26-04-2024 17:43:18 pm
Link: http://ebongalap.org/adolescent-students-and-alternative-sexuality
শিক্ষাক্ষেত্রের ক্রমবর্ধমান ভয়, ঘৃণা ও আতঙ্কের পরিবেশে এক নতুন অধ্যায়ের সংযোজন হল। সম্প্রতি কলকাতার প্রথম সারির এক নামী স্কুল তাঁদের দশজন ছাত্রীকে মুচলেকা দিয়ে স্বীকার করতে বাধ্য করালেন যে তারা ‘সমকামী’। যে সময়ে স্কুলের মধ্যে শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি বারংবার প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ছে, স্কুল কর্তৃপক্ষের নিয়োগ করা ব্যক্তিদের হাতে ছাত্রীদের যৌন হেনস্থার ঘটনা একের পর এক সামনে আসছে, সেই সময়ে এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, যে সমস্যা আরও গভীর, এবং ব্যাপক।
কমলা গার্লস স্কুলের ঘটনার সারসংক্ষেপ
ঘটনার সারসংক্ষেপ সংবাদমাধ্যম থেকে যা জানা গেছে তা হলো, ৮ মার্চ ২০১৮ তারিখে কমলা গার্লস স্কুলের অধ্যক্ষা দশজন ছাত্রীকে ডেকে পাঠান, তাদের বিরুদ্ধে দাখিল হওয়া ‘অভিযোগের’ ভিত্তিতে। এই ছাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, এবং অধ্যক্ষার বয়ান অনুযায়ী, এই ছাত্রীরা নিজেদের ‘সমকামী’ বলে স্বীকার করে। তারপর এই দশজন ছাত্রীকে ‘স্বীকারোক্তি’ পত্রে সই করতে বাধ্য করা হয়। উক্ত ছাত্রীদের অভিভাবকরা, যাঁদের এই গোটা প্রক্রিয়া সম্পর্কে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল, তাঁরা চুপ করে থাকেননি। তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে অধ্যক্ষার অফিসে যান এবং অভিযোগ করেন যে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁদের মেয়েদের মুচলেকাতে সই করতে বাধ্য করেছে।
অন্যদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষ দাবি করে, যে তাঁদের পদক্ষেপ সঠিক ও যথাযথ ছিল, এবং ছাত্রীদের ‘সঠিক পথে’ আনাই ছিল এর একমাত্র উদ্দেশ্য। সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হয়েছে, মেয়েগুলি নাকি ক্লাসে ‘অসভ্যতা’ করছিল বা ‘দুষ্টুমি’ করছিল। শাস্তি হিসাবে তাদের অধ্যক্ষার ঘরে ডেকে পাঠানো হয় এবং স্বীকারোক্তি পত্রে সই করতে বাধ্য করা হয়। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকার দাবি অনুযায়ী অন্য ছাত্রীরা নাকি উক্ত ছাত্রীদের ‘ওইধরনের আচরণের’ বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিল। তিনি বলেন, এই অভিযোগের ভিত্তিতে ওই ছাত্রীদের ডেকে পাঠানো হয় এবং তারা ওই আচরণের বিষয়টি স্বীকার করে। প্রধান শিক্ষিকার বক্তব্য অনুযায়ী বিষয়টি ‘স্পর্শকাতর’ ছিল বলেই উনি ছাত্রীদের লিখিতভাবে তাদের অবস্থান জানাতে বলেন। উনি অভিভাবকদের সহায়তা চেয়েছিলেন যাতে “এই ছাত্রীদের বাড়ি এবং স্কুল উভয় ক্ষেত্রেই সঠিক পথে আনা যায়।”
পরে, এই ছাত্রীদের অভিভাবকদের স্কুলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য এবং মিটমাট করে নেওয়ার জন্য ডেকে পাঠানো হয়, কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ যেভাবে ভেবেছিল, বিষয়টি সেভাবে এগোয়নি। উল্টে, অভিভাবকরা অভিযোগ জানান, যে তাঁদের মেয়েদের দিয়ে জোর করে সই করানো হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, ছাত্রীদের নাকি এইধরনের কথা বলা হয়েছিল যে, “লেখো যে তুমি তোমার বন্ধুর জামার মধ্যে হাত ঢুকিয়েছিলে, স্কার্টের মধ্যে হাত দিয়েছিলে, জড়িয়ে ধরেছিলে, চুমু খেয়েছিলে।” একজন ছাত্রীকে নাকি বহিষ্কার করার হুমকিও দেওয়া হয় কারণ সে নাকি তার অভিভাবকের সঙ্গে কথা না বলে কোনো সই করতে রাজি হয়নি।
( তথ্যসূত্র : ফার্স্টপোস্ট )
তাঁদের মেয়েদের ‘অন্যায়ের’ কথা অভিভাবকদের জানানো হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে তাঁদের মেয়েরা ‘সমকামীতায় ভুগছে’ এবং এ বিষয়ে অবশ্যই ‘ব্যবস্থা নেওয়া দরকার’। কিন্তু অভিভাবকরা সংবাদমাধ্যমকে জানান, গত মাসে স্কুলের মধ্যে একটি যৌন হে্নস্থার ঘটনায় কিছু ছাত্রীরা প্রত্যক্ষদর্শী ছিল বলে তাদের এইভাবে ফাঁসানো হচ্ছে।
( তথ্যসূত্র : টাইমস অফ ইন্ডিয়া )
গোটা ঘটনাটি বিভিন্নভাবে ঘোরতর সমস্যাজনক হওয়া সত্ত্বেও, ঘটনার কয়েকদিন পর রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের একটি বিতর্কিত মন্তব্যের ফলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। কমলা গার্লস’ স্কুলের ঘটনার বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সমকামীতার মতো কোনও ঘটনা যদি ঘটে থাকে, তাহলে তা ‘বাংলার ঐতিহ্য-বিরোধী’। মন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট ছিল, যে পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে সমকামীতা বরদাস্ত করা হবে না। দ্য কুইন্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী বলেন, ‘স্কুলে সমকামীতার মতো বিষয়কে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না’।
( তথ্যসূত্র : টাইমস নাও নিউজ )
সমস্যার জায়গা কোনগুলো
যে কোনো ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই এমন আচরণ সমস্যাজনক, কিন্তু স্কুলের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যেখানে বয়ঃসন্ধির ছাত্রছাত্রীরা রয়েছে, সেখানে এইধরনের ঘটনা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষাক্ষেত্রের মতো জায়গায় কিছু নিয়মকানুন, আচরণবিধি থাকবে এবং সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু পাশাপাশি স্কুল কর্তৃপক্ষকে বয়ঃসন্ধির ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে বড় হয়ে ওঠার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। তাই ছাত্রীরা কোনও ‘দুষ্টুমি’ করলে তার শাসন ও সংশোধন প্রয়োজন, কিন্তু একইসাথে খেয়াল রাখতে হবে, অনুশাসনের নামে একজন ছাত্রী বা ছাত্রের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা বাধাপ্রাপ্ত না হয়।
উক্ত ছাত্রীদের ‘বিপথগামী’ বলে দেগে দেওয়ার মানসিকতা একধরনের হোমোফোবিয়া ছাড়া আর কিছুই না। শুধু তাই নয়, এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যে মানুষের যৌনতার স্বাভাবিক বিকাশ এবং বিকল্প যৌনতা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনও সুস্পষ্ট ধারণাই নেই। যে স্কুলে ছাত্র ও ছাত্রী উভয়ই একসাথে পড়ে, সেখানে ছেলেরা ও মেয়েরা একইধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে, তাদের কি নিজেদের ‘বিসমকামীতা’ লিখিতভাবে জানাতে বলা হত? এই জরুরি প্রশ্নটি তুলেছেন স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি সংগঠনের মালবিকা।
আরও কিছু জরুরি প্রশ্ন গোটা ঘটনাটি থেকে উঠে এসেছে। প্রথমত, এই অন্য ছাত্রীদের ‘অভিযোগ’ কতটা সত্যি-ঘটনাভিত্তিক আর কতটা নিছক মজা সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার কি কোনও চেষ্টা হয়েছিল? দ্বিতীয়ত, সত্যিই যদি কোনও ঘটনা ঘটেই থাকে—অর্থাৎ একে অপরের হাত ধরা বা কাঁধে হাত দেওয়া, যদি তা খুব কুরুচিকর কিছু না হয়, বা কারোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গায়ে হাত দেওয়ার মতো ঘটনা না ঘটে, তাহলে আদৌ কি স্কুল কর্তৃপক্ষের অধিকার আছে তাতে নাক গলানোর? তৃতীয়ত, স্কুল কর্তৃপক্ষ সবধরনের স্পর্শকেই যৌন স্পর্শ হিসাবে দেগে দেওয়ার জন্য মরিয়া কেন? তাঁরা কি জানেন না, নিরাপদ পরিবেশে, সমলিঙ্গের মানুষের সাথে সুস্থ স্বাভাবিক শারীরিক স্পর্শ, তা যদি ‘ভালোবাসার’ স্পর্শই হয়, একজন মানুষের বড় হয়ে ওঠার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ?
মন, অনুভূতি ও শরীরের দিক থেকে বড় হয়ে ওঠার যে পর্যায়ে ছোটদের এমনিতেই অনেক বাধার মধ্যে দিয়ে এগোতে হয়, সেই বয়সে কিছু ছাত্রীকে চিহ্নিত করে কোণঠাসা করার মতো ঘটনা থেকে আরও বেশি বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। এর ফলে যাদের চিহ্নিত করা হলো, এবং যারা সেই চিহ্নিতকরণের সাক্ষী থাকল, উভয়েরই নিজেকে চেনা ও নিজের যৌনতাকে বোঝার প্রক্রিয়ায় যে কত বড় ক্ষতের সৃষ্টি হলো, তা অকল্পনীয়। অভিযুক্ত বা অন্যান্য ছাত্রী, যাদের হয়তো নিজের যৌনতার অভিমুখ সম্পর্কে কোনও অস্পষ্টতা আছে, অথবা যারা নিজেদের অন্যধরনের যৌনতাকে চিহ্নিত করতে পেরেছে, তাদের উপর যে মানসিক আঘাত নেমে এল, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
ছাত্রীদেরও একই মতামত। আমরা এক চোদ্দ বছরের ছাত্রীর সাথে কথা বলি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই ছাত্রীর মতে, “ছাত্রী হিসাবে, এরকম অল্প বয়সে, যদি স্কুলের মধ্যে কাউকে এরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে মানসিকভাবে তার ভেঙে পড়াই স্বাভাবিক। স্কুল এমন জায়গা যা আমাদের নিরাপত্তা দেবে এবং সবধরনের হেনস্থার হাত থেকে নিরাপদ রাখবে। কিন্তু এখানে শিক্ষকদের হাতেই ছাত্রীরা হেনস্থা আর বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এটা খুবই লজ্জাজনক এবং হতাশার”।
সুজাতা, এক দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে আমাদের সাথে কথা বলেছেন। উনি স্বীকার করেছেন, এই ভয়ঙ্কর ঘটনা শিশুর অধিকার আইনের বিরুদ্ধে। সুজাতার মতে, ‘স্কুলের এইধরনের জবানবন্দী আদায়ের কোনও অধিকার নেই।’ ‘কোনও ছাত্রী যদি বাকিদের থেকে আলাদা হয়, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তার উপর মেয়েগুলিকে যে সমকামী বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে, তার কোনও অকাট্য প্রমাণও নেই।’ গোটা পরিস্থিতি যেভাবে এগিয়েছে তাতে উনি ওই ছাত্রীদের নিয়ে চিন্তিত, যারা আবার নিয়মিত ক্লাস করা শুরু করেছে। ‘অভিভাবকরা যদি তাঁদের মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন, তাহলে তা স্বাভাবিক। তাঁদের জন্যেও গোটা ঘটনা খুবই কষ্টকর,’ সুজাতা বলেন।
প্রতিবাদী উদ্যোগ
সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে এই ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্বর উঠে এসেছে। একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, এলজিবিটি+ গ্রুপ, যৌন অধিকাররক্ষা এবং বৈষম্যবিরোধী/হিংসাবিরোধী গোষ্ঠীগুলি এই ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না হয়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি মনে করে স্কুল ও কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সচেতন করা প্রয়োজন যাতে তাঁরা ‘যৌনক্রিয়া’ ও ‘যৌনতার’ মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন। এতে ভবিষ্যতে এইধরনের ভুল বোঝাবুঝির মতো ঘটনা এড়ানো সম্ভব। স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি কমলা গার্লস স্কুল কর্তৃপক্ষের কাজ এবং মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্যের নিন্দা করে একটি খোলা চিঠি বিভিন্ন মহলে পাঠিয়েছে এবং সেই চিঠি রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রক এবং নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দপ্তরেও পাঠানো হয়েছে।
ভার্তা ট্রাস্ট সংস্থাও মনে করে গোটা ঘটনাটা লজ্জাজনক এবং স্কুল-কলেজগুলতে জেণ্ডার ও যৌনতার বিষয়ে ধারণার অস্পষ্টতা দূর করতে নির্দিষ্ট কার্যক্রম নেওয়া উচিত। এ বিষয়ে ভার্তা একটি অনলাইন পিটিশান তৈরি করে এবং রাজ্যের স্কুলশিক্ষা মন্ত্রী ও শিশুসুরক্ষা কমিশনের সভানেত্রীর কাছে এ বিষয় স্মারকলিপি জমা দেয়।
আশার কথা এই যে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে আলোচনার গুরুত্ব অনুভব করছেন এবং সম্প্রতি মডার্ণ হাই স্কুল ফর গার্লস ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এ নিয়ে যৌথভাবে এক আলোচনাসভার আয়োজন করে। এরকম উদ্যোগ আরো বেশি বেশি করে দরকার।
সহযোগী লেখক : নিকিতা কাবরা ( ডান্স মুভমেন্ট প্র্যাকটিশনার, মনোযোগী পাঠক, এক্সপ্রেশনিস্ট লেখক, মানবাধিকারপ্রেমী ) এবং সুধা ঝা ( সমাজকর্মী এবং দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানবাধিকার আন্দোলনের সাথে যুক্ত) । মূল ইংরাজি লেখাটি www.vartagensex.org এর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
অনুবাদ : সুদীপ চক্রবর্তী
Link: http://ebongalap.org/adolescent-students-and-alternative-sexuality