মুনলাইট থেকে জিগ্নেশ মেভানি : ফিরে দেখা ২০১৭
0 192
২০১৭ জুড়ে নানা ঝঞ্ঝাপাত ঘটেছে। দেশের কোণে কোণে রক্তপ্লাবন বয়ে গেছে, হৃদয় নিঙড়ে রক্তক্ষরণও কম হয়নি। তবুও বাগানে সুবাতাস বয়েছে, কাঁটাঝোপের আনাচে কানাচে ফুটেছে অবিন্যস্ত গোলাপ। আজ বছরশেষে গোলাপগুলির কথাই না হয় বলা যাক। আশা করা যাক, আগামী বছর বাগান ভরে উঠবে নানা রঙের গোলাপে, আমরা সিক্ত হব শান্তিসুধায়।
গোলাপ একঃ
২০১৭-র বসন্তে একটি মন মজানো সিনেমা দেখেছিলাম। মুনলাইট। আমেরিকার একটি কৃষ্ণবর্ণ ছেলের গল্প। ছেলেটি কালো এবং সমকামী। এই দুই পরিচিতি নিয়ে অত্যন্ত বিব্রতভাবে তার ছেলেবেলা কাটে। ছোটবেলা তার ডাকনাম ছিল লিটল। লিটলের মা পলা ছিলেন মাদকাসক্ত। দেহব্যবসা করেও তিনি মাদকের টাকা যোগাড় করতে পিছপা নন। লিটলের ভাব হয় তরুণ জুয়ানের সঙ্গে। জুয়ান এবং জুয়ানের সঙ্গিনীর সঙ্গে সময় কাটাতে ভাল লাগে লিটলের। জুয়ান ছিল পেশায় মাদক বিক্রেতা। পলাকে সে মাদক নেওয়ার জন্য ভৎর্সনা করে। ক্রমে লিটল জানতে পারে জুয়ান মাদক বিক্রেতা। লিটল জুয়ানকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে যে সে মাদক বেচে কিনা। জুয়ান নতমস্তকে নীরব থাকে।
লিটল বয়সন্ধিতে পৌঁছায়।তাকে লোকে কাইরন বলে ডাকা শুরু করে। জুয়ান মারা যায়। কাইরন জুয়ানের সঙ্গিনী টেরেসার সঙ্গে সময় কাটায়। স্কুলের ছেলেরা তাকে মারধোর করে। কিন্তু এরই মধ্যে বন্ধু কেভিনকে সে সমুদ্রের ধারে চুমু খায় এবং তারা হস্তমৈথুন করে।
কাইরন এখন পূর্ণ যুবক। এখন লোকে তাকে ব্ল্যাক নামে ডাকে। পলা মাদক ছেড়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকে। ব্ল্যাক আটলান্টায় মাদকের ব্যবসা করে। পলা তাকে বারবার পুনর্বাসন কেন্দ্রে ডাকে। ব্ল্যাক মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পৌঁছায়। সে পলাকে জানায় যে, পলার প্রতি যথেষ্ট সহানভূতি না প্রকাশের জন্য সে অনুতপ্ত। পলাও ছেলের কাছে ক্ষমা চান এবং জানান তিনি ছেলেকে খুব ভালবাসেন। এর মধ্যে সে একদিন বাল্যবন্ধু কেভিনের ফোন পায় এবং কেভিন তাকে মিয়ামিতে নিজের কাছে আসার জন্য নিমন্ত্রণ করে। পলার কাছ থেকে কাইরন মিয়ামি যায় কেভিনের সঙ্গে দেখা করতে। কেভিন এখন একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করে। কেভিনের পূর্বতন প্রেমিকার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ওর একটি সন্তান আছে এবং সন্তানকে নিয়ে পরিপূর্ণ কেভিনের জীবন। কাইরন জানতে চায় কেভিন কেন তাকে ডেকেছে। উত্তরে কেভিন তার ডাইনারে একটা গান চালিয়ে দেয় এবং খুব যত্ন করে সাজিয়ে কাইরনকে খেতে দেয়। রাতে কাইরনকে নিয়ে কেভিন নিজের বাড়ি যায় এবং সেখানে সে কাইরনকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। কাইরন বলে, কেভিনের সঙ্গে সেই সম্পর্কের পর কাইরন আর কারো সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়নি। সেইসময় ছবিতে ফ্ল্যাশব্যাকে লিটলকে সমুদ্রের তীরে পূর্ণ চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কানায় কানায় ভরে ওঠে মন। চোখে আনন্দাশ্রু নিয়ে হল থেকে বেরোই।
গোলাপ দুইঃ
২০১৭-র শরতে বোনের কাছ থেকে উপহার পেলাম এলভিস ও অমলাসুন্দরী। প্রথম গল্পেই চমকে উঠি। 'দূরবীন'। কি সাংঘাতিক লিখনশৈলী। যুগ-কাল অতিক্রম করে কি অনায়াস বিচরণ। ছেলেটা কে? কে লিখছে এমন গল্প? দ্বিতীয় গল্প 'নীল পিঁপড়ে'। গল্পের নরম বিন্যাস। কিন্তু শেষে পৌঁছে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়ায় গল্প। মৃত্যু আসে নরম চাদর গায়ে জড়িয়ে। ছোটবেলায় শুনেছিলাম ছোটগল্পের মুন্সিয়ানা তার শেষ মোচড়ে। বনফুলের তাই ছিল। শীর্ষেন্দুর গল্পেরও বৈশিষ্ট্য তাই। এ ছেলেও পাকা গল্পবলিয়ের মতো শেষ স্ট্রোকে বাজিমাত করে দেখছি। কয়েকটা গল্প পড়ে বোনকে ফোন করলুম। “এই ছেলেটা কে রে? এর তো সাংঘাতিক কলমের জোর। লম্বা দৌড়ের ঘোড়া মনে হচ্ছে রে”! বোন ফোনের ওপাশ থেকে হৈ হৈ করে ওঠে, “তাই না?আমিও এর গল্প পড়ে বাকরুদ্ধ! তাই তো তোমাকে দিলাম বইটা”। পরের গল্পের নাম 'একটি অলৌকিক কথন অথবা নিছক কইমাছ'। কি জোরালো অভিব্যক্তি। কি পাষাণ বাস্তবতা। এ গল্প পড়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে মনে পড়ে। সুবলারা আমাদের প্রত্যেকের পাড়াতে আছে। আমরা তাদের ভয় পাই, এড়িয়ে চলি। এ ছেলে, মানে আমাদের গল্পকার, অসামান্য সমানুভূতির জোরে সুবলার হৃদয় ছুঁতে পারে।
নাম গল্পটি মানে 'এলভিস ও অমলাসুন্দরী' শীতের রোদ্দুরের মত আরামদায়ক প্রেমের গল্প। এ গল্পেও কাল থেকে কালান্তরে সাবলীল বিচরণ ছেলেটার। এলভিস প্রেসলির গান সাঁকো বাঁধে দুই প্রজন্মের প্রেমের মধ্যে। ‘ঈশ্বরের কান্না’, ‘হাফ টাইমের পর’, ‘তুলসীতলা’ প্রতিটি গল্পে ছেলেটা আশ্চর্য পরাবাস্তব আঙ্গিকে কঠিন বাস্তবকে ছুঁয়ে ফেলে। ‘লোকটা’ একটা হাড় হিম করা গল্প। বইটাতে ১৪টি গল্প আছে। কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি। প্রতিটি গল্প একটি অন্যটির থেকে আলাদা। বইটা শেষ করে আবার বোনকে ফোন করলুম, “আমি তো এ ছেলের ফ্যান হয়ে গেলুম রে”। ও হ্যাঁ, ছেলেটার মানে লেখকের নাম, শমীক ঘোষ। অনেকদিন পর এমন একখানি ছোটগল্পকার জন্মেছে বাংলাদেশে।
গোলাপ তিনঃ
তিন নম্বর গোলাপের নাম মুনিরা(নাম পরিবর্তিত)। মুনিরা আমার বন্ধু। আমি যে আপিসে কাজ করি, সেখানে গাড়ি চালানোর ট্রেনিং নিতে মুনিরা আসত। এই হেমন্তে মুনিরা চাকরি পেল কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে। ড্রাইভারের চাকরি। খুশীতে মন নেচে উঠল। মুনিরাকে দেখে আমি প্রতিদিন শিখি। চরম বিপর্যয়ে কেমন করে সাহস হারাতে নেই, তার শিক্ষা নিই মু্নিরার থেকে। মু্নিরা শ্বশুরবাড়ি, স্বামীর অত্যাচারের কাছে নতি স্বীকার না করে নিজের স্বপ্নে বিশ্বাস রেখেছে। চরম দারিদ্র সত্ত্বেও মুনিরার চাকরি করায় স্বামীর আপত্তি ছিল। স্বামী নিজে ছিল বেকার। তবু মুনিরাকে বাড়ি থেকে বাইরে বেরোতে দিতে, ড্রাইভারের চাকরি করতে দিতে সে নারাজ। মুনিরা চাইত, রোজগার করে সংসারের হাল ফেরাতে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সমাজে নিজের পরিচয় গড়ে তুলতে। এই সামান্য চাওয়ার জন্য তার কপালে জুটত নিত্য মারধোর, ধর্ষণ। সহ্য করতে না পেরে একদিন দু’টি ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে এককাপড়ে ঘর ছাড়ে সে। টাকাপয়সাও ছিল না হাতে। আমাদের সংস্থা আর ওর বন্ধুবান্ধবদের সাহায্যে ও কখনও সমাজকল্যাণ সংস্থা পরিচালিত হোমে, কোনও বন্ধুর এককামরার বাড়ির কোণে আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে ওর স্বামী আত্মহত্যা করে। শ্বশুরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন, গ্রামের লোক সবাই মুনিরাকে দায়ী করে ওর খোঁজ শুরু করে। দেখা পেলে মুনিরাকে গণপিটুনি দিয়ে হাতের সুখ করবে আর কি! দু’টি কচি ছেলেমেয়ে নিয়ে তখন মুনিরার আত্মগোপনের পালা। দু’বেলা খাওয়া জোটে না তার। ছেলেটা খালি পেটে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে। আমাদের সংস্থার সামান্য সাহায্যে তার কোনক্রমে দিন গুজরান হত তখন। তবুও সে স্বপ্নচ্যুত হয়নি। দাঁতে দাঁত চেপে, শুকনো মুড়ি চিবিয়ে ট্রেনিং শেষ করেছে। আজ সে প্রতিষ্ঠিত। মেয়েকে ভাল বোর্ডিং স্কুলে দিয়েছে। ছেলেকে নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘর ভাড়া করে থাকে মুনিরা। আজ তার প্রফিডেন্ট ফান্ড আছে। গ্র্যাচুইটি আছে। মেডিক্লেম আছে। সে তার স্বপ্নের উড়ান ছুঁয়েছে। এবছর এই বন্ধুর সাফল্য আমার বড় প্রাপ্তি।
গোলাপ চারঃ
জিগ্নেশ মেভানির জয়। দলিত আন্দোলনের নেতা জিগ্নেশ গুজরাট বিধানসভা আন্দো্লনে জয়লাভ করলেন নির্দল প্রার্থী হিসেবে। প্রধানমন্ত্রী এবং অমিত শাহের খাস তালুকে এই জয় সারা দেশের রাজনীতিতে সুলক্ষণ। কিন্তু জিগ্নেশের জয় শুধু তাই নয়। জিগ্নেশের জয় যুগ যুগ ধরে দাবিয়ে রাখা জাতিসত্ত্বার জয়। জিগ্নেশের জয় ভারতবর্ষের বহুত্ববাদের জয়। ‘হিন্দু ব্রাহ্মণ’ ভারতবর্ষ প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্যে আজ ভারতের শাসকদল চলেছে, জিগ্নেশের জয় সেই ব্রাহ্মণ্যবাদের কতৃর্ত্বের বিরুদ্ধে সপাট থাপ্পড়। তাই জিগ্নেশের জয়ে আমি আশান্বিত, পুলকিতও বটে।
শেষ করি এখানেই। সপ্রেমে শুরু হোক নতুন বছর।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply