24-04-2024 09:57:44 am
Link: http://ebongalap.org/1785-2
১৯৯৯ সালের শীতের সকালে বাজার করে ফিরছি, দেখলাম এক অপরিচিতা মধ্যবয়সি মহিলা আমার বাড়ির দরজায় বেল বাজাচ্ছেন৷ আমাদের যৌথ পরিবার, তাই জিজ্ঞেস করে জানলাম যে আমাকেই খুঁজছেন৷ অফিসে খুব ব্যস্ত থাকায় দেখা করতে পারেননি৷ জানলাম যে উনি বেলেচন্ডি গ্রামের গৃহবধূ এবং ঐ গ্রামেই তাঁর জন্ম৷ নাম পুতুল ভদ্র, বাবা ছিলেন নামকরা নাট্যশিল্পী৷ মাত্র সাত বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে প্রচন্ড দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে মানুষ হয়েছেন৷ বাড়ির একটি গরুর পিঠে পিঠেই ছোটোবেলায় অনেকটা সময় কাটতো৷ প্রায় খিদে মেটাতে গরুর বাঁট চুষেই কাঁচা ঘন দুধ খেতেন৷ একটু বড় হয়ে গ্রামের ইস্কুল থেকেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে উচ্চমাধ্যমিক পাস করায় ওঁর একমাত্র স্টেনোগ্রাফার দাদার উৎসাহে দক্ষিণ বারাসাতের কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন৷ সেই সময় টিউশনি করে পরিবারকে কিছু সাহায্য করে গ্রামের বিপন্ন দরিদ্র্ মানুষদের প্রায় সাহায্য করতেন৷ তখন গ্রামের মহিলাদের দারিদ্র্ এবং নেশাখোর স্বামীর পীড়ণে করুণ অবস্থার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন৷ এই সময় মহিলাদের নিয়ে দল বাঁধার কথা ভাবেন৷ এরপর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম.এ পাশ করে সুন্দরবনের হরিহর মহা বিদ্যালয়ে পড়ান শুরু করেন৷ অনেক গরীব ছাত্রছাত্রীকে বিনা পয়সায় পড়াতেন এবং গ্রামের গৃহবধুদের নিয়ে দল করে আচার তৈরি করে বিক্রি করা, রাস্তার ধারে গাছ লাগান এবং মারকুটে স্বামীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান ইত্যাদি কাজ শুরু করেন৷ বর্তমানে এই দলকে স্বেচ্ছাসেবী দল হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান এবং গ্রামের সামাজিক ও পারিপাশ্বিক পরিবেশের উন্নয়ন করতে সরকারী সহায়তা চান৷ সে সময় সারা বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামেও পরিবেশ বিভাগ থেকে সহায়তা করা হতো৷ সেই সূত্রেই ওঁর আগমন৷
এরপর অফিসে এসে জেনে নেন কিভাবে স্বেচ্ছাসেবী দল রেজিস্ট্রেশন করে এন জি ও হিসাবে সরকারী সহায়তা লাভ করতে পারে৷ প্রথমে শুরু করেন গ্রামের পরিবেশ পরিস্কার রাখা এবং উপযুক্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা করা৷ নিজের গ্রামে যথেষ্ট কাজ অতি সুষ্ঠুভাবে করায় আশপাশের গ্রাম থেকেও বায়না আসতে থাকে৷ তাদের কাজও করা শুরু করেন৷ এরপর বন বিভাগের মতো যৌথ পরিবেশ পরিচালনের প্রস্তাব দেন৷ পশ্চিমবঙ্গে সেই প্রথম এই ব্যবস্থা চালু করা হল৷ এতে বছরের বিশেষ দিনে একসাথে পুকুর পরিষ্কার করা, রাস্তাঘাট পরিস্কার করা, বাড়িতে এবং রাস্তার ধারে উপযুক্ত গাছ লাগান, মাশরুমের চাষ করা, বাড়িতে ভালো শৌচাগার রাখা এসব কাজ শুরু হয়ে গেল৷ পরিদর্শন করতে গিয়ে অনেক সময় দেখা গেল সুন্দর শৌচাগারটির গর্তের মুখে কাঠের পাটাতন লাগিয়ে ঠাকুরঘর হিসেবে কেউ কেউ ব্যবহার করছেন৷ ভদ্রমহিলা সেগুলো বন্ধ করারও প্রয়াস নিলেন৷
তারপর পরিবেশ বিভাগ থেকে গ্রামে জনপ্রিয় ওষধি গাছের নার্সারি করে বিতরণ করার একটি প্রকল্প দেওয়া হল৷ ভদ্রমহিলা নিজে অনেক গ্রাম্য গাছপালা নানা অসুখে ব্যবহার করেন, তাই এ ব্যাপারটা ওঁর পক্ষে বেশ সুবিধাজনক হল৷ একবার পরিদর্শনে গিয়ে হাতে সুঁয়োপোকা লেগেছিল৷ সাথে সাথে উনি রাস্তার পাশ থেকে চাক চাকুন্দে ঝোপের (Cassia tora) পাতা ঘসে দিলেন এবং সত্ত্বর চুলকানো থামল৷ রাস্তার কুকুরের পায়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চলে গেলে উনি হলকোমলির পাতা থেঁতো করে লাগিয়ে লতা জড়িয়ে দিতেন৷ নিজের এবং আশপাশের গ্রামের বহু লোককে অ্যালভেরা, শতমুলি, গুড়মাড়, সর্পগন্ধার চারা দিতে দিতেন৷
এরপর ওঁর মাথায় আসে বৃষ্টির জল ভূগর্ভস্থ নোনা জলস্তরে ঢুকিয়ে জলকে পেয় করার কথা৷ NABARD সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়৷ ফলে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে মাত্র ৬০ ফুট গভীরতার লোনা জলস্তরকে ছাদ এবং পুকুর থেকে বৃষ্টির জল সংগ্রহ করে চেক্ভালভের মাধ্যমে টিউবয়েলের গোড়ায় সংযোজিত করে ঝড়খালি ও বেলিয়াচন্ডী গ্রামে মার্চ পর্যন্ত টিউবয়েলের জলকে পেয় করে ফেললেন৷ Central Ground Water Board এর প্রাক্তন Member Scretary তো পরিদর্শনে এসে থ। এত সস্তায় কি করে একাজ সম্ভব হল৷ আবার কৃষক ক্লাবের সভ্যদের নিয়ে পদ্ধতিটি চোখে দেখিয়ে শেখালেন৷
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জিলা পরিষদের কল্যাণে উনি গ্রামে গ্রামে রাস্তার ধারে, খালের পাড়ে গাছ লাগানোর কাজ করছেন৷
বর্তমানে মেডিসিনাল গাছপালার বাগানের এলাকাটা বাড়ানর এবং একটি গ্রাম্য মহিলাদের জন্যে জিম্নাসিয়ামের প্রচেষ্টা করে চলেছেন৷ ওঁর এই গ্রামের মহিলাদের নিয়ে প্রচেষ্টাগুলোকে সাধুবাদ জানাই৷
শুধু সুন্দরবন চর্চা পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত। বানান ও ভাষা অপরিবর্তিত রেখে পত্রিকার সম্পাদকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।
Link: http://ebongalap.org/1785-2