24-04-2024 07:17:12 am
Link: http://ebongalap.org/1525-2
বছর পনেরো আগের বৃষ্টিভেজা এক শ্রাবণ সন্ধ্যায়, রেজিস্ট্রি করে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় পরিজনের উপস্থিতিতে বিয়ে করল ম এবং ছ — দুই বন্ধু। সিঁদুর দান, সম্প্রদানের মত আর কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক প্রথা পালন করেনি তারা। আড়ালে আবডালে প্রবল সমালোচনার বান ডেকে গিয়েছিল আত্মীয়মহলে। দুই বাড়িতেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। বাবা-মায়েদের অতটা সমস্যা হয়নি কিন্তু দুই বাড়ির যাঁরা ভেবেছিলেন যে বেশ একটা নাটক হবে, নিদেনপক্ষে একটু কথা কাটাকাটি, তাঁরা খুব কষ্ট পেলেন। হিন্দু মেয়ে হয়ে বিয়ের দিন সিঁদুর না পরায় যা যা নেতিবাচক বিশেষণ ব্যবহৃত হয়েছিল তাদের উদ্দেশ্যে, তার মধ্যে অন্যতম হল যে ম একটি ‘ফেমিনিস্ট’। ছ-ও যে একটি তাই, সেটা ঠিক বোঝা যায়নি বলে তার একটু কম নিন্দে হল। যদিও অনেকের আন্তরিক সমর্থনও পেয়েছিল ওরা দু’জন। ম এর দিদা শুধু ‘তোদের দাদু বেঁচে থাকলে মানতো না!’ বলে হাসিমুখে হৈ হৈ করতে লাগলেন।
তারপর তো তারা আলাদা সংসার পাতল। এই সময় বেরোল শহরের এক ফিল্ম ইশকুলে ভর্তির বিজ্ঞাপন। ছ পরীক্ষা দিল। সফল হল। পড়তে হলে থাকতে হবে হোস্টেলে। ছাড়তে হবে টেলিভিশন চ্যানেলের চাকরি। ছ দোনামনা করে কিন্তু ম নিশ্চিত যে এই সুযোগ ছাড়া যাবেই না। একা থাকতে একান্ত অসুবিধে হলে, ম তার নিজের বাড়ি (মানে ‘বাপের বাড়ি’) গিয়েই থাকবে।
ছ ভর্তি হয়ে গেল। আর ম শেষমেশ ফিরেই এল নিজের বাড়ি। এরপর হোস্টেলে থাকার নানা আনুষঙ্গিক খরচা বাঁচাতে এবং কিছুটা ম-এর জন্যও ছ দিনের শেষে প্রায়শই ফিরে আসতে লাগল। এবার ম-এর কেমন যেন অস্বস্তি হয় মাঝে মাঝে। কেন? বাহ! ছ এই যে ফিরে এসে ‘শ্বশুরবাড়িতে’ থাকতে লাগল — ‘ঘরজামাই’ হয়ে গেল না? বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িটাই মেয়েদের নিজের বাড়ি (এমনটাই তো বলেছিল তার থেকে অনেক ছোট, চাকুরিজীবী একটি বিবাহিত মেয়ে!) কিন্তু ছেলেদের? ছিঃ! তো এই ‘ছিঃ’ টাই নানা মানুষজন বুঝিয়ে দিতে লাগল ম-কে ঠারে ঠোরে, হাবে ভাবে। বিশেষ করে যারা বিয়ের সময় কষ্ট পেয়েছিলেন, তারা এবার আশ্বস্ত হলেন য়ে তাদের ধারণা নির্ভুল।
ম-এর বাবা মাথা ঘামান না এসব নিয়ে। বাঁকা কথা মায়ের কানেও আসছিল নিশ্চয়ই! কিন্তু তিনিও বিশেষ পাত্তা দিতেন না বা প্রকাশ করতেন না। কিন্তু বাড়ির লোকেরা যাই ভাবুক না কেন সমাজ কি আর ছেড়ে কথা বলে? ম-এর বিশেষ করে খারাপ লাগত অপেক্ষাকৃত আধুনিক, কম বয়সী, উদার বলে ভাবা পরিচিতদের মানসিকতা দেখে। সমবয়সী এক ‘উদার’ বন্ধু সরাসরি ব্যঙ্গ করে ছ-কে শ্বশুরবাড়ি থাকা নিয়ে। ছ-এর এক তুতো দিদি, একদিন ‘ঘরজামাই’ নিয়ে কি একটা বলেই জিভ কাটেন… ‘এ বাবা ওর সামনেই বলে ফেললাম! ও তো নিজেই…!’ ম-এর এক নিকট আত্মীয়াকে জনৈক আধুনিক, শিক্ষিত, মোটা মাইনের চাকুরিরতা ‘নবীনা’ বলে যে, ‘ম এর মত বিয়ে করব না বাবা! ছ-দা তো ঘরজামাই!’ যাই হোক মোদ্দা কথা হল গিয়ে এই যে, এদের খুব নিন্দে হল। এবারে বিশেষ করে ছ-এর। সংসারের কিছু দায়দায়িত্ব ভাগ এরা করে নিত কিনা সে প্রশ্ন অবান্তর! ম-ও মাঝে মাঝে আর পেরে উঠত না! কত যে সমস্যা! ধরুন কেউ নেমন্তন্ন করতে এসেছেন। বাড়ির সবাইকেই করবেন। এবার সমাজের হিসেবে ম-এর থাকার কথা নয় এখন এই বাড়িতে!ফলে তিনি তো ম আর ছ-কে তালিকায় ধরেন নি! স্বাভাবিক। ছেলের বউ হলে আলাদা ব্যপার। মেয়েদের ক্ষেত্রে শ্বশুরমশাইয়ের বা পরিবারের কর্তার (অভাবে বয়োজ্যেষ্ঠ কর্ত্রী)নামে কার্ড দিয়ে মুখে বললেই একই সঙ্গে তার পরিবারের স্ত্রী, ছেলে, বউমা, অবিবাহিত মেয়ে, সবাইকেই বলা চলে। কিন্তু শ্বশুরমশাইয়ের নামে কার্ড দিয়ে একই সঙ্গে বিবাহিত মেয়ে, জামাইকে নিমন্ত্রণ তো সমাজগ্রাহ্য নয়! অধিকাংশ মেয়ে, জামাই এবং পরিবারের সকলেই এতে অপমানিতবোধ করবেন! ফলে খুব চাপ হয়ে যায় উভয়পক্ষেই। অস্বস্তিতে পড়ে যান নিমন্ত্রণকারী আর ম-এর খারাপ লাগে তাঁদের বিব্রত অবস্থা দেখে! নিজেই কাজের কথা বলে বা অন্য দিকে কথা ঘুরিয়ে পরিস্থিতি সহজ করার চেষ্টা করে। হাসিও পায় কত কারণে — ম-এর মা প্রথম প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে সবার জামাকাপড় পাঠিয়ে এমনকি পাশের ঘরে থাকা জামাইয়েরটাও সেখানেই পাঠিয়ে দেন, সেটা নাকি ছ-এর মা দিয়ে দেবেন পরে, সেটাই নাকি নিয়ম বা ভালো দেখায়! ছ-এর মায়েরও সেটাই মত! তবে এই হাস্যকর প্রচেষ্টা ওদের প্রবল আপত্তিতে সেখানেই থেমেছিল।
ছ-এর পড়া শেষ হয়। ওরা একটা বাড়ি দেখে থাকার জন্য। সেই সময় পারিবারিক একটি আপৎকালীন কারণে মনোবিদ তাদের বারণ করেন বাড়ি ছাড়তে। কিন্তু দিনের পর দিন ওভাবে থাকতে ওদেরও সমস্যা হচ্ছিল। তাহলে এবার? পরিবারে দু’-একজন সদস্যের তীব্র অনিচ্ছে সত্ত্বেও পরিস্থিতির চাপে বাধ্যতামূলক ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওরা আলাদা সংসার পাতল ঐ বাড়িরই একতলায় যেটা কিনা ফাঁকা পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছিল প্রায়। কার্যকারণ না জেনে, ম বাবার বাড়ি জবরদখল করেছে ভাবল অনেকেই! আইনি অধিকার থাকলেই গেঁড়ে বসতে হবে! বাবার সবকিছুই তো আসলে ছেলেরই! মেয়ে জামাইয়ের একি ব্যবহার!
আরও আছে। অনেকেই বিয়ের পরে ম-কে দেখে চমকে যেতেন কারণ প্রচলিতভাবে বিবাহিত মহিলার কোন চিহ্নই ধারণ না করায় তাকে দেখে বিবাহিত মনেই হত না। কথা বলতে বলতে সেই তাঁদের চোখ ঘুরত মাথার দিকে। একটু লালের আভাস যদি পাওয়া যায়! তবে একটু স্বস্তি পাওয়া যায়! অনেকে না পেরে বলেই ফেলতেন ‘শুনেছিলাম তোর বিয়ে হয়েছে?’ আর ম-এর উত্তর ‘হ্যাঁ, বিয়ে করেছি তো! এই তো ক’ বছরে’... এবারে তো জানতে হবে, যে গন্ডগোলটা ঠিক কোথায়? অতএব প্রশ্ন এখন ম কোথায় থাকে? শ্বশুরবাড়ি কোথায়? যেই না ম জানাত যে সে আগে যেখানে ছিল, সেখানেই আছে… দৃষ্টি সিঁথি থেকে সোজা মুখে… উফ সেই দৃষ্টির সামনে কখনও কখনও ম নিজেকেও কি অপরাধী ভেবে ফেলত না অবচেতনে? কোথায় যে একটা অস্বস্তি! ম এরপর জানিয়ে দিত যে গণ্ডগোল কিছু নেই, বরের সঙ্গেই থাকে। মানে দুজনেই ম-এর বাবার বাড়িতেই থাকে। শুনে ম-এর থেকে যেন প্রশ্নকারীর বেশি অস্বস্তি হত, অনেকে আবার বিভিন্ন সময়ে সেই অস্বস্তির হাত থেকে ম আর ছ-কে বাঁচাতে (নাকি নিজেও বাঁচতে), ভাল মনেই পরামর্শ দিয়েছেন ‘বাবা মাকে না হয় ভাড়া দিয়েই থাকো! তাহলে আর কারোর কিছু বলার থাকে না’! ম আর ছ-এরও এইসব প্রস্তাব শুনে কিছুই বলার থাকে না! ম ভাবে যে এটাই যদি ছ-এর বাড়ি হত তাহলে কত টাকা ভাড়া দিতে হত? অথবা এক ভাই এক বোন হওয়ার পরিবর্তে যদি সে বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে হত, তাহলে পরিস্থিতি কি একটু বদলাত? অথবা দাদা যদি বিয়ে করে অন্য কোথাও থাকত তাহলেও কি বিষয়টা এরকমই হত? কিছুটা তো অন্যরকম হতই কিন্তু সবটা নয়। যদি বাবা মাকে দেখাশুনোর জন্য একমাত্র মেয়ে বাপের বাড়ি এসে থাকতে বাধ্য হয়, এবং জামাইও বাধ্য হয়েই হয়তো দুই বাড়ি মিলিয়েই থাকে, তাহলে কিন্তু সেই জামাই আর শ্বশুরবাড়ির উদারতার খুব প্রশংসা হতে দেখা যায়। তাতে সমস্যা কিছু নেই, কিন্তু নিজের মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে থাকার জন্য পাঠিয়ে তার কণামাত্রও কি মেয়ের বাবা-মায়ের প্রাপ্য নয়? কারণ তাঁরা শুধু নিয়ম মানছেন আর সেটাই সামাজিকভাবে ‘স্বাভাবিক’!
আসলে সব ছ এবং সব ম-এরই নিজের বাড়ির পরিস্থিতি একসঙ্গে থাকার মত কিনা তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলে। না হলে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক, পরিণতমনস্ক মানুষ কোথায় থাকবে সেটা তো তাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যপার! কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সমাজের গা চিড়বিড় করে যে! আবার সম্প্রতি মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট একটি রায়ে জানিয়েছে যে স্ত্রী যদি স্বামীকে বাবা মায়ের থেকে আলাদা হওয়ার জন্য জোর করে, তবে সেই প্রেক্ষিতে স্বামী্ বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারেন। অর্থাৎ ‘মেয়েদের না, বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িটাই নিজের বাড়ি গো!’ আর ‘ছেলেদের বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি থাকাটা – ছিঃ!’ এই সামাজিক ‘নিয়ম’-এ কোথাও একটা আইনি সিলমোহর মেরে দেওয়া হল! তাই তো? বাসে উঠলে একটা কথা শুনে খুব হাসি পেত ছোটবেলায়, এখনও পায় কিন্তু অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ভিড় বাসে কন্ডাকটরের অবিরাম উপদেশ — ‘পিছনের দিকে এগিয়ে যান, পিছনে এগিয়ে যান’ শুনে আমরা সব ম-রা মিলে ‘পিছন দিকে এগোতে পারব না বাবা, পিছোলে হবে?’ এইসব ‘বোকা বোকা’ মজা করতাম। আজকাল এই পিছনে এগোনোটা পদে পদে অনুভব করি যেন। হাসি পায় না, ভয় করে, হতাশ লাগে। ঠিক যেমন ম-এর মজার ঘটনাগুলো শুনে আগে হাসতাম আর এখন কারোর কাছ থেকে একইরকম কোনো ঘটনা শুনে হতাশ লাগে! কারণ পনেরো, ষোল বছর তো হয়ে গেল, তবু সেরকম বদল কোথায়?...পেছনেই এগোচ্ছি তবে?
তো যাই হোক, ম আর ছ-এর গল্পটার একটা ছোট্ট উপসংহার আছে। পরিস্থিতি বদলায়। ছ কিছুটা সাফল্য পায়। ভাল কাজের জন্য দেশে বিদেশে সম্মানিত হয়! এখন সবাই খুব গর্বিত তাকে নিয়ে! কাজের ফাঁকে সাধ্যমত এবং সময় বিশেষে সাধ্যের বাইরে গিয়েও ছ নিজের এবং ম-এর বাবা মায়ের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ায়। তাহলে কি করে বলা যাবে যে একসঙ্গে, একবাড়িতে থেকেই কেবলমাত্র বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করা যায়? আর স্ত্রীর কারণে সেটা না পারলে বিচ্ছেদের আবেদন করা যায়? তাহলে একই যুক্তিতে কাজের সূত্রে নিজের শহরের পরিবর্তে অন্য শহরে, অন্য রাজ্যে, অন্য দেশে যেতে বাধ্য হওয়া ছেলের ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও মামলা করতে পারা যাবে তো! অথবা স্ত্রীকে সেই দায়িত্ব পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রেক্ষিতে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে তো? নাকি এগুলোতে খুব ‘সম্মান’ কারণ এগুলো ছেলেদের অর্থ উপার্জনের সঙ্গে জড়িত, এগুলোই ‘স্বাভাবিক’ আর মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি যাওয়াটাই নিয়ম কারণ এটাই চলে আসছে! অতএব যা চলে আসছে তা চলুক আর সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গির কল্যাণে, এই চলে আসা নিয়মের যাঁতাকলে পড়ে বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি থাকলে ছ-দের আর বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি না থাকলে ম-দের মগ্নচৈতন্যে গ্লানি আর অপরাধবোধের পাহাড় জমতে থাকুক। কিম্বা আর একটু ‘এগিয়ে’ ‘ফেমিনিস্ট’ বলে গালি খাক ম-এর সঙ্গে ছ-ও। এবং এই সামাজিক মানসিকতায় আইনি ছাপ্পা লাগিয়ে পেছনের দিকে এগিয়ে যাই আমরা! জয় হোক সামাজিক লিঙ্গ নির্মাণের!
পুনশ্চ : পরিচিত বা অপরিচিত কোন চরিত্রের সঙ্গে মিল সম্পূর্ণ কাকতালীয়।
‘মগ্নচৈতন্য’ শব্দবন্ধটির জন্য শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশের কাছে কৃতজ্ঞ।
Link: http://ebongalap.org/1525-2