14-02-2024 03:25:54 am
Link: http://ebongalap.org/gender-in-school-2-1
বীরভূম জেলায় অজয়ের উত্তরের গ্রামগুলোতে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া এবং পড়াশোনায় অংশগ্রহণের হার এই মুহুর্তে আশাপ্রদ হলেও, খেলার মাঠে মেয়েদের যোগদান বিরল। যদিবা মেয়েরা খেলায় অংশ নিচ্ছে, তবু সেই যোগদানে স্বাচ্ছন্দ্য নেই; বরং রয়েছে অলিখিত সতর্কতা আর লজ্জা। এই সময়ে দাঁড়িয়ে যখন খেলাকে ‘সাইকো থেরাপি’-র অংশ হিসাবে দেখা হচ্ছে, তখন শুধুমাত্র লিঙ্গের ভিত্তিতে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীরা প্রয়োজনীয় খেলাধূলা থেকে বঞ্চিত হয়ে চলেছে কিশোরী বয়স থেকেই। কিন্তু স্কুলের গন্ডিতে খেলার ক্ষেত্রে কিশোরীদের এই সীমিত অংশগ্রহণের কারণ কি? উত্তর খুঁজতে হাজির হয়েছিলাম বীরভূম জেলার ইলামবাজার বি কে রায় বালিকা বিদ্যালয়, ইলামবাজার উচ্চ বিদ্যালয় ও পায়ের উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সামনে। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করল যে খেলার মাঠে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অংশগ্রহণ কম। কিন্তু কেন?
নবম শ্রেণীর ছাত্রী সম্পূর্ণা রায়ের কথায়, শারীরিক সক্ষমতায় মেয়েরা পিছিয়ে, তাই খেলার জন্য যে দম আর শক্তি লাগে তাতে মেয়েরা পেরে ওঠে না। কিন্তু তার সহপাঠিনী পম্পা পাত্রের মত ভিন্ন; তার মনে হয়, শারীরিকভাবে সক্ষম হলেও সাধারণত মেয়েদের খেলায় যোগ দিতে লজ্জা লাগে। স্বাগতা আর মাম্পির সঙ্গে কথা হওয়ার পর ওদের স্কুল ঘুড়িষা শ্রীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের স্পোর্টস টিচার মুন্সী জামালউদ্দিন বললেন, “শারীরিক শিক্ষা সবার জন্য সমান হলেও বাস্তবে সবটুকু প্রয়োগ করা যায় না। এটা ঠিক যে শিশু বয়সে ছেলে ও মেয়েদের খেলাধুলা ও ব্যায়াম পৃথক নয়। কিন্তু ১০-১২ বছর বয়স থেকে ছেলে ও মেয়েদের শরীরের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এসময় থেকেই ছেলে আর মেয়েদের শারীরিক শিক্ষার কর্মসূচি আলাদা করতে হয়।” জামালবাবুর মতে, মেয়েরা তখন ভারি কোন খেলায় অংশগ্রহণ করে না, আবার ছেলেরা এইসময় দলগত খেলার দিকে ঝুঁকে পড়ে বেশি। তবে অনেক খেলাধুলায় ছেলেমেয়ে উভয়েই যোগ দেয়, যেমন- ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, দৌড় ইত্যাদি। আবার খেলাধুলার ক্ষেত্রে যে সমস্ত প্রতিযোগিতা হয় যেমন – সাঁতার, অ্যাথলেটিকস, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস প্রভৃতি ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথকভাবে করা হয়।
স্কুলের মাঠে যে মেয়েদের দেখা মেলা ভার এই বিষয়টা নিছক অঞ্চলগত সমস্যা নয়। যে ছবিটা ইলামবাজারে লক্ষ্য করেছি সেটাই আসলে আমাদের রাজ্যের মফস্বলের সার্বিক চিত্র। তবু, ইলামবাজার উচ্চবিদ্যালয়ের খেলার শিক্ষক সঞ্জয়বাবু মনে করেন, “স্কুলের খেলাধূলায় মেয়েদের কম অংশগ্রহণ করার ছবিটা শহর ও গ্রামভেদে কিছুটা হলেও আলাদা। বীরভূম জেলার সদর শহরে যে স্পোর্টস একাডেমি রয়েছে সেখানে মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু গ্রামে গ্রামে এখনো তা হয়ে ওঠেনি। এর কারণ অনেকটাই অর্থনৈতিক। রাজ্যের বড় শহরগুলিতে খেলার কোচিং এর জন্য যেমন টাকা খরচ হয়, তেমনি ভবিষ্যতের জীবিকার গ্যারেন্টি অনেকটাই ঠিক হয়ে যায় এখান থেকেই।” স্যারের সাথে সহমত ঐ স্কুলের ছাত্রী রিমা। রিমা স্পষ্টই বলছে, “চাকরির প্রতিশ্রুতি থাকলে অনেক মেয়েরাই খেলাধূলায় উৎসাহ পাবে।”
স্কুলস্তরে স্পোর্টস পরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষিকা পিয়ালি ঘোষ অবশ্য অন্য কথা বললেন। তাঁর মতে এর কারণ অনেকাংশেই পরিবারের মধ্যে ছেলে আর মেয়ের প্রতি বিষম ব্যবহার। পিয়ালিদেবীর মতে, "ছোট থেকেই বাড়ির পরিবেশ মেয়েটির ওপেনফিল্ড স্পোর্টসের প্রতি অনীহা তৈরি করে দেয়। তার জন্য রান্নাবাটি, পুতুলখেলা, গুটিখেলা ইত্যাদি নিয়ে সীমিত পরিসরের উঠোন নির্ধারিত হয়ে যায় অথচ ছোট্ট ছেলেটি ডাংগুলি বা ফুটবল নিয়ে খোলা মাঠের সন্ধানে বাড়ির বাইরে পা রাখে। জন্মদিনের উপহারেও মেয়ের বরাদ্দ বার্বিডল, আর ছেলের জন্য আনা হয় তীব্র ব্লাস্ট ফায়ারের আওয়াজ বিশিষ্ট বন্দুক বা ক্রিকেট ব্যাট।” শুধু খেলার ধরণ নির্ধারণ করে দেওয়াই নয়, পরিবারের গন্ডিতে বিষম আচরণ প্রয়োজনীয় পুষ্টি, বৃদ্ধি ও শারীরিক যত্নের দিক দিয়েও বঞ্চিত করে রাখে মেয়ে সন্তানদের। ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গে ১০-১৯ বছরের মেয়েদের ৯৮ শতাংশ কমবেশি রক্তাল্পতায় ভোগে। এর মধ্যে ১৮ শতাংশের প্রবল রক্তাল্পতা রয়েছে। এদের অপুষ্টিও খুব বেশি। পরে সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় এই মেয়েদেরই মৃত্যুর হার সর্বাধিক। শিশুসন্তানের সুষম শারীরিক বিকাশের জন্য যে পুষ্টির প্রয়োজন তা আমাদের মতো গরিব দেশে অধিকাংশ পরিবারই সংগ্রহ করতে পারেনা। তাছাড়া আজকের দিনে জিনিসপত্রের দাম বাড়া আর মানুষের কেনার ক্ষমতা কমে যাওয়ার জন্য অধিকাংশ পরিবারের শিশুরা পর্যাপ্ত প্রোটিন খাবার পায় না। এছাড়া, সঠিক পুষ্টি সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, খাবার নিয়ে নানান কুসংস্কার, পারিবারিক খাদ্যাভ্যাস, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে খাবারের ভাগ নিয়ে পক্ষপাত কন্যাশিশুর স্বাস্থ্যের বিকাশকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে।
পারিবারিক বৈষম্যের এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গেই সঞ্জয়বাবু বললেন, পারিবারিক শিক্ষা ও পরিবেশের কারণে অনেক কিশোরীই খেলার মাঠে নামতে চায় না। দীর্ঘ কাউন্সেলিং এর পর যদিবা কিছু ছাত্রীকে মাঠমুখী করা যায় এবং তাদের কয়েকজনের যথেষ্ট দক্ষতা ও সম্ভাবনা থাকলেও তারা স্পোর্টস কস্টিউম পড়তে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না। সালোয়ার-কামিজ পড়েই লংজাম্পের মত ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে।
ইতিহাসে চোখ ফেরালেও পাওয়া যাবে মেয়েদের মনে এই সমাজ-সঞ্জাত সঙ্কোচের দীর্ঘ কাহিনী- উনিশ শতকের রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে মেয়েদের পুঁথি পড়া পাপ বলে মানা হত। প্রচলিত বিশ্বাস ছিল সাক্ষর পত্নীর স্বামী নিরক্ষর পত্নীর স্বামীর থেকে তাড়াতাড়ি মারা যায়। যেখানে শিক্ষাক্ষেত্রে এই সংকীর্ণতা, সেখানে খেলার মাঠে মেয়েদের অংশগ্রহণের চিত্র কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়। এই মনোভাব দু-এক শতকের নয়, এর ইতিহাস আদতেই প্রাচীন। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই খেলার সাথে পুরুষের যোগ প্রায় নিয়তিনির্ধারিত। নৃতত্ত্ববিদদের অনেকেই মনে করেন মানবসভ্যতার আদিলগ্নে খেলাধূলার কৃৎকৌশল, নিয়ম-কানুন এসেছিল দলবদ্ধ শ্রমের কায়দা-কানুন থেকেই। শারীরিক কসরৎজনিত শ্রমে পুরুষের প্রাধান্য থাকায় খেলাধূলার সাথেও ঐতিহাসিকভাবে পুরুষের যোগই থেকে গেছে। ভূগোলের শিক্ষক শোভনলাল বিশ্বাস বললেন, ‘প্রাচীন মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ বর্তমান ইরাকে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ বছরেরও আগে প্রথম যে খেলার সূচনা হয় তা হল কুস্তি খেলা। একই সময়ে মুষ্টিযুদ্ধ, অসিযুদ্ধ ও দৌড়ের মতো খেলাগুলোরও জন্ম হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে মিশরে খেলা হিসেবে শিকারের প্রচলন ছিল। প্রাচীন রোমে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দের দিকে মল্লযুদ্ধের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ অব্দে প্রাচীন গ্রীসের অলিম্পিকের সূত্রপাত খেলাধুলার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। কিন্তু তখনো পর্যন্ত মেয়েদের অংশগ্রহণের বিষয়টা সামনে আসে নি। কিন্তু সময় তো এক জায়গায় থমকে থাকে না। ১৯০০ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আধুনিক অলিম্পিকে মেয়েরা প্রথম খেলাধূলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। মোট ন’শ সাতানব্বই জন প্রতিযোগীর মধ্যে মাত্র বাইশ জন ছিলেন মহিলা। বোঝা যাচ্ছে অলিম্পিকের মতো আসরে অংশগ্রহণের জন্য বিশ্বদুহিতাদের দু’হাজারেরও বেশি বছর ধরে সময় গুনতে হয়েছে।
তাই ইতিহাসের ভার আজও বহন করছে স্কুলের কিশোরীরা। শুধু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খেলাধুলার দিক দিয়ে নয়, ধর্ম ও গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতার শিকারও হচ্ছে আজকের প্রজন্মের মেয়েরা। যেমন মুসলিম পরিবারের ছাত্রীদের ক্ষেত্রে পারিবারিক পর্দাপ্রথার প্রভাব পড়েছে স্কুলের গন্ডিতেও। আজকাল স্কুলড্রেসের ওড়নাকে হিজাবের মত করে তারা মাথা ঢেকে কানের দু’পাশে জড়িয়ে নিচ্ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হল স্কুলে সচেতনতা আর শিক্ষার পাঠের সাথে সাথে এই প্রভাব কমার পরিবর্তে এখন বাড়ছে। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ শরিয়তি ফতোয়ার জাল কেটে বেরিয়ে আসতে পারছে না। রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মীয় মৌলবাদ কায়েম হচ্ছে একদিকে আর অন্যদিকে অধিকাংশ শিশুকন্যার জীবন থেকে স্বতঃস্ফূর্ত শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে। সমাজ-ধর্ম-রাষ্ট্র-পরিবারে বাধা আর নিষেধ তো ছিলই, তার সাথে বিদ্যালয়ের গন্ডীতেও সঙ্কোচ আর আতঙ্কে কুঁকড়ে থাকছে কিশোরী ছাত্রীরা। ভয় পাচ্ছে স্বাধীন চলাফেরায়, ইচ্ছেমতো পছন্দের খেলাধূলা বেছে নিতে, ভয় পাচ্ছে মন খুলে খেলার মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
ছবি সৌজন্য: লেখক
Link: http://ebongalap.org/gender-in-school-2-1