29-03-2024 06:49:33 am
Link: http://ebongalap.org/biba-head-and-shoulder-ad-review
বিজ্ঞাপন দেখতে আমার ভালো লাগে, মানে একটা নির্দিষ্ট মাধ্যম হিসেবেই ভালো লাগে। অণুগল্পের মত, এই বিজ্ঞাপনগুলো অণু-সিনেমা যেন – অল্প সময়ের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট গল্পকে দর্শকের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে, তাই এর নিজস্ব কিছু প্রকরণ-কৌশল থাকে, থাকে কিছু চমক।
একটা খুব চেনা কৌশল হল, প্রচলিত ধ্যানধারণা বা স্টিরিওটাইপ-কে উলটে পালটে খেলা করা। ইদানিংকালে দু’টি এরকম বিজ্ঞাপনে এই ওলটপালটের খেলা আমার বেশ চোখ টেনেছিল, মূলত এই কারণে যে এই দু’টি বিজ্ঞাপনেই বিষয়বস্তু ভারতীয় সমাজের জেন্ডার স্টিরিওটাইপিং। কিন্তু উলটে দিলেই পালটায় কি? নাকি এই ওলটপালটের চমকের আড়ালে আদতে খেলা করে সেই চিরকালীন ধ্যানধারণা?
ভণিতা ছেড়ে মূল বিজ্ঞাপনগুলোতে ঢুকে পড়া যাক। প্রথম আলোচ্য, হেড অ্যান্ড শোল্ডার শ্যাম্পুর একটি বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন ‘হেড এন্ড শোলডার মেন : স্কোর ইয়া বোর’।
বিজ্ঞাপনটি শুরু হল একটি আধুনিক ড্রয়িং রুমে – এক দম্পতি পাশাপাশি বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখছে। তাদের চেহারা, পোশাক-পরিচ্ছদ বলে তারা এ-যুগের যুবক-যুবতী, সচ্ছল, শিক্ষিত। যুবক পরের পর মন্তব্য করছে, সিরিয়ালে চরিত্রদের পোশাক-আশাক, স্বভাব-চরিত্র নিয়ে। যুবতীর চোখমুখে অস্বস্তি স্পষ্ট – যুবকের কাছ থেকে এই ব্যবহার প্রত্যাশিত নয় তার কাছে। অতঃপর, হঠাৎ শূন্য থেকে ধেয়ে এসে ছেলেটিকে ধরাশায়ী করে দেয় গাঢ় নীল রঙের একটি শ্যাম্পুর বোতল। বিজ্ঞাপনের ‘দৈববাণী’ জানান দেয় – বউ-এর শ্যাম্পু ব্যবহার ক’রে ক’রেই যুবকের এহেন অধঃপতন! এই ‘মেয়েলি’ আচরণ তার শোভা পায় না। হৃত পৌরুষ ফিরে পেতে মহিলাদের ‘গোলাপি’ বোতলের শ্যাম্পু ফেলে দিয়ে পুরুষদের ‘নীল’ বোতলের শ্যাম্পু ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। বিজ্ঞাপনের শেষে আমরা দেখতে পাই, সিরিয়ালে মগ্ন বউ-এর হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিচ্ছেন যুবক – খেলার স্কোর দেখার জন্য। যুবতীর মুখেও চওড়া হাসি, কারণ অচেনা ‘বোর’ স্বামী থেকে স্বাভাবিক ‘স্কোর’প্রিয় স্বামী ফিরে এসেছেন।
ছেলেদের সিরিয়াল দেখা ‘স্বাভাবিক’ নয়, কারণ এই বিশেষ ধরণের সোপ অপেরাগুলি ‘মেয়েলি’ সমস্যাকেন্দ্রিক এবং মহিলারাই এগুলির অভীষ্ট দর্শক। ‘মেয়েলি’ বিষয় পুরুষদের বিনোদনের উপায় হয়ে উঠতে পারে না – এটাই পুরুষতন্ত্রের নিয়ম এবং সেই নিয়ম অনুসারে না চলা পুরুষ জাতির কাছে লজ্জার। এই সামাজিক লজ্জাটিকে ব্যবহার ক’রে, একই ধরণের পণ্যের জন্য একটি আলাদা এবং নির্দিষ্ট ক্রেতাগোষ্ঠী তৈরির চেষ্টা করছে ব্র্যান্ডটি। হেড অ্যান্ড শোল্ডার শ্যাম্পু মূলত খুশকি-নিবারক হিসেবে পরিচিত, কিন্তু এ বিজ্ঞাপনে খুশকির কোনও উল্লেখ নেই। এখানে শুধু এই ধারণাটিকেই প্রতিষ্ঠা করা হয় যে, মেয়েরা যা ব্যবহার করে তা ছেলেদের ব্যবহারের যোগ্য নয়, কারণ মেয়েদের আচার-ব্যবহার ছেলেদের আচার-ব্যবহারের থেকে সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা, এমনকি কিঞ্চিৎ ইতর প্রকৃতিরও, নাহলে আর তাতে লজ্জার কী থাকতে পারে? অর্থাৎ ওলটপালট একটা হচ্ছে বটে, কিন্তু সেটা ছক ভাঙার জন্য নয়, বরং পুরোনো ছককেই প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে। এবং অবশেষে স্টিরিওটাইপের চেনা খাঁচায় ফেরত এসে ঝকঝকে ড্রইংরুমের আধুনিক সচ্ছল দম্পতি স্বস্তির হাসি হাসছে।
এবার দ্বিতীয় বিজ্ঞাপন। এটিতে আবার প্রথম থেকেই চেনা-চেনা দৃশ্যকল্পে ফ্রেম ভরে উঠতে থাকে; বিরাট আয়নার সামনে প্রসাধন করছে এক মেয়ে, ঘর-আসবাব খানদানি পরিচয় বহন করে। তার বাবা তাকে তাড়া দিতে আসেন যেমনটা যে কোনও সিনেমা-সিরিয়ালে মেয়েদের প্রসাধনদৃশ্যের চেনা অঙ্গ। ভীরু গলায় মেয়েটি আশঙ্কা প্রকাশ করে ফেলে – শুধু সিঙ্গাড়া খাইয়ে একটি ছেলের সঙ্গে সারা জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত কী ভাবে নিয়ে ফেলবে সে? বাবা ভুরু কুঁচকে নিরুত্তর বিদায় নেন।
পরের দৃশ্যে, পাত্রপক্ষ সন্তুষ্ট এবং সম্বন্ধ পাকা করতে উৎসুক। কিন্তু, মেয়ের বাবা হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসেন, ছেলে কি রান্না করতে পারে? কারণ ঘরের কাজ না জানলে সে ছেলে তাঁর মেয়েকে সুখী রাখবে কী করে? ছেলের মা নুডল ইত্যাদি বলতে যেতেই তাঁকে থামিয়ে দেন মেয়ের বাবা – নাহ, মেয়ে তাঁর নুডল খেয়ে তো জীবনধারণ করতে পারে না! মা থতমত খেলেও, পাত্র নিজেই এবার জবাব দেয় – সে রান্না শিখে নিতে প্রস্তুত; উপরন্তু, পাত্রীকে সপরিবারে ‘ছেলে দেখতে’ আসার আমন্ত্রণও জানায়। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে – চেঞ্জ ইজ বিউটিফুল, পরিবর্তন সুন্দর।
ওলটপালট হল, এবং ছক ভাঙার জন্যই বলা চলে। কিন্তু, কথা উঠতে পারে, এ প্রশ্ন মেয়েটি সর্বসমক্ষে নিজেই তো তুলতে পারত। তার জন্য সেই বাবা তথা পিতৃতন্ত্রের অভিভাবকত্বের প্রয়োজন পড়ল কেন?
লক্ষ করুন, বিজ্ঞাপনটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিশুদ্ধ পুরুষতান্ত্রিক আবহে বিরাজ করে। রাশভারী বাবা, অভিজাত বাড়ি, পাত্রী দেখতে আসা এবং পাত্রপক্ষকে মেয়ের রান্না খাইয়ে গুণপনার প্রমাণ দেওয়া – সমস্তটাই সনাতন ভারতীয় পরম্পরার অনুসারী যেখানে মেয়েটির সিদ্ধান্ত, পছন্দ, মতামত কোনওটিই ধর্তব্য নয়। মেয়েটিও যথোপযুক্ত ভীরু ও সুশীল। কিন্তু তার মধ্যেই কিন্তু সে নিজের শঙ্কাটি প্রকাশ করে ফেলছে। আবার, ভারিক্কি চেহারা, কাশ্মিরী শাল এবং মিলিটারি গোঁফে যে বাবা পিতৃতান্ত্রিক স্টিরিওটাইপ বাবা-র আদর্শ প্রতিভূ, তাঁর মুখ থেকেই বেরিয়ে আসছে পাত্রের ঘরকন্নায় উপযোগিতার প্রশ্নটি। এবং এহেন প্রশ্নে পাত্রপক্ষ থমকাচ্ছে, যেমন থমকানোর কথা, কিন্তু সম্বন্ধ ভাঙছে না, বরং নতুন পথে চালিত হচ্ছে। ছক উল্টোচ্ছে। এবং পাল্টেও যাচ্ছে। আর সেটাই এই বিজ্ঞাপনের চমক।
বিজ্ঞাপনটি বিবা-র, ভারতীয় সাবেক ধাঁচের পোশাকে আধুনিকতার মিশেল তাদের মূল বিপণনী বার্তা। এখানে সনাতনি ছকে বেড়ে ওঠা মেয়েটি বিবা-র পোশাকে সজ্জিত হয়ে তার মতপ্রকাশের সাহস পাচ্ছে, এবং সেই সাহস থেকে গোটা ছকটিতে ছড়িয়ে পরছে পরের পর বদলের ধাক্কা।
শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনটিতে সমাজের মজ্জাগত লিঙ্গবৈষম্যে ধাক্কা দিয়ে সেখানে ভয় ঢোকানো হচ্ছে, যা স্টিরিওটাইপকেই আরও জোর দিয়ে প্রতিষ্ঠা করছে। পোশাকের বিজ্ঞাপনটিতেও সেই চেনা ছক আছে, কিন্তু ঘটনাপরম্পরা একটা অচেনা দরজা খুলে দিচ্ছে, সেই চমকের ধাক্কাতেই দর্শক হঠাৎ করে এই বৈষম্য ও জেন্ডার স্টিরিওটাইপিং বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছেন, আমাদের সমাজে লিঙ্গভেদের চরিত্র নিয়ে একবার অন্তত ভাবছেন, নতুনকে স্বাগত জানাতে কিছুটা হলেও প্রস্তুত হচ্ছেন হয়তো। বিজ্ঞাপনী জগতে দ্বিতীয় ধরণের প্রচেষ্টা আরও বেশি করে হোক, এটুকুই মনে হয় আপাতত।
Link: http://ebongalap.org/biba-head-and-shoulder-ad-review