26-04-2024 08:14:50 am
Link: http://ebongalap.org/gender-in-school-1
অঘটন-ঘটন পটীয়সী ভাগ্যদেবী মোক্ষম সময়ে উদয় হয়ে মাঝে মধ্যে নাস্তিকদের অব্দি তাক লাগিয়ে দেন। যেমন আমার মা নিশ্চিত নাকানিচোবানি খেয়েছিলেন আমাকে “ভাই” আর “বোনের” তফাৎ বোঝাতে গিয়ে। বীরবিক্রমে তিনি বিলাতি বই থেকে ছবি দেখিয়ে বুঝিয়েছিলেন যে কিলবিলে স্পার্মের সাথে শক্তপোক্ত ভাবে একখানা ডিম জোট বাধলে তবেই হয় ছানা, নইলে ফস্কা গেরো! আর, ছেলে ছানা আর মেয়ে ছানার তফাৎ পেটের মধ্যে নেই। ছেলে না মেয়ে হবে তা ঠিক করে ক্রোমোসোম-রা, এটা ঠিকই, কিন্তু বইয়ের ছবির মতো উলটানো বাচ্চাকে জন্মের আগে দেখে ছেলে না মেয়ে তা আমরা সাধারণ লোকে বুঝতে পারিনা। পেটের মধ্যেকার ছবিতে ডাক্তার ছাড়া প্রায় কেউই এই ফারাক ধরতে পারেনা- হেঁটমুন্ড ছানা পেটের বাইরে বেরলেই যত ঝঞ্ঝাট। সেখানে তো “দেখনু বিনা চশমাতে”ই... বোঝা যায়। ‘কেন যায়? আমার ভাই হবে না বোন সেটা তুমিও জানো না, মা? বোন হলে বেশি ভালো হয়’... ইত্যাদি। এহেন সংকটকালে ভাগ্যদেবী পুনরায় প্রকট হলেন, মায়ের শিল্পী বন্ধু শুভা মাসির হাসিমুখ নিয়ে। আমায় পড়ে শোনান হল কমলা ভাসিনের অনবদ্য বই হোয়াট ইজ আ বয়? হোয়াট ইজ আ গার্ল?
বইয়ের প্রথম অংশে লেখায়-ছবিতে “পুরুষালি” মেয়ে আর “মেয়েলি” ছেলেদের গল্প। কথকতার ঢঙে গল্প চলে।
-“মেয়ে কারা?”
- না যারা লম্বা চুল রাখে, ভালো রান্না করে, বাচ্চাদের যত্ন নেয়।
- “তাই বুঝি?”
বলে কমলা ভাসিন বলেন এমন সব ছেলেদের কথা যাদের “গোছা ভরা চুল”, যারা সারাদিন “হেঁসেলে” কাটায় বা দেখভাল করে ছোট বোনটির। আর বলেন সেই সব মেয়েদের কথা যাদের চুল ছোট, গায়ে বেদম জোর আর পালোয়ানের মত চেহারা।
বইয়ের পরের অংশে তিনি আলোচনা করেন শারীরিক গঠনের পার্থক্য।
এমন ভাগ্যদেবী পায়ই বা কজন? বিশেষত, ইশকুলের গণ্ডিতে তার জায়গা কই? তবু, ছোটবেলার এই বইটির কথা নতুন করে মনে পড়ালো নতুন প্রজন্মের একদল বই লিখিয়ে-আঁকিয়ে-ভাবিয়েদের কোমর বেঁধে জোরদার প্রচেষ্টা।
২০১৬ সালে তৈরি হওয়া এই দলের নাম ‘দ্য ইররেলেভেন্ট প্রজেক্ট’। ‘ইররেলেভেন্ট’ কথাটাই এদের শ্লেষ বুঝিয়ে দেবে। নিতান্ত হেলাফেলা-র বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে যা শিশুশিক্ষার অন্যতম অংশ হয়ে ওঠেনি, মূল শিক্ষা ব্যবস্থায় যা উপেক্ষিত, এমন কিছু ছোট ছোট জিনিস নিয়ে চমৎকার ছবি-গল্প-বাড়ির কাজের খাতার মিলমিশ করিয়েছেন এরা। ওরা বলেন এই জিনিসগুলি সবার কাছে নেহাতই বাড়তি। তাইই হবে; নইলে ফি বছর যে সরকার হিমশিম খাচ্ছে সিলেবাস বদল নিয়ে তাতে এসব কথা কখনওই জায়গা পায়না!
প্রজেক্টটি যার মগজাস্ত্র থেকে উৎপন্ন, সেই মেঘনা চৌধুরি আমায় আড্ডার ছলে বলেছিলেন এর শুরুওয়াতের গল্প। ছিলেন এঞ্জিনিয়ার, হলেন ইশকুলের দিদিমণি। আর শুধু হলেনই না, অল্পবয়সী রক্তগরম জেন্ডার-সচেতন মাস্টারমশাইদের নিয়ে এমন একখানা দঙ্গল বানিয়ে ফেললেন। “আমাদের মনে হল শুধু আড্ডা-গল্পে এই জিনিসটা আটকে রাখা চলবে না… প্রথমে জোগাড় হল বন্ধুর প্রেস, তারপর গল্প আর ছবি আঁকিয়ে”। যে বইগুলো ওরা নিজেরা ইশকুলে পাননি, সেগুলো ওরা লিখবেন ঠিক করলেন। গল্পের বই নয় শুধু, সাথে সাথে নোটবুকও- পড়তে পড়তে যেখানে খুদে নিজেই লিখবে জেন্ডার-সচেতন মন্তব্য ।
এরকমভাবে তারা চরিত্র দিয়ে গল্প বোনেন, আর তার সাথে থাকে ছোটদের জন্য কিছু কাজ বা ‘টাস্ক’ আর বড়দের কি করা উচিত তার নির্দেশাবলী বা ‘গাইডেন্স’। যেমন, মোহনের খুব রাগ হয় তাকে “মোটু মোহন” বললে। কিন্তু তারপর নিজের শরীরকে সে আস্তে আস্তে ভালোবাসতে শেখে। সুন্দরের বাণিজ্যিক ধারণা ভেঙে মোহন দেওয়ালে সেঁটে দেয় নিজের আঁকা পোস্টার- “তুমি বড্ড সুন্দর”। আবার, ভাই-বোন এনি আর অর্জুন একসাথে খেলে; বোনকে মা বার বার ডাকেন রান্নাঘরে; ভাই এলে কিন্তু বিরক্ত হন। দুই খুদেতে হাত লাগিয়ে সব কাজ সমান ভাবে করতে চায়। ভাই জিগ্যেস করে, বোন মাকে সাহায্য করলে আমি করব না কেন? আবার যেরকম এত্ত এত্ত প্রশ্ন করে অণ্বেষা- আমরা যা যা “শিক্ষা” পাই, সেগুলো আদৌ ঠিক কি না, এ নিয়ে তার নানা কিম্ভূত প্রশ্ন। এরকম আরো কত কি! এমন সব অভিনব ভাবনা থেকে মেঘনারা ছোটদের জন্য একগোছা বই লিখে ফেলেছেন এর মধ্যেই।
জেন্ডারের নিরপেক্ষ ধারণা এবং সচেতনতা খুব ছোট বয়েস থেকেই তৈরি হওয়া উচিত। লিঙ্গভেদ ও জেণ্ডারের ধারণাটা বদ্ধমূল হয়ে যায় ছোটবেলাতেই। তাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায় থেকেই এর জায়গা করে দেওয়া। তাই ক্লাসের মধ্যেই বিভিন্ন নতুন নতুন পদ্ধতিতে লিঙ্গবিভেদ এবং তার সাপেক্ষে বিষম ব্যবহারের মানসিক ভাঙার প্রচেষ্টা করছেন এরা – বিভিন্ন ইশকুলের একদম তরুণ তরতাজা মাস্টার - কেউ অন্য সময় গবেষণা করেন কুইয়ার থিওরি নিয়ে, কেউ ছবি আঁকেন, নানা জায়গায় ওয়ার্কশপও করেন। মেঘনা, অশ্বিনী, আলিশ্যা, বরষা ছাড়াও দলে আছেন হরিশের মতন নারীবাদীরা যারা ইশকুলে তৈরি হওয়া ‘ম্যাসকুলিনিটি’ তথা পৌরুষের ধারণার বিরুদ্ধে এগিয়ে এসেছেন - কেউ ছবি এঁকেছেন, কেউ বানিয়েছেন ছাপাখানা।
তবে, এরা মূলত ইংরাজি মাধ্যম ইশকুলেই কাজ করেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি মনে হয়, সুন্দরবনের ছোট্ট গ্রামের মেয়েটি বা ছেলেটি কি বুঝবে এই গল্প?’ মেঘনা আশাবাদী। পুরুষতন্ত্র তো একটা মগজধোলাই যনতোর- সব জায়গাতেই তার সমান তর্জন-গর্জন। তবে কেন বুঝবে না তারা? আর এই বইগুলি তো শুধু বাচ্চাদের নয়, মাস্টারমশাই দের জন্যও- তারাও বুঝবেন এর গুরুত্ব এবং প্রথাগত শিক্ষার মধ্যে লুকিয়ে থাকা পুরুষতন্ত্রের ভূতগুলোকে কান ধরে টেনে আনবেন।
বিগত কয়েকবছরে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই শিক্ষাপদ্ধতির রদবদলে সোচ্চার হয়নি, ভুগতে হয়েছে ইশকুলের সিলেবাসকেও। কখনো বাদ দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে পুরো ইসলামের ইতিহাসই। আগের বছরই সিবিএসই বোর্ডের হেলথ এন্ড ফিজিক্যাল এডুকেশন পাঠ্যবইটিতে বলা হয়েছে মেয়েদের আদর্শ শারীরিক মাপ ৩৬-২৪-৩৬। বলা বাহুল্য, এই মুহুর্তে রাজনৈতিক ভাবেও, এই “ইররেলেভেন্ট” উদ্যোগটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইংরাজি মাধ্যম ইস্কুলের বাইরে কেমন করে পৌঁছবে এই বইগুলি? মাস্টারমশাইরাই বা কেমন করে “বডি শেমিং” বা জেণ্ডারের মত বিষয়গুলি সহজ করে বোঝাবেন? কিরকম ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় শিশুদের শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে?
‘এখন আলাপ’ ব্লগে তাই শুরু হচ্ছে এক নতুন ধারা-র ধারাবাহিক - স্কুলশিক্ষা, স্কুলের পরিধিতে জেন্ডার সচেতনতা, শিক্ষাপদ্ধতি ও বইপত্রের ধরন ইত্যাদির আলাপ আলোচনা নিয়ে। মেঘনাকে জিগ্যেস করলাম, ইংরাজি না জানা খুদেরা কি বাদ পড়বে বিবলু-মোহন-অণ্বেষার সাথে বড় হওয়ার থেকে? অনুবাদে কি সম্ভব তা? কালচারাল কণ্টেক্সট-এর বাইরে গিয়ে?
মেঘনা বলেছে হাল ছাড়ার কিছু নেই। হোক না অনুবাদ! আর, ছোট্ট ছোট্ট ইশকুলের দিদিমণি আর মাস্টারমশাইরাও না হয় লিখুন এমন সব বই তাদের ইশকুলের বিবলু অণ্বেষাদের জন্য…
Link: http://ebongalap.org/gender-in-school-1