#MeToo : অজ-গাঁয়ের অদৃশ্য মহিলা সাংবাদিকদের একটি খোলা চিঠি
0 105আমরা এখানে নেই। আমাদের এখানে থাকার কথা নয়। অন্ধকারের আড়াল থেকে, কবরের নিচে থেকে কথা বলতে চাওয়া বিপজ্জনক, আমরা জানি। আমরা জানি আমরা ঝুঁকি নিচ্ছি।
তবু, চারপাশে যখন আগুন জ্বলছে, তখন কি চুপ করে থাকা যায়?
একে একে সংখ্যায় বাড়তে থাকা অগুনতি গল্পগুলোর সঙ্গে আমাদের গল্পগুলোও জুড়ে দিতে চাই আমরা – আমাদের ওপর তোমাদের নির্যাতনের গল্প – আমাদের মতই অন্য সাংবাদিক, সহকর্মী, ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা কিম্বা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী – এদের সবার নির্যাতন করার কাহিনী জুড়ে দিতে চাই বাকি গল্পগুলোর সঙ্গে, তারপর তোমাদের প্রশ্ন করতে চাই, আমাদের এই অবস্থাটা কিভাবে বদলাতে পারো? কিন্তু, কোনও আইন-আদালত ছাড়া, কোনও অনলাইন বা অফলাইন মঞ্চ ছাড়া, ক্ষমতার কলকাঠি নাড়ার ক্ষমতা ছাড়া, এমনকী তোমাদের চোখে ন্যুনতম বিশ্বাসযোগ্যতা ছাড়াই আমরা যদি কথা বলতে শুরু করি, তোমরা কি নিজেদের ভুল স্বীকার করে নেবে? নাকি বলবে, যেমন চিরকাল বলে এসেছ – এটা আমাদের জায়গা নয়, আমাদের এখানে থাকারই কথা নয়, তাহলে অভিযোগ করার প্রশ্ন উঠছে কোত্থেকে? যেভাবে ফেসবুকে তোমরা বলেছ, “এবার তো সানি লিওনে বলবে ওর সাথেও যৌন হেনস্থা হয়েছে।”
হাজার হাজার সাহসী মেয়েরা, যারা এগিয়ে এসে নিজেদের গল্প বলেছে, তাদের মধ্যে দিয়ে আমাদের প্রতিদিনের নীরব লাঞ্ছনার কাহিনী কি প্রকাশ পায় না – যা থেকে তোমরা বুঝতে পারো এসব আমরা আর সহ্য করব না?
আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, যদিও তোমার বাইকে আমাদের দুজনকে দেখা, বা ফেসবুকে আমাদের সেলফি নিয়ে গুজব উঠছিল হাওয়ায় হাওয়ায়। কিন্তু ক্রমশ সীমা ছাড়িয়ে গেছিল। বিস্ময়করভাবেই আমি যৌন হেনস্থার যে মামলাটা করতে পেরেছিলাম, তোমাকে তার জন্য জেল খাটতে হয়েছে, কিন্তু আমার কেরিয়ার নষ্ট হয়ে গেছে তাতে। আমার পাশে দাঁড়ানোর মত কোনও সহকর্মী, কোনও আত্নীয় বন্ধু নেই। তোমার গায়ে একটা আঁচও লাগেনি, কিন্তু আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমি এখন তোমার কাছে একটা হোয়াটসএপ জোক, আমার মামলা করার ঘটনা নিয়ে তুমি হাসাহাসি কর, আমার চারপাশের লোকজন, এমনকী আমার পেশায় থাকা মহিলারাও, শুধু বলে আমার বোঝা উচিত ছিল এটাই হওয়ার।
আমাদের গল্পের পটভূমি আলিগড়, মাহোবা, চিত্রকূট, গুণ, মীরাট, উদয়পুর, ভিলওয়াড়া, সমস্তিপুর, রেওয়া – যেকোনো ছোট শহরেই মহিলা সাংবাদিকদের এরকম নির্যাতনের সঙ্গে প্রতিদিন প্রতিমুহুর্তে প্রাণপণ লড়াই করে চলার অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। আমাদের অফিসে, জেলা কার্যালয়ের বাইরে, থানার বাইরে, থানার ভেতরে একনাগাড়ে বারবার একই কথা শুনে যেতে হয়; যতক্ষণ না আমাদের মাথার ভেতর কথাগুলো গেঁথে যায়, ঘুরেফিরে বাজতেই থাকে : একটা বিউটি পার্লার খুলতে পারো তো? কিম্বা মণিহারী দোকান? নার্স বা টিচারের চাকরি পাচ্ছ না? তোমার কি মনে হয় এসব করে কালেক্টরনী হবে তুমি? তোমার বয়সী মেয়েদের কি এরকম ঠা-ঠা রোদে সারাদিন বাইরে ঘুরে বেড়ানো মানায়? চেহারার যত্ন নেওয়া উচিত তোমার। টিপ পরবে, শাড়ি পরবে। সিঁদুর কোথায়? এহে, আপনাকে কি ভুলবশত ব্লু-ফিল্ম পাঠিয়ে ফেলেছি? আসলে এই মিডিয়া গ্রুপে যে কোনও মহিলা আছে জানা ছিল না। সরি ম্যাডাম, ভুল করে চলে গেছে।
সিস্টেম চায় আমরা থাকি, কাজ আর ক্ষমতা ভাগ করে নিই, কিন্তু সেই সিস্টেমের সঙ্গে, সেই সিস্টেমের মধ্যে তোমাদের আঁতাত, তোমাদের টিটকারি আর হাসির শব্দের প্রতিধবনি – আমাদের লজ্জা, ভয়, হতাশা এমনকী মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
একটা মেয়েকে চিনতাম... সে [একটা নামী দৈনিক]-এ চাকরি পেয়েছিল। ওর ইন-চার্জ ছিলেন আগ্রায়। আমি জানিনা মেয়েটির সঙ্গে আগ্রার যোগাযোগ কী, বা ওদের মধ্যে কিরকম সম্পর্ক ছিল, কিন্তু সেই ইন-চার্জকে বরখাস্ত করা হয়। মেয়েটিকে রেখে দেওয়া হয়, তবু কেন জানিনা ও এতটাই ভেঙে পড়েছিল, মানসিক চাপে ছিল, যে সেই চাকরি ছেড়ে [অন্য একটি নামী হিন্দি দৈনিক]-এ যোগ দেয়। গুজব ছিল আগের ইন-চার্জ কোনও অসভ্যতা করেছিল – এরকম অবস্থায় ওরকম অবস্থায় দেখে ফেলেছিল...। আর তারপর মেয়েটির নতুন ইন-চার্জ তাকে এতটাই নির্যাতন করল যে শেষপর্যন্ত সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল। হাথরাসে বাড়ি ছিল মেয়েটির।
আমাদের অলিগলিতে, মহল্লায়, চৌরাস্তায় ক্ষমতার চেহারাটা অন্যরকম। সামাজিক নিয়মের নিগড়ে শক্ত করে বাঁধা আমাদের জীবন – তোমরা আমাদেরই আত্মীয়, প্রতিবেশী, পাহারাদার - যারা আমাদের এভাবে বেঁধে রাখতে একান্ত উৎসাহী। পাড়ার মেয়েরা বনে বাদাড়ে রাস্তায় রাস্তায় সাংবাদিকতা করে বেড়াবে - উঁচু জাতের পুরুষের এসবে রুচি নেই। বরং এসব মেয়েদের সবসময় শাসনে রাখবে তারা, যেমন বাড়িতে ছেলের বউ বা নিজেদের স্ত্রীদের সঙ্গে করে থাকে। তবু, এরকম পুরুষদের নাগালের মধ্যে থেকেও, অন্য শহরের অন্য মেয়েদের কথা না জেনেও, বা একটা হ্যাশট্যাগের ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হয়েও, আমরা এগিয়ে এসেছি এবং কথা বলেছি - গলার জোর এবং আইনের ভাঙাচোরা কলকাঠি ব্যবহার করে। আমাদের কথা বলাটা খুব জরুরি, নাহলে, আমরা যা করি সেটা করার জন্য সব বাধা ভেঙে এগোতে চাওয়ার কী মানে থাকে? যদি তোমাদের বিরুদ্ধে গলা তুলতে না পারি, রুখে না দাঁড়াতে পারি, তাহলে অন্য কোথাও ক্ষমতার অন্য কোনরকম অপব্যবহারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব কী করে?
তোমরা আমাদের তাড়া করে বেরিয়েছ - ফোনে, আমাদের শহরের পথে পথে, গাড়ি নিয়ে আমাদের পাশে পাশে এগিয়েছ কিম্বা সামনে এসে পথ আটকেছ, লালসায় মাখা চাউনি নিয়ে বলেছ, “চল না, একসাথে খানিক সাংবাদিকতা করা যাক।” তোমরা আমাদের গায়ে গা ঘষবে, আদালত চত্বরে, বা খবর করতে যাওয়া কোনও ক্রাইম সাইটে, আর চিরকুট গুঁজে দেবে হাতে, ইঙ্গিত করবে, টিটকারি দেবে, ক্রমাগত অপমান করে যাবে এই বলে যে খেলাটা কীভাবে চলে সেটা আমরা জানি না। আমাদের কোনও ভাল কাজে, আমাদের সেরা স্টোরিগুলোয় কোনও মন্তব্য করবে না তোমরা, কেননা তাহলে নাকি অফিসে সকলে সেটাকে অপেশাদার আচরণ বলে দেখবে এবং নানারকম গুজব রটাবে।
অথচ তোমরা যখন মধ্যরাতে হোয়াটসএপ পাঠাও অথবা আমাদের প্রোফাইল পিকচারে কমেণ্ট কর কিম্বা তোমাদের প্রস্তাব মেনে নিতে জোরাজুরি কর, যে জিনিসগুলো তোমরা তোমাদের সুশীল স্ত্রী বা কন্যাকে কখনই করতে দাও না, আমাদের সেগুলোই করতে বাধ্য করার সময় এই 'অপেশাদার আচরণ' বা সমাজের নিন্দামন্দের কথা তোমাদের মনে আসে না। আমরা লিখিত অভিযোগ করি, আর অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো, যেখানে আমরা সবেমাত্র স্বচ্ছন্দ হতে শুরু করেছিলাম, সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয় আমাদের, আমাদের এই এগিয়ে আসার জন্য পালটা এফআইআর পাওনা হয়, নিষেধাজ্ঞা জারি হয় এবং স্থায়ী ছাপ লেগে যায়: একজন চরিত্রহীন মহিলা যে নির্লজ্জ সাহস দেখিয়ে প্রকাশ্যে সব বলে দিয়েছে।
রাজধানীর বুকে আমার সংবাদপত্রের অফিসের এইচআর বিভাগে গেছিলাম এপয়েণ্টমেণ্ট লেটারটা হাতে নিয়ে। যে লোকটা সেখানে ছিল, আমাকে বলল সেই রাতের জন্য কোনও হোটেলে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে, সে ওখানেই আসবে এবং আমার সঙ্গে তখন কথা বলবে। আমি যখন মুখের ওপর না বলে দিলাম, সে বলল, “শুনুন ম্যাডাম, সাংবাদিকতা যদি করতে চান, সবকিছুই করতে হবে, হোটেলেও যেতে হবে এবং সেখানে একটু ওঠা বসাও করতে হবে।” আমি প্রচণ্ড রেগে গেছিলাম, এপয়েণ্টমেণ্ট লেটারটা কুটি কুটি করে ছিঁড়ে লোকটার মুখে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। জানতাম, মালিকের দরজা অবদি পৌঁছোনোর অনুমতি আমার নেই, আর অফিসের বাকিরা কেউই এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে না। প্রায় কোনও অফিসেই একজন কর্মচারী অন্য আরেকজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চায় না। একটা অন্য শহর থেকে কীভাবে এবং কতদিন আমি একা সেই লোকটার সাথে লড়াই চালাতে পারতাম?
আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি - এখন আমাদের কাছে এমন একটা প্ল্যাটফর্ম, এমন একটা আন্দোলন রয়েছে যা এইসব ক্ষমতার তাঁবেদারদের নিয়মিত নির্যাতনের, আমাদেরকে তাদের হাতের পুতুল করে রাখার কাহিনী প্রকাশ্যে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু, আমরা যারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি কিম্বা যারা ইতিমধ্যেই হেরে গেছি, আমাদের মনের গভীরে রয়ে গেছে একটা অন্ধকার কোণ, এই স্বস্তির নিঃশ্বাসটুকু সেখানে পৌঁছতে পারছে না – সেখানে আছে এক বন্ধু ও সহকর্মীর স্মৃতি - একটি একা মেয়ে যে প্রাণপণে চেষ্টা করছিল ছোট শহরে সাংবাদিকতা চালিয়ে যেতে এবং শেষপর্যন্ত যাকে ঠেলে দেওয়া হল হতাশা ও নীরব মৃত্যুর দিকে, এই বছরেই, মাত্র কিছুদিন আগে; অথচ তাকে নিয়ে অনলাইনে বা অফলাইনে কোথাও কোনও শোকের আর্তনাদ নেই।
দিনের শেষে আমাদের লড়াইটা একটা একা মেয়ের লড়াই, ঘরে বা বাইরে যার এমন কোনও ভরসার জায়গা নেই যেখানে সে ফিরে তাকাতে পারে, যার পুঁজি এবং ক্ষমতাও নগণ্য - তবু সেটুকু সম্বল করেই সে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। আত্মরক্ষার যা যা উপায় আছে আমাদের, সবই ঠেকে শেখা – নিজের অস্তিত্বকে লোকের নজর থেকে বাঁচিয়ে রাখা, একাধিক সিম কার্ড ব্যবহার করা, কিম্বা সবসময় কোনও প্রমাণ বা চিহ্ন রেখে দেওয়া, নিজেদের মধ্যে গোপন যোগসূত্র তৈরি করে রাখা যাতে বিপদে পড়লে সাহায্য পাওয়া যায়।
আমরা #MeToo অর্থাৎ ‘আমিও’ বলছি বটে, কিন্তু আমাদের আশঙ্কা এটা হয়ত যথেষ্ট নয় - তোমাদের ক্ষমতার সিংহাসন টলিয়ে দেওয়ার পক্ষে, বা যখন আমাদের ছুঁড়ে ফেলা হবে আমাদেরই নিজের হাতে তৈরি জীবনের বুনিয়াদ থেকে তখন আমাদের আশ্রয় হয়ে ওঠার জন্য।
ইটালিকস এর অংশগুলি ২০১৪ সালে উইমেন মিডিয়া এন্ড নিউজ ট্রাস্ট প্রকাশিত ‘জিলে কি হালচাল’ থেকে গৃহীত। এগুলি ছোট শহর ও গ্রামাঞ্চলের মহিলা রিপোর্টারদের সাক্ষাৎকার থেকে নির্বাচিত ও সম্পাদিত।
(‘খবর লহরিয়া’-র মফস্বল ও গ্রামীণ মহিলা রিপোর্টারদের দ্বারা লিখিত ও প্রকাশিত)
('খবর লহরিয়া' শুধুমাত্র মহিলা পরিচালিত একটি ভারতীয় সংবাদপত্র। উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন ছোট শহর ও গ্রাম থেকে মহিলা সাংবাদিকরা এই পত্রিকাটি প্রকাশ ও পরিচালনা করেন। বুন্দেলী, অবধি ইত্যাদি কয়েকটি আঞ্চলিক ভাষায় সাপ্তাহিকভাবে এটি প্রকাশিত হয়। বর্তমানে এই সংস্থার সাংবাদিকরা ডিজিটাল জার্নালিজম এর সঙ্গেও যুক্ত এবং এঁদের একটি নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে।)
ইংরাজি থেকে অনুবাদ : চান্দ্রেয়ী দে
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply