19-04-2024 06:51:47 am
Link: http://ebongalap.org/ebong-alap-special-blog-on-world-disability-day
কিছুদিন আগে বাবা বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরের একটি দর্জির দোকানে গিয়েছিলেন একটি প্রয়োজনে। নাম ঠিকানা জানার পর কথায় কথায় দর্জির মালিক সহসা বাবাকে বলেন, “ঐ গ্রামে বুবাই বাগ নামে এক অধ্যাপক আছেন, আপনি চেনেন?” বাবা বেশ কিছুটা গর্বের সঙ্গেই বলেন, “বুবাই বাগ, আমারই ছেলে”। এই গর্ব বা অহংকারের বেশ মিল আছে কয়েক বছর আগের জনপ্রিয় বাংলাছবি ‘মুক্তধারা’র সঙ্গে। সেখানে অরিন্দম চ্যাটার্জী (ব্রাত্য বসু, এক বধির সন্তানের পিতা) তাঁর পাশে বসা ভদ্রলোক এক বধির শিশুর নাচের প্রশংসা করলে, অরিন্দম বাবু ভেতর থেকে গর্ব অনুভব করে দুইবার বলেছিলেন ‘আমার মেয়ে’।
সাধারণ চেতনায় সেই গর্বের তেমন কোনো মানে না থাকলেও, প্রতিবন্ধকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করার সৌভাগ্যে এই আপাত দুটি গর্বের মধ্যে অনেকাংশে মিল চোখে পড়ে। এই দুই আখ্যানের (একটি সিনেমায় কাল্পনিকভাবে নির্মিত এবং অপরটি বাস্তবিক উপলদ্ধি) মধ্যে আপাত মেলবন্ধন থাকলেও বাস্তবে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের পারিবারিক স্তরে একধরনের গতানুগতিক পরিসরের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে হয়। সেই গতানুগতিকতায় বাবার থেকেও মায়ের সংগ্রাম বা লড়াই নিঃসন্দেহে পৃথক পরিচয়সত্তা নির্মাণ করে। এই লেখনীতে একদিকে সামাজিক স্তরে পিতামাতার ভূমিকা আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক স্তরে মায়ের ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখিত হবে।
বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবন্ধকতাকে ‘কর্মফল’ এবং পাপপুণ্যের নিরিখে দেখা হয়ে আসছে। সেই কর্মফল ও পাপপুণ্যের জগতে শুধু প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তি নয়, একই সঙ্গে তার পিতামাতার কর্মফল বা পাপপুণ্যকেও সমানভাবে দায়ী করা হয়। আবার অনেক কল্পকথায় বা ঐতিহ্যে প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্মের জন্যও তার পিতামাতাকে দায়ী করা হয়। সেই চেতনা আজকের দিনেও সমানভাবে দেখা যায়। এই চেতনা থেকে প্রতিবন্ধী সন্তানের পিতামাতারাও নিজেরা সামাজিক লজ্জা ও অপমান থেকে রক্ষা পেতে অন্তরালে থাকতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে তাঁদের অংশগ্রহণে খুব একটা আগ্রহ থাকে না। সন্তানের প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনের সদা কৌতূহল যেমন অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে, তেমনই তাদের অসচেতন কথাবার্তা পিতামাতার কষ্টের কারণ হয়ে ওঠে। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টিকে স্পষ্ট করা দরকার। যেমন, দৃষ্টিহীন সন্তান কীভাবে মাছ ছাড়িয়ে খায়? সেই প্রশ্নে জেরবার হতে দেখেছি অসংখ্য বাবা মাকে। আবার চলনজনিত প্রতিবন্ধী মানুষ কীভাবে নিজের প্রাত্যহিক কাজ (স্নান করা, প্রাতক্রিয়া করা ইত্যাদি) করে, সেই নিয়ে অনবরত প্রশ্নের সন্মুখীন হতে হয়। এই চেতনা থেকেই প্রতিবন্ধী সন্তানদের পিতামাতারা জনসমক্ষে আসতে একটু দ্বিধাবোধ করেন।
তার পশ্চাতে অবশ্য দীর্ঘকালীন দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করতে হয়। পারিবারিক স্তরে বেশিরভাগ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষেরা ‘না মানুষ’ থেকে যাওয়ার জন্যে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের অবহেলার শিকার হতে হয়। বাংলা সাহিত্যে এই ধরনের অজস্র নজির আছে। সাহিত্যগত উপস্থাপনায় দেখা যায় পিতামাতাসহ পরিবারের অন্য সকল সদস্য গভীর যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে চলেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রজনী’ উপন্যাসে রজনীর পিতাকে দেখা যায় অন্ধ কন্যাকে বিয়ে না দিতে পারার গভীর যন্ত্রণা ভোগ করতে। আবার সুভার পিতা বানীকণ্ঠ ‘বোবা কালা’ মেয়েকে গভীর সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে ‘খোঁড়া মালা’কে নিয়ে মালার মায়ের মত কুবেরের জীবনও ক্রমে কষ্টকর হয়েছিল। প্রতিবন্ধী সন্তান নিয়ে যে পিতামাতারা কত ধরনের অত্যাচার, কষ্ট ও যন্ত্রণা ভোগ করেন, তার দৃষ্টান্ত মেলে মতি নন্দী’র ‘ছোটবাবু’ উপন্যাসে দীপাঞ্জনের মা উৎপলার কণ্ঠে, ‘পাড়ার লোকেরা প্রতিবেশী এমনকি সহ ভাড়াটেরা ওকে নিয়ে হাসাহাসির জন্যই এখানে বাড়ি করে উঠে আসতে বাধ্য হয়েছি’।
দীপাঞ্জনের মায়ের উৎকণ্ঠা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় নূতন না হলেও, আমি কিন্তু মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি লড়াইের হাতেখড়ি। এ প্রসঙ্গে গত বছরের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। ২০১৬ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর বিকালে এক বন্ধু বেশ আনন্দের সঙ্গে ফোনে অনর্গল বলতে লাগলো, ‘দেখলি! রিও-তে প্যারালিম্পিকে মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেলু নামে একজন সোনা পেয়েছে’। কিছুক্ষণের মধ্যে বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে অভিনন্দনের বন্যা লক্ষ করে বেশ গর্ববোধ করলাম। স্বাভাবিক প্রশ্ন আসছিল, তাহলে, কী প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের তথাকথিত অপ্রতিবন্ধকতার সমাজ সাদরে গ্রহণ করবে? মনে মনে বেশ আনন্দ অনুভব করছিলাম। সেই আনন্দ থেকে ক্রমে অশ্রু নির্গত হতে লাগল, যখন জানতে পারলাম অন্য আর পাঁচজন সাধারণ প্রতিবন্ধকতার মত মারিয়াপ্পানের জীবনে যা কিছু অবদান তাঁর মায়ের জন্য। তাঁর জীবনে ওঠাপড়ার সঙ্গে মায়ের অবদান অনস্বীকার্য। একথা সত্যি যে ভারতীয় সমাজে আবহমানকাল ধরে মায়েদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা সকলেই স্বীকার করেন। বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তির কথা আমাদের অজানা নয়। নানা কল্পকথার মাধ্যমে ছোট থেকেই সেই গল্প শুনে এসেছি। তবে মারিয়াপ্পানের মাতৃভক্তির ধরন যে বেশ কিছুটা অন্যরকম তা আমি খুব সহজেই অনুধাবন করতে পেরেছি। কিছুটা হলেও একই গতিধারার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তো আমাদের অনেকেরই জীবনযাত্রা।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, আমার প্রতিবন্ধকতা জন্ম বা জিনগত নয়। এটি নেহাতই চিকিৎসাবিদ্যার ব্যর্থতা (ভুল চিকিৎসা) থেকে পোলিও দ্বারা সৃষ্ট। তার সঙ্গে জড়িত অশিক্ষা, কুসংস্কার এবং দারিদ্র। ব্যক্তিগত ভাবে আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলেও, আমার প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে ঠাকুরদেবতার খুব একটা সম্পর্ক ছিল না বলেই বিশ্বাস করি। তথাপি ছোট থেকেই দেখেছি, পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ আমার মাকে প্রতিবন্ধকতার জন্য দায়ী করে একাধিক দৈব পদ্ধতির মাধ্যমে যুক্ত করার চেষ্টা করত। সেই প্রক্রিয়াতে আমাকেও এমনভাবে যুক্ত করত যেন মা আর আমি শুধু ভগবানের অভিশাপে প্রতিবন্ধকতার জগতে প্রবেশ করেছি।
যাই হোক, সেই দায় থেকে মুক্তি এখনও পাইনি। তবে যা পেয়েছি, সবই মায়ের জন্য। মাত্র ২০-২২ বছর বয়সে তথাকথিত অল্প শিক্ষিত গ্রামীণ গৃহবধূ বেরিয়ে পড়েছিল, ছেলেকে ‘ভালো’ (অপ্রতিবন্ধী) করার অভিপ্রায়ে। সঙ্গে ছিল গভীর সাহস ও হেরে না যাওয়ার অসীম মানসিকতা। সেই কাজে সবসময় যে বাবাকে পাশে পেয়েছিল, তা নয়। পোলিও আক্রান্ত এক বছরতিনেকের সন্তান নিয়ে চলেছিল লড়াই। উপযুক্ত আর্থিক সঙ্গতি না থাকায়, ধারদেনা করেই ছুটেছিল কলকাতা শহর ও জেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ঠাকুরস্থানের দরজায় দরজায়। ‘ভালো’ বা তথাকথিত সম্পূর্ণ সুস্থ করতে না পারার আক্ষেপ পদে পদে লক্ষ্য করেছিলাম।
তবে আজকে আমার শিক্ষাদীক্ষা যা কিছু সবই মায়ের জন্য। আর আমার হার না মানা মানসিকতাও এসেছে মায়ের কাছ থেকে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে অপর্ণা সেন পরিচালিত ‘পারমিতার একদিন’ ছবির কথা। যেখানে প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত পারিবারিক চাপে কিছুটা বাধ্য হয়ে স্বামীর ঘর ত্যাগ করে চলে যান।
গ্রামীণ ঐতিহ্যে একইরকমের পারিবারিক বা সামাজিক চাপ আমার বা মায়ের জীবনে অনেক সময় এসেছে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই পিছিয়ে না গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইের মাধ্যমে সকলকে আপন করে নিয়ে মা নিজের সঙ্গে তাঁর সন্তানের পৃথক সত্তা নির্মাণ করতে বদ্ধপরিকর। আজকের দিনেও সেই লক্ষ্যে অবিচল। সেই কাজে যে অনেকাংশে সফল, তা সমগ্র অঞ্চলের লোকজনের কথোপকথন থেকে জানা যায়। আজও কেউ আমার বর্তমান অবস্থার কথা শুনলে, সহসায় বলে, ‘তোমার মা জীবনে অনেক লড়াই করেছেন, আজ তুমি তার ফল পাচ্ছো’। কথাগুলি সর্বাংশে সত্যি শুধু নয়, শুনলেও গর্ব অনুভব করি।
মায়ের লড়াই নিয়ে সে ধরণের বিশেষণই ব্যবহার করি না কেন, তা খুব কম মনে নয়। শুধু এটুকু বুঝি, আমার জীবনে যা কিছু, সবই মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। মায়ের লড়াই শিখিয়েছে, জীবনে কোন কিছুই তুচ্ছ বা অবজ্ঞার হতে পারে না। কীভাবে সব পরিস্থিতিতে নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে হয়। কীভাবে কোনো অবস্থায় দমে না গিয়ে নিজের মত বড় হতে হয়। সেই পথে যতই বাধা বা ‘তথাকথিত প্রতিবন্ধকতা’ আসুক না কেন, তা তুচ্ছজ্ঞান বা অবহেলা করতে হয়। এই চেতনা থেকেই হাওড়া স্টেশনের ১৫ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ব্রিজ পর্যন্ত হামাগুড়িয়ে যাতায়াত করতে পেরেছি। বাড়ি থেকে ১ কিলোমিটার হামাগুড়িয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাতায়াত করেছি প্রতিদিন। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনতলা বা একতলায় হামাগুড়িয়ে অনায়াসে যাতায়াত করেছি। ছাত্রাবাসেও থেকেছি দোতলায়। কোনো অবস্থাতেই নিজের প্রতিবন্ধকতাকে অস্ত্র বা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে সাহস পাইনি। তাই হাঁটাচলার দৃশ্যত অসুবিধা থাকলেও বা দুটি ক্র্যাচের সহযোগে যাতায়াত করলেও বিশ্বাস হয় না আমার সামনে কোনো প্রতিবন্ধকতা বা বাধা থাকতে পারে।
Link: http://ebongalap.org/ebong-alap-special-blog-on-world-disability-day