আর ঠাওর করতে পারি না। চোখ থেকে জল কেন গড়িয়ে পড়ে, তা আমার বোধগম্যের বাইরে। একমাত্র ঘুমিয়ে পড়া, যদি ভাগ্য সহায় হয়, এর একমাত্র সমাধান বলে মনে হয়।
এতক্ষণ ধরে বিভিন্ন ও বিস্তর ‘অভিযোগ’ আওড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ হল, আমি যখন ডিপ্রেশনে থাকি তখন কোন বিষয়গুলি নিয়ে আমাকে লড়াই করতে হয় সে ব্যাপারে আলোকপাত করা। এতদিন আমি সেই লড়াইয়ে সফল হয়ে এসেছি তার কারণ আমার একজন দক্ষ কাউন্সেলার আছেন এবং আমার মা এবং আমার সঙ্গী—দুজনেই অসাধারণ বন্ধু হিসাবে পাশে থেকেছেন; তাছাড়া উল্লেখ করতে হয় কিছু পারিবারিক আত্মীয়, প্রায় বছর কুড়ির পুরনো কয়েকজন ‘ক্যুইর’ বন্ধু, এবং আমার নতুন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহকর্মীদের কথা। প্রত্যেকেই আমাকে মূলস্রোতে ফিরে আসতে সাহায্য করেছেন। যদিও আমি জানি কারোর পক্ষেই চিরকাল এইভাবে পাশে থাকা সম্ভব নয়। তাই নিজেকেও অনেক সময় আশাবাদী হওয়ার উপাদান সংগ্রহ করার চেষ্টায় থাকতে হয়, যা আমাদের স্বভাবসিদ্ধ মানিয়ে নেওয়ার এক প্রক্রিয়া।
যদি আপনাকে কখনও কোনও ‘ক্যুইর’ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার সমাধানের কাজ করতে হয়, তাহলে আপনার যে বিষয়গুলি সম্পর্কে সহানুভূতিশীল হওয়া প্রয়োজন, এই লেখায় তার মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি উল্লিখিত হয়েছে। আপনাকে সেই মানুষটিকে তার যৌনতা ও জেন্ডার পরিচিতির নিরিখেও দেখতে হবে, আবার তার বাইরে একটা গোটা মানুষ হিসেবেও। এমনটা হতেই পারে যে আপনার সামনে বসা মানুষটি আপনাকে তাঁর বিভিন্ন সমস্যার কথা বললেন যেগুলি একে অপরের সাথে জটিলভাবে সম্পর্কিত, এবং তার মধ্যে একটি কারণকেই মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির ‘আসল’ কারণ বলে মনে করে নেওয়াটা সম্পূর্ণ অমূলক হতে পারে।
অনুবাদ: সুদীপ চক্রবর্তী। ছবি সৌজন্য - Varta
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply