• প্রাক-নাস্তিক যুগে আমার শারদোৎসব


    0    147

    October 21, 2018

     

    সলতে পাকানো

    এ লেখার শুরুতেই একটা ডিসক্লেমার দেওয়া প্রয়োজন। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনও পুজোআচ্চায় বিশ্বাস করি না এবং দূর্গাপুজোকে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী একটি উৎসব বলেই মনে করি। এ লেখার কারণ এই নয় যে আমি মা দূর্গাকে মহিমান্বিত করতে চাই। এ লেখার কারণ এই যে, চারিদিকে দূর্গাপুজোকে ঘিরে ভয়ংকর রকম অবক্ষয় চোখে পড়ছে, ফলে মন আশ্রয় নিচ্ছে অতীতচারিতায়। এ লেখার পটভূমি আমার প্রাক-নাস্তিক যুগ।

    আমার কথা

    শরতকালটা মন কেমনের মাস। যত বয়স বাড়ছে ততই মেঘের দল শরতের আকাশে ছোটবেলার আল্পনা আঁকে। সে আল্পনায় কখনও ভেসে ওঠে বাগবাজার সার্বজনীনের মেরি-গো-রাউন্ড, কখনও ভেসে ওঠে গোপীমোহন দত্ত লেনের  পুজোর ভলান্টিয়ার ব্যাজ পাওয়ার আনন্দ, কখনো পুজোর শেষে অ্যানুয়াল পরীক্ষার জুজু। আমাদের কৈশোরে অর্থাৎ সত্তরের দশকে পুজোটা মোটের ওপর দূর্গা পুজোই ছিল,  তখনও ‘থীম পুজো’ হয়ে ওঠে নি। পাড়ায় পাড়ায় পুজো উদ্বোধনে তখনও মন্ত্রীদের উপস্থিতি আবশ্যিক হয়ে ওঠেনি। তখনও অপ্রাসঙ্গিক হিন্দি গানের সঙ্গে মাথামুন্ডহীন নাচের মাঝখান দিয়ে হেঁটে মুখ্যমন্ত্রী পুজো উদ্বোধনে আসতেন না, তখনও ল্যাকমে কাজল দিয়ে সেলিব্রটিরা মায়ের চোখ আঁকতেন না। মোটের ওপর তখনও পর্যন্ত বারোয়ারী পুজোগুলো পাড়ার লোকের উৎসব ছিল, রাজনৈতিক দলের ভোট পাওয়ার পরব অথবা খোলা বাজারের বিজ্ঞাপনের মঞ্চ হয়ে ওঠেনি।

    সেই প্রাগৈতিহাসিক কালে মহালয়া থেকে অষ্টমী পর্যন্ত আমাদের নাওয়া-খাওয়া ভুলে ফূর্তি চলত। শোকের পালা শুরু হত নবমী থেকে। নবমী বিকেল থেকেই প্রবল কান্না বুকে মোচড় দিত। কাল ঠাকুর বিসর্জন। সেই দুঃখকে আরও বাড়িয়ে দিত ঢাকের বাদ্যি - “ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ/ঠাকুর যাবে বিসর্জন”।

    এ বাজনার তালে তালে নবমী-নিশি পোহাত। আমাদের গোপীমোহন দত্ত লেনের সার্বজনীন পুজো ছিল প্রায় বাড়ির পুজোর মত ঘরোয়া। আমার ঠাকুর্দা, আমার বন্ধু সুমনার দাদু, উল্টোদিকের বাড়ির অতনু’দার জ্যাঠা এরাই ছিলেন পুজোর হর্তাকর্তা। আমার দাদু সব ব্যাপারে ব্যস্তসমস্ত। দাদুর তাড়ায় দশমী বিকেল বিকেল পাড়ার ঠাকুর বাগবাজার ঘাটের পথে রওনা হয়ে যেত। কারণ এর থেকে দেরী হলে বাগবাজার সার্বজনীনের পুজোর বিসর্জনের ভীড় লেগে যাবে। মা দূর্গা ছেলেপুলে নিয়ে লরিতে উঠতেন। আমরা সব বছর লরিতে ওঠার অনুমতি পেতাম না। লরিতে পাড়ার কোন কোন ছেলে যাচ্ছে দেখে আমাকে, সুমনাকে, আমার বোন রুমকিকে লরিতে ওঠার অনুমতি দেওয়া হত। একবার উল্টোদিকের বাড়ির মিলনদা আমার গায়ে ফুল ছুঁড়েছিল গরমের ছুটিতে। আমার পিসি সেকথা পুজো অবধি মনে রেখেছিল। সেবার পুজোয় মিলন ছিল লরিতে, তাই পেছনের গাড়িতে ক’রে পিসিদের কড়া পাহারায় আমাদের বিসর্জনে যেতে হয়েছিল।

     চোখের জলে মা দূর্গার সংসারকে বাগবাজারের গঙ্গায় ভাসিয়ে , মাথায় গঙ্গা জল ছিটিয়ে আমরা পাড়ায় ফিরতাম। পাড়ায় ঢুকেই চোখে পড়ত শূন্য মন্ডপ। মন্ডপে মায়াময় দুঃখ ছড়িয়ে পিলসুজের আলো জ্বলত। সে আলোতে কি এক রহস্য ছিল। বুকটা খাঁ খাঁ ক’রে উঠত। বাবার মুখে শুনেছি যে তাঁর ঠাকুর্দা বলতেন, ফাঁকা মন্ডপে এই প্রদীপ জ্বালিয়ে শূন্যতাকে পুজো করা হয়। ঠাকুর চলে গেছেন। পাঁচ দিনের জাঁকজমক শেষ। এখন মন্ডপ শূন্য। আমার প্রপিতামহ বলতেন, প্রতিমা বিসর্জনের পর এই যে চরাচর জুড়ে শূন্যতা নামে, সে শূন্যতাও পূজনীয়।

    দশমীর বিষাদ কাটত পাড়ার জলসায়। লক্ষ্মী পুজো থেকে কালী পুজোর মধ্যে পাড়ায় জলসা হত। পুজোর অনেক আগে থেকেই পাড়ার জলসার প্রস্তূতি শুরু হত। আমাদের পাড়ায় তিনদিন ধ’রে জলসা হত। তার মধ্যে একদিন সারারাত ধ’রে সিনেমা দেখানো হত। একদিন গানের অনুষ্ঠান। আরেকদিন যাত্রপালা। আমাদের পরিবার চিরকেলে রক্ষণশীল পরিবার। যাত্রা দেখার অনুমতি আমার আর রুমকির মিলত না। সিনেমাও বেছে বেছে দেখতে দেওয়া হত। এই সারারাত সিনেমার আসরেই সদ্য কিশোরী আমি ‘আপনজন’ -এর ছেনোকে দেখে শ্রেণীদ্বন্দ্ব বুঝি। ‘দীপ জ্বেলে যাই’-এর ভেঙ্গে যাওয়া প্রেম আমাকে প্রথম মাথুর শেখায়।

    যাত্রা দেখার অনুমতি একবারই পেয়েছিলাম। সেবার এসেছিল গৌড়-নিতাই। ঠাকুরের নামে যাত্রা। তাই বোধহয় সেবার ছাড় পেয়েছিলাম। আমি, রুমকি, বাবুলি আর বুম্বা পরপর চার ভাইবোন বসেছিলাম। মেঝেতে তেরপোল পাতা ছিল। মাথায় কার্তিকের হিমে ঠান্ডা লাগবে ব’লে মা আমাকে ঐ গরমেও একখানা স্কার্ফ পরিয়ে দিয়েছিলেন। আমার ঠান্ডা লাগার ধাত, সামনে অ্যানুয়াল পরীক্ষা, সাবধানের মার নেই। পাছে কিছু বললে যাত্রা দেখাই বন্ধ হ’য়ে যায়, তাই মায়ের অত্যচার মেনে নিই। আমাদের গোঁড়া বাড়ি থেকে বিশেষ কোথাও আমাদের একা ছাড়া হত না, এমনকি বাড়ির সামনের যাত্রাপালার আসরেও নয়। সেবার আমরা মৌজ ক’রে যাত্রা দেখতে বসেছি।যাত্রার মাঝামাঝি পৌঁছে যেইমাত্র নিতাই গান ধরল, “মেরেছ কলসীর কানা/তা ব’লে কি প্রেম দেব না”, অমনি ভীড়ের মধ্যে থেকে পাহারাদার নতুন কাকা হাজির। গম্ভীর গলায় বললেন, “উঠে এসো, এসব আর দেখে কাজ নেই”। সেই প্রথম সেই শেষ আমার পেশাদার যাত্রা দেখা।

    গানের অনুষ্ঠানে অবশ্য আমাদের ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। বিকেল থেকে সেজেগুজে গিয়ে আমরা সামনের সারির দখল নিতাম। আমাদের পাড়ার জামাই ছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। ফলে তাকে প্রতিবার শ্বশুরবাড়ির পাড়াকে খুশি করতেই হত। আর তাঁর সূত্রেই অনেক বিখ্যাত সংগীতশিল্পী আমাদের পাড়ায় গান গেয়েছেন। সন্ধ্যা মুখার্জী গেয়েছিলেন একবার। হেমন্ত ছিলেন আমাদের দেশের লোক। ওঁরও আদিবাড়ি বহরু। সেবার পুজোর আগে দাদু, ঠাকুমা আমার ছোট পিসি আর ছোটকাকাকে নিয়ে বম্বে বেড়াতে গেলেন। আমার দাদু গাড়ি ক’রে সারা ভারত ঘুরেছেন। এই বম্বে যাত্রাই দাদুর শেষ গাড়ি ক’রে দেশভ্রমণ। যাইহোক, বম্বে গিয়ে দাদু হেমন্তকে ফোন করলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দাদুকে সাদরে বাড়িতে ডাকলেন। আমার ছোটপিসি তখন কলেজ পড়ুয়া। সে নাকি মৌসুমিকেও হেমন্তর বাড়ির সিঁড়িতে দেখেছে, তখনও মৌসুমি হেমন্তর পুত্রবধূ হন নি। মনে আছে সেবার বম্বে থেকে ফিরে বন্ধুমহলে ছোটপিসির দর বেড়ে গেল। হেমন্তর বাড়িতে সে চা জলখাবার খেয়ে এসেছে। যাইহোক, দাদুর অনুরোধে হেমন্ত সেবার আমাদের পাড়ায় শুনিয়েছিলেন  “অলির কথা শুনে বকুল হাসে”, সঙ্গে খঞ্জনি বাজিয়েছিলেন টোপাদা।

    আরেকবার এসেছিলেন অমৃত সিং অরোরা। অমৃত সিং অরোরার গাইতে আসা নিয়ে পাড়ায় বেশ জলঘোলা হয়েছিল। তখন দাদুদের প্রজন্মের ব্য়স হচ্ছে, আমার দাদু তো অসুস্থই হয়ে পড়েছেন, ফলে  আস্তে আস্তে ইয়ং জেনারেশন পুজোর দায়িত্ব নিচ্ছেন। আমার বাবা অবশ্য কোনকালে পাড়ার পুজোয় সেভাবে যুক্ত হতেন না, কিন্তু আমার কাকারা আর তাদের বন্ধুরা উদ্যোক্তার দায়িত্ব নিলেন। তারা ঠিক করলেন অমৃত সিং অরোরাকে আনবেন। পাড়ার বড়দের অমৃত সিং অরোরাকে না-পসন্দ। ঘন ঘন মিটিং হ’তে লাগল। আমাদের বাড়িতেও অমৃত সিং-কে ঘিরে শিবির বিভাজন দেখা দিল। ছোটদের দলে আমার ফুলকাকা আর ছোটকাকা আর বড়দের দলে দাদু স্বয়ং। মিটিং-এ বড়রা বললেন, তাদের আপত্তি  এই কারণে নয় যে, অমৃত সিং খারাপ গান। কিন্তু তারা চান শারদোৎসবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাংলা গান হোক। ফুলকাকা দাদুর মুখের ওপর ব’লে বসলেন, “তোমরা নতুন কিছু করতে দেবে না ”। অবশেষে বড়রা হার মানলেন। অমৃত সিং অরোরা এলেন। মঞ্চে উঠে সবাইকে বাংলায় বিজয়ার প্রণাম জানিয়ে গান ধরলেন, “ক্লান্তি আমার ক্ষমা কোরো প্রভু”। সে গান শুনে আমি অমৃত সিং অরোরার প্রেমে পড়ে গেলাম।  সেবার অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট খুব খারাপ হল। কারণ, আমি তখন শয়নে স্বপনে অমৃত সিং অরোরাকে দেখি। পড়াশোনা চুলোয় গেল।

    পাপস্খালন

    সেই কৈশোরে আমার কখনও পুজোকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ব’লে মনে হত না। মনে হত যেন পাঁচদিন ব্যাপী এক মহামেলা চলছে। পুরুত মশাই আসেন বটে, অং বং চং কিসব বলেন, কিন্তু সেসব আমাদের কানে সেভাবে প্রবেশ করত না। আমাদের কেউ অষ্টমীর অঞ্জলি দিতেও বাধ্য করতেন না। কোনোবার দিতাম, কোনোবার খেলতে খেলতে, ভলান্টারি করতে করতে অঞ্জলি দিতে ভুলে যেতাম। তারপর ক্লাস এইট থেকে তো আমি স্বঘোষিত নাস্তিক। তখন থেকে দূর্গাপুজোকে পুজো না ব’লে কায়দা ক’রে শারোদৎসব বলা শুরু করলাম। নতুন জামার টাকায় বই কেনা শুরু করলাম, বাড়ির বাসন মাজার লোক সতীর মায়ের ছোট মেয়ে মতিকে নিজের নতুন জামা দান ক’রে আত্মতুষ্টিতে ভোগা শুরু করলাম। আরও অনেক বদগুণ দেখা দিল। নিজেকে ভাবলুম ধর্মের বাইরে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে একথা এই সেদিন পর্যন্ত ভাবিনি যে, দূর্গা আসলে কাদের দেবী? মা দূর্গা যাকে বধ করলেন সেই মহিষাসুরই বা কোন সম্প্রদায়ের প্রতীক? দূর্গা পুজো যদি বাঙালির শারোদৎসবই হবে, তাহলে সেই পুজোয় বাঙালি মুসলমানদের দেখা যায় না কেন? কেন ব্রাহ্মণকেই পুজো করতে হয়? কেন ব্রাহ্মণের রাঁধা ভোগ ছাড়া নিম্নবর্ণের মানুষের রাঁধা ভোগ মায়ের মুখে রোচে না? আর আমি যে এই নিজেকে নাস্তিক ঘোষণা ক’রে খরগোশের গর্তে মুখ গুঁজে এতখানি জীবন কাটালুম, ‘আমার কোন দায় নেই’  বলে নিজের পদবীর পাপকে অস্বীকার করলুম, এও কি কম বড় অন্যায়!

    এখন আমার পাপস্খালনের সময়। স্বচ্ছতোয়ায় সব কলুষ বিসর্জনের পালা!

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics