26-04-2024 07:09:17 am
Link: http://ebongalap.org/from-jishu-to-jiya
আমি জিয়া, এই নামটা আমি নিজেই নিজেকে দিয়েছি৷ পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই একটি মানব শিশুর গায়ে যে ট্যাগগুলো সেটে দেওয়া হয়, তার মধ্যে সর্বপ্রথম (বোধহয় প্রধানও)ট্যাগটাই হল লিঙ্গের৷ তারপর ধর্ম-বর্ণ-জাতি ইত্যাদি৷ সে-সব দিকে আর না গিয়ে বরং লিঙ্গগত পরিচয় যেটুকু নিয়েই কথা বলা যাক৷
জন্মগতভাবে আমি একটি পুরুষ শরীরের অধিকারী৷ বাবা-মা নাম রেখেছিলেন যীশু৷ ভারী ভাল নাম না? কিন্তু কী করব বলুন, আমাদের সমাজে নাম শুধু ''নাম-মাত্র''' হয়ে তো থাকে না৷ এর পেছনে সমাজ নির্ধারিত একটি বাঁধা গল্পও থাকে৷ শুধু নামটুকু বদলে দিলেই গল্পগুলোও নিজে থেকেই বদলে যায়৷ তাই যীশু থেকে জিয়া হওয়া৷ কিন্তু যত সহজে বললাম তার চেয়ে বহুগুণ কঠিন ছিল এই মাঝখানের যাত্রাপথটুকু৷
আমার নিজের অন্তর-বাহিরের দ্বন্দ্ব বা পারিবারিক টানাপোড়েনের দিকে যাচ্ছি না৷ সেগুলো তো সহজেই অনুমেয়৷ একটু অন্য লড়াই-এর গল্প শোনাই—তখন সদ্য গ্রাজুয়েশন শেষ করেছি ছোটবেলা থেকে সংসারে আর্থিক অনটন দেখে বড় হয়েছি, ফলে খুব তাড়াতাড়ি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর তাগিদ ছিল৷ হঠাৎ করে বাবার হার্ট অ্যাটাক হল। সেভাবে জমানো টানা নেই, বোন স্কুলে পড়ে আর মা গৃহবধূ৷ আত্মীয়-স্বজনের কাছে ধার করে বাবাকে সুস্থ করা গেল৷ আমার টিউশানির কটা টাকায় কোনোমতে আধবেলা খেয়ে সংসার চলছে৷ আমিও পড়ানোর পাশাপাশি দু-একটা বাড়িতে পরিচারিকার কাজ পেলাম৷ তাও মাস গেলে টেনেটুনে তিন হাজার৷ চাকরির চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। যেখানেই ইন্টারভিউ দিতে যেতাম, কথাবার্তা বলার পর বলা হতো, জানানো হবে। বলা বাহুল্য, কোনো জায়গা থেকেই কখনও ডাক আসেনি। বা বলা হতো, এখন লোকের প্রয়োজন নেই। পরে জানতে পারতাম, এর পাশাপাশি পরিচয় নিয়ে অবমাননা তো ছিলই৷ তবে এসবের মাঝেই আমার এক টুকরো আকাশ ছিল GBSS (গৌড়বঙ্গ সংহতি সমিতি)৷ এটা রূপান্তরকামী মানুষদের নিয়ে তৈরি একটি self help group৷ ২০১২ সালের ১৪ এপ্রিল আমরা, মালদার কিছু কমিউনিটির মানুষজন বসে এরকম একটা সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিই। প্রথমবার বসে শুধু এখানেই একমাত্র নিজেকে নিজের মত করে মেলতে পারতাম৷ নিজেদের ইচ্ছেমতো পোশাক পরতাম সেখানে, নিজেদের মনের কথা বলতাম, নিজেদের বাড়ির সমস্যা শেয়ার করতাম। এখন মালদার অনেক জায়গাতেই এই গ্রুপটি কাজ করে, এইচআইভি নিয়ে সচেতনতামূলক কাজ, একে অপরের পাশে থাকা ইত্যাদি কাজ করে গৌড়বঙ্গ সংহতি সমিতি। হরিজন সম্প্রদায়ের বাচ্চাদের জন্য স্কুল খুলে তাদের পড়ানোর কাজও এখন করছি আমরা।
যাই হোক, অনেক জায়গায় চাকরীর সন্ধান করেও শুধুমাত্র তথাকথিত 'পুরুষ' এবং 'নারী' পূর্ণরূপে কোনোটিই না হওয়ার জন্য যখন কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই করতে পারিনি, তখন বেশ কিছুদিনের জন্য হিজরা হিসাবে অন্নসংস্থানের জন্য কাজ করেছি। কিন্তু সেই কাজ মন থেকে করতে চাইতাম না। তারপর সেই সময় এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারি বিহার-উত্তরপ্রদেশ এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় অভিজাত পরিবারগুলিতে বিয়ে ইত্যাদি শুভ অনুষ্ঠানে আমাদের মত যারা, তাদের নিয়ে গিয়ে নাচানো হয়, যার পোষাকি নাম ‘লগন ড্যান্স’৷ এতে আবার নাকি প্রচুর পয়সা৷ এক-একটি বিয়ের মরশুমে সত্তর থেকে একলক্ষ পর্যন্ত রোজগার করা যায়৷ ঘরে এরকম টানাটানি, অন্য উপায় না দেখে রাজি হয়ে গেলাম৷ শুধু নাচই তো . . . এতে যদি নিজের পরিচয় নিয়ে খাওয়া-পরাটা অন্তত জুটে যায়, মন্দ কি . . .! এমনিতে নাচ-গান আমি ভালোই বাসতাম, বিশেষত নাচ৷ সুর-ছন্দ-লয়ের শরীরী চিত্রাঙ্কন অপূর্ব লাগত৷ কখনো প্রথাগতভাবে শেখার সুযোগ হয়নি, কিন্তু TV-তে দেখে খুব তাড়াতাড়ি তুলে ফেলতে পারতাম৷ যাই হোক, প্রথম লগনে যাই বিহারের একটি গ্রামে৷ প্রচণ্ড রোদে তেতে ওঠা বৈশাখ মাসের গরমে বেলা দশটা থেকে বিকেল চারটে অবধি নাচ, ভোজপুরী চটুল গানের সাথে৷ সেই সাথে বাড়ির প্রত্যেক পুরুষদের মনোরঞ্জন৷ সবথেকে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি থেকে শুরু করে বাদ যায়নি নব বরটিও৷ ওখানে ওটাই প্রথা৷ পৌরুষ প্রদর্শণের ওটাই রীতি৷ আমি নাচছি আর আমার শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে অসংখ্য পুরুষের হাত-ঠোঁট৷ সেই সঙ্গে চলছে বন্দুক৷ এতটুকু ক্লান্ত হওয়ার যো নেই৷ নইলে মালিক পুরো টাকা পাবেন না৷ এর সাথে থাকত অনেক কে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও৷ কী বললেন? পুলিশ . . .!!! যারা নাগরিকের অধিকার পেল মাত্র ক-দিন এবং যাদের কোনো গননাই নেই, তাদের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে কার কি এসে যায় . . .? দিনের পর দিন অসহ্য যন্ত্রণায় কেটেছে৷ সূর্য ডুবলেই শরীর-মন ঘিরে নেমে আসত গভীর অবসাদ৷ অনেকবার আত্মহত্যার কথাও ভেবেছি কিন্তু প্রতিবারই ভেসে উঠেছে বাবা-মা-বোনের মুখ৷ ওরা যে একেবারে ভেসে যাবে৷ এই তীব্র লড়াই-এর মাঝে একদিন GBSS-এর মাধ্যমেই খোঁজ পেলাম প্রান্তকথার আর সেই সংগঠনের মাধ্যমেই আমি আজ কোলকাতার একটি সুপ্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে O.T টেকনিশিয়ান হিসেবে শিক্ষারত৷ জীবনদানে সহায়তার প্রশিক্ষণ নিচ্ছি৷ একটাই বেদনা এখনও কুঁড়ে কুঁড়ে খায় প্রতিদিন৷ আমি নিজে আজ আলোর সন্ধান পেয়েছি বটে কিন্তু এখনোও অনেকে অন্ধকারে আলো অপেক্ষায় . . .
Link: http://ebongalap.org/from-jishu-to-jiya