26-04-2024 18:17:54 pm
Link: http://ebongalap.org/editorial-6-december
ধর্মের নামে হিংসা কেবল আমাদের সময়ের বা আমাদের সমাজের বাস্তব নয়। তবে মূলত দুটো কারণে প্রশ্নটা আরও বেশি করে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে।
এক, আমাদের দেশের এক অতি শক্তিশালী দল আমাদের দেশটাকে হিন্দুদের দেশ হিসেবে পুনরুদ্ভাবন করার চেষ্টা করছে, আমাদের লম্বা ইতিহাসের মিশ্রিত ঐতিহ্যগুলোকে অস্বীকার, ধ্বংস, দখল করার প্রয়াস চালাচ্ছে, এবং আপাতত কিছুটা সফলও হচ্ছে। একদিক থেকে দেখতে গেলে বিশাল এই দেশের নানা ভাবে বেঁচে থাকা কোটি কোটি মানুষের নানা সমস্যার মুখ আপাতত এক ‘হিন্দু ভারতের পুনরুদ্ধারের’ দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাজমহল থেকে পদ্মাবতী পর্যন্ত নানান বিতর্ক ও আক্রমণে এই রাজনীতির নানান চেহারা আমরা দেখতে পারছি।
দুই, ইতিহাসের এই মুহুর্তে, সোভিয়েতের পতন, বাজারের কর্মসূচিতে চিন ও ভিয়েতনামের উৎসাহী অংশগ্রহণ, কমিউনিজমের ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে তাত্ত্বিক সংশয় ইত্যাদি সব মিলিয়ে আজকের বিভক্ত দুনিয়ার চেহারাটা যেন মার্কিন (ও পশ্চিমি) সাম্রাজ্যবাদ বনাম ইসলাম হয়ে উঠেছে। খুব সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার কিছু পারমাণবিক দাবী, চিনের সঙ্গে এশিয়ার কিছু দেশ, যার মধ্যে ভারতও আছে ইত্যাদির মহড়া, এই জাতীয় কিছু গন্ডগোল বাদ দিলে, গত দুই তিন দশকের মূল দ্বন্দ্বগুলো কিন্তু পশ্চিম বনাম পশ্চিম এশিয়াতেই ঘটেছে। তার বাইরে আফগানিস্তানও আবার সেই মুসলমান প্রধান দেশ।
যদিও পরিস্কারভাবেই এই লড়াইয়ের মূল কারণ তেলের উৎসের দখলদারি, (আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে পাইপলাইন) তবু চিরকালের মতই এই লড়াইকে প্রগতি ও পশ্চাদপরতা, আধুনিকতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি, সভ্যতা ও অসভ্যতার দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তালিবানকে যে তৈরি করা হয়েছিল বাইরের শক্তির স্বার্থে, সাদাম থেকে শুরু করে সিরিয়া পর্যন্ত গল্পটা যে আলাদা নয়, এই নিয়ে আলোচনা করে খুব লাভ হচ্ছে না।
এর ফলে চারপাশে আমাদের সমাজ আরও বেশি করে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। ইসলামের ওপর যত আক্রমণ বাড়ছে, তত ইসলামি সমাজের গোঁড়াদের সুবিধে হচ্ছে, ভীরু সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানোর। আমাদের সামাজিক পরিবেশ তাদের সুবিধে করে দিচ্ছে। পাশাপাশি ‘হিন্দুত্ব’ এক মারকুটে হিন্দুত্বের প্রচার চালাচ্ছে। এই নতুন হিন্দুত্বের সমর্থনে কিন্তু সবচেয়ে বেশি গলা ফাটাচ্ছে সামাজিক ক্ষমতালোভী শ্রেণি। তাই যাদের কোনও অভাব নেই, তাদের রাগ যেন সবচেয়ে বেশি। সাধারণভাবে আমাদের দেশের মুসলমানরা অনেক বেশি গরিব, অনেক বেশি অবহেলিত। কিন্তু তাদের ওপরেই সবচেয়ে বেশি রাগ, যেন তারাই আমাদের সব সমৃদ্ধির পথে কাঁটা। এই মুহূর্তে ভারতের জনসংখ্যার ৮০% হিন্দু, ১৪% মুসলমান। মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আগের দশকগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে, তবু ন্যাশনাল টেলিভিশনে একজন স্বনামধন্য গুরু এসে বলেন যে ‘ডেমোগ্রাফিক ব্যালেন্স’ বজায় রাখাই আমাদের দেশের মূল সমস্যা। বোঝা যায় না যে দুনিয়ায় সম্পদ বেশি বেশি করে কয়েক জনের কুক্ষিগত হচ্ছে সেখানে এই ১৪% শতাংশ গরিব মুসলমান মানুষ দেশের প্রধান বিপদ হয় কী করে?
কিন্তু বাস্তব এই যে এই প্রচার চলছে, এবং পুরোপুরি ব্যর্থ মোটেই হচ্ছে না। এ কথাও সত্যি যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ফেল করেছে’ এই রকম একটা কথা চারপাশে গেড়ে বসছে। তাহলে কী করা যাবে? কী করে যেকোনও ধর্মের মানুষকে পোড়ানোর লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া যাবে?
তাঁদের লেখায় শর্মিষ্ঠা ও সীমান্ত শুভবুদ্ধির কথা বলেছেন, যে বুদ্ধির মানবতা ধর্মের পরিচয় মানে না। এ কথা নতুন নয়। শর্মিষ্ঠার বর্ণনায় কিছু কিছু মানুষ বলেছেন, কী করে মিডিয়া ভুল খবর দেয়, কার্যত অনেক সময় দাঙ্গা ছড়ায়। এ অভিজ্ঞতাও নতুন নয়। ষাটের দশকে কলকাতার দাঙ্গার পটভূমিকায় লেখা উৎপল দত্তের ‘দ্বীপ’ নাটক বামপন্থীদের উদ্যোগে পাড়ায় অভিনীত হত, তাতে এই বক্তব্য পরিষ্কার রাখা ছিল।
আমি সামাজিক গন্ডির দিক থেকে হিন্দু। হিন্দু মৌলবাদীদের বিষয়ে যতটা জানি, তাদের অত্যাচার ও তার বিরুদ্ধে হিন্দুদের মধ্যে থেকেই প্রতিবাদ সম্পর্কে যেটুকু খোঁজ রাখি, মুসলমান সমাজের ভেতরের নানান দ্বন্দ্ব বিষয়ে তার কণামাত্রও জানি না। তাই ফারুকউল ইসলামের লেখাটা আমাকে অন্য একটা দিক সম্পর্কে জানালো। এই ধরণের আলোচনা যত আমরা করব ততই নানান আড়াল ঘুচবে। অনেক সময়ই বলা হয় যে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে হিন্দুদ্রোহিতা আর মুসলমান তোষণ, আমাদের সব রকমের হিংস্রতার বিরুদ্ধে আরও বেশি বেশি করে মুখ খোলা দরকার।
সাবিরের লেখাটায় একটা গভীরতর প্রশ্ন আছে, যেটা আজকাল আমাদের অনেককেই ভাবায়। প্রশ্নটা হল সামাজিক ঘৃণার। সাবিরের লেখায় মুসলমান মৌসির হাতে বড় হওয়া রঘুবীর প্রশ্ন করে, শরীরের কোন রসের প্রভাবে মানুষ মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে এতটা ঘৃণা করতে পারে? যৌনপল্লীতে যে মেয়েটিকে গতকাল আদর করেছি, আজ তাকে টুকরো করে কাটছি কী করে?
আমাদের চলমান ইতিহাসের পথে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এই প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া যায়নি। শুভেন্দুদা তাঁর লেখায় ‘শরীরের’ ব্যবহারের কথা বলেছেন। ১৯৬৪-র দাঙ্গায় যাদবপুরের বামকর্মীদের দেখেছি সারা রাত জেগে লাঠি রড নিয়ে দেশভাগের পর হিন্দু উদ্বাস্তু কলোনিতে থেকে যাওয়া মুসলমানদের বাড়ি পাহারা দিতে। এই বামকর্মীরাও সকলেই দাঙ্গায় দেশ ছেড়ে এসেছেন, তাতে তাঁদের সাম্প্রদায়িক হতে হয়নি।
কিন্তু দু:খের বিষয় এই যে একদিন স্থানীয় স্তরে দেখা সেই বামপন্থীরা দুনিয়াজোড়া ছবি হয়ে উঠতে পারেননি। বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতেও ইহুদিদের খুন করা হয়েছে গণহারে, পড়শিরাই লুঠ করেছে তাদের বাড়ি ঘর, মেটিয়াবুরুজ আর গুজরাটের সঙ্গে গুণগত কোনও ফারাক পাওয়া যায়নি। চিনেও জাতি দ্বন্দ্ব বন্ধ হয়নি একেবারে। জিতেন নন্দি লিখেছেন কী ভাবে বাম শ্রমিক আন্দোলন কর্মীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব তাঁকে বিস্মিত ও হতাশ করেছে। ভাবতে বাধ্য করেছে, কোন পথে তবে বদল আসবে?
এক কথায় উত্তর আমরা জানি না। তবে সাবিরের লেখায় এক আশ্চর্য পাড়ার কথা আমরা পাই যেখানে বিকাশ ঈদের সময় নিয়ম করে রোজা রাখেএবং ঈদ পাল নকরে। পূজা কমিটির সদস্য জাহাঙ্গীর ফি বছর পূজার দিনগুলো উপবাস করে কারণ তাকে পুরোহিতকে সাহায্য করতে হয়। বিসর্জনের আগে আয়েশা সিঁদুর খেলে বাড়ি ফেরে, দেখে তাজিয়া তৈরি হচ্ছে, পরের দিন মহরম যে।
ভাবি এই মৃত্যু উপত্যকা না হয়ে যদি ওই পাড়াটা সবার দেশ হত!
- সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
Link: http://ebongalap.org/editorial-6-december