25-04-2024 14:16:08 pm
Link: http://ebongalap.org/durgapuja-germany
পুজোয় শেষবার বাড়িতে ছিলাম ২০১৪ সালে। প্রতিবারের মতোই সেবারও সপরিবারে পুজোর ছুটিতে গিয়েছিলাম শিলচর। এরপর আর বাড়ি যাওয়া হয়নি পুজোয়। চার বছর পর এবছরই প্রথম নতুন জামা গায়ে চাপিয়ে, বন্ধুবান্ধবদের সাথে হইহই করে পুজো কাটালাম। জার্মানির যে অঞ্চলে আমি থাকি, তার আশেপাশে দুর্গাপুজো বলতে মাত্র দু’টো — কোলন আর ডুসেলডর্ফ। বন শহরের কাছে থাকায় কোলনে যাব, সেটাই মনস্থ করলাম। ঠিক হলো নবমী আর দশমী, দুদিনই যাব।
প্রবাসী মনের উচ্ছ্বাস পরিমাণে কিঞ্চিৎ বেশি হয়ে যাওয়ায় ভোর ৬টা থেকে সারাদিনই শাড়ি-সহযোগে কাজ সারলাম। কাজের শেষে বন্ধুদের সাথে কোলন পাড়ি। বন্ধু বলতে আমার চেয়ে বেশ ছোট একটি মেয়ে, ঘুটুম, যে এই কয়েকদিনে আমার বোনের মত হয়ে উঠেছে। প্রথমবারের মতো শাড়ি পরা বছর একুশের ঘুটুম, আমার বন্ধু খ্রিস্টিয়ান আর ঘুটুমের বন্ধু ইরানীয় মেয়ে কোজার’কে বগলদাবা করে চললাম আমরা কোলনের উদ্দেশ্যে। পুজো উপলক্ষে ঘুটুমের মা, রীতাদি খুব যত্ন করে শুধু ঘুটুমকেই না, কোজারকেও শাড়ি-টিপ-গয়না পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছিল।
বিশাল বড় হলঘরে সারি সারি চেয়ার-টেবিল পাতা। ঘরে ঢুকতেই মনে হলো কলকাতায় এসে পড়েছি। ঝকমকে শাড়ি আর ঝিকমিকি গয়নাতে কে কাকে পাল্লা দেবে সেই লড়াই গঙ্গা ছাড়িয়ে রাইনতীরেও এসে পৌছেছে দেখে কিছুটা বিরক্ত হলাম। আরও বিরক্ত হলাম একটি বিশেষ প্রজাতির মহিলাদের দেখে। শুনতে খারাপ মনে লাগলেও, বিদেশে থাকতে শুরু করার পর থেকে এই বিশেষ ধরনের ভারতীয় (এবং বাঙালি) মহিলাদের সাথে আমার বারকয়েক সাক্ষাৎ হবার (কু/সু)-ভাগ্য হয়েছে। যতবারই দেখা বা কথা হয়, বুঝতে পারি যে এনাদের জীবনের বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে অন্য মহিলাদের জীবন-জীবিকা সম্পর্কে অস্বাভাবিক কৌতূহল। “তুমি কী করো?”, “কত মাইনে পাও?”, “বিয়ে করেছো?”, “কেন করোনি?”, “একা একা সব জায়গায় যাও?”, “রাতবিরেতে এমন জামাকাপড় পরে বেরোও যে ভয় করেনা?”... ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয়েছে আমায় বহুবার। এদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই মহিলাদের গতানুগতিক জীবন বা চিন্তাধারার সাথে খাপ খায় না এমন কিছু দেখলেই তা নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিতে হবে। শুধু আলোচনা কেন, রীতিমত আড্ডার বিষয় করে তুলতে হবে আলোচ্য মহিলা বা তাঁদের জীবনচর্যাকে। এরকমই এক মহিলা সেদিন আমার পাশের চেয়ারটিতে বসেছিলেন। কথায় কথায় আমার অবিবাহিত জীবন ও তরুণ গবেষকের মাইনের বহর শুনে নির্দ্বিধায় শুনিয়ে গেলেন তাঁর ছেলের মাসকাবারির ফর্দ। কত বড় বাড়ি, বউকে কী গয়না দেয়, কত টাকা বছর গেলে পকেটে তুলে আনে ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা সময়ের পর বিরক্ত হয়ে অভদ্র হতে শুরু করে দিলাম আমি। ধৈর্য্যেরও একটা সীমা থাকে!
যাইহোক, বন্ধুদের সাথে হুলিয়ে আড্ডা-মেরে, ভোগের প্রসাদ সাঁটিয়ে বাড়ি ফিরেই পরের দিনের প্রস্তুতি। দশমীর দিন সাবধানতায় কিছু বাকি রাখিনি। পুজোর হলঘরে ঢুকতেই চারদিক মেপে নিলাম। দ্বিতীয় দিনে এখানকার বাঙালি বন্ধুদের দলের সাথে গিয়েছিলাম বলে আগে থেকেই দূরত্ব বজায় রাখার সুবিধে ছিল। একদল ছেলের মাঝে আমি একা মেয়ে দেখে কোনও অতি-কৌতূহলী কাকিমা/জেঠিমা’রা আমার সাথে বকরবকর করতে এলেন না। হাজার খুঁজেও আমার প্রবাসের নবমীসন্ধ্যা মাটি করে দেওয়া বুড়িকে সেদিন আর দেখতে পেলাম না। আমার অতি-সাহসী উত্তর শুনে হার্ট ফেল করে যায়নি আশা করি।
প্রবাসে পুজো কাটানোর কয়েকটা বিশেষ দিক আছে। সারা বছর ধরে যত শাড়ি-গয়না কেনা হয়, তার এক রকমের অলিখিত প্রতিযোগিতা হয় পুজোর এই কয়েকটা দিনে। এটা বললে ভুল বলা হবে যে, প্রবাসে পুজোর সবটাই ভাঁওতা বা লোকদেখানোর মেলা। তা একদমই নয়। কোলনের পুজো দেখে আমার ব্যক্তিগতভাবে বেশ গর্বই হলো যে দেশ থেকে সাত হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাংলা গান, নাচ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক রীতিগুলিকে চেনানোর একটা সৎ প্রচেষ্টা রয়েছে। বিদেশের মাটিতে জন্মানো, বড় হওয়া ছেলেমেয়েরা এই চারদিন বাংলায় কথা বলছে। ভালো লাগে দেখে যে প্রবীণেরা দোতারা হাতে মঞ্চ মাতাচ্ছেন, পাড়ার দাদুদের মত চেয়ার পেতে নজর রাখছেন কে চাঁদা না দিয়েই খিচুড়িতে ভাগ বসাতে ব্যস্ত।
কিন্তু এত সবের পরেও মনের ভেতর খচখচ করতে থাকে। স্বজাতির কাছে দুঃখ পাওয়া সবসময়েই একটু বেশি কষ্টের। আমার দক্ষিণ এশীয় মধ্যবিত্ত নারী জীবন এতদিনে পুরুষদের থেকে অস্বস্তিকর আচরণ বা প্রশ্নে অভ্যস্ত। আমি প্রস্তুত ছিলাম না আমার মতই আরেক প্রবাসী নারীর মধ্যে সেই সমস্ত সংকীর্ণতা দেখার, যা অনেক দূরে সরিয়ে রেখে জীবনে এগিয়ে আসতে চেয়েছি। শুধু ব্যক্তিগত প্রশ্নবাণে জর্জরিত করার ব্যাপারে নয়। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম এই কয়েক বছরে। অনেক ভারতীয় নারীরা বিদেশবাসী হন তাঁদের জীবনসঙ্গীদের কর্মক্ষেত্র বদলের কারণে। নতুন দেশে, পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া সত্যিই অনেক কষ্টের এবং সময়সাপেক্ষ, তা মানি। কিন্তু নাগরিক সমাজে বেড়ে ওঠা মেয়েদের জন্য এতটাও কষ্টের হয়ত নয়, যে এই অবসাদ বা বিরক্তি কাটানোর কোনও উপায় সে নিজে বের করতে চেষ্টা করবে না। জার্মানি যেহেতু অন্যরকম একটি দেশ, এখানে নতুন করে বাসা গড়তে গেলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন হয় ভাষার ওপর ন্যুনতম দক্ষতা, যেটা ছাড়া চাকরি বা পড়াশোনা, এমনকি রোজকার বাজার-হাটও বেশ সমস্যাজনক হতে পারে।
আমরা স্বীকার না করলেও, সংকীর্ণমনস্কতা বর্তমান সময়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। এর যে প্রতিরোধ দরকার, তা উপলব্ধি না করতে পেরে অনেকেই মেতে উঠছি সংকীর্ণতার, এক ধরনের সামাজিক অস্পৃশ্যতার চর্চায়। যে মেয়েটি স্বেচ্ছায় একা থাকে, বা যে মেয়েটি বিবাহবিচ্ছেদের সাথে যুঝতে হিমসিম খাচ্ছে প্রতিনিয়ত বা যে মেয়েটি সত্যিই সুখী তাঁর দাম্পত্য জীবনে, তাঁকে আর নতুন করে আপনাদের অনধিকারমূলক প্রশ্নে ঘিরে দেবেন না। বরং জানতে, চিনতে চেষ্টা করুন পাশের মানুষটিকে। বুঝতে চেষ্টা করুন তাঁর জীবনের অভিঘাতের সাথে আপনার পার্থক্য। প্রবাসে জীবন সত্যিই অনেক কঠিন। সে কারণেই, অকারণ প্রতিযোগিতায় ভরে দেবেন না নিজের অন্তরটুকু।
দেবীপক্ষের শেষলগ্নে এসে অসুরবধের চেষ্টা করুন। স্বজাতির বিরুদ্ধে ত্রিশুল নয়, একে অন্যের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ান। বুঝুন, আমাদের সবার লড়াই কোথাও গিয়ে আসলে একই। চেষ্টা করুন অন্য কারো হেরে যাওয়ার কারণ না হতে, ভাগ করে নিন নিজের ছোট-বড় সব জয়-পরাজয়।
তবেই না বুক ফুলিয়ে বলবেন, ‘শুভ বিজয়া”।
Link: http://ebongalap.org/durgapuja-germany