• নজরে বিজ্ঞাপন : মেয়েদের আত্মবিশ্বাসের মাপকাঠি কি ফেয়ারএভার ক্রিম?


    4    201

    September 8, 2018

     

    সম্প্রতি একটি অদ্ভুত বিজ্ঞাপন দেখলুম। বিজ্ঞাপনটিতে দেখাচ্ছে, একটি মেয়ে রেস্তোঁরায় টেবিলে একা বসে বসে বিন্দাস কফি খাচ্ছে আর বই পড়ছে। পাশের টেবিলে একদল যুবকের ক্যামেরায় চোখ। লেন্সের ভেতর দিয়ে মেয়েটিকে ঝাড়ি মারছে তারা। লক্ষ্যণীয়, মেয়েটির বিনা অনুমতিতে তারা লেন্স জুম করছে মেয়েটিকে আরও ভালো করে দেখার জন্য। অনুমতি নেওয়ার বালাই নেই। বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের এটুকুও জানা নেই যে কফিশপে বসে বিনা অনুমতিতে অচেনা মহিলাকে ক্যামেরায় ধরে ঝাড়ি মারার নাম, যৌন হেনস্থা। ভারতবর্ষের আইন অনুযায়ী এটি একটি দন্ডনীয় অপরাধ।

    বিজ্ঞাপনটির দ্বিতীয় সমস্যা হল ছেলেগুলোর কথোপকথন। ক্যামেরা যেই ক্লোজ শটে মেয়েটির মুখ ধরল, তখন দেখা গেল মেয়েটির মুখে একটি ব্রণ আর রংটাও শ্যামলা। ব্যস, অমনি ছেলেদুটির মুখ থেকে পিতৃতন্ত্র এবং বর্ণবিদ্বেষ টুপটাপ ঝরতে শুরু করল। ন্যূনতম ভদ্রতার ধার না ধেরে অল্পবয়সী ছেলেদুটি মেয়েটিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, মেয়েটি দূর থেকে টপ আর কাছে এলে ফ্লপ। আর মেয়েটিও সেই কথা শুনে কেমন যেন বেচারি হয়ে গেল। বিজ্ঞাপনের ভাবখানা হল, মেয়েরা শুধুমাত্র পুরুষের মনোরঞ্জন করতেই সাজগোজ করে। যত্তসব বস্তাপচা পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী! আর পিতৃতান্ত্রিক পুরুষরাও এসব আজগুবি কথা ভেবে আত্মতুষ্টিতে ভোগে। এই বিজ্ঞাপনেও সেই ভিত্তিহীন আত্মতুষ্টিরই প্রতিফলন দেখি আমরা।

    বিজ্ঞাপনের পরবর্তী অংশও একইরকম সমস্যাজনক। সেই যে মেয়েটি ‘ফ্লপ’ শুনে ভারি দুঃখ পেয়েছিল, সে ক’দিন ফর্সা হওয়ার ক্রিম মেখে এমন ফর্সা হল যে তার ব্যক্তিত্বই পুরো বদলে গেল! ফর্সা হওয়ার আনন্দে ডগমগ সেই মেয়ের আত্মবিশ্বাসও বেড়ে গেল। মেয়েটি কোনও এক শপিং মলে সেই ছেলেদুটিকে দেখে নিজেই এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, সে এখন টপ না ফ্লপ?

    আচ্ছা, এইসব বিজ্ঞাপন-নির্মাতারা কি মনে করেন মেয়েরা আত্মসম্মানশূন্য প্রাণী? যে ছেলে দু’টি মেয়েটিকে অমন অপমান করল, মেয়েটি কিনা সেই ছেলেদের জন্যই ফর্সা হবে? আর হ্যাঁ, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষেরই আত্মবিশ্বাস থাকে তার মননে, ত্বকে নয়!

    এই বিজ্ঞাপনটিতে মেয়েটিকে দেখানো হয়েছে ‘ভিকটিম’ হিসেবে। তার নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলির ওপর তার কোন হাত নেই। অচেনা দুটি পুরুষ তাকে পুতুলনাচের পুতুলের মত নাচাচ্ছে। এমনকি ফর্সা হওয়ার সিদ্ধান্তটিও তার নিজের নয়। এই যে সারাক্ষণ মেয়েদের ‘বেচারি’ দেখানোর প্রবণতা, এও কিন্তু পিতৃতন্ত্রের মুদ্রাদোষ। পিতৃ্তন্ত্র মেয়েদের সারাজীবন নাবালিকা, পরনির্ভরশীল করে রাখতে চায়। তাই সে যখনই নারী চরিত্র নির্মাণ করে তখনই তাকে দুর্বল, পরজীবী প্রাণী হিসেবে গড়ে তোলে। শুধু তাই নয়, এই বিজ্ঞাপনে মেয়েদের সৌন্দর্যের ধারণাটিও পিতৃতন্ত্রের নির্মাণ। সৌন্দর্য বিভিন্নরকম। কালো, সাদা, লম্বা, বেঁটে, মোটা, রোগা, দৈহিক এবং মানসিকভাবে ‘সক্ষম’ অথবা প্রতিবন্ধী - সৌন্দর্যের আঙিনায় সকলেরই সাদর আমন্ত্রণ। যে বিজ্ঞাপন সৌন্দর্যের বিভিন্নতাকে নস্যাৎ করতে চায়, সৌন্দর্যের ধারণাটিকে একমুখী রাখতে চায়, সে আসলে প্রকৃতিকেই অস্বীকার করছে।

    মুশকিল হল কিছু মানুষ এইসব বিজ্ঞাপনে বিশ্বাস করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁদের মধ্যে মেয়েরাও আছেন।  তাতে দোষও দেওয়া যায় না। জন্ম থেকেই যে ‘কালো মেয়ে’ ব’লে গঞ্জনা শুনে বড় হয়, কৈশোরের উপান্তে যাকে ব্রণ দূর করার জন্য মুখে শাঁখের গুঁড়ো মাখানো হয়, সে মেয়ে তো চাইবেই উজ্জ্বল ত্বকের জন্য ক্রিম মাখতে। কিন্তু দায়িত্বশীল বাণিজ্য যারা করেন তাদের কি এমনভাবে কোনও সৌন্দর্য-সামগ্রীর বিজ্ঞাপন দেওয়া উচিত? ব্যবসারও তো কিছু নৈতিক দায়িত্ব থাকে! যে বিজ্ঞাপন গায়ের রঙের জন্য, মুখে ব্রণর জন্য কোনও মানুষকে বাতিল করতে শিক্ষা দেয়, অপমান করার বার্তা দেয়, সেই বিজ্ঞাপন কি কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে?

     
     



    Tags
     



    Comments (4)
    • ” সব মানুষেরই আত্মবিশ্বাস থাকে তার মননে,ত্বকে নয়,” এটাই সত্য কারণ বাইরের রূপ দেখে কাউকে বর্ণনা করা উচিত নয়।

    • মেয়েরা শুধুমাত্র পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য সাজগোজ করে না,নিজের ইচ্ছে এবং ভালোলাগাকে প্রকাশিত করার জন্যই সাজে।

    • এই লেখাটি পড়ে আমার মনে হয়েছে যে ,এখন আমরা পাশাপাশি স্কুলে বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে লক্ষ্য করছি বিভিন্ন প্রোডাক্ট মেখে ফর্সা হওয়ার প্রচেষ্টা। এর ফলে পরবর্তীতে তাদের মুখের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

    • বিজ্ঞাপনটি পড়ে আমার মনে হয়েছে যে, যৌন হেনস্থা শুধুমাত্র এক বা দুই রকমের হয় তা নয় ,বিভিন্ন রকম ভাবে হতে পারে ,যা আমাদের/আমার আজানা।

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics